নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আমার পিসেমশাই – দেবব্রত সান্যাল

0

Narayan Gangopadhyay

জীবনী বা প্রবন্ধ লিখতে বসিনি । কাছের লোকেরা জীবনী লিখলে পক্ষপাতহীন হয় না। আর প্রবন্ধ লিখতে গেলে যে পরিমাণ গবেষণার প্রয়োজন তা করে উঠতে পারিনি। একটি ছোট ছেলে অপার বিস্ময়ে একজন বিখ্যাত সাহিত্যিককে খুব কাছ থেকে দেখেছিলো। সেই ছেলেটিকে ছোটবেলার মুগ্ধতার স্মৃতি নিয়ে কম বয়েসে চলে গেলেন তার সাহিত্যিক পিসেমশাই। সেই স্মৃতির কিছু হারিয়ে যাবার আগে অক্ষরের সুতোয় গেঁথে ফেললাম।

(এক –  শেষ থেকে)

অনেক দিনই তো হয়ে গেলো। উনিশশো সত্তর সাল । আমি তখন জলপাইগুড়িতে জেলা স্কুলের ক্লাস সিক্সে পড়ি। দিনটা রবিবার ছিল। বাড়িতে ফোন তো ছিলো না।  যুগান্তর পত্রিকায় পিসেমশাইয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে  বাবা বিকেলেই দার্জিলিং মেলে কলকাতায় চলে গেছেন। এর আগে কখনো পিসেমশাইয়ের কোনো বিশেষ অসুস্থতার কথা শুনিনি। তবে দেখতাম খাবার আগে, উনি  নিজেই নিজেকে ইনজেকশন দিতেন। আর  ইঞ্জেকশনের পর পরিত্যক্ত কাঁচ কাটার সেই আশ্চর্য ছোট্ট চাকুটি আমার ভাগ্যে জুটতো। সেই কৃতজ্ঞতা বশে একদিন ওনাকে সৎ পরামর্শ দিলাম, ‘পিসেমশাই, এখানে তো কেউ দেখছে না। আজ আর ইনজেকশন নিতে হবে না।’ আমি যে কাউকে বলে দেব না, সেটা বাহুল্য বোধে ওনাকে আর বলিনি। উনিও কিন্তু আমাকে ন্যায় নীতি সততার উপর কোনো ভাষণ শোনান নি। একটু হেসেছিলেন। আর যে মানুষটি নিজে ইচ্ছে করে ইনজেকশন নেন তাকে আর যাই বলা যাক অসুস্থ বলা যায় না। পটলডাঙার বাড়িতে আমি যাইনি।  কিন্তু বৈঠকখানা রোডের বাড়ি, বা পঞ্চাননতলার বাড়িতে, অসুখের কোনো কথা হতো না। তাই বাবা কলকাতা চলে গেলেও আমি বিশেষ বিচলিত হইনি। মানুষের অসুখ হয় আবার সেরেও যায়।  আমারই তো প্রতি মাসে দুবার করে জ্বর হতো, তা বলে কি কিছু বাকি থাকতো? অনেকেই অবিশ্বাসের চোখে জিজ্ঞেস করতো,’নিজের পিসেমশাই?’ সেই অবিশ্বাসটাতে মজা গর্ব সব একসাথে পেতাম।

সন্ধ্যেবেলা খবরটা এলো রেডিও থেকে।  একটা খবর যেটা রেডিওর কাকু না বললে, সত্যি  বলে কখনো মানতাম না।  মা কাঁদছিলেন, দিদিরা কাঁদছিলো, আমিও কাঁদছিলাম। এখন বুঝি যদিও সব কান্না মিলে মিশে থাকে তবু সেদিন আমি আমার ক্ষতিটা বুঝতে পারিনি।

তারপর যখন কলকাতায় পিসেমশাইয়ের বাড়ি গেলাম, তখন বুঝলাম, সে বাড়িতে কে নেই এর চেয়ে কি নেই বড়ো হয়ে গেছে। পিসিমা, যে মানুষটা আমাদের সব খুশি, মজার উৎস ছিলেন। খাওয়া, বেড়ানো, বই নিয়ে যার কাছে সব সময় আবদার করা যেত, তিনি একদম চুপ হয়ে গেছেন। যেন এ বাড়ির সবকিছু ওই রবিবারে হারিয়ে গেছে।

 (দুই – জলপাইগুড়িতে)

পিসেমশাই কলেজে পড়াতেন জানতাম। কিন্তু তাতে ভীতিপ্রদ কিছু ছিল না। কখনো অন্য বড়দের মতো, রেজাল্ট কেমন হলো জাতীয় বিরক্তিকর প্রশ্ন করতেন না। গরমের ছুটিতে কখনো জলপাইগুড়িতে আসতেন। আমাদের উঠোনে একটা আরাম কেদারায় বসে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিতেন। আমাদের ওই বাড়িতে বসেই ওনার বেশ কিছু বিখ্যাত উপন্যাস আর ছোট গল্প লেখা হয়েছে। উনি পাহাড়ে বেড়াতে ভালো বাসতেন। ছুটির বেশ কিছুদিন মনের মতো কোথাও গিয়ে কাটিয়ে দিতেন।  সেই পটভূমিকায় একাধিক গল্প আর টেনিদার ‘ঝাউবাংলার রহস্য’ লেখা হয়েছে। ওনার ছেলে অরিজিৎ গাঙ্গুলি (বাবলুদা) শুধু আমাদের নয়, পাড়ার আমাদের বয়েসী সবার দাদা ছিল। আমি জানতাম, দাদা পড়াশুনোয় একটু বেশিই ভালো, যে কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় আর সব দুঃসাহসিক কাজে আমাদের লিডার। সেই সময়ের একটা  ঘটনা মনে আছে। পিসেমশাই পুজোর ছুটিতে সপরিবার আমাদের জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসেছিলেন। আমাদের বাবুপাড়ার বাড়ির কাছেই করলা নদী। তিস্তা নদীও বেশি দূরে নয়।  বর্ষার সময় তিস্তার জলে দুই পার ভেসে যেত, আবার শীতের সময় নদীতে চর জেগে উঠত। তখনও জল্পেশ সেতু হয়নি। সেই সময়টা লোকে, ঋত্তিক ঘটকের অযান্ত্রিক মডেলের গাড়ি চেপে তিস্তা পার হত। সেদিন শীতের বিকেলবেলা  আমরা ছোটরা সবাই  মিলে, দাদার সাথে  তিস্তার চরের দিকে বেড়াতে গিয়েছি । চরের ধারে  পাথরের  মধ্যে একটা সিঁদুর (কেউ কেউ রক্তও বলছিল ) মাখানো ত্রিশূল পোঁতা, লাল কাপড়, কিছু  খুচরো পয়সা আর কি কি সব । কপালকুন্ডলার গল্প  জানা থাকার জন্য, কাপালিকদের সম্বন্ধে ভয় – বিদ্বেষ দুটোই ছিল । প্রশ্ন উঠছে, ওটা যে কাপালিকের সম্পত্তি তা কিভাবে নির্ণয় হলো! কোনো মরার মাথার খুলি বা খাঁড়া জাতীয় কিছু সেখানে ছিল না । কিন্তু পঞ্চাশ বছর  আগে সেই দিনে এ প্রশ্ন মনে জাগে নি।  শীতের বিকেল মরে সন্ধ্যে হতে সময় লাগেনা।  একটা শীত শীত গা ছমছমে ভাব।  দাদার নেতৃত্বে, সেই তথাকথিত কাপালিকের ত্রিশুল, পয়সা সবকিছু  তিস্তার জলে ফেলে, ছুটে বাড়ি ফিরে এলাম । সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, পিসেমশাই বাড়ীর উঠোনে  আরাম কেদারায় বসে ছিলেন। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে, ওনাকে  আমাদের বীরত্বের কাহিনি বললাম। উনি স্বাভাবিক প্রশান্ত মুখে সবটা শুনে বললেন, ‘গরিব মানুষের জিনিসগুলো ফেলে কি লাভ হলো?’  শিলালিপিতে আরেকটা আঁচড় পড়ল।   

 (তিন – চারমূর্তি)

একটা কথা বলে নেওয়া ভালো, পিসেমশাই তাঁর পটলডাঙ্গা স্ট্রিটের বাড়িওয়ালা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের টেনিদা  নামটি ধার নিয়েছিলেন, এই পর্যন্তই । বাকিটা পুরোপুরি ওনার কল্পনা। সেই কল্পনার মানুষটি সময়ের সাথে পাল্টেছে, স্বার্থপর বদমেজাজি লোকের থেকে দোষে গুণে গ্ৰুপের লিডার হয়ে উঠেছে । পাঠকের ভালোবাসায় তাদের ছোট থেকে বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গী হয়েছে। পিসেমশাই নিজে লেখাপড়ায় খুবই কৃতি ছিলেন। প্যালার মতো একেবারেই নয়। ওনার পাওয়া সোনার মেডেলটা চোখ বড়ো বড়ো করে দেখেছি। বরং বিদ্যায় বুদ্ধিতে চেহারায়, কিছুটা হলেও ক্যাবলার কাছাকাছি। হাবুল সেনের মতো কাউকে বাস্তবে দেখিনি।

প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের সাথে সঙ্গত কারণেই পিসেমশাইয়ের পরিবারের  মেলামেশা ওঠাবসা ছিলো না। পিসিমা, পিসেমশাই দুজনেই প্রচুর ব্যস্ত থাকতেন এবং অসাহিত্যিক আড্ডা দেবার মতো মানসিকতা ছিলোনা। পটলডাঙার বাড়ি ছেড়ে আসার পর বাড়িওয়ালা – ভাড়াটের যে সম্পর্ক ছিল , সেটাও রইলো না। সেদিক দিয়ে বরং ফুচুদার চরিত্রটি সত্যির কিছুটা কাছে ছিল।

পিসেমশাই ভোজন রসিক ছিলেন, কিন্তু প্যালার মতো পেটুক নয়।  পিসিমা অসম্ভব ভালো রান্না করতেন। পিসিমা সেই সময় মহিলা বলে যে পত্রিকাটি চালাতেন, তাতে আমার মা, তপতী সান্যাল  রান্নাঘর বিভাগের পরিচালিকা ছিলেন। তবু বলবো রান্নায় পিসিমার জুড়ি ছিলোনা। তাই বাড়িতে অনেক রকম রান্না হতো, পিসেমশাই সেটা উপভোগ করলেও আহার পরিমিতই করতেন।

ওনার ভাষা বা আচরণ কখনোই মজার ছিল না। খুব ভালো কথা বলতেন, কিন্তু কান কানপুরে, নাক নাসিকে পাঠানোর ভাষা ব্যবহার করতেন না। ‘ডি লা গ্র্যান্ডি’ ওনার মুখে কখনো শুনিনি।ভাষা নিয়ে মজা করেছেন ভাষাটা জেনে। সেদিক থেকে পিসিমা, ডঃ আশা দেবী ছোটদের গল্প, ছড়া লিখতেন আর সব কিছু খুব মজার করে বলতে পারতেন। ওনার লেখা ‘ঘুমতি নদীর ঢেউ’ সে সময় খুব জনপ্রিয় ছিল।

পিসেমশাই পাশাপাশি একাধিক লেখা লিখতেন তাঁর সেই বাহাদুর খাতায়। চারমূর্তির পাশাপাশি সিরিয়াস উপন্যাস আর ছোট গল্প লেখা হতো। লিখতেনও বেশ তাড়াতাড়ি।  আমার মা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দাদা, এ গল্পের চরিত্র ও গল্পে চলে যায় না?’  উনি হেসে বলে ছিলেন, ‘খেয়াল রাখতে হয়।’

পিসেমশাইয়ের লেখা পড়ে খুব ইচ্ছে করতো, একবার ঝন্টি পাহাড়ি বা ঝাউবাংলা ঘুরে আসি। সে বয়েসেও  বুঝতাম সেটা খুব সহজ হবে না। কিন্তু ঘুঁটেপাড়া তো বিশেষ দূরে ছিলোনা, গোবরডাঙার পাশেই। তাই ভাবলাম ঘুঁটে পাড়াতো একবার ঘুরেই আসা যায়। কি করে যেতে হয় তা গল্পে পরিষ্কার লেখা ছিল তবু সৌজন্যবশে বিষয়টা পিসেমশাইকে জানিয়েছিলাম। উনি বুঝিয়ে বলেছিলেন, সবচেয়ে সোজা পথ হলো গল্পের ভিতর দিয়ে যাওয়া।

আমাদের তিন ভাইবোনকে একটা বইয়ের (ছোটদের ভালো ভালো গল্প) উৎসর্গে লিখেছিলেন, ‘বুলবুল, টুলটুল, বাপ্পা / তোমাদের সাথে চলবে না কোনো ধাপ্পা। …

(চার – অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ)

উনিশ শো আটষট্টি সালের ৪ অক্টোবর রাতে তিস্তা করলা মিলে জলপাইগুড়ি শহর ভাসিয়ে দিয়েছিলো। আমরা বাড়ির লোকেরা বাড়ির বাথরুমের ছাতে উঠে প্রাণে বাঁচলাম, কিন্তু বাড়ি ঘর তিস্তার পলির প্রলেপে থাকার অযোগ্য হয়ে গিয়েছিলো। জলপাইগুড়ি থেকে কালিয়াগঞ্জ আর সেখান থেকে কলকাতা চলে এসেছিলাম। সময়টা কালীপুজোর আগের দিনগুলো।  তখন আমরা ভাইবোনেরা পিসেমশাইয়ের বৈঠকখানা রোডের বাড়িতে আছি। স্বাভাবিক নিয়মে কিছুদিন পরেই স্কুল খোলার কথা আর বাৎসরিক পরীক্ষা হবার কথা। তখন জলপাইগুড়িতে স্বাভাবিক বলতে কিছুই ছিলো না।  সেই সুযোগে লেখাপড়া শিকেয় তুলে পিসেমশাইয়ের বাড়িতে সারা বাড়ি ভর্তি বই পড়ে চলেছি। পিসেমশাই জলপাইগুড়ির বন্যার গল্প মন দিয়ে শুনে ছিলেন।  একটা অসামান্য গল্পও লিখেছিলেন, দোসর। আমার মনে আছে উনি ওনার এক সাহিত্যিক বন্ধুকে আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘জানোতো এ বন্যার পরের দিন বাড়ির ছাতে বসে পুজোবার্ষিকী খুঁজছিলো।’  আমি খুব রোগপটকা ছিলাম বলেই বোধহয় আমার নাম দিয়েছিলেন, গোর্খা টিমের গোলকিপার।

আমার একদম পড়াশুনো না করে সারাদিন বই পড়ে, ঘুরে বেরিয়ে সময় কাটানোটা পিসিমাকে চিন্তিত করতো। পিসেমশাই কখনো কিছু বলেন নি।

পিসেমশাই চলে যাবার তিন চার বছর পর ওনার ছোটদের জন্য লেখা একটি বই হাতে এলো। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ এবং

কেন্দ্রীয় চরিত্রে একটি বাচ্চা ছেলে, যে ছুটির সময় পিসিমার বাড়িতে এসেছে। পিসিমা খুব ভালো বাসলেও একটু কড়া আর পিসেমশাই একেবারে আমার পিসেমশাইয়ের মতো।  ছেলেটি পড়াশুনো না করে দুস্টুমি করে বেড়ায়। পিসিমার সামান্য শাসন ও পিসেমশাইয়ের সস্নেহ প্রশ্রয়।

অনেকেই বলেছেন আমার নিজের লেখা উপন্যাসে আমি নাকি খুব বেশি করে থাকি। হয়তো থাকি।  কিন্তু আমি পিকলুকে যতটা কাছের বলে জানি তেমন করে আর কোনো চরিত্রকে না। গল্পের শেষে অবশ্য লেখা ছিল, ‘বিদেশী গল্পের ছায়ায়’ আর পরে পি জি . উডহাউসের  ‘দা ক্রাইম ওয়েভ অ্যাট ব্ল্যান্ডিংস’ পড়েছি। তবু বিশ্বাস করি পিসেমশাইয়ের লক্ষ্য অব্যর্থ হতে বাধ্য।

(পাঁচ – বড়চর্চা)

আমার বাবাকে ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক ভাবে ব্যস্ত মানুষ হিসেবে দেখেছি। জীবনের সিদ্ধান্ত সবই নিজেই নিতেন, কাউকে বিশেষ আমল দিতেন না, একজনকে ছাড়া।  তিনি ওনার জামাইবাবু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। শুনেছি কলেজ পাশ করার বাবা হঠাৎ করে, দাড়ি বড় করে গীতা পড়তে শুরু করেছিলেন  বাড়ির লোকেরা শংকিত থাকতো, এই বুঝি উনি সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন। পিসেমশাই জলপাইগুড়ির বাড়ি এসে বাবার আধা সন্ন্যাসী হাবভাব দেখে, তৎক্ষণাৎ নাপিত ডেকে ভাবের মূলে আঘাত করলেন। বাবার সন্ন্যাসী হওয়া হলোনা। আরেকবার শুনেছি বাবার কবিতা লেখার ব্যামো হয়েছিল।  সেটি যেমন ভাবে এসেছিলো, তেমন ভাবেই সেরে গিয়েছিলো।  কিন্তু তারপর পিসেমশাই কবিতার জন্ম নিয়ে যে মজার গল্পটি লিখলেন, তাতে বাবার লেখা সেই কবিতা থেকে লাইন তুলে দিলেন।

পিসেমশাইয়ের ধস নাটকটি  অনেকেই বেতারে শুনেছেন বা সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় নিশিযাপন নামক ছবি হিসাবে দেখেছেন। প্রথমে সেখানে একটি চরিত্রের নাম আমার বাবার নামের সাথে মিলে গিয়েছিলো। বাবা পিসেমশাইকে অভিযোগ করেছিলেন, ‘দাদা, এটা কি করলেন? প্রথমে চাকর বানালেন, তারপর মেরে দিলেন, তাতেও হলো না শেষে ভূত বানিয়ে দিলেন।’ পিসেমশাই খুব অপ্রস্তুত হয়েছিলেন এবং নামটা পাল্টে দিয়েছিলেন।

পিসেমশাইয়ের বাড়িতে যে খুব সাহিত্যিক আড্ডা হতো তা নয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র একেবারে অন্য রকম বন্ধু ছিলেন। যখন ইচ্ছে  আসতেন, অনেকক্ষণ থাকতেন আর ওই বাড়ির দুই পাঠিকা আমার মা আর ঠাকুমার কাছ থেকে নিজের লেখার ফিডব্যাক  নিতেন।

সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করার শখ ছিল। এদিকে পিসিমার সেই ওষুধে বিশেষ ভরসা ছিল না।  তবে সাদা সাদা মিষ্টিগুলি  খেতে দাদার বোধহয় ভালোই লাগতো। একবার দাদার কোনো একটা অসুখ জেনে, পবিত্র বাবু নিজেই হোমিওপ্যাথির বড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন। পিসিমা সেগুলো মোটেই খাওয়াতে চাননি। ফলে পরের বার যখন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় পিসেমশাইয়ের বাড়ি এলেন, দাদা সোজা গিয়ে তাকে নালিশ করলো, ‘পিওর দাদু  (এমন নামকরণ পিসিমার মজা করার একটা অঙ্গ ছিল)  পিওর দাদু, মা না তোমার সব ওষুধ  ফেলে দিয়েছে।’  পিসিমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো। 

 (ছয় – আর সবাই)

এখন বুঝতে পারি পিসেমশাই পন্ডিত মানুষ ছিলেন।  তখন বুঝতে পারিনি, তার কারণ সেটা বোঝার মতো বয়েস বুদ্ধি কোনোটাই ছিলো না। তাছাড়া আজকাল যেমন দেখি, পান্ডিত্যটা জাহির করার জিনিস, সেটা ওনার মধ্যে ছিলো না। যদিও সুনন্দর জার্নালে হালকা চালে লেখা ফিচারে তার গভীরতা ফুটে বের হয়।

পিসিমাকে একসময়ে অনেক বাংলা পরীক্ষার খাতা দেখতে হতো। একদিন উনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন, এক ছাত্র নাকি লিখেছে, মেঘনাদ বিভীষণকে বলছে, চাচা দুয়ার খুইল্যা দাও। শুনে সেই বিদগ্ধ পন্ডিত, হো হো করে হেসেছিলেন। পরে সুনন্দর জার্নালে হাউলার বলে একটি লেখা লিখেছিলেন।

পিসেমশাই কবিতা লিখতেন না, কিন্তু নিয়মিত ভাবে পড়তেন। ওনার নিজস্ব পছন্দ ও নির্বাচন খুব পরিষ্কার ছিল। ঢুলি ছবির জন্য গান লিখছিলেন (ত্রিনয়নি দুর্গা)।  বরং পিসিমা দুর্দান্ত ছড়া লিখতে পারতেন ও লিখতেন। ওনাদের বাড়িতে প্রচুর পত্রিকা আসতো।  সেইসব পত্রিকা নিচের ঘরে থাকতো।  সেখানে কেউ বড়ো একটা যেতোনা, প্রফুল্লদা ছাড়া। সেখানে পত্রিকা পড়তে গেলে অনেক সময়ই প্রফুল্লদার হাতে পড়তে হতো। প্রফুল্লদা পিসিমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করতো আর  কাজ গুলিয়ে ফেলে পিসিমার হতাশার কারণ হতো । প্রফুল্লদা কবি, কিন্তু সেই সাহিত্যিকের বাড়িতে আর কেউ তার কবিতা ভরা খাতার কথা জানতো না।  আমিই ছিলাম তার কবিতার একমাত্র শ্রোতা। প্রফুল্লদা সুর করে তার ওড়িয়া কবিতা পড়তো, ভাষা না জানলেও সামনে একজন আস্ত কবিকে পেয়ে কবিতাগুলো মন দিয়ে শুনতাম। যতদূর মনে পরে প্রকৃতিই ছিল কবিতার বিষয় বস্তু।  প্রফুল্লদা কখনো নিজের বাড়ির কথা বলতো না। কিন্তু কবিতায় সেটা লুকিয়ে রাখতো না। একটা লাইন তো এখনো মনে আছে,’টিকি গাঁও মর হঁসে।’

Leave a Reply

error: Content is protected !!