নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্পকার হিসেবে কৃতিত্ব

সোমাদ্রি : সাহিত্যের যুগ শেষ হয়। যেমন কল্লোল বা কালিকলমের পর্বের পরে বাংলা কথা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল কিছু জ্যোতিষ্কের আবির্ভাবে। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০)। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও সমালোচক ছিলেন। প্রায় শৈশবের সময় থেকেই কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে যে চারাচেতনার জন্ম হয়েছিল তাই পরবর্তীতে বৃক্ষরূপ পায়। আজীবন কবিতা ও গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন কথাকোবিদ্। উপন্যাস ও ছোট গল্পের পারদর্শীতা থাকা সত্ত্বেও তাকে ছোটগল্পকার হিসেবেই মূলত দেখা হয়। কারণ সমকালীন বা অগ্রহ উল্লেখ্য গাল্পিকদের মধ্যেও তার গল্প আপন স্বাতন্ত্র্যতায় উজ্জ্বল।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম অপ্রকাশিত ছোটগল্পের নাম ‘পাশাপাশি’। তার গল্পের শ্রেণি বিভেদ লক্ষ্যণীয়। সামাজিক বড়লোক ও গরীব। একদিন বর্ষাভেজা সন্ধ্যায় বড়লোকের বাড়িতে টি-পার্টি চলছে ঠিক তখনই বিনা চিকিৎসায় গরীব বাড়ির ছেলেটি মারা যায়। লেখকের স্মৃতিচারণ থেকে একথা জানা যায়। গল্পটি অপ্রকাশিত। আসলে গল্পকারের মানসিকতা এই গল্পের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। সামাজিক বৈষম্য বাল্যকাল থেকেই তাকে প্রভাবিত করেছিল। এই সমস্ত প্রেক্ষাপট জেনেই আমরা ছোটগল্পকার হিসেবে তার শিল্পীসত্তার উদঘাটন করবো। তাবে তার আগে আমরা একটু তার ছোটগল্প সংকলনের নাম জেনে নেব। ১৯৩৫-৩৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অজস্র গল্প রচনা করেন। উল্লেখযোগ্যগুলি হলো — ‘বীতংস’, ‘ভাঙাবন্দর’, ‘কালা বদর’, ‘ভোগবতী’, ‘শ্বেতকমল’, ‘দুঃশাসন’, ‘গন্ধরাজ’, ‘শুভক্ষণ’, ‘উর্বসী’, ‘এগজিবিশন’, ‘ছায়াতরী’, ‘ঘূর্ণি’, ‘বন জ্যোৎস্না’ প্রভৃতি।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পগুলির বিষয়বস্তুর অন্যতম পর্যায় প্রেম। প্রেমের সফলতা-বিফলতা, বৈধতা-অবৈধতা, প্রাকবিবাহ-বৈবাহিক এবং বিবাহোত্তক সম্পর্ক নিয়ে নানা গল্প রচনা করেছেন। তাঁর কাছে প্রেম শুধু মানব জীবনের অনেক জটিল মনস্তত্ত্বের স্বরূপ তিনি উন্মোচন করেছেন। যেমন তার লেখনিতে দেখতে পাই – বিয়ে করে দু’জন মানুষ নিজেদের মধ্যে একটা ব্যবধান অনুভব করতে করতে একসময় পরস্পরের কাছাকাছি আসতে বাধ্য হয়। আবার প্রেমের নেশায় ঘর ছেড়ে বিপথে হারানোর পরেও যখন ভালোমানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তখন মনের মধ্যেই জেগে ওঠে সংস্কার। প্রেমের পরিণতি মিলনের জন্য যেখানে চাকরিই ছিল প্রধান শর্ত, সেখানে সেই চাকরিই দু’জনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আসলে প্রেমকে কোনো নির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বিষয়টি যতখানি জটিল ততখানি অপরিণামদর্শী।
মানুষের অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণে তার কলম বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। ‘উন্মেষ’ গল্পে আমরা দেখতে পাই মেয়ের মনে বোধের সঞ্চার ঘটাতে পিতা যে উপায়ের আশ্রয় নিয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে বিকারের ছায়া। ফ্রয়েড একবার বলেছিলেন বিকারটাই মানব মনের স্বাভাবিক রূপ। লেখক অত্যন্ত সার্থক ভাবে সেই রূপের পরিচয়ই তুলে ধরেছেন তাঁর কোনও কোনও গল্পে।
আমরা জানি উনি ব্যক্তিগত জীবনে অধ্যাপনার কাজের সূত্রে দেখেছেন নানান ছাত্র-ছাত্রী। তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝেছেন। আর সেই মনের কথাগুলোই ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যানভাসে। তার লেখনিতে ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘মাননীয় পরীক্ষক মহাশয় সমীপেষু’, ‘কেয়া’ ইত্যাদি গল্পের পাতায়। এই ক্যানভাস যাপনে তিনি শিক্ষাজগতের ফাঁকির দিকটা বিশ্লেষণ করেছেন।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনিতে তাই প্রকৃতির গৌরব সুন্দর ভাবে গাঁথা। ‘বনতুলসী’ নামক গল্পে প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতা কিভাবে মানুষের মানসিক ও শারীরিক অস্তিত্ব গ্রাস করে তা দেখানো হয়েছে। ‘দোসর’ গল্পে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে যে ভালোবাসা তা যে আসলে উদার প্রকৃতির দান, একথা অস্বীকার করা যায় না। উত্তরবঙ্গের চায়ের ফ্লেভারে তাই প্রকৃতি গন্ধ মিলে মিশে একাকার। ধরা দিয়েছে অন্য উত্তর বাংলার কথা। যতনে, স্বযতনে।
বাংলা ছোটগল্পে সংগীত কখনও কখনও গল্পের আবহ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও তা বিষয় বস্তু সাধারণত হয় না। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সেই অ্যাডভেঞ্চারও করেছিলেন। ‘উস্তাদ মেহের খাঁ’ বা ‘প্রতিপক্ষ’। প্রথম গল্পে সংগীতের মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ও দ্বিতীয় গল্পে সংগীতের কারণে দাম্পত্য জীবনের বিঘ্ন দেখেছি। আসলে তার রচনায় কাল চেতনা বিশেষ ভাবে দেখা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতার পরবর্তী দুই দশক পর্যন্ত আর্থ সামাজিক ও মানবিক রূপের যথার্থ পরিচয় তিনি দিয়েছেন। আজও নারী নিগ্রহ আমরা দেখছি সমাজে। সেই সময়ও ছিল একই রূপ, জ্বলন্ত এক সময়। ‘এগজিবিশন’, ‘পিতারি’, ‘হাঁস’, ‘দরজা’ প্রভৃতি গল্পে সমকালীন পরিবেশের তুলিরং আঁকা। সমাজ পরিবেশের অস্বাভাবিকতা দেখা যায় ‘দুঃশাসন’, ‘হাড়’ প্রভৃতি চিত্রগল্পকথায়।
একজন সফলতম সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তিনি তার স্বচ্ছ মতামত তার আঙ্গিকে দিয়েছিলেন সমকালীন গল্পকারদের। সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ প্রভৃতিকেই। আসলে তার দৃষ্টি সমাজ বাস্তবতাকে চিহ্নিত করলেও মানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই তো তারঁ গল্পের মধ্য দিয়ে শুভ চেতনার ইঙ্গিত সবসময় দেখতে পায় বাংলা সাহিত্য। কুর্নিশ তোমায় অধ্যাপক, সেলাম তোমার কলমকে…

error: Content is protected !!