কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (নবম কিস্তি)

আমাদের পুরো ব্যাচটাকে কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করা হলো। আমাদের দলে আমি, কর, সিং আর শমীম। শমীমের বাড়ি পাটনায়, একটু বাঙালি বাঙালি চেহারা, সিং এর সাথে রাঁচীতে একই কলেজে পড়েছে তবে কলেজে দু’জনের বন্ধুত্ব ছিল না বলেই প্রকাশ। রাঁচীর কলেজে নাকি জাতপাতের সংঘাতটা প্রবল। মেস কমিটির নির্বাচনে রাজপুত, ভূমিহার আর পন্ডিতের মারামারি নাকি সাধারণ ঘটনা। এমন কী মেসে কী ডাল রান্না হবে তা নিয়েও রক্তারক্তি কান্ড হয়ে যেত।

আমাদের দলের ডাক নাম হলো উত্তর ভারতীয় দল। এখানে তামিল, তেলেগু, মালায়লাম বা কানাড়া না বললেই উত্তর ভারতীয়, সে যদি তুমি মিজোরাম থেকে হও তাও। অবশ্য এ দোষটা আমাদের মধ্যেও আছে। দক্ষিণ ভারতের চারটে রাজ্যের যে কোনও একটাকে বলা হয় ম্যাড্রাস বা একটু উন্নত হলে সাউথ। আমার দিদিকে বলতে শুনেছি ‘সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক’।

আমাদের প্রথম পোস্টিং হলো, ক্রাশার। প্রথম দিন সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। এখানে কাজের সময় দুই ধরনের, একটা হলো শিফট, অর্থাৎ ভোর ছটা থেকে আড়াইটা, দুপুর দুটো থেকে রাত সাড়ে দশটা আর রাত দশটা থেকে পরদিন ভোর সাড়ে ছটা, অন্যটা জেনারেল, অর্থাৎ সকাল আটটার থেকে বিকেল পাঁচটা। মধ্যে খাবার জন্য ছুটি, যথাক্রমে আধ ঘন্টা আর এক ঘন্টা। ক্রাশারের ইনচার্জ মুনিরাজ আমাদের দেখে বিরক্তি গোপন না করে বললেন, ‘আবার আরেক দল জি.ই.টি। আমি তো ক্লান্ত হয়ে গেলাম।’ ওনার সাথে আরেক জন ছিলেন, যিনি একটি কথা না বলে ওনার সাথে আসতে বললেন। একটু অবাক হলেও, ওনার পিছে পিছে আমরা সবাই একটা লিফটে উঠলাম, আমাদের নিয়ে লিফটটা নিচে চললো, তিন তলার মতো হবে। প্রতি তলার দেওয়ালে কালো কালিতে একটা দুর্বোধ্য বিশেষণের সাথে ইংরেজিতে মুনিয়া লেখা আছে। এখানকার কর্মচারীরা মুনিরাজ সম্বন্ধে যে উচ্চমত পোষণ করে না সেটা স্পষ্ট। লিফট থামলো অ্যাপ্রন ফিডারের পাশে, সেখানে বেশ বড় বড় করে সেই বিশেষণ সমেত মুনিয়া লেখা আছে, তার পাশে মেজ মেজ অক্ষরে লেখা ছক্কা স্বামীনাথন। সেটা দেখিয়ে আমাদের পথপ্রদর্শক বললেন, ‘এই হলাম আমি।’

মাইনস থেকে লোহার আকর বড় বড় পাথরের মতো আকারে বের করা হয়। সেগুলোকে ক্রাশারে নিয়ে গিয়ে তাদের আকার ছোটো করা হয়। মুনিরাজ আমাদেরকে ক্রাশার দেখানোর ভার দিলেন রামপ্রসাদের ওপর। রামপ্রসাদের জি.ই.টি দশা মাস দুয়েক হলো শেষ হয়েছে, লোকে কেন যে ওকে আড়ালে উপ্পিটু রামপ্রসাদ বলে জানা নেই। শুনেছি একবার সকালের জলখাবারের সময় খিদের তাগিদে সহ্যাদ্রি ভবনের রেস্তোরাঁর বন্ধ কাঁচের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। মুখে খৈ ফোটাতে ফোটাতে রামপ্রসাদ আমাদের ক্রাশার কন্ট্রোল রুমে নিয়ে গেলো। প্রবল গর্বিত মুখে একটা বড় লাল মত সুইচ দেখিয়ে বলল, ‘এই বোতামটি টিপলে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে।’ এমারজেন্সি স্টপ স্পষ্ট লেখা আছে। শমীম তাও ন্যাকার মতো বলল, ‘সত্যি! আমার তো বিশ্বাস হয় না।’ রামপ্রসাদ আহত হয়ে বলল, ‘বিশ্বাস হয় না? আমার কথা বিশ্বাস হয় না? এখনই হাতে নাতে প্রমাণ হয়ে যাবে।’ তারপর আমরা কিছু বোঝার আগেই রামপ্রসাদ দুম করে লাল বোতামটায় থাবা মারল, ফলে যা হবার তাই হলো। সাথে সাথে পুরো ক্রাশার থেকে সাইলো, সব কনভেয়র, অ্যাপ্রন ফিডার সমেত সব কিছু থেমে গেল। ওয়াকি টকিতে প্ল্যান্ট ইনচার্জ ভি.এস. রমনের হুংকার ভেসে এলো, ‘কী হলো।’ রামপ্রসাদ অস্পষ্ট স্বরে জানালো, ‘কিছু না স্যার, ডেমো দিচ্ছিলাম।’

‘ডেমো! চালু প্ল্যান্টে ডেমো! জীসাস! এক্ষুনি এসে আমার সাথে দেখা করো।’

জীসাস বলাটা রমন স্যারের অভ্যেস। তা বলে উনি মোটেই খ্রীস্টান নন। তামিলিয়ান ব্রাহ্মণ। এই প্রজেক্টের সুবাদে যখন কানাডা গিয়েছিলেন তখন আমিষ আহার এবং খ্রীস্ট নাম জপার অভ্যেস করে এসেছেন। উনি রেডিও কাঁধে চাপিয়ে প্ল্যান্টে বের হলে মনে হতো জগ্গু দাদা পাড়ায় বেরিয়েছেন, গলি ফাঁকা। আগাছার মত অযত্নের ফল সাদা দাড়ি আর সাদা হেলমেটে ওনাকে বেশ ভয়ঙ্কর লাগতো।

কোম্পানি থেকে রেনকোট, গামবুট আর হেলমেট নিয়ম করে দেওয়া হয়। না দিলে বিশেষ বিপদ ছিল। কুদ্রেমুখের বার্ষিক বৃষ্টি সাত হাজার মিলি লিটারের মতো, সাথে প্রচন্ড হাওয়া, রেনকোটের বোতাম খুলে ভিজিয়ে দেয়। সমুদ্রতল থেকে আটশো মিটার উঁচু হবার সুবাদে বেশ ঠান্ডা তো আছেই।

মুনীরাজের জী.ই.টি যদিও পছন্দ ছিল না, তবু আমাদের ধরে মাঝে মধ্যে জ্ঞান দিতেন। ‘ভারতরত্ন স্যার মোক্সগুন্ডম বিশ্বেশ্বরায়া, নাম শুনেছো তো, মহীশুরের দেওয়ান ছিলেন। ঘরে দুটো বাতি রাখতেন, সরকারি আর ব্যক্তিগত। অফিসের কথা বলার পর কেউ ব্যক্তিগত আলাপ করলে একটা নিভিয়ে অন্যটা জ্বালাতেন। সাথে দুটো কলম রাখতেন, অফিসের কাজে অফিসের কালি খরচ করতেন আর ব্যক্তিগত কাজে নিজের কালি।’

আমার ঠোঁটটা চুলকে বলে উঠলো, ‘স্যার, বারবার আলো জ্বালা নেভা করলে তো তেল নষ্ট হয়, আর আমরা সবাই তো অফিসের কাজেও নিজেদের পেন ব্যবহার করি।’

***

এক শনিবার সন্ধেতে প্রথামত সামান্য মদ্যপানের পর কর বিশেষ দুঃখের সাথে আমাদের জানালো, মেয়েদের ব্যাপারটা ওর বিশেষ আসে না, মানে মেয়ে জাতিটাকে ওর বেশ ভালো লাগে, কিন্তু চ্যাটার্জির মতো ঠিক ইয়ে করে উঠতে পারে না। আমাদের সহ্যাদ্রি ভবনে যে মেয়েটি রিসেপশনিস্টের কাজ করে, তার নামটি যদিও জানা নেই, তবে ও মনে মনে ওকে জুলি বলে ডাকে এবং মেয়েটি লক্ষীট্যারা হওয়া সত্ত্বেও ওর সান্নিধ্য পেতে বিশেষ আগ্রহী। কিন্তু সেটা কী ভাবে করলে ঝামেলা এড়িয়ে ফলপ্রাপ্তি হবে সেটা জানা নেই।

সিং এর কাছে বেশ খবর টবর থাকে। ‘করেছো কী করদা, শেষে কার প্রেমে পড়লে! ওর নাম মোটেই জুলি টুলি নয় সুসি। ও কে জানো তো? ও হেগড়ের রক্ষিতা, হেগড়ে এখানে বিদেশী মদের দোকানের মালিক আর সহ্যাদ্রি ভবনটার ঠিকাদার।’

কর একটু দমল না।

‘না না প্রেম ফ্রেম নাই বা হলো। ওসব আমার আসেও না। তাহলে একদিন কী আমার সাথে ইয়ে করতে রাজি হবে না? আমি তো ইঞ্জিনিয়ার, তাছাড়া আমি না হয় পুরো এক মাসের মাইনে পি.এফ কেটে ওই ষোলোশো আশি টাকা দেবো। হবে না!’

এতক্ষণ আমার লেখাটা পড়ে যদি কারোর ধারণা হয় আমাদের বিপদভঞ্জন করের চেহারা বোকা বোকা ছিল, মানে আমাদের গল্পে নাটকে কমেডিয়ানদের চেহারা যেমন হয় তেমন, তাহলে ভুল হবে। করকে দেখতে মোটেই খারাপ বলা যাবে না, পাঁচ আটের ওপর লম্বা, মুখ চোখ ভালো, খুব ফর্সা, চুল আর চোখ কটা, গোঁফ দাড়ি বিশেষ নেই এই যা।

চুল, চোখ নিয়ে কর বেশ গর্বিত ছিল। বলতো, ‘সবাই বলে আমি গত জন্মে সাহেব ছিলাম।’

(‘ইংরেজিটা এমনভাবে ভুললি কী করে, পূর্বজন্মের কিছুই কী মনে পড়ে না?’)

‘আমাদের পরিবারে আর কারোর এমন চুল নেই।’

(‘প্রতিবেশী, রামুকাকা বা পাড়ার কারোর আছে?’)

মুখে দাড়ি গোঁফ না থাকাটা করের মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। ওর মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল যে গুম্ফশশ্রুহীনতাই ওর নারী সঙ্গপ্রাপ্তির পথে প্রধান অন্তরায়। কর মুখে দাড়ি গজানোর জন্য লোকে যা যা বলতো সব পুরোপুরি বিশ্বাস করত। মুখে প্রোটিন লাগালে উপকার জানার পর যখন তখন অমলেটের জন্য রাখা ডিমের কুসুম মেরে দিত। সার দিলে উন্নতি হবে শুনে মুখে গোবর লাগাতেও রাজি ছিল। আর ইয়ে নিয়ে ওর কোনো প্রতক্ষ্য অভিজ্ঞতা ছিলনা। হঠাৎ করে এমন বড়সড় বাজেট নিয়ে ইয়েপ্রার্থী যে কেন হয়ে উঠলো আমার মাথায় ঢুকলো না।

চেহারা নিয়ে মানে গায়ের রঙ নিয়ে দুঃখ, আমাদের মধ্যে আরেক জনেরও ছিল। তার নাম এ.এস.পী. কান্নন। কান্ননের বাড়ি তামিলনাড়ুর এক গ্রামে, যেখানে ওই প্রথম ইঞ্জিনিয়ার, দলিত পরিবারে জন্মানোর সূত্রে জীবনে অনেক অপমান দেখেছে। ওর বাবা মা এখনো উঁচু জাতের কারোর বাড়ি গেলে মাটিতে বসে খেতে দিলে পাতা ফেলে খাবার জায়গা মুছে দিয়ে আসে।

কান্নন বাইরে বের হলে সাজ সজ্জার দিকে বিশেষ নজর রাখে। লাল প্যান্টের ওপর সবুজ শার্ট পরে মুখে বেশি বেশি পাউডার মেখে দিনরাতের খেয়াল না রেখে সানগ্লাস পরে বের হয়। সম্ভবস্থলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে। চুল ঠিক করে আর নাকের দুই পাশটা দুই আঙুল দিয়ে ঘষে নেয়। সব ক্লাসে প্রয়োজন অপ্রয়োজনে প্রশ্ন করে করে বক্তার সাথে আমাদের পাগল করার উপক্রম করত। আর বলত, ‘আমার খুব ফর্সা মেয়ে বিয়ে করার সাধ, তাতে আমার ছেলে মেয়েরা ফর্সা হবে। তবে আমাদের জাতে ফর্সা মেয়ে কই।’

error: Content is protected !!