কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (দশম কিস্তি)

()

শিফট ডিউটি আরম্ভ হতেই জীবনটা জীবিকার প্রয়োজন মাত্র হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত সময়ে ঘুম থেকে ওঠা, অদ্ভুত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া, ঘুমানোর সময় জেগে থাকা, যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে পেট ভরানো ইত্যাদি। চারদিকে যে সব খাবার পাওয়া যায়, তার সাথে দীর্ঘদিনের খাদ্য সংক্রান্ত ধ্যান ধারণার প্রচুর বিরোধ। জলপাইগুড়িতে দক্ষিণী খাবার পাওয়াই যায় না আর কলকাতায় সোপার্জিত কষ্টের পয়সায় ইডলি, দোসা খাবার ইচ্ছে কখনই মনের কোণে স্থান পায়নি। তার ওপর অতিরিক্ত সংযোজন উপ্পিটু (ঝাল সুজি), শিরা (জল দিয়ে তৈরি রঙিন সুজি), অওলাকি (কী যেন দিয়ে ভাজা চিড়ে), বিসিবেলে রাত (খিচুড়ির মতো দেখতে হলেও খেয়ে বোধহয় অন্য বস্তু) ইত্যাদি। বিশেষ বলতে শিরা উপপিটুর অবৈধ সম্পর্কের ফল চো চো বাত ও চিনে বাদাম আর লেবু দেয়া ঝাল ভাত চিত্রান্না।

সবাই মিলে রান্না করার চেষ্টা যে একেবারে হয়নি তা নয়, তবে শিফটের প্রকোপে একেক জন একেক সময়ে আসছি যাচ্ছি, তাতে একত্র হবার সম্ভাবনা কম থাকতো। উপরন্তু বাজার থেকে ডিম নিয়ে এলে কর হয় জাম্বো অমলেট ( চার পাঁচটা ডিমের অমলেট, নামটা ওরই দেয়া) বানিয়ে, নয় মুখে মেখে ফুরিয়ে ফেলতো। বাসন কে মাজবে সেটাও বড় সমস্যা। করের বাসন মাজতে একটু আপত্তি আছে, তাই সিঙ্কে ডিমের খোলার সাথে বাসনও রেখে দিতো। একদিন সিঙ্ক উপচে পড়ে মিনি বন্যাও হয়ে গেল।

কুদ্রেমুখ টাউনশিপে কোনো কোয়ার্টারই দোতলার বেশি হতো না। একটা ব্লকে চারটি করে ফ্যামিলি কোয়ার্টার। ব্যাচেলর অফিসারদের যোগ্য কোয়ার্টার তখন পুরো তৈরি হয়নি। তাই কিছুদিনের জন্য এই ভাগাভাগি করে থাকা। আমাদের কোর্য়ার্টারটা দোতলায়। বাজার কিছুটা দূরে হলেও পার্কটা কাছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় প্রকৃতির সবুজ রঙের শিশিটি উপচে পড়েছে। কিছুটা দূরেই একটা মুদির দোকান ছিল। আসা যাওয়ার পথে খুব সুন্দর কফির গন্ধ পেতাম। দোকানের এক কোণে এক মহিলা কফির বীজ গুঁড়ো করতেন। সেই ভাবীর টানে কিনা বলতে পারি না, কর নিত্য যাতায়াত করে (প্রয়োজনীয় কম, অপ্রয়োজনীয় বেশি) জিনিসপত্র কিনে বাজেটে টান পড়িয়ে দিলো। তবে কফিতে আমাদের দুজনেরও সম্মতি ছিল। করের নির্দেশনায় মহোৎসাহে কফি বানালাম। অমন সুন্দর গন্ধওয়ালা কফি যে এতটা বাজে খেতে হয় ধারণা ছিল না। নন্দকুমারকে বলতে, অবাক হয়ে বললো, ‘তোমাদের কাছে কফি ফিল্টার আছে? ও কফি ফিল্টার না করে খেতে নেই।’ কফি ফিল্টার একটা ছোট দুতলা স্টিলের কৌটোর মতো, যেখানে ওই বৌদির বা অন্য সবার গুঁড়ো করা কফি ছেঁকে ভিজিয়ে রেখে তবেই বানাতে হয়। এখানে প্রায় সবার কাছেই আছে। শুনে কর বললো, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম না! ভাবীও এমনি কিছু একটা বলছিল। ভাবী খুব ইন্টেলিজেন্ট মাইরি।’

আমরা যেখানে বাসা বেঁধে ছিলাম সেখানকার আসে পাশে পরিবার সমেত মানুষেরাও থাকতেন। তাদের মধ্যে সুন্দরাপ্পার বাড়িটাতে অনেকেরই নজর থাকতো। সুন্দরাপ্পার কোটার সৌন্দর্য ওর বউ পূরণ করে ছিল এবং সে কখন বাইরের দড়িতে কাপড় মেলতে আসবে সেটার প্রতিক্ষা কমবেশি সবারই থাকতো। করের জুলির প্রতি আনুগত্য দুম করে কমে এলো। আসপাশের জি ই টি দের এই উৎসাহ মিসেস সুন্দরাপ্পার নজরে পড়েনি তা নয়। তাতে ওঁর কাপড় কাচার উৎসাহ বেড়েছে বই কমেনি।

এক বিকেলে আমাদের প্রতিবেশী বেশ কিছুটা প্রায় রান্না করা হরিণের মাংস পাঠাল, সাথে ‘চাইলে আরও একটু সিদ্ধ করে নিতে পারো বলে’ সামান্য পরামর্শ। হরিণের মাংস কোথা থেকে এলো, ব্যাপারটা আইন সম্মত কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন উৎসাহের জোয়ারে ভেসে গেল। সিং রুটি বানাতে অগ্রণী ভূমিকা নিল। শমীমকেও নিমন্ত্রণ করা হলো। মাংসটা শক্ত শক্ত আছে বলে আবার হিটারে চাপানো হলো। পুরো ব্যাপারটা একটা উৎসবের চেহারা নিল। শনিবার হওয়া সত্ত্বেও এমনকি করও ঠিক ততটাই গিললো, যতটাতে বমি হয় না। ঠিক হলো ব্রিজ খেলবো, কর আমার পার্টনার। কী অপরাধে আমার এই শাস্তি তা জানতে চাইলে সিং বলল, ‘লিখিত পরীক্ষার সময় তুমি শালা ভালবেসে ওকে উত্তর দেখাওনি, সে পাপের তুলনায় এ শাস্তি তো কিছুই না।’ কাউকে গোপন কথা বলতে নেই! তবে সুখের কথা যে দুই দানের পরেই কর স্বীকার করে নিল ব্রিজ খেলাটায় ও বিশেষ পটু নয়। সাদা বাংলায় যার অর্থ হলো বিপদভঞ্জন কর তিন তাসের খেলা ছাড়া কোনও খেলাই এ জন্মে খেলেনি। ব্রিজ বলতে নদীর ওপরে যেটা বানানো হয় সেটা ছাড়া অন্যকিছু জানে না। সেদিন ব্যবহারিক ভাবে জানা গেল শমীমের খিস্তির ভান্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। রুটি যা তৈরি হলো তা, যা আশা করেছিলাম তার চেয়ে ঢের ভালো। দুবার হিটারের তার ছিঁড়লো, জোড়া লাগানো হলো। মাংস কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা সিদ্ধ করার পরও সেই শক্ত অবস্থাতেই রয়ে গেল। আমাদের মতো উৎসাহী ক্ষুধার্তরাও তাকে খাওয়ার যোগ্য বলে মানতে পারলাম না। শেষে করের রূপ চর্চার জন্য সরিয়ে রাখা ডিমের ঘন্ট বানিয়ে পিত্তি রক্ষা হল।

শনিবার রাতে এমনটা হওয়ায় পরদিন আমাদের রোখ চেপে গেলো, ডুবে যাক তরী, ভেসে যাক প্রাণ আজ দুপুরে মাংস খেতেই হবে। আর সেটা নিজেরা রান্না করেই খেতে হবে। চটাপট চাঁদা উঠে গেল, বাসন মাজতে হবে না সেই শর্তে কর ভদ্রা মার্কেট থেকে শ্রেষ্ঠ মুর্গি আনার মহান দায়িত্ব নিয়ে সাহাদার বাড়িতে সকালের খাওয়ার ব্যক্তিগত সেটিং করতে বেরিয়ে গেল। আমি আর সিং মাংসের মশালা কোথায় বাঁটা যায় তাই নিয়ে গভীর আলোচনা করতে থাকলাম। বেলা বাড়তে থাকলো কিন্তু করের দেখা নেই। আমরা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম, কখন মাংসটা পরিষ্কার করব, কখনই বা রান্না হবে। বারোটা নাগাদ কর এলো হাতে একটা ছোটো প্যাকেট, দেখেই অনুমান করা যায় সেটা আর যাই হোক মুর্গির মাংস নয়। কর ধপ করে বসে বলল, ‘মুর্গি আনিনি। একটাও ভালো না, সব লায়ার মুর্গি।’

 ‘লায়ার আবার কী? মুর্গি আবার সত্যবাদী, মিথ্যাবাদী হয় নাকি? সবচেয়ে বড় কথা হল মুর্গি কী কথা বলতে পারে যে মিথ্যে বলবে?’ সিং এর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল করের আজ আহত হবার প্রচুর সম্ভাবনা।

‘না হয় মুর্গিটা একটু মিথ্যে বললই, তা বুঝবেটা কে? আর আমাদের তো কেটে খাওয়া নিয়ে কথা।’ আমি আপোষের পথ নিলাম।

‘লায়ার মুর্গির টেস্ট ভালো হয় না। সোমদার সাথে বাজারে দেখা, উনিই বললেন, এগুলো সব ডিম পাড়া মুর্গি, এর স্বাদ ভালো হয় না।’

‘মুর্গির কথা জানি না, তুই এক বিরাট লায়ার। সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। তুই আজ সোমদার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া সেটিং করেছিস, তাই না।’

‘সেটিং আবার কী, সোমদা খুব করে বলল তো কী করব? অভদ্রের মতো না করে দেবো? তোদের জন্য সয়াবিন নিয়ে এসেছি, ঠিক মতো রাঁধলে মাংস কোথায় লাগে।’

পরে সোমদার কাছে শুনেছিলাম, রবিবার এগারোটা নাগাদ বাজারের সামনে করের সাথে দেখা। ‘আমাকে জিজ্ঞেস করল মুর্গি ভালো কিনা। আমি বললাম অত ভালো না লেয়ার মুর্গি। ও বলল, আজ আমার মুর্গি খাবার প্ল্যান ছিল, তো আমি বললাম, তাতে কী আছে আমি তো মুরগি নিয়েছি। আমার বাড়ি চলে এসো। চ্যাটার্জিকেও আসতে বলো। তো ও বলল চ্যাটার্জিদের বড় প্রোগ্রাম, ও তো আসতে পারবে না।’

***

সকালের শিফট থাকলে বিকেলটা ফাঁকা থাকত। তখন আমারা ক্লাবে গিয়ে সময় কাটাতাম। সহ্যাদ্রি ভবনের এক তলায় ছিল অফিসারদের ক্লাব। টেনিস, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড, দাবা আর তাস, সব কিছুর ঠিকঠাক আয়োজন আছে। সুইমিং পুলও আছে। তাসের ঘরে বেশ ভিড় থাকে, টাকা পয়সাও হাত বদল হয়। একটা ছোটো লাইব্রেরী আছে সাথে রিডিং রুম। আমি বিলিয়ার্ড কখনও খেলা তো দূরে থাক, কাছ থেকেও দেখিনি, তাই একবার খেলে দেখার সাধ ছিল। তবে একবার খেলার পর ক্যারামের বা মতান্তরে বাগাডুলির বড়দা ছাড়া বিশেষ কিছু না লাগায় আর ও পথ মাড়াইনি।

ব্যাডমিন্টন জলপাইগুড়ির সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা, খেলার মানও যথেষ্ট ভালো। দেবাশিস বসাক, বাবলু বড়ুয়া, অনিতা ভট্টাচার্যরা তো রাজ্য পর্যায়ে খেলতো। জলপাইগুড়িতে কোনোদিন পাত্তা না পেলেও আমি এখানে দিব্যি ভালো খেলোয়ার হয়ে গেলাম। মেয়েরাও সেখানে খেলতে আসত। করের দীর্ঘশ্বাসে ঝড় বইতে লাগল, ‘আমার মাইরি কুত্তার লাক। টেবিল টেনিসটা মোটামুটি খেলি, একটা মেয়েও খেলা তো দূর দেখতেও আসে না।’ মাসে একদিন ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলা বন্ধ রেখে পর্দা টাঙিয়ে ষোলো মিলিমিটার ছবি দেখানো হতো, যা পাওয়া যেতো তাই। ক্লাবে অনেক কিছুর সাথে একটা বার ও ছিলো। যাদের বাড়ি বসে খাবার অনুমতি ছিল না, তারা ওখানে ভিড় জমাতো। তাছাড়া বারে একটা টি. ভি. লাগানো ছিল যেখানে কখনো ক্যাসেট লাগিয়ে রাতের বেলায় স্পেশাল শো নাম দিয়ে ফিকে নীল ছবি দেখানো হতো। কুদ্রেমুখে যেন মাঝ সমুদ্রে থেমে থাকা এক জাহাজ, তার ক্লান্ত নাবিকদের জীবনে বৈচিত্র আনার জন্য এ নাকি এক বিশেষ খোরাক।

error: Content is protected !!