গেল বছর রথের মেলা থেকে খুব শখ করে লেবুগাছ কিনেছিলেন সেনবাবু। বসিরহাট থেকে আসা লোকটা এই চারাগাছটার গুণাগুণ বাতলাতে গিয়ে প্রায়ই “আহা-আহা” করে উঠছিল। মস্ত ভিড় জমেছিল চারপাশে। সেনবাবু মিনিট দশ চুপচাপ থেকে টুক করে একটা চকচকে পাতাওয়ালা চারা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, এই কত দেব, ঠিক করে বল…

লোকটা সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে আরেকবার দাম শুনিয়ে দিল। কিন্তু সেনবাবুও নাছোড়বান্দা।

এই চিমটে মতো গাছটার দাম পঞ্চাশ টাকা! আমায় কি বুদ্ধু ভেবেছিস?

ওনার মতো আরো কিছু লোক এ দাম শুনেই সরে গেল।  এক বৌদি তো লেবু ছেড়ে ধেয়ে গেল গোলাপ চারায়।  লোকটা তা দেখে পিছু ডাকল,

ও বাবু, ও চশমাওয়ালা বাবু শুনছেন, আসেন একটু কমায় দিমু।

এদিকে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় গিন্নি পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সস্তার জিনিস এনেছ তো সব ওই ডাস্টবিনে যাবে।  তারপর হা-পিত্তেস করতে করতে শুনিয়ে দিলো সেই একই ডায়লগ, একটা ভালো চয়েস নেই লোকটার।  যা পায় উঠিয়ে নিয়ে আসে।

ইঙ্গিতে যে ওই জিকো নামের কুকুরটা তা বেশ বুঝতে পারছিলেন সেনবাবু।  কিন্তু এই ছানাটাকে দেখেই সেদিন মন গলে গেছিল তাঁর।  বাছা মা-বাপহীন হয়ে একা একা ঘুরে বেরাচ্ছিল দেখে উনি তুলে নিয়ে এলেন।  আর এখন মাত্র কদিনেই গা চকচকে হয়ে গেছে জিকোর।  একদিন অন্তর সে মাংস খায়, রোজ পাতে থাকে একটা করে ডিম – হেবি ব্যাপার।  গিন্নির মতে ডাভ সাবানটারও নাকি অনেক ভাগ্য।  সেনবাবু তা নিজেও মাখেন আবার জিকোকেও মাখান। এদিকে নিজের মেয়েটা দিনদিন প্যাংলা হয়েই চলেছে সেদিকে খেয়াল নেই।  সবাই তাই দেখা হলেই একপ্রস্থ উপদেশ দেন মিসেস সেনকে।  কিন্তু যে বাড়ির খুঁটি সেই লোকটাই তো কিচ্ছু বোঝেনা।

সেনবাবু এদিকে থলে নাচাতে নাচাতে লোকটার কাছে এলেন,

– দেখ্‌, ঝামেলা পাকাস না। আমি ঠিক অর্ধেক দাম দেব, দিবি তো দে – না হয় চললাম।

লোকটা রাজি হয়ে গেল।  তারপর চারাটা কাগজে মুড়িয়ে হাতে মাপ দেখিয়ে বলল,

বাবু, এই এত্ত বড় নেবু হবে দ্যাখবেন। 

সেনবাবু পয়সা মিটিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। এক হাতে জিলিপির একটা বড় প্যাকেট আর অন্য হাতে কাগজ ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে লেবুর চারাটা।

এদিকে লেবুচারাটারও মহা ভাগ্য। যদিও মিসেস সেন সেদিন হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।  সেনবাবু তাই তাঁর ঘরের লাগোয়া বারান্দায় লেবুচারাটা যত্ন করে লাগিয়ে দিলেন।  এরপর জল দেওয়া, পাতা পরিষ্কার, মাটি খোঁড়া সব কিছু নিজের হাতেই করছিলেন।  দেখতে দেখতে লেবুগাছটা বেশ মোটাসোটা হয়ে উঠল ও একসাথে গাছে এল অনেকগুলো ফুল।  মানে এই সব কটা লেবু হয়ে ফললে নাকি একটা বিশাল ব্যাপার হবে, এমনটাই বলছিল সবাই। 

সত্যি সত্যি গাছ নুয়ে এলো লেবুতে।  টবেতে এত লেবু নাকি কেউ কখনও দেখেনি।  বারান্দার পাশ দিয়ে গাছটাকে দেখে এমনটাই মন্তব্য করছিল সবাই।  হঠাৎ সেদিন আরেক কান্ড হয়ে গেল।  বাড়িতে কারা যেন এসে উপস্থিত।

গিন্নির প্রচন্ড আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে অন্দরমহল থেকে। কাজের মেয়েটারও দৌঁড়োদৌঁড়ি। এদিকে লেবুগাছটা টব শুদ্ধ এখন সেন্টার টেবিলে এসে বসেছে। সেনবাবু হতভম্ব হয়ে সোজা ঘরেই ঢুকে পড়লেন। আর লোকগুলো ওনাকে দেখে ছুট্টে এল,

আমরা লোকাল নিউজের দপ্তর থেকে এসেছি। আপনার লেবুগাছটা নিয়ে একটা মিনিট সাতের কভারেজ করতে চাই, তাই এটা কিভাবে – কোত্থেকে আনলেন? যদি একটু বুঝিয়ে বলেন…

সেনবাবু দেখলেন গিন্নি তাকে বলার জন্য সমানে ইশারা করে চলেছে।  তাই আর কিন্তু-টিন্তু না করে বৃত্তান্ত খুলে বসলেন ও ফেরার আগে ছেলেগুলো ক্যামেরা ঘুরিয়ে গিন্নির দিকে দিতেই উনি সহাস্যে বলে গেলেন, ওর চয়েসগুলো সাঙ্ঘাতিক, না হলে ওই রোগাপাতলা লেবুচারাটায় যে এমন রেকর্ড রকম ফল ফলবে আশা করতে পারিনি।

Leave a Reply

error: Content is protected !!