অতৃপ্ত মন – সুলতা পাত্র

Bengali Short Story, Sulata Patra,

       এক ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে মানস ও অনুপমার সংসারে সমৃদ্ধি না থাকলেও সুখের ঘাটতি খুব একটা ছিল না। মানস ও অনুপমার এই ছোট্ট পরিবারটি গড়ে উঠেছিলো পূর্ব মেদিনীপুরে দীঘার কাছে অলংকারপুর গ্রামে।

       মানসের বাবা-মা গত হয়েছেন। একটি বোন তার বিয়ে হয়েছে ঘাটালে, বেশ দূরে শ্বশুরবাড়ি তাই দাদা-বৌদি ও ভাইপো-ভাইঝির সাথে ফোনে প্রায় কথা হয়। মাঝেমাঝে আসেন অলংকারপুরে, তবে বছরে একবারের বেশি আসা হয় না।

       মানস ও অনুপমার ছেলের নাম অভিজিৎ, মেয়ে মৃদুলা। দুজনেই পড়াশুনাতে খুব ভালো। মৃদুলা এমফিল. পড়ছে, অভিজিৎ ক্লাস টুয়েলভে পরীক্ষা দেবে।

       বাড়িতে দুটো গাভী ও বাছুর আছে,  আর আছে কয়েকটি মুরগি। গ্রামের মাঠে বেশ কয়েক বিঘে ধান জমি চাষাবাদ হয়ে উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি হয়।

       গোয়ালা বাড়ি থেকে দুধ কিনে নিয়ে যায়।  বাগানের ডাব, নারকেল, সফেদা, কলা, আম এইসব বিক্রি করেও বেশ কিছু পয়সা আসে। মানসের একটি ছোট মুদির ও দোকান আছে।

       অভিজিৎ ও মৃদুলা পড়াশোনার ফাঁকে টিউশন করে কিছু টাকা মা ও বাবার হাতে তুলে দেয়। এইভাবে টানাটুনির মধ্য দিয়ে চলে যায় সংসার।

       সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম সেরে রাতে শোবার আগে অনুপমা দেখেন, অভিজিৎ পেতলের কলসি থেকে মগে জল নিতে এসেছে। ছেলের পিঠে হাত রেখে বলেন, -‘হ্যাঁ রে খোকা, মন দিয়ে পড়াশোনা করছিস তো? তোকে যে ডক্টর হতে হবে বাবা। তোর দিদি কিন্তু এই বছর এমফিল. কমপ্লিট করার পর আশা করছি, প্রফেসর বা হাইস্কুলের শিক্ষিকার চাকরি পেয়ে যাবে।’

       অভিজিৎ বলে, -‘যথাসাধ্য চেষ্টা করছি মা, জানিনা কতটা পারবো।’

       ‘চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই বাবা। আমরা যে তোর ও মৃদুলার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় দিন গুনছি। পাড়াতে কয়েকজন বিত্তশালী মানুষ আছেন, যাঁরা আমাদের মত লোকজনকে সম্মানের চোখে দেখেন না। কারণ আমাদের যে বেশি পয়সা নেই সেই অবস্থাটা তো কাটিয়ে উঠতে হবে খোকা, তার জন্য চাই ভালো রেজাল্ট।’

       ‘বাবাও তুমি আশীর্বাদ করো মা, আমি যেন তোমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।’

       ‘ঈশ্বর আছেন খোকা, দেখিস তোদের দুই ভাই বোনের ও আমাদের পরিশ্রম বিফলে যাবে না। যা বাবা অনেক রাত হলো খুব বেশি রাত জেগে পড়িস না। ভোরে উঠে পড়াশোনা করলে স্মৃতিতে গচ্ছিত থেকে যায়।’

       ‘হ্যাঁ মা তুমিও ঘুমোও গিয়ে।’…

        কেটে গেছে কয়েকটি বছর, মৃদুলার কাঁথিতে বিয়ে হয়েছে, মৃদুলা ও তার স্বামী অর্পণ একই কলেজের প্রফেসর। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে সে পর হয়ে যায় না তার প্রমাণ দিয়েছে মৃদুলা। প্রত্যেক মাসে বাবা মায়ের একাউন্টে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়। বাবা-মায়ের ও ভাইয়ের খোঁজ খবর রাখে।

      বাবা মায়ের কাছে টাকা পাঠানো নিয়ে মৃদুলার শ্বশুর শাশুড়ি যে একদম ঝামেলা করেননি তা নয়। তবে তার প্রত্যুত্তর তাঁরা সম্মানের সাথেই পেয়েছেন।

       মৃদুলা স্পষ্টই জানিয়েছে, -‘দেখুন আপনারা যেমন আপনাদের সন্তান অর্পণ কে পড়াশোনা করিয়েছেন, তেমনি আমার বাবা-মাও তো আমাকে তাঁদের গরিব সংসার থেকে অনেক কষ্টে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে পড়িয়েছেন তাই না?’

       শাশুড়ি বলেন, -‘তুমি বাবার বাড়িতে টাকা পাঠাবে, বিয়ের আগে তো তেমন কথা ছিল না বৌমা।’

       ‘আপনাদের হয়তো বলা হয়নি মা। কারণ আমার বাবা-মা এই প্রস্তাব দিতে দিতেন না, কিন্তু আপনার ছেলেকে আমি আমার বক্তব্য জানিয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা বাবার বয়স হয়েছে শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, দোকানটা তাই বিক্রি হয়ে গেছে। ভাই কলকাতাতে এম.ডি.করছে তারপর আমেরিকা যাবে এফ.আর.সি.এস.করতে, তাই প্রচুর টাকার দরকার। আমি টাকা তো দেবোই হয়তো বাবাকে কয়েক বিঘে জমি বিক্রিও করতে হতে পারে। ভাই আমেরিকা থেকে ফিরে এলে, সেদিন সেই আমাকে আর টাকা পাঠাতে দেবে না। তাই এই নিয়ে আর কোনদিন কোন কথা বলবেন না মা।’

       মৃদুলার শাশুড়ি অবশ্য নেহাৎ মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ নন। তারপর নিজের ছেলে অর্পণ যখন বিয়ের আগে কথা দিয়েছে, সেখানে আর কোন কথা আসতেই পারে না। সেই বোধ-বুদ্ধি ভদ্রমহিলার আছে।

       সবকিছুই ভালোভাবে এগোচ্ছে, কিন্তু মানসের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অভিজিৎ তার কলেজের ডক্টরদের সাথে কনসাল্ট করলে, উনারা একটি ডক্টর বোর্ড বসিয়ে বিভিন্ন টেস্ট করার পর ধরা পড়ে মানসের একটি বিরল রোগ হয়েছে। নাম এস.এ.লি. আকাশ ভেঙ্গে পড়ে পরিবারের সবার মাথায়। মানস করাঘাত করেন নিজের ভাগ্যকে।

        এস.এল.লি.অসুখে মানব দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আস্তে আস্তে বিকল হয়ে যায়। মানসের রোগ নির্ণয় অনেক পরে হয়েছিলো, এই অসুখে ভুগছেন অনেকদিন জানা যায়নি।  রুগ্ন শরীরে এই অসুখের ধকল কতদিন নিতে পারবেন ঈশ্বর জানেন। ডক্টর বলে দিয়েছেন, তরকারিতে লবণ না খাওয়াই উচিত যদি দরকার হয় নেহাৎ ছিটেফোঁটা দিয়ে তেল বিহীন সেদ্ধ তরকারি খেতে হবে। মাছে অল্প লবণ যতটুকু না দিলে নয় ততটুকু দেওয়া যেতে পারে।

              যতটা সম্ভব মিষ্টি বর্জিত ফল খাওয়া যাবে।  হাঁটা জরুরী এবং সাথে পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন, মানসিক আনন্দে থাকতে হবে। ডক্টর অনেক টাকার ঔষধ প্রেসক্রাইব করে দিয়েছেন, সেগুলো কন্টিনিউ করতে হবে…

      পাসপোর্ট ভিসা হয়ে গেলেও অভিজিৎ আমেরিকা যেতে চাইছে না।  মানস বলেন, -‘খোকা আমাদের যে তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বাবা, আমেরিকা যাওয়া বন্ধ করিস না।

      ‘বাবা আমি এম. ডি. করেছি, অলংকার পুরে কোন সরকারি হসপিটালে চাকরি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এ সময় যে তোমার পাশে আমার থাকাটা জরুরী।’

      ‘তোর দিদি আছে চিন্তা করিস না, তোরা দুই ভাইবোন যে আমার অহংকার সেটা খর্ব করিস না বাবা। তাছাড়া তুই তো ভালো রেজাল্ট করে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যাচ্ছিস। তুই আমেরিকা থেকে ফিরে আয় আমি ঠিক ভালো থাকবো।’

      বাধ্য হয়ে আমেরিকাতে গেছে অভিজিৎ। মৃদুলা কলকাতার ডক্টর, অভিজিৎ এর স্যারের কাছে মানস কে চেকআপ করাতে নিয়ে যায়।  অভিজিৎ তার স্যারের সাথে ফোনে মানসের চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করে। আমেরিকা যাবার আগে স্যারকে কান্নাকাটি করে বলে গেছে, ‘বাবাকে ভালো করে দিন স্যার!’

      মৃদুলা তার বেতনের তিন ভাগ টাকা বাবার পেছনে খরচ করে। অর্পণকে বলেছে, – ‘আমাকে তিনটে বছর সময় দাও, ভাই ফিরে এলে তখন সংসারে এত অনটন থাকবে না, আমাকে এত টাকাও বাবার বাড়িতে দিতে হবে না।’

      অর্পণ সাহস জুগিয়ে গেছে,  মৃদুলা কে প্রতিবাদ জানাই নি কোনদিন। কেটেছে সময়, কেটেছে দিন,  মাস, বছর,মানসের শরীরের অবনতি হয়ে চলেছে। এত ভালো ট্রিটমেন্টে থেকেও উন্নতি হয়নি। কখনো স্থিতিশীল কখনো অবনতি এই ভাবেই চলছে।

      অভিজিৎ আমেরিকা থেকে ফিরবে মাসখানেক পর,বাবার চিন্তায় সেও ভালো নেই। মানস বলে দিয়েছে অনুপমা ও মৃদুলা কে, অভিজিৎ ভারতে ফেরার আগে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, সেই খবর যেন জানানো না হয় অভিজিৎ-কে।

      মাত্র পনেরো দিন বাকি আছে ভারতে ফিরবে অভিজিৎ,সত্যিই আর দেখা হলো না ছেলের সাথে মানসের।  সবে যখন অনুপমা ও মানসের আশা-আকাঙ্ক্ষার ফুল গুলো প্রস্ফুটিতো হতে শুরু করেছে ঠিক তখনই অতৃপ্ত মনে বিদায় নিলেন মানস।

      ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করার জন্য অনুপমা ফোনের সুইচ অফ করে দেন।  অশ্রুসজল নয়নে বলতে থাকেন,-‘খোকা রে এমন ভাগ্য তোর বাবার, তোর হাতে মুখাগ্নি ও পেল না। সাবধানে আয় বাবা কি করব সবই আমার দুর্ভাগ্য’!

      অভিজিৎ ফোন করে মৃদুলা কে, – ‘দিদি কি ব্যাপার বলতো? বাবার ফোনের সুইচ অফ কেনো, বাবা ভালো আছে তো?’

      কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদুলা জানায়, -‘আমি বাবা মায়ের কাছে গেছিলাম ভাই, দুই দিন আগে বাড়ি ফিরেছি। ফোনটা খারাপ হয়ে গেছে, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফোন ঠিক করে নিয়ে যাবো। এত দামি ফোন নিশ্চয়ই সুইচের কোন প্রবলেম হয়েছে।’

        মৃদুলা মায়ের পাশে বসেই ফোন করছিলো। ছেলে ফোন রাখার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন অনুপমা।

        মৃদুলা সান্তনা দিয়ে বলে, -‘মাগো তোমাকে যে শক্ত হতে হবে, আমাদের জন্য যে বাঁচতে হবে। তোমার অভি আসছে মা বিশাল বড় ডক্টর হয়ে। তোমার ছেলের সংসারে বাবার স্মৃতি নিয়ে, তোমাকে যে ভালো থাকতে হবে মা। অনেক কর্তব্য করেছো ছেলের বিয়ে দেওয়া হয়নি যে, মিনতি করি শরীরের প্রতি যত্ন নাও মা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো, আমাদের জন্য ভালো থেকো….

        শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে। সবাইকে মৃদুলা জানিয়েছে, তার দাদা সকাল এগারো টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। আত্মীয়-স্বজনরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, কারণ শ্রাদ্ধ অভিজিৎ দিতে পারবে। মুখাগ্নি করেছে মেয়ে মৃদুলা, ছেলের হাতে শ্রাদ্ধ নিয়ে মানসের আত্মা শান্তি পাক সকলেই চান।

        গ্রামের রাস্তায় প্রাইভেট কারে করে আসার সময় দূর থেকে দেখতে পায় অভিজিৎ বাড়ির সামনে ভীষণ ভিড়। ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে বলে। বাড়িতে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে মায়ের থান পরা বেশ দেখে অভিজিৎ। তারপর দেখে মানসের ফটোতে মালা। অভিজিৎ কি জিজ্ঞেস করবে বুঝে না ওঠার আগেই  তার চোখে চার দিকটা অন্ধকার মনে হয়। অনুপমা কান্নায় ভেঙে পড়েন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে, অভিজিৎ অজ্ঞান হয়ে যায়। সকলে সাবধানে কোলে তুলে বাড়ির মধ্যে নিয়ে এলে, মৃদুলা চোখে-মুখে জলের ছিটে দিতে থাকে।

লেখকের পরিচিতিঃ-

সাহিত্যিক ও কবি কলকাতা নিবাসী সুলতা পাত্র, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
error: Content is protected !!