সরযু কথা – চম্পাকলি চট্টোপাধ্যায়

ব্রাহ্ম মুহূর্ত। অন্ধকার অবসরে যেতেই শুরু আলোর  যাত্রা। কিরণমালার বিচ্ছুরণে জেগে ওঠে  জল স্থল বনাঞ্চল। মায়াময়  মৃদু আলোর  স্পর্শে পাখির ডানায় উড়ান। রঙমঞ্চ প্রস্তুত।  জলপাই গাছ ,চালতা গাছ, আলু খেত কুয়োতলা   তুলসীতলার  ঝাপসা কাটছে ধীর লয়ে।

ঝপাং শব্দ।  কুয়াশার সরে ভেজা কুয়োর জলে বালতি ডোবে। শীত বসন্ত গ্রীষ্ম বর্ষার ভোরে সে শব্দের অনুরণনে  আসপাশের লোক ঘুমের ঘোরে টের পায়  রাত ফুরিয়ে এল। সরযুদেবী ততক্ষণে কুয়োতলায়  স্নান সেরে শুদ্ধ কাপড়ে পুজোর আসনে। হাড় হিম মাঘের ঠান্ডাতেও এর অন্যথা হয় না। কপালের শ্বেতচন্দনের উজলি ছটা আর ভোরালো সরযুদেবীর মুখমন্ডলকে করে তোলে উজ্জ্বল। পুজোপাঠের সুরে বসু সংসার জেগে ওঠে।

আজ সেই  মুখ কেমন  থমথমে। কপালের  শুভ্র চন্দনটিকা বড়ো ম্লান। প্রতিদিনের উদ্বোধনের উদ্দীপ্তিতে কেউ যেন কালি ছিটিয়ে দিয়েছে।  অন্যমনস্কতায়  ভেঙে যাচ্ছে মগ্নতা বারবার।

কোনকালে বিধবা হয়ে সংসার সামলাতে সামলাতে আজ প্রায় জীবনের শেষ প্রান্তে। জীবনের মাটি খরা বন্যায়  হয়নি কম বিপর্যস্ত। পতিত জমিতে বেঁচে থাকার জন্য শ্রম করেছেন দিনরাত। নিয়মনিষ্ঠার কড়াশাসনে নিজেকে বেঁধে তিন ছেলেদের  কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। নিজের ছিল না অক্ষর জ্ঞান। চোখ এড়িয়ে কিন্তু  কেউ পড়ায় ফাঁকি দিতে পারেনি। তীক্ষ্ণ নজরে খবরদারির  সুফলে দুই  ছেলে আজ যোগ্য স্থানে চাকরি করছে। ছোট ছেলে দীপু নামী অফিসার।  যথেষ্ট নামডাক তার। ধনী বাড়ির মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে ভাবসাব তার একটু অন্যরকম হলেও সরযুদেবী তাতে বিশেষ  আমল দেন না। কাছে এলে মা মা করার মধ্যে কোন খামতি তো থাকেনা।  দীপু আসলে চট করে বদলে ফেলে  নিজেকে। বড় ছেলে তপুর মতো ও অভাবের নির্মমতা বোঝেনি। ছোট বলে বোঝেনি দুবেলা ভাতের জোগান কেমন করে কোথা থেকে আর  পড়ার খরচ আসছে কোথা থেকে। সাংসারিক গভীরতা কম ওর। ওর বদলে যাওয়ার দুর্বলতা সরযুদেবীকে ভাবায়। অন্যের মতে সহজেই পা গলিয়ে ফেলে। এটাই ওকে নিয়ে সরযুদেবীর ভয়। বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তানের জামাই দীপু। গুণের জোরে এমন জামাই তিনি গ্রহণ করেছেন সাদরে। নতুবা এমন অসম ঘরে তিনি সম্পর্ক করবেন কেন ? দীপুর পছন্দে অমত করেন নি ঠিক , কিন্তু মন থেকে মোছেনি কিন্তু ভাব।

***

 ওদিকের টান বেশি। ঝোঁক সেদিকে থাকাই স্বাভাবিক। সরযুদেবী এসবে মাথা গলান নি। ওরা ভাল থাকলেই ভাল। ওদের ভাল রাখার জন্য সংসার টেনেছেন  কত কষ্টে। নিজের সুখ তো কবেই ছারখার। তিন নাবালক ছেলে রেখে হেমকান্ত বসু যেদিন সরযুদেবীকে ত্যাগ দিয়ে দিক চক্রবাল রেখায় নিজের ছায়া মিলিয়ে দিলেন তখন সাদা থানের বিবর্ণতায় শুধু ছটি জলভরা চোখের জলছাপ। পোড়া  চোখে শুধু সংসারের শূন্যতা। খালি হাত শুষে নিয়েছে সব শোক। সহানুভূতির দৃঢ় চোখ খুঁজেছেন সন্তর্পনে। বয়স  কম কার আর্দ্র চোখের পেছনে কোন অনল জ্বলছে  ভয়ে সশঙ্ক সর্বদা।

 নাবালক বড় ছেলেকে চা কোম্পানিতে ঢুকিয়ে দিলেন হেমকান্তের বন্ধু নলিন ঘোষ। উনুনে নিয়মিত আগুন জ্বালার ব্যবস্থা হল। সামান্য টাকায় কী ভাবে চালিয়েছেন সেসব গল্পকথার মতো। তপুর স্কুলের ব্যাগে ধুলো জমতে লাগল। চোখে জল নিয়ে মধ্যে মধ্যে ধুলো ঝেড়ে বই গুলো নাড়াচাড়া করত তপু। লাকড়ির আগুনে  সেই দৃশ্য পুড়িয়ে ফেলতে আরো লাকড়ি গুজে  দিতেন উনুনে। মেজছেলে খেপু ঘাট আঘাটা ঘেঁটে কলমি ঢেকি শাক জড়ো

করতো রান্নাঘরের বারান্দায়। ভাতের সাথে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা। আমিষ উনুন তখন নিভন্ত।

তপু  উন্নতি করেছে চাকরিতে। প্রাইভেটে বিএ পাস করেছে। খেপু বাড়ির খেত নিয়ে আছে। তপু দীপুর পড়ার খরচ চালিয়েছে। দীপু জানে না এ লড়াই। ও তখন খুব ছোট। তপুর দান অনেক।

এখন ঘরে ঘরে বিজলি বাতি। বাড়ির পিছনের জমিতে মুনিষ খাটে। মরসুমে  খেত ভরে যায় মরসুমের  সবজিতে। বছরের আলু সংরক্ষণ করে বাকিটা বিক্রি করে লাভ হয় বৈকি। এসব ছেলেরা দেখা শোনা করে। সরযুদেবী এখন বেশিরভাগ সময় জপতপে দিন কাটান।

হবিষ্যি ঘরের রান্নার দিকে নজর তপুর। মায়ের রান্নার পদ বলে দেবে। মাকে সে মত রাঁধতে হবে,মায়ের রান্না খেতেই ভালবাসে যে। আমিষ ঘরে শুধু মাছটা রান্না করে তপুর বউ কমল। ভারি সুশ্রী সুচারু প্রকৃতির মেয়ে কমল। সরযুদেবীর ভাল লাগে ওকে। সংসারের শ্রী ফিরিয়ে এনেছে মেয়েটি। বারবার বলে মায়ের ঘাড়ে এত রান্না চাপাও  কেন?  মাতো এক তরকারি ভাত  খায়। অন্য পদ গুলো ধরে আমাদের  দিয়ে দেন। নিজে যা খাবেন তাও আবার দলা মেখে  সকলের জন্য ভাগে ভাগে রাখেন। কী দরকার দলা মাখা খাওয়ার। মায়ের খাওয়া ঠিক মতো হয় না অনুযোগ করলে তপু বলে জানো তো মা র দলা না খেলে পেট ভরে না। যা কিছু খাই না কেন ঐ দলা ঠান্ডা হলে ও অমৃত। বাড়ির ছোট সদস্যরা হয়েছে তেমন। দলা দলা করে পাগল। প্রতি দ্বাদশীতে সরযুদেবী ঠাকুরকে পোলাও ভোগ দেন।  আমিষ ঘর সেদিন বন্ধ।

***

জগবন্ধুর পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে  সংসারের কর্তব্য কর্মের মধ্যে থেকে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করা বড্ড কঠিন। সংসার যন্ত্রের খুটখাট,মন্ত্রের স্বরূপে ভ্রমের বুদবুদ তুলে ভক্তিকে  দুর্বল করে দেয়। গুরু ভাইবোন নিয়ে সংকীর্তন করেন তখন বাড়িতে। তপু খেপু ব্যবস্থা করে সব।  শুধু  অভিযোগ করে, মা এখন বয়স হচ্ছে। ভোর চারটের সময় কুয়োর জলে স্নানটা ছাড়ো মাঘের হিমঠান্ডায় অন্তত। অভ্যেস হয়ে গেছে। না করলে শরীর খারাপ লাগে। ঐ স্নান পুজো আর মাথার ওপর গুরুদেব  এই তো আমার শক্তি জোর   নয়তো তলিয়ে যেতাম তোদের নিয়ে।

তপু চুপ করে যায়। মহিলা জেদি শুনবেন  না। নিজে যা ঠিক করবেন তাই। তাই বা বলা যায় কী করে। সংস্কারকে তো তিনি বর্জন করতে পারেন। দীপুর অসম বিবাহ মেনেছেন হাসি মুখে। খেপুর খেপামি সহ্য করেন। ওর ছন্নছাড়া জীবনকে গতে চালাতে  চেষ্টা করেছেন কিন্তু জোর করে ওর মত অমান্য করে বিয়ে দিয়ে বাঁধতে চাননি। হাতের সব আঙুল সমান হয়না এটা যেমন জানেন আবার জানেন যে প্রত্যেক আঙুলের আছে  ভিন্ন কাজ।  তপুকে যেবার ডাক্তার বললেন ওর মুরগির ঝোল খাওয়া ভীষন জরুরী কমল খেপু তা শুনে  আতংকিত হয়ে উঠেছিল। সরযুদেবী ওদের চোখে দেখেছিলেন আশংকার গভীর কালো  ছায়া। সদ্য রোগমুক্তির পরও সকলের  বিমর্ষ মুখে একটাই প্রশ্ন  মুরগির ঝোল খাওয়ানো  কী সম্ভব হবে ? দোটানায় দুলতে দুলতে কমল ডাক্তারকে বলেছিল আচ্ছা। সেও তো অনেক বছর আগের কথা যখন মুরগির প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বসু ঘরে।  খেপু ঠিক করেছিল ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে আনবে। বৌদিকে বলেছিল চিন্তা করো না সব হয়ে যাবে ব্যবস্থা। আলাদা থাল করে দেবে দাদার। বারান্দায় থাকবে  হেঁসেলে না ঢুকলেই হল।

সরযুদেবী কোন মন্তব্য করেন নি খেপুর কথায়। ভক্তিতে মুক্তি তিনি জানেন। সংসারী মানুষের মুক্তির সাধনা কর্তব্য থেকে বিচ্যুত না  হওয়া।   গুরুদেব বারবার বলেছেন মন যা বলবে তাই করবে। সকলের ভাল হয় তাতেই। ভালমন্দের বিচার ক্ষমতা দেবে তোমার সাধনা। ছোঁয়াছুয়ির কঠোর অনুশাসনে নিজেকে বেঁধেছেন বলে সবাই মানবে কেন? প্রয়োজনে বিধিনিষেধের পর্দা সড়াতে হয়। আত্মবিশ্বাস আসল কথা ।

লড়াই করতে হলে কঠোর হতে হয়। মনের জোর বাড়াতে আর কর্তব্যে অবিচল থাকতে একনিষ্ঠ সংযম  উদ্যম রাখতে হবে।

তপুর পথ্যের মুরগির ঝোল রাঁধলেন স্বয়ং সরযুদেবী। কমলের বিস্ফারিত চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন প্রয়োজনে সব করতে হয় কমল। আষের গন্ধ যার অসহ্য তীব্র যার ছোঁয়াছুয়ি বাতিক তিনি রাঁধলেন চিকেন স্টু আমিষ রান্নাঘরে। সত্যি সেদিন বসু পরিবারে এসেছিল ওলট পালটের হাওয়া। তপু খেপু কমল ছেলেমেয়েরা অবিশ্বাস্য চোখে চেনা সরযুদেবীর অচেনা রূপে বাকস্তব্ধ। ওকে খেতে দাও কমল  আমি চানে গেলাম। আমার পাকশালায় তো আগুন জালতে হবে। হারানো জোর ফিরে পেয়েছিল তপু সেদিন মাংস খাওয়ার আগেই। দীপুর খবরটা কী ভাবে দেবে ভেবে অস্থির তপুকে  কমল বলে মাকে সোজা বলে দাও মা সায় দেবে দেখো। সায় হয়তো দেবে  মনে কী মানতে পারবে ? দীপু যে কী করে। আগে একটু জানালে কী হত। দেখি কথাটা আগে বলি তো।

***

শুনেছেন গত বিকেলে।

পুজোর আসনে অস্থির চাঞ্চল্যে চন্দন বাটতে  হাত থেমে যায় সরযুদেবীর। অদ্ভুত সমস্যায় দীপু তাকে ফেলেছে। দ্বন্দ্ব দেখেছেন জীবনে অনেক। সাধ্যমত  সামলেছেন। এই সমস্যার কী  নিদান দেবেন। মন্দিরার সুর কেটে নামগান ঝুলে যায়। ভেতরে ঘূরণিপাক  ভুলিয়ে দিচ্ছে সঠিক পথ।  প্রভু পথ দেখাও। প্রভু কী বলবেন জানেন   নিজেকে খুঁজে নিতে হবে পথ। দীপুর জন্য অহেতুক দুর্বলতাই বুঝি এমন বেতালা করছে। দূরে থাকে বলে রাশ আলগা। আলগা রশির ফাঁকে অন্যায় আবদারগুলো সহজেই বেরিয়ে পড়ে। মায়ের সাথে আগে কথা বলতে পারত। 

 দীপুর সংসারে ওর শ্বশুর শাশুড়ির প্রভাব বেশি  সরযুদেবী সেটা জানেন। নিজের ভিটে ছেড়ে  ওদের শহুরে জীবনে তিনি বেমানান হয়ে থাকতে চাননি। নিজের বিধিনিষেধ ঘর উঠোন তুলসীতলা পুজোর আসন ছেড়ে  থাকতে পারেন না তিনি। দোষ দীপুর একার  নয় সরযুদেবীর ও বটে। বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে দীপু আর বসুপরিবার। একবছর বাদে বাদে এলে দীপুকে কাছে পান।  ওর বউ সুসি কটা দিন মানিয়ে গুছিয়ে থাকার চেষ্টা ও করে। সুসি এলে কমল খুশিতে সকালে  সুসির জন্য আলাদা করে ময়দার রুটি করে দেয় আটা খেতে পারে না বলে। দুপুরে  সব্জি ডাল দুরকমের মাছ। রাতে সেই ময়দার রুটি বা পাউরুটি সেঁকা সঙ্গে  সব্জি মাংস।  ভাইরা ভাই ভাই  বউ এর জন্য এলাহি আয়োজন করত। কমল আন্তরিক হয়েই  বলতো  ওখানে তো করো কাজ , এখানে  আরাম করো। হাসি খুশি আনন্দে

পলকে কেটে যেত দিনগুলো।

সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনুমতি চাইছে যখন কিছু তো বলতেই হবে। পছন্দ অপছন্দ ওদের ব্যাপার। ওরা সরযুদেবীর মত মানবেন কী মানবেন না সেটা ওরা ঠিক করবে,মায়ের আদেশ বাধ্যতামূলক নয় এই বয়সে। দীপু  বলেছে বিকেলে ফোনে  মা তার মত বলে দেন যেন। সরযুদেবী জগবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন। মায়ের মান রাখল না। সরযুদেবীর চোখে জল। যে ছেলের মাথায় হাত রেখে  মানুষের মতো মানুষ হওয়ার প্রার্থনা করতেন সে মায়ের অভিমান বুঝলাম না। যতদূর পড়তে চেয়েছে তপু পড়িয়েছে। যেমন বিয়ে করতে চেয়েছে তেমন করেছে। কোথাও  কোন বাধা পায় নি। আজও বাধা দেবেন না।

***

সুরে তালে বাজছে মন্দিরা। কী হবে কী করবে সে নিয়ে সরযুদেবী ভাববেন কেন? কেন হবেন অস্থিরমতি। ছেলেরা তাদের নিজের গন্ডীতে। ওদের সংসারে  যা খুশি করুক ওরা। জড়াবেন কেন  ওদের সংসার রীতিতে নিজেকে। জয় জগবন্ধু সকলের মঙ্গল করো।

দীপুর ফোন এসেছে মা। জপের মালা জপের থলিতে রেখে ফোন ধরেন শান্ত ভাবে।  জানো তো মা আমার বড় শালার সদ্যোজাত ছেলেকে দত্তক নিচ্ছি। ভাল হবে  বলো মা। সুসি খুশি। তোমরা খুশি তো।

ঠিক করে যখন ফেলেছ আমার  মতামতের আর প্রয়োজন নেই। যাতে খুশি থাকবে তাই করবে।   ব্যক্তিগত ভাবে বলছি  তোমার  এই  বন্দোবস্তে আমার মত নেই। চারদিকে অনাথ বাচ্চার অভাব নেই। তুমি যদি তাদের কোন একজনের  নাথ হতে   খুশি হতাম বেশি। শালার ছেলের তো অন্যের পরিচয়ের  দরকার নেই। এটা তো  সম্পত্তি মালিকানা হস্তগতের  পদ্ধতি মাত্র। আমি জানব দীপুর ঘরে আমার কোন নাতি নাতনি নেই। ভাল থেকো। মায়ের গলা কেঁপে উঠল। তপু তাড়াতাড়ি ফোনটা মায়ের হাত থেকে নিয়ে আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে।

error: Content is protected !!