শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু মণীন্দ্রনাথ গুপ্ত – দেবব্রত সান্যাল

“ভাবি, কত কমে চালানো যায়, কত হালকাভাবে চলা যায়।
গা থেকে রঙিন পালক, বাড়তি পালক ঝেড়ে ফেলি
কেননা আমি যে-উঁচুতে যাব সেখানে এখনও কোনও পাখি ওড়েনি”
 
এই জীবন বেদ  নিয়েই “আধুনিকতার সঙ্গে তিনি  সময়ের স্রোতে” যোগ দিতে চান নি। “সমকালীনতা না, ধ্রুবতাও না।” ভেবেছেন  “ফুরফুরে চিরকালের নির্যাস— চির-জীবনবোধের তন্মাত্র, তার আভা।”
মণীন্দ্র গুপ্তকে তার পাঠকরা মনে রেখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে চলার জন্য। তিনি বলেছেন, ‘যদি আমার কবিতার প্রসঙ্গ ওঠে, আমি কি নিজেকে এইভাবে বোঝাতে পারব যে আমি ভাববাদী নই, বস্তুবাদী নই, হয়তো নাগাকুকিদের মতো সর্বপ্রাণবাদী। কোনও বস্তুকে ভাবতে গেলে আমার কল্পনা তার আদিরূপের দিকে, তার আদিম অবস্থার দিকে যায়।’ এই মানসিকতার খোঁজ করলাম তাঁর ভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তিন পর্বে ভাগ করে লেখা  জীবন আলেখ্য হয়েও ঠিক প্রচলিত ধারায় আত্মচরিত না হয়ে ওঠা  ‘অক্ষয় মালবেরি’র পাতায়। এই আখ্যান হঠাৎ করে শেষ হয়েছে বাইশ বছর বয়সে যখন সামরিক প্রশিক্ষণ ছেড়ে নিজেই বেছে নিয়েছেন বেকার জীবন। তাঁর বিচারে জীবনের প্রতি অজস্র ভালোবাসায় তাঁর মনে হয়েছিল ওই সময়টা পর্যন্তই তিনি ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
প্রাপ্তি আশার  চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তাঁর সেই অতুলনীয় ভাষা,মায়াময় বর্ণনা আর বরিশাল বা  আসামের মায়াময় মাতৃহীন শৈশব, বর্ণময় যৌবন। 
“আমার দাদুকে গভীর রাত্রির আকাশের তলায় বার করা হয়েছিল … কালো আকাশ তারায় ভরা। সোঁ সোঁ হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে যেন আকাশ পর্যন্ত একটা হাওয়ার পথ তৈরী হচ্ছে। বায়ু অনিলে মেশে। এই নখরযুক্ত আত্মাকে প্রবল বেগে টেনে নেওয়া হাওয়াই কি সেই অনিল? … (অক্ষয় মালবেরি )
 
কবি মণীন্দ্র গুপ্তের প্রতি পাঠকেরআকর্ষণ অমোঘ, জেনেও বলি গদ্যশিল্পী মণীন্দ্র গুপ্ত অপার্থিব। এরপর হাতে এলো চারটি উপন্যাস, ‘প্রেম’, ‘মৃত্যু কি নক্ষত্র’, ‘নুড়ি বাঁদর’, ‘আলতামসী’, ‘নেংটি’, সম্বলিত উপন্যাস সমগ্র।
অক্ষয় মালবেরি ছিল তাঁর না সুখী, না দুঃখী, ফেলা আসা একাকী জীবনের সংকলন। যেখানে প্রতিটা দুঃখের এবং বয়সের আলাদা আলাদা রূপ। আর জীবনের শেষপ্রান্তে অসম্ভব শারীরিক কষ্ট নিয়ে রোগশয্যায় লেখা তাঁর শেষ উপন্যাস নেংটি কি তাহলে অন্য একটা প্যারালাল জীবনের কথা? যে জীবনের শুরু ‘সেই বাঁশবনের এপারে, সন্ধ্যায়, বাংলাদেশে…’। যার সময়কাল ১৯২৪ সালের একুশে নভেম্বর যখন বুয়েনস এয়ার্সে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘বেণুবনছায়াঘন সন্ধ্যা’-র ছবি আঁকছেন কবিতায়। বাংলার গ্রামদেশে অজস্র শিশুরা হয়ত একলা চিত হয়ে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ছে, সেইরকমই কোথাও মণীন্দ্র গুপ্ত পাঠককে খুঁজে নিতে বলেন উপন্যাসের নাম চরিত্র নেংটি মোহনদাসকে।
 ’ইহজগৎও স্থির পরজগৎও স্থির, মাঝখানে শুধু আমিই কাঁপি’। ‘অক্ষয় মালবেরি’-র  স্রষ্টা ‘নেংটি’ উপন্যাসে একথাই বলে গেছেন।
 
আখ্যানের স্থান-কালে যদি প্রাক-মহাভারত থেকে একুশ শতককে একাকার করার সাহিত্যিক বাসনা থাকে, তবে সে-বিস্তার বোধ করি সহনশীল উদারতায় আশ্রয় খুঁজবেই । নুড়ি বাঁদরের সঙ্গে পর্বতাভিযাত্রিনী মানবী ফ্রেয়ার দেওয়া-নেওয়ার গল্পটি সেই ইঙ্গিতই দেয় । আখ্যানভাগ পরাবাস্তব, এবং গভীরভাবে প্রতিবিম্বিত .. এখানেই মনে হয় বাংলা সাহিত্য কী তার মার্কেজকে চিনতে পারেনি?
 … মদ মাংস মধু পুড়ছে, মিষ্টি গন্ধ অগুরু চন্দন পুড়ছে। দুর্গন্ধ পুড়ে পুড়ে গন্ধহীন হচ্ছে। পুড়ে সব হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ফুরোচ্ছে না। কোনোদিন ফুরোবে না।
এই অফুরন্তই ব্রহ্ম!… (নুড়ি বাঁদর)

তাঁর কথা লিখতে গিয়ে তাঁর লেখার অংশের যেটুকু আমার লাগসই মনে হচ্ছে সেটুকু তুলে ধরে মানুষটাকে চেনাতে গেলে বড়ো ভুল হবে। সে চেষ্টাও করছি না।
“টুকরো করে দেখা কামীর দেখা। সম্পূর্ণতায় দেখা রসিকের দেখা। আর পাঠক ও কবি সবাইকেই মনে রাখতে হবে: কবিতা কোনো টুকরো লাইন জোড়া দেবার খেলা নয়। প্রতিটি কবিতা আলাদাভাবে এক-একটি জৈব সম্পূর্ণতা।”
যে ভারহীন হয়ে চলার কথায় শুরু করেছিলাম, সেই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি,
“গ্রীকরা তো শেষ লড়াইয়ে যেতেন পুরো বিবস্ত্র হয়ে। তেমনি শেষ কবিতার বেলায় কোনো আভরণ, আড়াল থাকবে না। এতদিনের এত যে যুদ্ধ শেখা তা কেবল ঠিক লক্ষ্যে আঘাত করার জন্যে। হত্যার মতো মৌলিক, মৃত্যু পেরিয়ে আসার মতো সহাস্য— এ শুধু পাওয়া যাবে যদি শরীর দিয়ে শরীরকে আঘাত করি, অস্ত্রাঘাত করি এবং করতে দিই সোজা নিরাবরণ চামড়ায়…”

error: Content is protected !!