বিশ্ব নাগরিক অমিয় চক্রবর্তী – দেবব্রত সান্যাল

“বাহিরে তোমার যা পেয়েছি সেবা
অন্তরে তাহা রাখি,
কর্মে তাহার শেষ নাহি হয়
প্রেমে তাহা থাকে বাকি।
আমার আলোর ক্লান্তি ঘুচাতে
দীপে তেল ভরি দিলে।
তোমার হৃদয় আমার হৃদয়ে
সে আলোকে যায় মিলে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পথসঙ্গীটি তাঁর অসম বয়েসী সচিব ও বন্ধু কবি অমিয় চক্রবর্তী। পনেরো বছরের কিশোর অমিয়চন্দ্র শান্তিনিকেতনে পড়ার ইচ্ছে জানিয়ে নিজেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ তাতে সম্মতি দেন। যদিও সেই সময়ে আসা হয়নি, কিন্তু সম্ভাবনার বীজ তখন থেকেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। তিরিশের দশকে রবীন্দ্র সান্নিধ্যে থেকে, রবীন্দ্র আশীর্বাদ ধন্য হয়েও স্বভাবনায় ও রীতিতে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখা কবির নাম অমিয় চক্রবর্তী।
তিরিশের দশকের বাংলা কবিতা বলতে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তর একসঙ্গে উচ্চারিত নাম কবি অমিয় চক্রবর্তীর। গবেষকদের মতে সমকালীন কবিদের সাথে তাঁর পার্থক্য সুস্পষ্ট। “জীবনানন্দের মতো যন্ত্রণার গভীর ও জটিল চিহ্ন তাঁর কবিতায় নেই, নেই বুদ্ধদেব বসুর মতো সৌন্দর্য মুগ্ধ, আবেগ কম্পিত কাব্যোৎসার বা সুধীন্দ্রনাথের মতো হতাশাবোধ বা তার্কিক সুলভ রীতি। পৃথিবী , ঈশ্বর, মানুষের গহন চেতনার স্বরূপ, মৃত্যু ও বিজ্ঞান এই পাঁচটি মূল ধারায় তাঁর চিন্তা ও অনুভূতির স্রোত কবিতা হয়েছে।”
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল শ্রীরামপুরে মামাবাড়িতে অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছিল। তাঁর বাবা শ্রী দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করে আসামে গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। কবির মা অনিন্দিতা দেবী “বঙ্গনারী” ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতেন। মার প্রভাবে অন্য ভাইদের সাথে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যকে ভালোভাবে আয়ত্ব করেন কিশোর অমিয় চন্দ্র। এই সময় বড় ভাই অরুণের মৃত্যু তাঁর জীবনের অভিমুখ বদলে দেয়। চঞ্চল, খেলাধুলো ভালোবাসা ছেলেটি অন্তর্মুখী ও ভাবুক হয়ে যায়। কলকাতায় হেয়ার স্কুলে পড়তে এসে সাহিত্য ও সঙ্গীত অনুরাগী বড়মামা আর সেজমামার দ্বারা প্রভাবিত হন। এই সূত্রেই তিনি সবুজপত্র (বীরবল ছদ্মনামে যার সম্পাদনা করতেন শ্রী প্রমথ চৌধুরী) আর বিচিত্রার নিয়মিত সদস্য হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় বিচিত্রায়। আই এ এবং ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি এ পাশ করার পর তিনি বিশ্বভারতীর কাজে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি শান্তিনিকেতনে থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সচিব হিসেবে দায়িত্বটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
১৯২৭ সালে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তাঁর বিয়ে হলো ড্ডেনমার্রের কোপেনহেগেনবাসী হিয়োর্ডিস সিগার্ডের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ হিমের দেশের কন্যার নাম দিলেন হৈমন্তী। শান্তিজীবনে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া অমিয় চক্রবর্তীর জীবনকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে। তাঁর নিজের কথায়, “একান্ত উৎসাহে ভাস্বর সেই অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত আমার মানসিক অধিকারের বাইরে রয়ে গেছে। শালবীথির তপ্ত ছায়াবৃত মর্মর, ছাতিমতলার শুভ্র স্তব্ধ পাথর এবং উৎকীর্ণ মন, রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সাহস আশা-কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজও বুকে জেগে আছে কাশমাঠখোয়াইয়ের পাণ্ডুর উজ্জ্বল বলয়-চক্র, দারুণ গ্রীষ্মে উৎফুল্ল আমলকী-সারি এবং বহু দূরে পাড়-বসানো সবুজ তালতড়ি। আশ্রমেরই অভিন্ন অন্তর্গত রূপে সেই দৃষ্টি আমার কৈশোর জীবনে প্রসারিত।”
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী নিলেন ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ পর্যন্ত পড়াশুনো করেন এবং কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে গবেষণার জন্য ডি. ফিল. লাভ করেন ১৯৩৭ সালে।
শিবনারায়ণ রায় অমিয় চক্রবর্তীকে কবি ও মনীষী সহৃদয় বিশ্বনাগরিক বলে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন। আক্ষরিক অর্থেই কবি ছিলেন একজন বিশ্ব নাগরিক। রবীন্দ্রনাথের সহকারীরূপেও তিনি অনেক দেশে গিয়েছেন । প্রকৃতপক্ষে তিনি বিশ্ব-পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বেশী ভ্রমণ করেছেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি, ডেনমার্ক, রাশিয়া এবং আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হিসেবে। পরে আরো দু’বার রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারস্য ও মধ্য-প্রাচ্য ভ্রমণ করেছেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে।
বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী প্রশান্ত এবং আটলাণ্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, পর্ব ও পশ্চিম এশিয়া, দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং জাপান ও কোরিয়া সহ পৃথিবীর নানা দেশ-মহাদেশ বহুবার পরিভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, স্মিথ কলেজ, ন্যুইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ভারতের কলকাতা ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং রবার্ট ওপেন্‌হাইমারের আমন্ত্রণে ১৯৫১-তে প্রিন্স্‌টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্‌ষ্টিট্যুট অব অ্যাডভান্স্‌ড স্টাডিসের ফেলো হিসেবে ভ্রমণ করেছেন। সেবছরে গ্রীষ্মে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন প্রোটেস্টাণ্ট চার্চ সম্মেলনে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। এই সময় পশ্চিম ও পূর্ব জর্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ধর্ম এবং প্রাচ্য সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। একাধিকবার অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েছেন শিবনারায়ণ রায়ের আমন্ত্রণে।

অমিয় চক্রবর্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘খসড়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে আর পরের বছর ‘একমুঠো’। খসড়া কাব্যের স্বকীয় স্বাতন্ত্র রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়েছিল আর একমুঠোকে তিনি ‘নবযুগের কাব্য’ বলে বরণ করেন।

“বাসনা-কলেতে মন ভাঙা ‘পরে
হাবুডুবু খায় বুদ্ধি -ভরে। কারখানা সব কার? প্রশ্ন হাওয়ায় উড়ে যায়।” (সমুদ্র – খসড়া)

ওই সময় কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেন যে, “খসড়া প্রকাশের পর অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিৎ নয়।”

“ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র , ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।”
(বৃষ্টি- একমুঠো)

সমালোচকরা শুরুতে তাঁকে রবীন্দ্র অনুসারী বললেও বিদেশ থেকে ফেরার পর অমিয় চক্রবর্তী আধুনিক বাংলা কবিদের পুরোধা হয়ে উঠলেন। একটু নিবিড় ভাবে দেখলে অনুভব করা যায়, রবীন্দ্র ভাবনা ও তাঁর নিজস্ব ভাবনার মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে আন্তর্জাতিক সংকটবোধ তীব্রতর ও যন্ত্রনাময় ।কিন্তু অমিয় চক্রবর্তীর মনোভাব আন্তর্জাতিক প্রীতিবোধে স্থিত। রবীন্দ্রনাথ নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকে দেখেছেন, অমিয় চক্রবর্তী নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বিশ্বাস গড়ে নিয়েছেন।
১৯৪২ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কয়েকমাস পরে প্রকাশিত হয় ‘মাটির দেয়াল’। কবির নিজের কথায়, “ মাটি, ধরণী, বসুন্ধরা যে নামেই হোক ভূমিস্পর্শ অভিযানই আমার স্বপ্রকাশ, তার অন্য ভাষা নেই, ভাষ্য নেই। সংসারে একটি মৃন্ময়ী বাসা বেঁধেছিলাম সেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।”
তার প্রকাশ ‘বড়বাবুর কাছে নিবেদন’ কবিতায়।
“তালিকা প্রস্তুত :
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না—
হইনা নির্বাসিত কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।
যার একখণ্ড এই ক্ষুদ্র চাকুরের আমিত্ব।
যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।
কুয়োর ঠাণ্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।”

১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ পড়ে বুদ্ধদেব বসু কবিকে বাংলা দেশের সমকালীন পর্যায়ের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক কবি আখ্যা দিয়েছিলেন। সূর্যখন্ডিত ছায়া পর্যায়ের ‘সংহতি’ কবিতা কবির দুর্জয় আশার সঙ্গীত।

“দেবতা তবুও ধরেছে মলিন ঝাঁটা,
স্পর্শ বাঁচায়ে পুণ্যের পথে হাঁটা,
সমাজধর্মে আছি বর্মেতে আঁটা,
ঝোড়ো হাওয়া আর ঐ পোড়ো দরজাটা
মেলাবেন তিনি, মেলাবেন॥”

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় এক আশ্চর্য বৈদেহিকতা ব্যাপ্ত হয়ে আছে, রক্তমাংসের আক্রমণ সেখানে সবচেয়ে কম ।

অমিয় চক্রবর্তী তিরিশের অন্যান্য কবিদের তুলনায় ভিন্নরূপ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন। শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন: “অমিয়-র কোনো নিজস্ব পত্রিকা অথবা গোষ্ঠী ছিল না। ক্ষীণকায় মৃদুভাষী মানুষটির কিছু গভীর প্রত্যয় ছিল, কিন্তু বিতর্কে তিনি অনাগ্রহী অথবা আস্থাহীন। অপরপক্ষে জীবনানন্দের মতো তিনি সঙ্গ-বিমুখ ছিলেন;- বস্তুত নরনারী, পশুপাখি, শহরগ্রাম, বিশ্বের বিচিত্র অধিবাসী এবং বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম প্রাকৃতিক রূপ সম্পর্কে তাঁর কৌতহল ছিল অপরিসীম। সঙ্গ ভালোবাসতেন, কিন্তু সব সময়েই মনে হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র এক গভীর নিরাসক্তি তাঁকে সচল রাখত। প্যাশন বা আবেগের আতিশয্যকে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন।”

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার গীতিপ্রবনতায় রোম্যান্টিক গীতিময়তার সন্ধান মেলে। কিন্তু কবিতার দৃঢ় গাঁথুনি, ছন্দনিরীক্ষা, শব্দনির্মাণের অভিনবত্বেও তা আধুনিক। তাছাড়াও রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা, অভিজ্ঞতা স্নাত অভিনবত্ব। বাসন্তীকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে : ‘অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার প্রধান গুণ তার হার্দ্যগুণ। তিনি যেন সকলের আত্মার আত্মীয়।’

‘পারাপার’ (১৯৫৩ সালে প্রকাশিত) কাব্যের ‘বৈদান্তিক’ কবিতায় উপনিষদিক ব্রহ্মরহস্যের পরিচয় মিললেও তা কোনোভাবেই কাব্যের মূলসুর হয়ে ওঠেনি। কেবল প্রকরণের স্বার্থেই তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পুরাণের ব্যবহার করেছেন কবিতায়।
“প্রকান্ড বন প্রকান্ড গাছ,-
বেরিয়ে এলেই নেই।
ভিতরে কত লক্ষ কথা, পাতায় পাতায়, শাখা শাখায় সবুজ অন্ধকার;
জোনাকি কীট, পাখি পালক , পেঁচার চোখ, বটের ঝুরি,
ভিতরে কত আরো গভীরে জন্তু চলে, হলদে পথ, তীব্র ঝরে জোৎস্না -হিম বুক-চিরিয়ে,
কী প্রকান্ড মেঘের ঝড় বৃষ্টি সেই আরণ্যক”

কেননা, ঈশ্বর সম্পর্কিত আরেকটি কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন :
“ঈশ্বর মুখে নিয়ে দামি সিগারেট
বসে বসে দেখছেন স্বর্গে।
নতুন জুতো-পরা পা দুটো রেলিঙে
উঠিয়ে, আরাম করে, ভালো খেয়ে দেয়ে,
মাটির পৃথিবীটাকে কৌতুকে করুণায়
ঈশ্বর দেখছেন স্বর্গ থেকে।”

প্রচলিত ধর্মবোধের বাইরে এসে মানবতাবাদী ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস রেখেছেন অমিয় চক্রকর্তী। বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় কাল্পনিক নয়, বরং মানবতাবাদী ঈশ্বরই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে :

“দুঃখ সুখে শোকে ক্ষুধায় অভাবে আজ
আরো বেশি কাছে জানি সবারই জীবনে তাঁকে,
বাঁচবার অধিকারে প্রাণে প্রাণে এই তিনি
মানুষের ঈশ্বর, মানুষের ঈশ্বর।”

তাঁর প্রেমচেতনাও কেবল হার্দিক সংঘটন নয়, বরং তার পারিপার্শ্বের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে তা প্রকটিত। যেমন :

“অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না
দেখি তুমি নেই।”( রাত্রি)

এই প্রেমচেতনার সাথে সম্পৃক্ত মনোজাগতিক নানা রহস্যময় অভিজ্ঞান। ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের নিরঙ্কুশ প্রয়োগ অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায় দুর্নিরীক্ষ নয়। মনোজগতের নানা পর্বের উন্মোচনে কবি ফ্রয়েড-ইয়ুং প্রভৃতি মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হয়েছেন। যেমন :
“ডুবন্ত মনের ছবির পরে ছবি
মৃন্ময়ী বাড়ি গোলক চাঁপা গোড়া-বাধানো
হারানো
পাঠায়
আমার মেঘের কোঠায়
ওঠে জ’মে
নীল আদ্যন্ত হাওয়া
তরী নাক্ষত্রিক
চেতনা
ছোটে কোন এরোড্রামে।”

তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ ঋদ্ধি তাঁকে জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে বলে :
“আসো যদি তবে শাবল হাতুড়ি
আনো ভাঙার যন্ত্র,
নতুন চাষের মন্ত্র।
গ্রামে যাও, গ্রামে যাও,
এক লাখ হয়ে মাঠে নদী ধারে
অন্ন বাঁচাও, পরে সারে সারে
চাবে না অন্ন, আনবে অন্ন ভেঙে এ-দৈত্যপুরী,
তোমরা অন্নদাতা।
জয় করো এই শান-বাঁধা কলকাতা।”

বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার ভিতরও তিনি ‘শান্তির ললিত বাণী’ প্রত্যাশা করেন। তাই তো যুদ্ধবিধ্বস্ত জানালায় তিনি সুখী মেয়েটির মুখ অঙ্কিত করেছেন :
“বোমা-ভাঙ্গা অবসান। শহরে বিদিক সোজা পথে
পদাশব্দ। শূন্য পাশের গলির জগতে
চূর্ণ চূর্ণ বেলা। তারি মধ্যে ম্লান হাসিমুখ
মেয়ে জানলার কাঁচে একান্ত উৎসুক
চুল আঁচড়ায় যত্ন করে; ইটস্তূপে ছেলে শুয়ে
প্রাণ পুনর্বার চলে অগণ্য মৃত্যুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে।”


সংগতির কবি বলে খ্যাত কবি তাঁর জীবনের শেষ দিকে এসে উপলব্ধি করেছেন, “ব্যক্তিরূপী ঐশিক শক্তি সম্পর্কে আমার ধারণার ক্রমশঃ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। আজ আমি মনে করি কোনো চরম ব্যক্তির সাধ্য নেই সব কিছুকে মেলাবার । জগৎ সংসার অসীম রহস্যময় নিয়মে চলে। এখন আমি শুধু সেই রহস্য উদ্ঘাটক অনুশীলন সাধ্য জ্ঞানবিজ্ঞানের যাথার্থ্যে বিশ্বাস রাখি।”
বাংলাভাষায় তাঁর পনেরোটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।ইংরেজিতেও ন’টি বই লিখেছেন। ভূষিত হয়েছেন, ইউনেস্কো পুরষ্কার, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার, দেশিকোত্তম আর পদ্মভূষণ সম্মানে। শেষ বয়েসে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৮৬ সালের ১২ জুন শান্তিনিকেতনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ত্রিশের কবিতার প্রাণবীজ ধারণ করে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা হয়ে উঠেছে সমকালীন জীবনভাষ্যের অনন্য দলিল। যে দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী বাংলা কবিতায় নান্দনিক সৌধ, অমিয় চক্রবর্তীর নাম সেখানে চিরস্থায়ীভাবে খোদিত থাকবে।
( ঋণ: শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতা সংগ্রহ-২, কবি অমিয় চক্রবর্তী – শ্রীমতি সুমিতা চক্রবর্তী, অমিয় চক্রবর্তী কাব্যভাবনা ও রূপকল্প এবং অনান্য প্রবন্ধ)

Our Visitor

0 1 5 4 7 0
Users Today : 2
Users Yesterday : 11
Users Last 7 days : 117
Users Last 30 days : 427
Users This Month : 227
Users This Year : 4926
Total Users : 15470
Views Today : 4
Views Yesterday : 19
Views Last 7 days : 176
Views Last 30 days : 643
Views This Month : 337
Views This Year : 7426
Total views : 24011
Who's Online : 0
Your IP Address : 18.97.9.175
Server Time : 2024-12-14
error: Content is protected !!