জোয়ান ঘোড়া ‘মণীশ ঘটক’ – দেবব্রত সান্যাল

মণীশ ঘটক মানেই কল্লোল যুগের প্রথম সারির মুখ। ‘বলতে গেলে মণীশই কল্লোলের প্রথম মশালচী’  অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের কল্লোল যুগ বইটিতে উল্লেখিত মনীশ ঘটক কিন্তু যুবনাশ্ব। ব্রাত্যজনের কাহিনি তুলে এনেছিলেন তাঁর পটলডাঙার পাঁচালীতে। মান্ধাতার বাবার আমল থেকে যা চলে আসছে তা লিখে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। আমাদের আলোচনার কবি মনীশ ঘটক একটু পৃথক।

মণীশ ঘটক জন্মেছিলেন ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০২ সালে, রাজশাহী জেলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা সুরেশচন্দ্র ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।  পরিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুকূল পরিমণ্ডলে আরো আট ভাই বোনের সাথে বড়ো হয়ে , প্রায় সকলেই সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছিলেন।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পংতি তুলে বলি,

“এমন মানুষ পাওয়া শক্ত লেখার রাজ্য ঢুঁড়ে,

এই নিচ্ছেন কলম আর এই ফেলছেন ছুঁড়ে।” 

অনিয়ম আর বেহিসাব মিলে যা হয় তিনি হলেন মনীশ ঘটক। আমৃত্যু বর্তিকার সম্পাদক ছিলেন , কিন্তু শেষে তিনমাস অন্তর একটি কবিতা আর দু তিন পাতা সম্পাদকীয় লিখে উঠতে ক্লেশ হতো।

গঙ্গার মর্ত অবতরণের বেগ যেমন মহাদেব ধারণ করেছিলেন তেমনি দুর্ধষ্য উদ্দাম মনীশের ছিল এক আন্দোলন, যার নাম কল্লোল। ১৯৩০-৩১ সালে পটল ডাঙ্গার পাঁচালির যুবনাশ্ব কবিতার জগতে এলেন স্বনামে। প্রথম দিকে লিখলেন প্রেমের কবিতা।

“প্রেম এলো বন্যাসম দুকূল প্লাবিয়া

সুগভীর সমারোহে।”

 গতানুগিতক নয়, তীব্র ঋজু অনুভূতি ও আবেশ মিশে রইলো সেই কবিতায়।

“আর কেহ বুঝিবে না তোমাতে আমাতে

এ বোঝাপড়ার পালা সাঙ্গ করে যাবো আজ রাতে

অন্তরঙ্গ আলাপনে।”

গদ্য লেখায় অনিয়মিত হলেও নতুন রূপে কবি মনীশ ঘটক ফিরে এলেন ১৯৩৭ এ।  প্রগতি (অজিত দত্ত সম্পাদিত), কবিতা (বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত), পরিচয় (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত) পত্রিকা গুলোর পাশাপাশি ভারতবর্ষ, নাচঘর, বিষাণ, উত্তরসূরি, বিশ্বভারতী, বসুমতীতেও লিখেছেন সমান তালে।

তাঁর বিখ্যাত কবিতা কুড়ানি তাঁর গল্পকার আর কবি সত্বার এক যুগল বন্দি।

    তর্জিলা আক্রোশে

অষ্টমবর্ষীয়া গৌরী ঘাড় বাঁকাইয়া,

“খট্টাইশ, বান্দর, তরে করুম না বিয়া।”

সক্ষোভে কহিলাম

যা গিয়া! একাই খামু জাম, সব্রি-আম।”

গলিতাশ্রু হাস্যমুখী কহে হাত ধরি,

তরে বুঝি কই নাই? আমিও বান্দরী!”

………………………………….

হঠাৎ শুনিনু হাসি। তীক্ষ্ণ  সকৌতুকে

কে কহিছে—”মা তোমার বুদ্ধি তো জবর!

নিজের বৌয়ের লাইগা কে বিসরায় বর?”

সহসা থামিয়া গেল সৌর আবর্তন,

সহসা সহস্র পক্ষী তুলিল গুঞ্জন!

সহসা দক্ষিণা বায়ু শাখা দুলাইয়া

সব কটি চাঁপাফুল দিল ফুটাইয়া।”

মনীশ ঘটক সমাজ সচেতন, চারপাশের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, ব্যঙ্গের শানানো তীরে লড়ছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

“লাফ দেবার প্রাক্কালে হিংস্র চিতার মতো

পতনোন্মুখ না পড়া বাজের মতো কী দেখতে পাচ্ছো

হে প্রবঞ্চক, ও হে আত্মপ্রবঞ্চক কীসব দেখতে পাচ্ছো?”

মনীশ ঘটক পৌরুষের কবি। তাঁর কবিতা তেজের কবিতা। কবি সম্পাদক সজনীকান্ত দাস যিনি প্রাথমিকভাবে তাঁকে  ‘মূর্তিমান বিদ্রোহ’ মনে করলেও লিখেছেন,’মণীশ শক্ত জোরালো মানুষ, ঢাকঢাক গুড়গুড়ের দলে নয়।’

অধ্যাপক, লেখক, গবেষক এবং লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ সুধীর চক্রবর্তী মণীশ ঘটকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন । তাঁর মতে,’এত স্পষ্টভাষী, ঋজু শরীরের নির্মেদ মানুষ আর স্বভাবকোমল ব্যক্তিত্ব আর তো দেখলাম না।’

কবির ভাষায়,” বিস্ময়ের হৃদ্য় শাব্দিক অনুবাদই কবিতা, কখনো প্রেমে বিস্ময়, কখনো দুঃখে বিস্ময়, কখনো শোভাতে বিস্ময়, কখনো অসুন্দর বিস্ময়।  আজীবনের বাসভূমি এই পৃথিবী কখনো প্রাচীন হয় না। বহু পরিচয়ের ফলে মানুষ কখনো কবির চোখে তার অস্তিত্বের মোহ হারায় না।”

তাই সেই বিস্মিত কবি অনুভব করেছেন, “আমার মনে হয়েছিল মানুষ বলেই আমার কবিতা না লিখে উপায় নেই। কবিতা আমার মনুষ্যত্বের পূর্ণতার একটি সোপান।”

আশি বছরের দীর্ঘজীবনে নেরুদার কবিতার  অনুবাদ  ছাড়া পাঁচটি কবিতার বই লিখেছেন শিলালিপি, যদিও সন্ধ্যা, বিদুষী বাক, একচক্রা (শেষ কাব্য সঙ্কলন)। যে গদ্য রচনা তাঁকে বিখ্যাত করেছিল সেখানেও তিনটি বই। কনখল (উপন্যাস )

পটলডাঙ্গার পাঁচালী (গল্প), মান্ধাতার বাবার আমল (আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ)।

কম লেখার যন্ত্রণা ফুটেছে তাঁর কবিতায়,

“হায় আফশোষ

ফুটন্ত খৈয়ের মতো লেখা যখন ফুটছিল

গরম বালুর তপ্ত মাটির খোলায়

উড়ন্ত ফুলের মতো মাছ লাফিয়ে উঠেছিল

তন্ পড়া বেড়াজালের দ্রুত দোলায়

বেহিসাবি ওরে লেখক খেয়াল তখন করিসনি

খৈ জমিয়ে মাছ কুড়িয়ে কোঁচড় ভরিসনি

ভিজে খোলায় খৈ ফোটে না

মাছ ওঠে না ছেঁড়া জালে 

কোনও পুরস্কার পাননি।  মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন, “পেশাদারী সাহিত্য জগৎ যে নির্মম ঔদাসীন্যে বাবার সাহিত্য কীর্তিকে উপেক্ষা করে চলতো প্রতি পূজায় পুরস্কার ও পদক বিতরণে, সেজন্য আর আমার বুকের স্নায়ু বেদনায় ছিঁড়ে যাবে না।”

শেষ দিকে না লিখতে পারার যন্ত্রনায় ভগ্নস্বাস্থ্য কবি ব্যাধিকবলিত হয়ে  তাঁর কবিতা ভাষাতেই ‘মহীরূহ হয়েছে অঙ্গার। তবু ‘বর্তিকার শেষ শারদ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে  জানিয়েছিলেন, ‘আমার শেষ প্রার্থনা এই যে যাঁর লিখবার কিছু ক্ষমতা আছে তিনি অন্তত দিনে তিন ঘণ্টা আপনমনে লিখে যাবেন, রাতারাতি বড়োলোক হবার আশা ত্যাগ করে।’

Our Visitor

0 1 0 3 0 5
Users Today : 7
Users Yesterday : 7
Users Last 7 days : 102
Users Last 30 days : 367
Users This Month : 124
Users This Year : 4198
Total Users : 10305
Views Today : 8
Views Yesterday : 9
Views Last 7 days : 142
Views Last 30 days : 710
Views This Month : 174
Views This Year : 6543
Total views : 16186
Who's Online : 0
Your IP Address : 51.222.253.6
Server Time : 2023-12-10
error: Content is protected !!
%d