dock under cloudy sky in front of mountain

এই শহরের ইঁট কাঠ পাথরের দমবন্ধ আবহে যখন হাঁফিয়ে উঠতাম ছুটে চলে যেতাম ঝিমলি (আমার বোন) এর বাড়ি কল্যাণী। বাড়ি তো নয়, বিশাল বাগানের মাঝখানে ছোট্ট একটা শান্তির নীড়। বোনের ছেলে সবুজের ছিল ছোট থেকেই  অদ্ভুত রকমের গাছ ফুল বাহারি হাজারো অরর্কিড এর নেশা। পড়াশোনাতেও  তুখোর। খেলা ধূলোতেও মন্দ নয়,  নিয়ম করে সামনের মাঠে রীতিমত ঘাম ঝড়িয়ে আসত।

আমারো ফুল ফুটানোর নেশা ছোট থেকেই। থলি ভরে গোবর সার মামারা বাড়ি থেকে বাবার সাথে বয়ে নিয়ে আসতাম। সবুজকে সে গল্প শোনাতে অবাক হয়ে শুনতো। 

অনিন্দ্য  তো মাটি সারের কোন অসুবিধার রাখে নি। সবুজকে সাহায্য করার জন্য    সবুজের বিস্তর আপত্তি সত্ত্বেও একটা মালি রেখে দিয়েছে। যদিও সে সপ্তাহে একদিন আসে আর সবুজ কে বেদম ভয় পায়।

বেশ কেটে যাচ্ছিল আমাদের আনন্দে খুশিতে দিনগুলো। কোথা থেকে পৃথিবীকে ঘিরে ধরল করোনার করাল থাবা। গৃহবন্দী হলাম সবাই। স্কুল, কলেজ সব অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হল। কী দমবন্ধ সময়ের ভিতর দিয়ে দিন কাটাতে শুরু করলাম। লক ডাউন, মৃত্যুর  সাইরেন…

এভাবেই চলছে। সব বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত। সেদিন সকালে ব্যালকনিতে বসে চা খাচ্ছি হঠাৎই মুঠোফোন বেজে উঠল-

– দিদিভাই  একবার অ্যাক্রaপলিস মলের কাছে ভাঃ সুমনের চেম্বারে আসতে পারবি? বিকেল পাঁচটা নাগাদ! 

আৎকে উঠলাম –

– কেন রে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে কেন? কার কি হল?

– আসতে পারবি কিনা বল! দেখা হলে সব বুঝে যাবি।

আমি যথাসময় পৌছে একি দেখলাম? সবুজের চোখ মুখ একেবারেই অন্য রকম। চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা ভাবলেশহীণ  অভিব্যক্তি।  এ আমি কোন সবুজ কে দেখছি। আমাকে দেখেই কোন অভিব্যক্তি নেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ওর বয়সে কোভিড বিশেষ শুনিনি কিন্তু  ও করোনাক্রান্ত।  তারপর বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছিল ঝিমলি কে। সব সামলে নিয়েছিল।

 বেশ কিছুদিন ধরে বাগান করা খেলা পড়াশনা সব বন্ধ করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে লক্ষ্য করছিল ঝিমলি। এক জায়গায় স্থির হয়ে বেশিক্ষণ বসছে না। অস্থির অস্থির ভাব। সিবিএসসির বারোক্লাসের ছাত্র। খুব তুখোর বুদ্ধি। অনেক উচ্চাশাও ছিল। এখন খালি এক কথা বলে চলেছে -সব  শেষ হয়ে গেল। আমি এখন কী করব মা? বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়াটা ওকে বিধ্বস্ত করে দিল। খায় না, ঘুম ও নেই, খেলা ছেড়েছে, প্রাণের দোসর বাগান ও প্রাণহীণ।  খালি এক কথা – সব শেষ হয়ে গেল।

আবার নতুন উপসর্গ ‘যশ’ এর জন্য  বড় বড় বৃক্ষ কেটে দেওয়া ওকে আরো উন্মাদ করে দিল। ওর চোখ মুখ  ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে। অমন সুন্দর মনভোলানো রঙীন বাগান সব রং হারালো প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায়। কোভিড,লকডাউন,প্যানডোমিক আবহাওয়া, যশ, সর্বোপরি ক্রমশ পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ পরিণতি আমাদের সবুজ, যাকে আজ মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসতে বাধ্য করল। সব দেখে ডাক্তার ও মর্মাহত, বাকরুদ্ধ।  তিনি যা বললেন তাতে হাড় হিম হয়ে যাবার উপক্রম।  

– ক্রমশ ও কিন্তু  ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ছে।   আরো মারাত্মক কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। ইন্টেলিজেন্ট বয় তো। ওদের চিন্তা ধারা অনেক অ্যাডভান্স। টিভি একদম দেখতে দেবেন না। 

বললে হবে দিনরাত হিসেব করছে কতজন গেল পরিস্থিতির কি উন্নতি হল,কতটা মৃতের হার কমল, কতটা বাড়ল।

ঝিমলি বলে উঠল – সত্যিই ও ওই কোভিডের মিছিল দেখে ছটফট করে। তার ওপরে অ্যাম্বুল্যান্সের ওই শব্দ শুনে চিৎকার করে বলে ওঠে – ওদের থামাও থামাও। আমি নিতে পারছি না। আমিও একদিন তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। 

বিশ্বের পরিবেশে বিষ ঢুকেছে। মারণ বিষ। ও তোমরা বুঝবে না। পৃথিবীর এই অসুখ সারতে এখনো তিন চার বছর লেগে যাবে। ততদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে না।সব শেষ। আর আমাদের বাসযোগ্য  নয় এই সুন্দর পৃথিবী। দেখ না আমি আর বাগানকে ভালবাসি না। সব মিথ্যে,প্রহসন। বিজ্ঞান বলছে বিশ্ব  প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের জীবন ধারনের আমূল তারতম্য। এই মারক রোগের এটাই অন্যতম কারণ।  

ঝিমলি বাগান টা নতুন করে সাজাতে বললে সে কি বিকৃতি, দাঁতের খিঁচড়ে ওঠে- কি হবে ? আমি তো শেষ। এই দূষিত পরিবেশ আমাকে বাঁচতে দিল না মা। পাগল বানিয়ে দিল। আমার  কিছুই হল না।

ডাক্তার সুমন বললেন  একটা কাজ করুন- ওকে বাড়িতে রাখা যাবে না, সম্ভব ও নয়। খুব ই বিপজ্জনক ও সমস্যাবহুল।  যদি পারেন কোন ভাল অ্যাসাইলামে দিন। আমার জানা আদিসপ্তগ্রামে একটা ভাল যত্নশীল অ্যাসাইলাম আছে। যদি বলেন আমি যোগাযোগ করে দিতে পারি। এ ক্রমশ আরো ভায়োলেন্ট হয় পড়বে। তখন সামলাতে পারবেন না। ওর বয়সি চল্লিশ ভাগ ছেলে মেয়ে আজ পরিবেশ জনিত মানসিক রোগের শিকার।  বিশেষত  এই বয়ঃসন্ধির সন্তান রা। মা বাবা দিশেহারা। এদের ভবিষ্যতটা পুরো ঘন কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার।

কোথাও  কোন আলোর ইশারা নেই। যার ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা ও বাড়ছে। এরা বড় অসহায়। স্বপ্নগুলো কাঁচের পাত্রের মত ঝনঝন করে চুরমার হয়ে যায়। 

ঝিমলি অনিন্দ্য কে জড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আমি ঝিমলিকে ছাড়িয় শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে গেলাম। সবুজ  নিজের মধ্যেই মগ্ন। অনিন্দ্য নিজেকে সামলে ডাক্তারের পরামর্শ মত পথেই পা বাড়াল। সবুজের কোন তাপ উত্তাপ নেই। অনিন্দ্য  ওকে  আদিসপ্তগ্রামের ‘মাতৃ মন্দিরে এ নিয়ে চলল। সঙ্গে আমি নীরব, নির্বাক সাথী। পিছিয়ে পড়ল কত কত প্রতিভা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার অভাবে।

সবুজ  ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকল পর্যাপ্ত  অক্সিজেনের অভাবে।

Leave a Reply

error: Content is protected !!