নতুনের খোঁজে – চম্পাকলী চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ও তাসের দেশ কিভাবে নিয়ম পরিবর্তন করতে চেয়েছিল, এই ফিচারে রয়েছে তারই গন্ধ।
‘জন্মমুহূর্তের সৌভাগ্য নিয়ে যে জন্মেছে তার ভয় কী?’ সওদাগর পুত্র জিজ্ঞেস করেছিল রাজপুত্রকে।
‘অদৃষ্টের ভিক্ষাদানের ছাপ মুছে, নিজের শক্তিতে জয় করতে হয় নতুন দেশ।’
নিরাপদ নিশ্চিত একমুখী যাপনের নির্দিষ্ট সীমায় বন্দীমন বিদ্রোহ করে নতুন দেশ দেখার নেশায়। অকূল সাগরে তরী ভাসিয়ে রাজপুত্র চলে চেনা জগতের পরিধি ছেড়ে নতুন দেশ দেখতে বা নবীনার খোঁজে। নতুন বা নবীনা মনের এক ভাবনা যা রাজপুত্রকে কিছু হারিয়ে কিছু পাওয়ার সন্ধানে দ্বন্দ্ব বহুল জটিল সত্তার ঘূর্ণিতে দোলায়।
নবীনার প্রতীকার্থে বলা যায় বন্দী মনের মুক্তির স্বাধীনতা,বদলে যাওয়া। ‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্যে রাজপুত্র মুক্তির দূত, সত্তার বহুত্বের অভিমুখ, বৈচিত্র্যপূর্ণ মানসিক জটিলতার দ্বান্দিক বিকাশ।
অন্যান্য নৃত্যনাট্যের কাহিনির আলোচনার তুলনায় তাসের দেশ একটু পিছিয়ে। কেন? মন ভোলানো আপাত দৃষ্টিতে রূপকথার গল্প বলে? অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা ঘটে এই তাসের দেশে। হাসি মজার আড়ালে চূড়ান্ত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কথায় গানে পরিস্ফুট। জাতিসত্তা যে চরম বা পরম হতে পারে না ব্যক্তিক সত্তা ও যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা সুস্থ সমাজের বিশেষ লক্ষণ। ব্যক্তিক পরিচয়কে অস্বীকার করে উগ্র জাতিসত্তাকে প্রশ্রয় দেয় ফ্যাসিবাদ। পুতুল দেশ তাই তাসের দেশ।
‘সাধনা’ পত্রিকার ‘আষাঢ় ১২৯৯’ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘একটি আষাঢ়ে গল্প’ প্রকাশিত হয়। গল্পটি নাট্যরূপে প্রথম প্রকাশ পায় ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৪৫ এর মাঘ মাসে ।পরিমার্জিত এই দ্বিতীয় সংস্করণ উৎসর্গ করেন ‘কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র’কে। কেন? তিনি লিখেছিলেন ‘স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম’।
উদীয়মান নায়ক সুভাষ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য বদ্ধ সনাতন প্রথার জীর্ণ পুরাতন ভাঙার জন্য নতুন পথ ও মতের সন্ধানে উদ্বুদ্ধ তরুণ। উদ্দেশ্য, ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা।
যে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা সুস্থসমাজে কাম্য বাস্তবে তা অর্জন অসম্ভব। উগ্র জাতীয়তাবাদের কালো মেঘ গর্জে ওঠে, অশনির সংকেতে সতর্ক করে সমাজ বহুমাত্রিক নয়। রাষ্ট্র সমাজ একমাত্রিক। একমাত্রিক ক্ষমতায়নের করালথাবায় সমাজজীবন মর্তুকাম হয়ে উঠতে বাধ্য। স্বেচ্ছাচারী শাসনের কঠিন নিয়ম নীতির নিয়ন্ত্রণে মানুষকে যন্ত্রভূতে পরিণত করে আদেশ দেয়, ‘চলো নিয়ম মতে’। তাসের দেশ এরকম এক শাসনাধীন দেশ। তাসের দেশের অদ্ভুত রাজ্যে নিয়মের কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ তাসেদের জীবন দেখে অবাক রাজপুত্র বুঝতে পারে ‘এলেম নতুন দেশে।’
নতুন দেশ আসলে কোন নতুন দেশ কী? এই প্রশ্ন বারে বারে আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে। এরকম দেশ তো চেনা,ভীষণ চেনা। আমরাই তো থাকি এরকম দেশে। রাষ্ট্রের কঠিন রক্ত চোখ সবসময় লোকের স্বাধীনতা খর্ব করে চলছে। পেটোয়া সম্পাদকের কলমস্তম্ভ যা বলতে শেখায় তাই বলতে হয়,যে তথ্য প্রচার করে তা বিশ্বাস করতে হয়,শাসক যা চাপায় তার চাপ নিতে আমরা বাধ্য। স্বাধীন দেশ বা পরাধীন দেশের তফাত কোথায়? জগদ্দল প্রথায় ব্যক্তির বহুমুখী সত্তার অনায়াস অবলোপন। এক্তিয়ারের বাইরে তাসেরা চলতে পারে না,তাদের গন্ডি নির্দ্দিষ্ট। সনাতন ছন্দ মানতে বাধ্যতামূলক আইন। এই বদ্ধতা থেকে বেনিয়মের মুক্তাঞ্চলে রাজপুত্র কী বলতে পারবে চলো অনিয়ম মতে। ভীষণ ভাবে চিহ্নিত হয়ে যাই আমরা তাসবংশীয়দের সাথে। স্বেচ্ছাচারী শাসকের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য জনতার মধ্যে ভয় সৃষ্টি। গেল গেল ধ্বনিতে আকাশ ফাটিয়ে বলে ‘চালটা প্রাচীন চলনটা আধুনিক। আধুনিক হলে বিপদ বিস্তর। ইতিহাসের গৌরব সংস্কৃতির গর্ব খর্ব করে অনর্থ ঘটানো যাবে না। যা সনাতন তাই সত্যি। তাই মানতে বাধ্য সকলে।
মরা প্রাণে অকারণ আনন্দ নির্বাসিত। জীবনের অর্থ জেনে লাভ কী? গড্ডলিকা স্রোতে ভেসে জীবন্মৃত অবস্থায় ‘তন্দ্রাতীরনিবাসী’ হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি আমরাই তো তাসের মানুষ হয়ে।
আমরা হলাম সেই মানুষ যারা তাসের সঙ সেজে বেড়াই। সেই সঙ শিকলকে বলে অলংকার, জেলখানাকে শ্বশুরবাড়ি আর মরাকে বাঁচা।
নিয়মের কড়া শাসনে শৃঙ্খলিত চিড়েতন হরতন ইস্কাবনদের মতো আমরা রোবটের ছন্দে চলি।
পন্ডিতদের বিধানে এটা করো না ওটা করোনা কৃষ্টি বিপন্ন হবে।দেশের সম্পাদক পন্ডিত প্রত্যেকে শাসকের দলভুক্ত,দলদাস। ওরা চায় দ্বন্দ্বহীন সমাজ ব্যবস্থা যেখানে বর্ণ রঙ ভেদে, গোষ্ঠী সম্পর্কে, অন্যান্য সম্পর্কের বহুমুখী কর্তব্য ভুলে যে যার নিজের সীমানায় নির্দ্দিষ্ট থাকবে। দ্বন্দ্ব হীন সমাজ প্রশ্নহীন আনুগত্যের আখড়া। অহেতুক প্রশ্নে শাস্তির ভয় সমাজচ্যুতির ভয়। মেয়েদের জন্য থাকে আর ও কত শত ভীতি। তাসের দেশের মেয়েরা যখন ভিনদেশি রাজপুত্রের চঞ্চলতা ছুঁয়ে সহজ অথচ কঠিন যা কিনা শাসক বিরোধী ইচ্ছের জয়গানে মাতে পন্ডিতদের আসন টলে ওঠে তখন।রানিবিবি হেসে উঠতেই অনিয়মের হাসি সংক্রামিত হয় হরতনি রুইতনি প্রভৃতিদের মধ্যে। ‘পন্ডিত আর নয় তোমাদের শান্তিরসে হিম হয়ে জমে গেছে আমাদের রক্ত,আর ভুলিয়ে না।’
প্রাণ সঞ্চারে অসত্যের আড়াল খসে যায়,শোনা যায় ‘মুক্ত হও,শুদ্ধ হও, পূর্ণ হও।’
কবির সৃষ্ট তাসের দেশে ভাঙনের জয়গান শাসক সহ সকলে গেয়ে উঠতে পেরেছিল। আমরা পারছি কী? আমাদের মুক্তি কবে কে আনবে?
কোন রাজপুত্র (বা রাজকন্যা) এসে বলবে না— ‘বেড়ার নিয়ম ভাঙ্গলেই পথের নিয়ম আপনিই বেরিয়ে পড়ে,নইলে এগোব কী করে।’
এখানে প্রশ্ন। এগোতে চাই কী আমরা। না হাইবংশীয় তাসেদের মতো হাই তুলে বেঁচে থাকতে চাই?
অভিনয়ের জগতে উন্নয়নের মুখোশে স্বেচ্ছাচারী কিছু ক্ষমতালোভীর সামনে ‘মরা দেহে ভূতের নৃত্য’চালিয়ে যাব কী?
আক্ষরিক অর্থে আমরা রঙমাখা তাসের সঙ।
আমাদের জাতীয় সংগীত হল
‘সামনে যে আসে,
চলে তারি পিছু পিছু।
বাঁধা তার পুরাতন চালটা,
নাই কোনো উলটা পালটা
নাই পরিবর্তন।
ইচ্ছে হাসি আর অনিয়মের অকারণ আনন্দের অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ চাই। তবে যদি বেরোতে পারি
নতুনের খোঁজে। তবে যদি পরিবর্তন আসে।