প্রিয় উপন্যাস ‘ন হন্যতে’ – ব্রততী রায়
সেরা কবি, লেখক, অনুবাদক, সমালোচকের শীর্ষে বিরাজ করছেন ধ্রুবতারার মতো রবি কবি। তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে হয়েও আমাদের খুব কাছের মানুষ আপনজন। তাঁকে তাঁর মহিমার শীর্ষে রেখেই আজ আমার প্রিয় উপন্যাস নিয়ে অল্প কিছু বলব। এ আমার একান্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। ঠিক রিভিউ নয়। সেরার স্থান নেবার কারণ অনুধাবন বা বিশ্লেষণ মাত্র। অপূর্ণ প্রেমের অনন্য জীবনবোধের কাহিনী। যার ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই, অমর সেই ‘ন হন্যতে।’
আমার যৌবনের চোর কুঠুরীতে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছে মৈত্রেয়ী দেবীর অমর আত্মজীবনী মূলক উপন্যাসটি। মির্চা ইউক্লিডের’ “লা নুই বেঙ্গলী” প্রতি উত্তর বলা যায় “ন হন্যতে” কে। সে কথা আজ থাক।
আমার ভাল লাগার কারণ আজ মুখ্য। ব্যর্থ প্রেমের এক অমর সৃষ্টি “ন হন্যতে হন্যমান শরীরে।” প্রায় সব বাঙালি মেয়েরই ব্যর্থ প্রেমে বালিশ ভিজেছে। হয়তো জ্ঞান হারায়নি বা অন্য কিছু। লেখিকা অনেক অনেক বেশি সাহসী। তাঁর বাবার কাছে দর্শন পড়তে আসে এক বিদেশী ছাত্র মির্চা ইউক্লিড। তার সাথে লেখিকা কি করে গভীর প্রেম ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ল তারই দুঃসাহসী কাহিনীর সুলোলিত বিন্যাস এই কাহিনি। আধুনিক হলেও অভিজাত বাঙালি পরিবারের সকলের দৃষ্টির অগোচরে সেই সময়ে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। সেই সময় বলতে প্রায় চল্লিশের দশকের কথা। একই টেবিলে খেতে বসে পায়ে পা জড়িয়ে প্রেম আজকের দিনেও ভাবনার অতীত। মির্চার লঙ্কা চিবিয়ে লাল হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করলেও বেশ ভাল লাগে।আমি যে বয়েসে বইটা হাতে পেলাম সেদিনই যেন লেখিকার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছি। এ যেন আমাদেরই কথা, শুধু সময়ের ফারাক। আমরা নব্বই দশকের ব্যর্থ প্রেমিকা। আর সর্বোপরি অত দুঃসাহস দেখাতে ও পারিনি।
তবে উপন্যাসটি দেহ, মন, প্রাণ দিয়ে গ্রাস করেছি। বলতে দ্বিধা নেই লেহন করেছি। সে অনুভূতি আমি বিশ্লেষণ করতে অপারগ। নব্বই-এর দশকে আমরা যা পারিনি লেখিকা চল্লিশের দশকে প্রেমকে পরিণতি দিতে চুম্বনে আবিষ্ট হয়েছেন অবলীলায়। আমি নারী হয়ে অপাপবিদ্ধ ভালবাসায় গর্বিত।
লেখনীর অনাবিল দাপুটে অভিব্যক্তিতে পরিণতি যাই হোক উপন্যাসের প্রতিটি বিন্যাস আমার হৃদয়ে শীর্ষ আসনে জ্বলজ্বল করছে। অসাধারণ শব্দ চয়ন, লেখিকার গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাই উপন্যাসটি পাঠ করে। চঞ্চল, জেদি, অকুণ্ঠ তরুণী মৈত্রেয়ী ভালবাসার মানুষটিকে ভুলে শান্ত ও পরিণত হয়ে ওঠেন। তারই আলোকে উপন্যাসটি রচিত।
তাঁর গুরু সর্বোপরি সবার গুরু রবিকবির স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবী মংপুর নির্জন বাংলোটি শেষ বয়সে কাব্য চর্চার জন্য দিয়ে যান কবিকে। কবি নিরালা, নির্জন, কোলাহল বর্জিত এই স্থানটিকে শেষ বয়সে বেছে নেন। সপ্তপর্ণির নীচে বেদিতে বসে মনের খোরাক সঞ্চয় করতেন, লেখনীতে তাকে বাঙ্ময় করে তুলতেন।
অনেক বার বলতে গেলে প্রতিবছরই প্রায় মংপু যাওয়া হয়ই আমাদের। কেয়ার টেকারের সঙ্গেও দিব্য সখ্য হয়ে গেছে। আমাকে দেখেই একগাল হেসে স্বাগত জানাল। শুরু করে দিল ভাঙা বাংলায় রবীন্দ্র সংগীত। আমাকেও প্রতিবারের মত গলা মেলাতে অনুরোধ। অচর্চিত অপটু গলায় গলা মেলাতেই হলো – আকাশ ভরা সূর্য তারা… গেয়ে উঠলাম।