তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্যুতি
সোমাদ্রি সাহা
‘Old order changeth yielding place to new.’ – Tennyson
টেনিসনের কথা অনুসারেই রাবীন্দ্রিক যুগের বহমানতার সাথে সাথেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসকে তিন বাড়ুয্যেচিত এক নতুন উচ্চতায় আলোক দ্যুতি দিয়েছেন। তিন জনের জগৎ আলাদা, তবে শক্তিতে তাঁরা স্বগোত্রীয়। উপন্যাসের বিশ্বপটভূমির কথা মনে রেখেই বলা যায়, তাঁরা অসাধারণ ঔপন্যাসিক। মানিকের পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা; তারাশঙ্করের হাসুলিবাঁকের উপকথা, গণদেবতা; বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, আরণ্যক অর্পূব রচনা। মানিকের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সঙ্গে ব্যক্তি জীবনের যোগ, তারাশঙ্করের আঞ্চলিক জীবনবোধ-সামন্তচেতনা, বিভূতিভূষণের জীবন-প্রকৃতি-দর্শন বাংলা উপন্যাসকে ধনী করে তুলেছে। আমরাও সেই আলোকে ঋদ্ধ হয়েছি, হচ্ছি, হব।
‘রক্তকরবী’ নাটকের ব্যাখ্যায় রবি ঠাকুর বাল্মীকির রামায়ণের রূপকার্থের মধ্যে আবিস্কার করেন এক যুগ-সংঘর্ষের কাহিনি। রাম কৃষি-সভ্যতার প্রতীক, রাবণ শিল্প-সভ্যতার। যজ্ঞভূমি কর্ষণ-কালে জনকের লাঙলের ফলার চিহ্ন থেকে উত্থিতা লক্ষ্মীর অংশোদ্ভূতা সীতা হল সোনার ধান। তাকে নিয়েই সেই রক্তক্ষয়ী লঙ্কাকান্ড। তাকে অপহরণ করার জন্য স্বর্ণমুদ্রা রূপী স্বর্ণ-মারীচের প্রলোভন ও রাবণের শক্তির চাতুর্য-পূর্ণ প্রকাশ। রামায়ণে সেই যুগ-সংঘর্ষের এবং সভ্যতার সংঘাতের দ্বান্দ্বিক রূপ প্রতিভাসিত। আর আমাদের ত্রয়ীর কলমেও সেই যুগ-সংঘাত ও যুগ-সংঘর্ষের দ্বান্দ্বিক রূপ বারংবার আমাদের আলোর সন্ধান দিয়েছে।
বাংলা উপন্যাসের জগতে এরপর আবির্ভাব ঘটে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬)। আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক মাধুর্য, পল্লির স্নিগ্ধ শান্ত রূপ, অরণ্য, পাহাড় যে এখনও আমাদের জীবনকে করে, তাঁর লেখা পথের পাঁচালী, অপরাজিতা, আরণ্যক ইত্যাদি উপন্যাস পড়লেই তা বোঝা যায়। তারাশঙ্করের উপন্যাসে পাই অতীতের গৌরব আর ঐশ্বর্য হারানো জমিদার, নিম্নশ্রেণির বিচিত্র পেশার সাধারণ মানুষের কথা। এই মানুষজন আমাদের চির চেনা বৈষ্ণবী, কবিয়াল, যাত্রাশিল্পী, মৃৎশিল্পী, বেদে, সাপুড়ে, বাজিকর, ঝুমুর দলের নাচিয়ে ইত্যাদি। উঠতি শিল্পমালিক আর শ্রমিকদের জীবনের ছবিও পাওয়া যাবে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে ‘গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, ধাত্রীদেবতা, হাসুলী বাঁকের উপকথা, কবি’ প্রভৃতি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘মার্কসবাদের পটভূমিতে ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব এবং ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের আলোকে নর-নারীর জটিল সম্পর্ক’ যা তিনি উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা জর্জরিত মানুষের জীবনের ছবি তাঁর উপন্যাসে উজ্জ্বল। সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে গ্রামীণ বাস্তবতার চিত্র। দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, শহরতলী প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস।
প্রসঙ্গক্রমে একটি স্মরণীয় সাক্ষাৎকার –
প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা অনার্সের একটি ছাত্র এক রাশ দ্বিধা ও প্রত্যাশা নিয়ে এক সূর্যকরোজ্জ্বল সকালবেলা বি টি রোড ধরে এগিয়ে চলেছে বরানগরের দিকে। মার্ক্সবাদী সাহিত্য-নীতি বিষয়ে তরুণদের একটি পাঠচক্রে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এক প্রখ্যাত লেখকের কাছে চলেছে সে, বন্ধুদের কাছে দায়িত্ব পেয়ে। সে ছাড়া আর কারো সাহস হয় নি এই দায়িত্ব নেবার। আদৌ কি তিনি আসবেন নিতান্ত তরুণ কবিদের এই অকিঞ্চিত্কর পাঠচক্রে?
বাস থেকে নেমে ছেলেটি একে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে একটি শাদাসিধে ছোটোখাটো বাড়ির দরজায় এসে কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দিলেন এক মহিলা, নীরব।
-উনি কি আছেন?
-বাজারে গেছেন।
রোমান্টিক তরুণ কবির কল্পনায় তখন ‘লেখক’ ও ‘বাজারের’ মধ্যে কোনও স্বাভাবিক সংযোগের অবকাশ ছিল না। সে মনে মনে ভাবে, লেখক কি সাধারণ কোনও মানুষ নাকি? তাঁকে কেন বাজারে যেতে হবে? ভাবতে ভাবতে সামনের খোলা মাঠে পায়চারি করতে থাকে সে। আধ ঘণ্টা পরে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা দীর্ঘদেহী সুঠাম এক শ্যামবর্ণ মানুষ দু-হাতে দুটি থলে নিয়ে ওই বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছেলেটির বুকের রক্তে কাঁপন লাগলো। বাজার যখন হাতে, তাহলে উনিই তো সেই লেখক! পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। আড়চোখে তার দিকে চেয়ে মানুষটি বললেন :
-আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?
-হ্যাঁ।
-আসুন, ভিতরে বসুন। বাজারটা রেখে দিয়ে আমি আসছি।
লেখক পর্দা সরিয়ে ভিতরে গেলেন। তরুণটি বিমূঢ় ভাবে বসে বসে দেখতে থাকে লেখকের লেখার ঘরটিকে। উপকরণহীন একটি চৌকি, একটি ছোটো টেবিল, একটি চেয়ার। টেবিলে কোনও বই নেই, শূন্য। পুতুলনাচের ইতিকথা, পদ্মানদীর মাঝি, দিবারাত্রির কাব্য, কয়েকদিন আগে পড়া চতুষ্কোণ
-মাথার মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে তার চরিত্রেরা। রাজকুমার সরসী, কুবের, কপিলা, হোসেন মিয়া, শশী, কুসুম, হেরম্ব…
-এই রকম নিরাভরণ তাদের স্রষ্টার ঘর? এই সেই বিতর্কিত ও সুপরিচিত লেখক?
ফিরে এসে লেখক বসলেন বিমূঢ় তরুণটির মুখোমুখি। কী বলবে সে, কী বলা উচিত? সব ঝাপসা হয়ে গেছে। তার অপ্রস্তুত নীরবতা দেখে সরাসরি তরুণটির চোখের দিকে তাকিয়ে লেখক বললেন :
-কী ভাবছেন? ভাবছেন যে, একজন লেখকের ঘর এমন ফাঁকা কেন? নাকি ভাবছেন যে, লেখক নিজের হাতে বাজার করেন কেন?… না করে আর উপায় কী বলুন? ঝি-চাকর রাখার মতো টাকা কে দেবে আমাকে? দেন কি আপনারা? পড়েন কি কেউ আমার লেখা? আপনি কি আমার কোনও লেখা পড়েছেন?
-হ্যাঁ, অনেক…
-কিনে পড়েছেন?
-আজ্ঞে না, লাইব্রেরি থেকে, চেয়ে-চিন্তে…
-তাতে কী সুবিধে হলো আমার? আপনার বন্ধুরা কেউ কিনেছেন?… কেনেন নি তো? তবে? পাঠকরা কেউ বই কিনবেন না, প্রকাশক বলবেন বই বিক্রি হয় না, টাকাটা তবে আসবে কোথা থেকে? লেখকের ঘরটাও তাই এ-রকমই থাকবে।
লাঞ্ছনার এই সত্য জেনে তরুণ কবিটি মাথা নিচু করে বসে রইল। একটু পরেই দরাজ গলায় প্রশ্ন এলো:
-বলুন এবার, কী জন্য এসেছেন। গল্প চাই একটা?
ছেলেটি আত্মপরিচয় দিয়ে জানালো তার আগমনের উদ্দেশ্য, তাদের পাঠচক্রে কিছু বলার জন্য অনুরোধ। সব শুনে লেখক বললেন :
-ঠিক আছে, যাব। কোথায় কবে কখন, লিখে দিয়ে যান একটা চিরকুটে।
বিহ্বল তরুণটি বিস্ময়-মুগ্ধ তখন। কোনও মতে আবেগ দমিত করে সে বলল:
-নিয়ে যাব আমরা এসে।
-কিছু দরকার নেই। আপনারা পয়সা পাবেন কোথায়? চলে যেতে পারব একাই। পথনির্দেশটা শুধু রেখে যান।
আরও দু-চারটে কথা বলে ছেলেটি পথে নেমে আসে। যে প্রত্যাশা নিয়ে সে এসেছিল, ফিরে যাচ্ছে তার বহুগুণ উপার্জন নিয়ে। বরানগর থেকে কলেজ স্ট্রিট, সেখান থেকে বৌবাজার পেরিয়ে বন্ধু প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের বাড়িতে উড়তে উড়তে পৌঁছে গেল সে, জয়ের বার্তা নিয়ে।
*সেদিনের সেই প্রখ্যাত লেখক : মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
*আর সেই তরুণ কবি হলেন : শঙ্খ ঘোষ (যাঁর প্রকৃত নাম : চিত্তপ্রিয় ঘোষ)
(সূত্র : সময়ের জলছবি: শঙ্খ ঘোষ)
আজকের উত্তর আধুনিকতায় দাঁড়িয়ে এই আলোর কিছুটা ঝলক রাখলাম। কারণ লেখক জীবন বড়ই কষ্টের। তবে সৃষ্টি তো এই সব কষ্টকে উপেক্ষা করে না, আদর করে। সেই আদর তিন চেতনা দিয়ে ঈড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না-র মতো। একই দেহের মধ্যে বিরল জ্যোতির্ময় আশীর্বাদ বাংলা সাহিত্য পেয়েছে ও আমরা সেই বাংলায় লিখতে-পড়তে পারছি বলেই আরও একটা জন্ম বাঙালি হওয়াই যায়।
উপন্যাসের দুনিয়ায় ইংরেজি ভাষার দাপট অনেক কালের পুরোনো। তাছাড়াও রয়েছে রুশ ভাষার প্রতাপ। ইংরেজির ডিকেন্স, হার্ডি, অথবা রুশ টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি’দের মতো বাংলায়ও রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক’য়ের মতো ঔপন্যাসিকেরা। বাংলা সাহিত্য-জগতে বঙ্কিম-রবি-শরৎ ত্রয়ী ঔপন্যাসিক হিসেবে অনন্য স্থানের অধিকারী। তবে সুনীতিকুমার থেকে জানা যায়—তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছিলেন— বঙ্কিম-শরৎ-তারা ছিলেন সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক-ত্রয়। যারা বিত্তবান হবার কারণে এর-ওর ছবি টাঙানো অভিজাত ড্রয়িংরুমে বসে গর্বিতভাবে সংস্কৃতিচর্চা করতে পছন্দ করেন তারা যে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথকে বেশি টানবেন তা অনুমান করা যায়। আর যারা কথার যাদুতে মজে আনন্দ চান, সময় পার করতে চান, তারা শরৎচন্দ্রকে অবলম্বন করলে সুফল পাবেন।
আনন্দের জন্য শরৎচন্দ্রের পুরো গল্পটি পড়ে শেষ তক যেতেই হবে এমন কথা নেই। আপনি রেল স্টেশনে বসে আছেন? ট্রেন দু’ঘণ্টা লেট? তাঁর যেকোনো একটি উপন্যাস নিয়ে পড়তে থাকুন। ট্রেন আধা ঘণ্টার মধ্যে চলে আসলেও ক্ষতি নেই—যতটুকু পড়েছেন তাতেই আনন্দ। আমরা সাধারণত কষ্ট করে উপন্যাসের সবটুকু পড়ে তবে শেষে পুরো আনন্দ পাই। কিন্তু শরৎচন্দ্রের বেলায় একথা খাটে না: আমরা পড়তে শুরু করেই আনন্দের সাথে এগুতে থাকি, এবং পথ শেষ হবার আগেই কোনো কারণে যাত্রাভঙ্গ হলেও ঠকেছি বলে আফসোস হয় না। কিন্তু যদি জীবনকে সামগ্রিকভাবে ও অর্থনৈতিক শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে মানুষের প্রকৃত টানাপড়েনকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে চাই তবে বিভূতিভূষণ-মানিক-তারাশঙ্করই সবচেয়ে উপযুক্ত এবং এ বিচারে এ তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ই সেরা ত্রয়ীটি তৈরি করেছে বলে দাবী করা চলে। ধরা যেতে পারে যে, উপন্যাসের উপাদান চারটি: আখ্যান, চরিত্র, ভাষা ও জীবনদর্শন। এ চার উপাদান-বিচারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী (১৯২৯), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা (১৯৪২) বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপন্যাস ত্রয়ী বলেই মনে হয়। তারও উপর আরও দাবী করা যায় যে, এ তিনটি উপন্যাস বড় ক্যানভাসের উপন্যাস।
উপন্যাসের বড় ক্যানভাস বলতে কী বোঝায়? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়: যে উপন্যাস একটি কালের একটি স্থানের মানবমণ্ডলীকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে সহায়ক হয় সে উপন্যাসের প্লটই বড় ক্যানভাস। বিস্তৃতভাবে লেখা একাধিক ইতিহাস বই পড়েও যা আয়ত্তে আনা যায় না, বড় ক্যানভাসের উপন্যাস পড়ে তা সহজেই সাধন করা যায়। তবে এটাও বলতে হয় যে, এ ধরনের উপন্যাস একটি স্থান-কালকেই কেবল ধারণ করে না, বর্ণরূপায়িত করে না, বরং এর মধ্য দিয়ে তা মানুষের বহমান সার্বিক রূপকেও তুলে ধরে। বড় ক্যানভাসের উপন্যাসে আমরা একটি সমাজের ‘উচ্চ’ থেকে ‘নিচ’ বলে বিবেচিত সব অর্থনৈতিক শ্রেণির প্রতিনিধিকেই চরিত্র হিসেবে পেয়ে থাকি; ফলে প্রত্যেকের মানস-কাঠামো এবং তাদের শ্রেণিভিত্তিক আন্তঃসম্পর্ককেও আমরা বুঝতে পারি। এ-কথা ঠিক, টলস্টয়ের ওয়ার এন্ড পিস উপন্যাসের ক্যানভাসের তুলনায় আমাদের গ্রাম-ভিত্তিক বড় ক্যানভাস আদতে খুব বড় নয়। ফলে এ উপন্যাসগুলো কলেবরেও ছোট এবং এতে রাজধানীর উজির-নাজির-নকিব-কোতোয়াল-রক্ষী-সেবকেরা চরিত্র হিসেবে অনুপস্থিত। কিন্তু তাতে মূল দ্বন্দ্বের, চিন্তা ও জীবনাবস্থার বৈপরীত্যের চিরায়ত রূপটি ক্ষুণ্ণ হয়নি। কাহিনী বা আখ্যানের মধ্যে বিদ্যমান নাটকীয়তা বিচারে ইংরেজ ঔপন্যাসিকেরা অনেক অগ্রসর হলেও চরিত্র নির্মাণ, ভাষার ব্যবহার ও বর্ণনার অন্তরালে প্রবহমান জীবনদর্শন বিচারে এ তিন উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনেও নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। ভাষা ও ভঙ্গির দিক থেকে পাঁচালী জীবন চিত্রণে নম্র ও কাব্যিক, গণদেবতা আগ্রাসী ও নাটকীয়ভাবে গদ্যময়, আর ইতিকথা এদের মধ্যবর্তী—একাধারে কাব্যিক ও নান্দনিকভাবে ধারালো।
‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’ আক্ষেপের রবীন্দ্রনাথ, অথবা তার অগ্রজ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা সাধারণত বাবু ও সর্বোপরি মানুষ। এর বিপরীতে আমাদের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রগুলো কতটুকু মানুষ তা জানি না তবে তারা যে হারে-মাংসে বাঙালী তা সহজেই দাবী করতে পারি। এখন তিন দিকবাড়ুয্যের তিন-উপন্যাসকে একটু ফিরে দেখি।
পথের পাঁচালীতে আমরা পাই অবিকৃত প্রকৃতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে মর্ম-নাড়ী-যুক্ত রোমান্টিক জীবনের ব্যাকুলতা, কষ্ট, আনন্দ আর আশা-দুরাশার দোলাচল। গুরুতর দারিদ্র্য ও সংকটের মধ্যেও দুর্গা, তার ভাই, মা ও বাবা চারজনই বিভিন্ন মাত্রায় কম-বেশি রোমান্টিক বা কল্পবিলাসী। কাহিনী খুবই সাধারণ, চরিত্রও সাধারণ। সমালোচকেরা সাধারণত বলে থাকেন যে, প্রত্যেক পাঠকই এখানে নিজেকে খুঁজে পেয়ে থাকেন। উপন্যাসটি অসাধারণ হয়েছে প্রকৃতির ও মনোজগতের সরল কিন্তু গভীর উপস্থাপনায়। এটি সম্ভব হয়েছে বিভূতিভূষণ কর্তৃক সুবিস্তৃত চিত্রণের ফলশ্রুতিতে—মনের ভেতরটাকে, প্রাকৃতিক জগতটাকে, প্রকৃতির সাথে জীবনের মাখামাখিটাকে চিত্রিত করার কাব্যিক দক্ষতার কারণে। এটা হয়তো ঠিক, বিভূতিভূষণের বিবরণ নিরাসক্ত ও অবজেক্টিভ; কিন্তু স্বতন্ত্র বাক্যগুলোর মধ্যে নয়, কাব্যিকতাটি রয়েছে বাক্যের সমাহারের ভেতর, সামগ্রিক বুননের ভেতর, দেখবার ও প্রকাশ করবার মনোভাব ও ভঙ্গির ভেতর। জীবনের রূঢ়তা ও শ্রেণি-দ্বান্দ্বিকতা যেমনটা আমরা দেখি গণদেবতায়, তেমনটা উৎকটভাবে তা এ উপন্যাসে উপস্থিত নয়। তবে বিত্তবানের মনোভাব, তার ভেতরে থাকা অহমিকা, দৈনন্দিন আটপৌরে জীবনে তার নিষ্ঠুর বাচনিক বহিঃপ্রকাশ এবং অর্থনৈতিক আচরণগত নির্মমতার উদাহরণ এ উপন্যাসে একেবারে অনুপস্থিতও নয়। তব্রেজের বউ ও অন্নদা রায়ের কথোপকথনে আমরা শেষেরটির উত্তম নজির দেখতে পাই। বাংলাদেশের অনেক বঁধুই জা-স্বামীর জিহ্বায়-হাতে কিভাবে নিপীড়িত অপমানিত হয় তার নজিরও উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। আবার শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে মানুষের মমতা, হিংসা, শ্লাঘা সবই ফুটে উঠেছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে একই চরিত্রের মধ্যে। সর্বজয়া পুত্রের প্রতি যতটা স্নেহময়ী, কন্যা দুর্গার প্রতি ততটা নয়, এবং ইন্দির ঠাকরুনের প্রতি একপ্রকার নির্মমই বলা যায়। বিচ্ছেদ ও দারিদ্র্য এ উপন্যাসে পাঠকের মনকে কোথাও কোথাও বেদনার রসে নীল করে তোলে—অন্তর নিংড়ানো করুণার রসে চোখও আর্দ্র হয়ে উঠে; তবে শ্রেণি-দ্বান্দ্বিক ভাবনা তৈরি হয় না, বরং আশা-বেদনা, স্বপ্ন-অন্বেষা, অসহায়ত্বের বোধ, পরিবর্তনের কল্পনা—প্রকৃতির বিপরীতে প্রাকৃতিক মানুষের বসবাস-সংগ্রামের সার্বিকরূপের সাথেই যেন আমাদের পরিচয় ঘটে—পাঠক নিজেকে একধরনের আধ্যাত্মিক উচ্চ স্তরে উপনীত অবস্থায় দেখতে পায়।
এ উপন্যাসে ইন্দির ঠাকরুন ও সর্বজয়ার অসহায়ত্ব স্পষ্ট এবং দুর্গার একাকীত্বটি গভীর। দুর্গার একাকীত্ব এ উপন্যাসের একটি অন্যতম প্রধান থিম। এমনকি একথাও হয়তো বলা সম্ভব: পথের পাঁচালী নারী বিষয়ক উপন্যাস, ইন্দির ঠাকরুন, দুর্গা ও সর্বজয়া’ই এর প্রধান চরিত্র—অপু এংকর, দ্রষ্টা, ভাষ্যকার। ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর সাথে সাথে যেভাবে সেকালের অবসান হয়েছিল, সেভাবেই দুর্গার মৃত্যু ও দুর্গাকে ফেলে রেখে গ্রাম ছাড়ার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। তারপরের অংশে সর্বজয়া নিজেকে আবিষ্কার করে ইন্দির ঠাকরুনের জায়গায়। মহাকালের বিপরীতে দাপটে মানবজীবনের পরিণতির চিত্র তুলে ধরতেও ঔপন্যাসিক সুযোগ হাতছাড়া করেননি। হরিহরের পূর্বপুরুষ বীরু ডাকাত বা ইংরেজ কর্মকর্তা লারমার সাহেব সংবাদ তারই উদাহরণ। আবার লারমার সাহেবের মৃত শিশুপুত্রের সমাধির চিত্রটি আঁকার সময় তিনি প্রকৃতির মমতাকেও যেন দেখতে পেয়েছেন দিব্যদৃষ্টিতে। মনোগত জীবনের প্রবাহ, অহমিকার পরিণতি, মন-প্রকৃতির সম্বন্ধ বিষয়ে বিভূতি তাঁর নিজ জীবনদর্শনকে উপন্যাসের অন্তরালে প্রচ্ছন্নভাবে বহমান রেখেছেন সতর্ক প্রয়াসে। ফলে উপন্যাসটিতে প্রকৃতির কথা ও উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের মনের কথা আবর্তিত হয়েছে জালের বুননের মতো এবং কোনো কোন স্থানে যুক্ত হয়েছে ঔপন্যাসিকের চিন্তা, একটি প্রবাহের মতো করে।
পুতুলনাচের ইতিকথা নিয়ে প্রথমেই এটি না বললে নয়: এ উপন্যাসের ভাষা একেবারে ঝরঝরে, পিচ্ছিল, সহজ-পাঠ্য, কিন্তু কাব্যিয় মাদকতায় ভরা। পাঁচালীর ভাষা সেকালের সাধুরূপ, আবার একই সাথে যশোর-কুষ্টিয়া এলাকার গ্রাম্য শব্দের ছড়াছড়ি, কাজেই পঠন সামান্য আয়াস-সাপেক্ষ। ইতিকথা পড়া যেন পিচ্ছিল পাহাড় থেকে আপনি গড়িয়ে পড়া; বাক্যগুলোও সহজ-পাঠ্য। ভাষা সাধু হলেও মনে হয় এ যেন চলতি রূপেরই আরেক রূপ। এখানে সংলাপগুলোও কাব্য গোছের—সবাই একই স্টাইলে কথা বলে। মানুষ একেকজন একেক স্টাইলে কথা বলে থাকে; শব্দের চয়ন ও প্রকাশ থেকেও চারিত্র বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করা যায়। ঔপন্যাসিকেরা সেদিকে খেয়াল রেখে সংলাপকে চরিত্রোচিতও করে থাকেন। তবে এককালে অনেকেই সংলাপও সাধু ভাষায় লিখতেন; এখানে চরিত্রকে বুঝতে হয় সংলাপের স্টাইল নয়, তার মধ্যকার তথ্য থেকে। ইতিকথার সংলাপও অনুরূপ—ফারাকটা হচ্ছে এখানে যে, সংলাপ চলতি ভাষার ও কাব্যিক ঢংয়ের। মানিকের পদ্মানদীর মাঝি এবং পুতুলনাচের ইতিকথার মধ্যে কোনটি সেরা তা নির্ধারণ করা যেমন কঠিন তেমনই ইতিকথার বিশ্লেষণ করাও কঠিন। সবচেয়ে ভাল পন্থা হলো নিজেই উপন্যাসটি পড়ে দেখা। সম্ভবত যেকোনো পাঠকই উপন্যাসটি একাধিকবারও পড়ে ফেলতে পারবেন অনায়াসে ও সানন্দে। বিদেশী একটি উপন্যাসের সাথে এর একটি তুলনা করার চেষ্টা করা যেতে পারে। টমাস হার্ডির উপন্যাস টেস অব দি ডি’আরবারভিলস কেও তার সেরা উপন্যাস বলা না গেলেও সেটিকে একটি অনন্য উপন্যাস বলা যায়, তার মধ্যে বিদ্যমান কাব্যময়তার কারণে। এ কাব্যময়তা কিন্তু সেখানকার গ্রামের মানুষের চিত্রকে বদলিয়ে ফেলেনি। সেরকম একটি উপন্যাস বাংলায় পড়ার ইচ্ছাকে খানিকটা হলেও পূরণ করা যেতে পারে ইতিকথা পড়ে।
টেস একটি শুদ্ধ-নির্মল নারী: প্রাকৃতিক, আকর্ষণীয়া এবং দরিদ্র। হার্ডির উপন্যাসটি টেস নামক পুতুলের নাচের, বিধ্বস্ত টেস’য়ের ইতিকথা। কিন্তু আমাদের ইতিকথার পুতুল কে? কুসুম? নাকি শশী নিজেই? প্রকাশ্যতঃ কুসুম; কিন্তু অনুমান করা যায়, শশীই বিধ্বস্ত পুতুল—আবার এটিও ঠিক যে, শশীর ধ্বসের আরও নানা কারণ রয়েছে। উপন্যাসে আরেক পুতুল হচ্ছে মতি নামের মেয়েটি। কুমুদ-মতির কাহিনী শশী-কুসুমের সমান্তরাল কিন্তু বিপ্রতীপ নাচের ইতিকথা। মতি কাঁচা মাটি, কিন্তু পরিণতি টেস’য়ের মতো নয়। আর কুসুম পাকা, রঙ্গময়ী ও রহস্যময়ী। হার্ডির টেস-কেন্দ্রিক উপন্যাসের ব্যাপ্তিকে ছাড়িয়ে মানিকের উপন্যাস বিস্তৃততর হয়েছে—এটি অন্যটির মতো এক-কেন্দ্রিক নয়। মানিকে জীবন বহু মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে; এখানে সকলেই পুতুল: হারুর শবদেহ থেকে পরান, যামিনী কবিরাজ, সেনদিদি, গোপাল, বিন্দু, সবাই। তবে গভীরতার বিচারে টেস-ট্র্যাজেডি অতলগামী, মানিকের বেলায় সকলই যেন স্বাভাবিক।
গণদেবতা
সবশেষে গণদেবতার কথা। অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজন, সাংস্কৃতিক বিভাজন, নিষ্ঠুর–দাম্ভিক অসাম্যভিত্তিক চিন্তা তাড়িত সামাজিক মিথোস্ক্রিয়ার বিদ্যমানতা, একের অহমিকা ও অপরের বঞ্চনা ইত্যাদিকে জীবন-ভাবনায় বড় করে দেখা হলে একজন যেরকম উপন্যাস লিখতে চাইবেন ঠিক সেরকম একটি সফল ও শক্তিমান উপন্যাস হচ্ছে এই গণদেবতা। এ উপন্যাসে ভাষা আগ্রাসী ও উৎকট, বর্ণনধারা ঝর্ণার মতো সংক্ষুব্ধ ও নৃত্যপরা, কিন্তু সাবলীল। ভাষায় প্রশান্তের গাম্ভীর্য নেই, আছে এমনকি পরিহাসেরও ধার। ঘটনার বিবরণে এ উপন্যাসে রয়েছে অভিঘাতমূলক নাটকীয়তা। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, একেবারে প্রথম পরিচ্ছেদটি থেকেই। উপন্যাস শুরু হয়েছে এ দুটি বাক্য দিয়ে: ‘কারণ সামান্যই। সামান্য কারণেই গ্রামে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল।’ কিন্তু এখানে পরিহাস বা আয়রনি’টা হচ্ছে এই যে, প্রকৃত প্রস্তাবে কারণটা মোটেই সামান্য নয়, বরং এর মধ্যেই নিহিত আছে শ্রেণি-দ্বান্দ্বিক সংকটের চরম রূপ। অন্যদিকে, এ পরিচ্ছেদটি শেষ হয়েছে একটি বিরাট ঘটনার মাত্র একটি বাক্য সম্বলিত বিবরণের মধ্য দিয়ে। অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো বাক্যটি লেখা হয়েছে এভাবে: ‘পরদিন প্রাতে শোনা গেল, অনিরুদ্ধের দুই বিঘা বাকুড়ির আধা-পাকা ধান কে বা কাহারা নিঃশেষে কাটিয়া তুলিয়া লইয়াছে।’ গোটা সাতেক পৃষ্ঠার এ প্রথম পরিচ্ছেদটি— যেখানে উপন্যাসের প্রধান প্রধান সব নিয়ন্ত্রক চরিত্রগুলোর সাথেই পাঠকের পরিচয় ঘটে যায় এবং ঘটে তাদের মধ্যকার অন্ত:সম্পর্কের স্বরূপ উন্মোচন—আড়াইশ’ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির এমন একটি সারমর্ম যা পুরো উপন্যাসটির প্রতিনিধিত্বকারী স্বয়ংসম্পূর্ণ অণু-উপন্যাস হয়ে উঠেছে।
এ উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরাও সকলে গ্রামেরই বাসিন্দা—তবে এ গ্রাম বিভূতির বা মানিকের গ্রামের মতো শান্ত-স্নিগ্ধ নয়। এতে যেন শহরের বাতাস এসে লেগেছে—কামার-কুমার-ছুতোরগুলো যেন সব শহুরে শ্রমিক, পয়সাওয়ালা মাতবর গোছের লোকগুলো যেন বস্তির সর্দার। আর ক’জন গণ্যমান্য মানুষ—তারাও যেন অপদার্থ, শক্তিহীন, নিজের উপর বিরক্ত। পথের পাঁচালী বা পুতুলনাচের ইতিকথায় রাষ্ট্রের হাতের দেখা মেলে না, অপরাধ ও ত্রাসের সাক্ষাত আমরা পাই না। গণদেবতায় রাতের আঁধারে ধান কেটে নিয়ে যাওয়া, ঘরে আগুন লাগানো, মামলা-মোকদ্দমা, পুলিশ-তহশিলদারের আনাগোনা রয়েছে। সে অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। মোটকথা, মানুষগুলো সকলেই যেন সর্বদাই তেতে আছে, স্বার্থের দ্বন্দ্বে মারমুখো হয়ে কেবলই ফুঁসছে। তবে তিনটে উপন্যাসের প্রতিটিকে অন্য দুটোর পরিপূরক হিসেবে দেখলে আমরা একটি পূর্ণতর সমগ্র পাই বলেই মনে হয়।
হৃদয়হরণকারী তিন লেখক। ত্রয়ী। ঈড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না। মহাকাব্যোচিত বিচিত্র সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই তিন আলোকময় দ্যুতি দিয়েছেন বহু-বিচিত্র স্বনিষ্ঠ চরিত্র। উপস্থাপিত হয়েছে বাংলার জনপদের চিরাচরিত অদ্ধতা-মূঢ়তা, বিশ্বাস-কুলাচার, কালারুদ্র-কর্তাবাবা এবং নিবিড়-ঘন প্রকৃতির যুগ-প্রাচীন রূপ। তিন লেখক যে আগামী বছরের আগামী আলোর সম্ভাবনাময় প্রতীক। যুগ সংঘাতের এক নির্মম রূপকার। তিন লেখকের লেখনিতেই দেখতে পাই জমিদারতন্ত্র শেষে ভেঙে পড়ছে যুগজীর্ণ কৃষি-সভ্যতা। আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর গড়ে উঠেছে যন্ত্র-সভ্যতা তথা শিল্প-সভ্যতার ইমারত। আর এই ইমারতি যুগের পাপ-পুণ্যবোধ, বিশ্বাস-সংস্কার, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং প্রণয়-প্রতিষ্ঠা নিয়ে শত-শতাব্দী ধরে সমাজ শাসনের রূপগুলো ত্রয়ীর কলমে গতি পেয়েছে। সমাজে অফুরন্ত অশ্রুজলের করুণ আলেখ্য পেরিয়ে নতুন আলোর স্বপ্ন দেখা প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনীয় আলো প্রিয় লেখকদের কল্লোল যুগের উপন্যাসে স্পষ্ট। জলন্ত ধুমকেতুর মতো এঁদের আবির্ভাব, আলোর সুতীব্র ধিক্কারে গতানুগতিক জীবন-দর্শন, সমাজ-দর্শন ও সাহিত্য-দর্শনকে তছনছ করে দিয়ে তাঁদের অকাল প্রস্থান। বাংলা সাহিত্য এই মহাশিল্পীদের প্রতিভার আগ্নেয় দীপ্তিতে বিস্মিত, বিমূঢ়। মানুষের মগ্ন-চেতনার স্তরে যে জৈবিক প্রেরণার প্রাধান্য বর্তমান মনস্তাত্ত্বিক জগতে স্বীকৃতি লাভ করেছে ত্রয়ীর গল্প-উপন্যাসে তাইই হয়েছে কাহিনী ও চরিত্রসমূহের অমোঘ ও দুর্জয়-শক্তি। আসলে সকলেই যুগে অগ্রবর্তী ছিলেন। তাই তাঁদের সমসাময়িক কাল পারেনি তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি ও নিবিড়তা উপলব্ধি করতে। আজও কি পারলাম সেই সব সৃষ্টির পূর্ণ-মূল্যায়ণ করতে!