মিথ জীবনেও নারীরা অবহেলিত
সোমাদ্রি সাহা
‘ওই ঘাটে কত বধূ কত শত বর্ষ বর্ষ ধরি
ভিড়ায়েছে ভাগ্যভীরু তরী।’
– রবি ঠাকুর
ভাগ্যভীরু ভারতীয় নারীর জীবন যুগ যুগ ধরে খুঁজেছে প্রেম-প্রীতিঘন একটি সুখী সচ্ছল গৃহকোণ। কিন্তু পেয়েছি কি? আসলে আধুনিক কালে নারী তুমি একাকিত্বের আঁধার। “ধর্ষণ” শব্দটি শেষ তিন দশক ধরে খুব বেশি বিব্রত করছে। নারী তুমি পুরুষকে ভালবাসতে পারলে না (পড়ুন পুরুষ ভালবাসতে পারল না নারীকে) কিন্তু বিশ্বাস করো এক জন্মে আমিও নারী হবো, তুমি হবে পুরুষ। আর সে জন্ম থেকে ভেঙে যাবে পুরুষতান্ত্রিকতার মিথ। ভালবাসবে দু’জনেই দু’জনকে। সব জন্মের নারীকে ব্যবহার করার যে চালাকি, তা পুরুষতন্ত্র শিখিয়েছে। শিখিয়েছে তোমাদের বঞ্চিত করতে। নারীবাদী কথা বললেও সেই অতি আধুনিকতা তৃতীয় বিশ্বে লক্ষ্য করা যায় না। অনন্ত অবহেলার মিথ কথারা সেই স্বপ্ন জন্মে অবাক হয়ে দেখবে, বৃষ্টি হবে পুষ্পময়। লেখা হবে নতুন মহাকাব্য। মহাকাব্যের আঙ্গিকে মহাভারতের কথা। পাঠক ভাবুক নয়, তবু নতুন দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই আমরা দেখে আসব ইতিহাসে। ইতিহাসের বহু তত্ত্বের মূলে নারীদের পুরুষরা অবহেলা করেছেন। সে কথার মূলে প্রবেশ করব। কিন্তু জানিয়ে রাখি শেষের কথা। আমি হতাশাগ্রস্থ নই। নারীরা যে মহাভারতীয় দৃষ্টিতে সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়েছিলেন তারও দৃষ্টান্ত এই প্রবন্ধে রয়েছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মহাভারত; মহাকাব্য হিসেবে বিবেচিত ধর্মগ্রন্থটি ‘মহাভারতের কথা অমৃতসমান’ বিবেচিত হয়। গবেষকরা বলেন মহাভারতের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ চতুর্থ শতকের মধ্যে এবং কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের কাল খ্রিস্টপূর্ব নবম শতক। মহাভারতে তীব্রভাবে নারী সম্পর্কে মনুসংহিতার প্রভাব লক্ষণীয়। নারী ধারণা হীন হয়েছে; কেন বলছি এসব? আগ্রহী পাঠকদের জন্য কিছু উদাহরণ — মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভীষ্ম, যদিও দ্রৌপদীকে তিনি সত্য মন থেকে ভালবাসতেন, একমাত্র তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন বস্ত্রহরণের সময় তবু তাঁর মধ্যেও স্পষ্টরূপে মনুর ছায়া পরিলক্ষিত হয়, তিনি বলেন (১৩/৩৮), “উহাদের (স্ত্রীলোকদের) মত কামোন্মত্ত আর কেহই নাই। … কাষ্ঠরশি যেমন অগ্নির, অসংখ্য নদীর দ্বারা যেমন সমুদ্রের ও সর্বভূত সংহার দ্বারা অন্তকের তৃপ্তি হয় না, তদ্রুপ অসংখ্য পুরুষ সংসর্গ করিলেও স্ত্রীলোকের তৃপ্তি হয় না।” ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও মুখেও শোনা যায় তীব্র নারী নিন্দা, “উহারা (নারীরা) ক্রিয়া-কৌতুক দ্বারা পুরুষদিগকে বিমোহিত করে। উহাদিগের হস্তগত হইলে প্রায় কোনো পুরুষই পরিত্রাণ লাভ করিতে পারে না। গাভী যেমন নূতন নূতন তৃণভক্ষণ করিতে অভিলাষ করে, তদ্রুপ উহারা নূতন নূতন পুরুষের সহিত সংসর্গ করিতে বাসনা করিয়া থাকে” (১৩/৩৯)। মহাজ্ঞানী পিতামহ ভীষ্মের উপলব্ধি, “মানুষের চরিত্রে যত দোষ থাকতে পারে, সব দোষই নারী ও শূদ্রের চরিত্রে আছে। জন্মান্তরীয় পাপের ফলে জীব স্ত্রীরূপে (শূদ্ররূপেও) জন্মগ্রহণ করে” (ভীষ্মপর্ব ৩৩/৩২); “স্ত্রীগণের প্রতি কোন কার্য বা ধর্ম নেই। (কারণ) তারা বীর্যশূণ্য, শাস্ত্রজ্ঞানহীন।” (অনু, ১৩/৩৯) এরপরেও নাকি মহাভারতের কথা অমৃতসমান! (সূত্র : মনুসংহিতা ও নারী, পৃষ্ঠা ৭২-৭৬) “তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু, মৃত্যু, পাতাল, দাবানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও বহ্নিকে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করিলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান-সমান হবে” (অনুশাসনপর্ব ৩৮)। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ‘সম্পূর্ণ ধর্মগ্রন্থ’ রূপেই এখন গীতার স্থান; এবং কারো কারো কাছে আধুনিক ধর্মগ্রন্থ! গীতাকে বলা হয়, শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী, ভগবদগীতা। কিন্তু এই গীতাতেও দেখি ভগবানের কণ্ঠে মনুর বক্তব্য! শ্রীমদ্ভগবদগীতায় পঞ্চপাণ্ডবের শ্রেষ্ঠ বীর অজুর্নের বলেছেন— “অধর্মাভিভাবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ/স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ॥” (গীতা, ১:৪০) অর্থাৎ “হে কৃষ্ণ, অধর্মের আবির্ভাব হলে কুলস্ত্রীরা ব্যভিচারিণী হয়। হে বার্ষ্ণেয়, কুলনারীগণ ব্যভিচারিণী হলে বর্ণসংকরের সৃষ্টি হয়।” এর পরেই বর্ণসঙ্কর সৃষ্টি হলে কি হয়, তারও উত্তর রয়েছে : “সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘানাং কুলস্য চ/পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ॥” (গীতা, ১:৪১) অর্থাৎ বর্ণসঙ্কর, কুলনাশকারীদের এবং কুলের নরকের কারণ হয়। শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি ক্রিয়ার লোপ হওয়াতে ইহাদের পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয়।” এ প্রসঙ্গে ভগবান(?) শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের বক্তব্য খণ্ডন না করেই বরঞ্চ বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করেন এবং অর্জুনকেও ছাড়িয়ে গিয়ে নারীদের ‘পাপযোনি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন : “মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহ্যপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ/স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেপি যান্তি পরাং গতিম্॥” (গীতা, ৯:৩২) অর্থাৎ “আমাকে আশ্রয় করে স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্র এসব পাপযোনিরাও পরম গতি লাভ করে থাকে।” এরপরই দয়ময় ভগবান ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিদের ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলেন : “কিং পুনর্ব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা/অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্॥” (৯:৩৩) মানে হলো “পুণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে? অতএব আমার আরাধনা করো। কারণ এই মর্তলোক অনিত্য এবং সুখ শুন্য।” গীতা অনুসারে ভগবানের কাছে নারীর আলাদা কোনো জাত বা বর্ণ নেই; সব নারীই পাপযোনিভুক্ত। আমায় এই কথাগুলো কাঁদায়, জানি পেশাদারিত্বে আবেগ থাকতে নেই। তবু পরিণত কোনও ব্যক্তিও জানে নিজের জন্মের উপর ক্রোমোজোম ছাড়া কোনো হাত থাকতে পারে কী? যদি হাত নাই থাকে, তবে নারী, বৈশ্য, শূদ্ররা পাপযোনিভুক্ত হয় কী করে? এ ধরনের নারী বিদ্বেষী বাণী এখানেই শেষ নয়, আরও রয়েছে; প্রচুর পরিমাণে আছে। নারীদের নিয়ে হিন্দু ভগবান থেকে শুরু করে মুনি-ঋষি, ঠাকুর-পুরোহিত, রাজন্যবর্গ কারোর-ই চিন্তার শেষ নেই। তাই তো ঋতুস্রাবের ফলে পুজো না দিতে পারার ভুল নিয়ম আজও প্রচলিত। হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে ভালো নারী গন্ডি ঠিক করে দিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে সতী-সাধ্বী-ধর্মচারিণী হচ্ছে—”ন চন্দ্রসূর্যৌ ন তরুং পুন্নানুও যা নিরীক্ষতে/ভর্তৃবর্জং বরারোহা সা ভবেদ্ধর্মচারিণী॥ (মহাভারত, ১২/১৪৬/৮৮) অর্থাৎ “যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনো পুংলিঙ্গান্ত (নামের বস্তু), চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন করত না, সে-ই ধর্মচারিণী।” স্মার্ট যুগে দেখলেন তো ধর্মচারিণী হতে হলে কি কি গুণ থাকা প্রয়োজন? এতো দেখি পর্দাপ্রথা থেকেও চূড়ান্ত ও উন্মত্ত সংস্করণ! সনাতন ধর্মাবলম্বী লজ্জা হয় এরপরেও কোন মুখে হিন্দুরা দাবি করেন, হিন্দু ধর্ম প্রগতিশীল, তাদের ধর্মে নারী সম্পর্কে কোনো বাজে ধারণা নেই? না জেনেই এগুলো গোপন করে নিজেদের ধর্ম যুগোপযুগী, নারী-মুক্তির পক্ষে কিংবা নারী-মুক্তি হিন্দু ধর্মেই রয়েছে বলে সাফাই গান!! নারীরা অবহেলিত বুদ্ধিজীবীরা, শিক্ষিত, উচ্চ-শিক্ষিতরা মানতেই চায় না। হিন্দুধর্ম নারীকে বিন্দুমাত্র মানুষের মূল্য দেয় না; নারী শুধুমাত্র পণ্য, নারীর নিজস্ব কোনো অধিকার নেই, নেই স্বাধীনতা; এখনো হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিয়ের সময় কন্যাদান করা হয় পুরুষের (স্বামী/প্রভু) কাছে যজ্ঞ-মন্ত্র ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা মেনেই। বৈদিকযুগ থেকেই বিয়ের সময়ই কন্যাদান নয়, অহরহই যে কোনো অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ক্ষত্রিয় রাজা বা ঠাকুর-পুরোহিত-ব্রাহ্মণদের মনোরঞ্জনের জন্য নারীদের দান করা হতো, দেখুন পবিত্র মহাভারতের কিছু নমুনা : মহাভারতের কথিত শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নিজেও যজ্ঞে-দানে-দক্ষিণায় বহু শত নারীকে দান করে দিতেন অবলীলায় অতিথি রাজাদের আপ্যায়নে (আশ্বমেধিকপর্ব ৮০/৩২, ৮৫/১৮)! রাজাদের লালসার তো শেষ নেই! শুধু ক্ষত্রিয় রাজারা ভোগের জন্য নারী পেলে তো হবে না, অমৃতের সন্তান ব্রাহ্মণেরা কী দোষ করল তবে! চিন্তার কিছু নেই, ওদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। শ্রাদ্ধের-দক্ষিণার তালিকাতে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের নারী দান করার বিধান রয়েছে, দেখুন : আশ্রমবাসিকপর্ব ১৪/৪, ৩৯/২০, মহাপ্রস্থানপর্ব ১/৪, স্বর্গরোহণপর্ব ৬/১২,১৩। যাইহোক, এই ইহজগতে না হয় দুদর্মনীয় কামভোগের একটা ব্যবস্থা করা গেল, কিন্তু মৃত্যুর পর কী হবে? মরণের পরেও তো সুখ-শান্তির ব্যবস্থা থাকা চাই। চিন্তা নেই, তারও রেডিমেড ব্যবস্থা আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মতো যুদ্ধ করে মারা গেলে স্বর্গে পাওয়া যাবে অসংখ্য সুন্দরী নারী। প্রমাণ চাই তো নিশ্চয়ই! দেখুন : বনপর্ব ১৮৬-১৮৭, কর্ণপর্ব ৪৯/৭৬-৭৮, শান্তিপর্ব ৬৪/১৭, ৩০; ৯৬/১৮, ১৯, ৮৩, ৮৫, ৮৬, ৮৮, ১০৬; রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ড ৭১/২২, ২৫, ২৬, সুন্দরকাণ্ড ২০/১৩। (সূত্র : প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা ৬৩)। এরপর পুরুষ পুরানো সেই ভাঙা রেকর্ড ‘ভগবানের কাছে নারী-পুরুষ সবই সমান’ এই যুক্তিটি দেবেন না।
হিন্দু শাস্ত্র বলেছে — সন্তান-উৎপাদনের জন্য নারী প্রয়োজন। মহাভারতে স্বামীর মৃত্যুর পর অম্বিকা-অম্বালিকাকে নিয়োগ প্রথায় সন্তান-উৎপাদনের নির্দেশ দ্যান শাশুড়ি সত্যবতী। ভাসুর ব্যাসদেব আসেন। এই প্রথার কথা শুনে আজ নাক কোঁচকালেও মনু এ বিষয়ে কী বলে গেছেন তা পড়ুন – “দেবরাদ্বা সপিন্ডাদ্বা স্ত্রিয়া সম্যঙ্ নিযুক্তয়া।/প্রজ্যেপ্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্য পরিক্ষয়ে॥” মানে হল সন্তানের অভাবে (পতি প্রভৃতি গুরুজন কর্তৃক) সম্যকরূপে নিযুক্ত হয়ে স্ত্রীলোক দেবর বা সপিন্ড থেকে সন্তান লাভ করবে। অপর একটি, “বিধবাযাং নিযুক্তস্তু ঘৃতাক্তো বাগ্য়তো নিশি।/একমুৎপাদয়েৎ পুত্রং না দ্বিতীয় কথঞ্চন॥” অর্থ করলে দাঁড়ায় বিধবাতে (সন্তান উৎপাদনে) নিযুক্ত ব্যক্তি ঘৃতাক্ত দেহে মৌনী হয়ে রাত্রিবেলা একটি পুত্র উৎপাদন করবে, দ্বিতীয় পুত্র কখনোই নয়। ঘি মেখে যাতে শরীরের উত্তাপের আদান-প্রদান না ঘটে, মৌনী হয়ে, যাতে ভালোবাসার কথা না হয়, রাত্রিকালে অন্ধকার থাকে। সেই সময়ে ব্যাসদেব এলেন যান্ত্রিক প্রথায় কামনাহীন মিলনের দায়িত্ব পূরণে, অম্বিকা ব্যাসদেবের রুক্ষ্ম রূপ দেখে চোখ বন্ধ করলেন। জন্ম হল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের…পরে অম্বালিক ব্যাস মূর্তি দেখে ফ্যাকাশে হলেন, জন্ম হল পান্ডুর। যে পুরুষটিকে গ্রহণ করতে অম্বিকা-অম্বালিকার রুচিতে বেধেছে, সেই পুরুষের কাছে নিজেরা পুনরায় না গিয়ে পাঠিয়ে দিলেন দাসীকে। দাসী ব্যাসদেবকে সহজেই গ্রহণ করলেন, জন্ম হল সর্বগুণসম্পন্ন বিদুরের – সে অন্য প্রসঙ্গ।
মহাভারতের অন্য গপ্পে মনসাদেবীর কথা এখানে বলা যেতেই পারে। মনসাদেবীর স্বামী জরৎকারু একদিন মনসার উরুতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। সন্ধ্যা বন্দনার সময় হয়ে যাওয়ায় মনসা স্বামীর ঘুম ভাঙালেন। ক্রুদ্ধ জরৎকারু এই দোষে স্ত্রীকে ত্যাগ করলেন। স্ত্রীত্যাগের কারণ হিসেবে ঘটনাটা বোধহয় ততটাও গুরুতর ছিলেন না। মনু এ প্রসঙ্গে বলেছেন “প্রোথিতো ধর্ম কার্য্যার্থং প্রতীক্ষ্যোহষ্টৌ নরঃ সমাঃ।/বিদ্যার্থং ষড়যশোহর্থং কামার্থং স্ত্রীং ম্ভুবৎসরান॥” অর্থাৎ (স্বামী) ধর্মানুষ্ঠানের জন্য প্রবাসে গেলে (স্ত্রী তার) জন্য আট বছর, বিদ্যার্জন বা যশলাভের জন্য গেলে ছয় বছর এবং (অপর স্ত্রী সম্ভোগরূপ) কামের জন্য গেলে তিনি বছর প্রতীক্ষা করবেন…। আবার “অধিবিন্না তু যা নারী নির্গচ্ছেদ্রুষিতা গৃহাৎ।/সা সদ্যঃ সন্নিরোদ্ধত্য ত্যজ্যা বা কুলসংন্নিধৌ॥” অর্থটি হল যে অধিবিন্না নারী রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে (দড়ি প্রভৃতি দিয়ে) বেঁধে রাখা উচিত অথবা পিত্রাদির সমক্ষে তিনি পরিত্যাজ্যা। এখানে দেখতে পাওয়া যায় স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা সম্পর্কটি এক দাঁড়িপাল্লার অনন্ত অসমানে ন্যস্ত। আর স্বামী ত্যাগ করলে মনসার হয়ে মহাদেব ও মনসার বাবা কশ্যপ জরৎকারুকে বোঝাতে আসেন। বলেন – স্ত্রীকে ত্যাগ করতে হলে পুত্রোৎপাদন করেই ত্যাগ করা উচিত। জরৎকারু পুত্র উৎপাদন করেই স্ত্রীকে ত্যাগ করে চলে গেলেন।
মহাভারতের আদিপর্বে রাজা কস্মাষপাদের স্ত্রী মদয়ন্তীর গল্পও বুঝিয়ে দ্যায় নারীর সন্তান উৎপাদক হিসেবে উপযোগিতাই একমাত্র বিচার্য ছিল। মদয়ন্তীকে পুত্র উৎপাদনে অক্ষম রাজা স্বয়ং বশিষ্ঠের হাতে প্রদান করেন সন্তান উৎপাদন করার জন্য। একথা খুব স্পষ্ট, সন্তান-উৎপাদনে নারীর অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলন সমাজে স্বীকৃত ছিল।
নারীবিদ্বেষী পুরুষের দল ছিল। থাকবেও। তবে সময়ের নিয়মে, নারীবিদ্বেষীর উলোটপুরাণ মহাভারতেই রয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, মহাভারত রচিত হয়েছিল দীর্ঘ কাল ধরে। অর্থাৎ, মহর্ষি বেদব্যাস রচিত ভারতকথার উপরে যুগে যুগে সংযোজিত হয়েছে নতুন কাহিনী, উপকাহিনী ইত্যাদি। সেই সঙ্গে কালের প্রভাব এসে পড়েছে চরিত্রগুলির উপরেও। তবে একথাও ঠিক, এমন কিছু চরিত্রকে আমরা এই মাহাকাব্যে দেখতে পাই, যাঁরা যে কোনও কালের থেকেই এগিয়ে —
১. গঙ্গা— শান্তনুপত্নী গঙ্গাকে অনেক সময়েই অনৈতিক বলে মনে হতে পারে পাঠকদের। কিন্তু গঙ্গা নারীত্বের ‘স্বাভাবিক’ লক্ষণগুলিকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন বলেই মনে হয়। শান্তনু তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে বিবাহপ্রস্তাব দিলে গঙ্গা তাঁকে তিনটি শর্তে বিবাহ করতে রাজি হন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল এই— তাঁর কোনও কাজকে শান্তনু প্রশ্ন করতে পারবেন না। এই শর্ত কি আজকের মেয়েরাও দিতে পারেন?
২. সত্যবতী— শান্তনুর দ্বিতীয়া পত্নী সত্যবতী আর এক দুঃসাহসী মহিলা। তিনি জানতেন, তাঁর দুই স্বল্পায়ু পুত্রের অবর্তমানে কুরু-সিংহাসন শূন্য হয়ে যাবে। তাই পুত্রদের মৃত্যুর পরে তিনি তাঁদের বিধবা অম্বিকা ও অম্বালিকাকে গর্ভবতী করার জন্য ব্যাসদেবকে নিয়োগ করেন।
৩. অম্বা— কাশীর জ্যেষ্ঠা রাজকন্যা অম্বা শল্যের প্রেমে পড়েন এবং স্বয়ম্বরে তাঁকেই বরমাল্য প্রদান করবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু ভীষ্ম তাঁকে অপহরণ করায় তাঁর পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়। তাঁর দুই বোন অম্বিকা আর অম্বালিকাকেও ভীষ্ম একই সঙ্গে অপহরণ করে তাঁর ভাইদের সঙ্গে বিবাহ দেন। অম্বা বিবাহ করেননি। তিনি ভীষ্মকে ক্ষমাও করেননি। পরের জন্মে শিখণ্ডী হিসেবে অবতীর্ণ হয়ে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হন। অতুলনীয় এক নারী চেতনা।
৪. কুন্তি— কুন্তীর সবথেকে উল্লেখযোগ্য কাজটি তাঁর সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত এবং দেবতাদের দ্বারা তাঁর গর্ভধারণের বিষয়টিকে গোপন না করা। বিবাহের পূর্বে সন্তান কর্ণের জন্মদান। এখনও নারী আধুনিকতাকে তা অতিক্রম করে।
৫. গান্ধারী— অসামান্য পতিব্রতা গান্ধারী স্বামীর অন্ধত্বকে নিজের বলেই মেনে নেন এবং সমগ্র মহাভারতে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গ এক মুহূর্তের জন্যও ত্যাগ করেননি। এটাও নারীর ত্যাগের অনন্ত এক রূপ।
৬. দ্রৌপদী— পাঞ্চালীর পঞ্চস্বামী বরণ ছাড়াও অসংখ্য কাজ রয়েছে, যাকে আজকের প্রেক্ষিতেও ভাবা অসম্ভব। সবথেকে বড় কথা তাঁর সম্মানবোধ। কীচক থেকে দুঃশাসন পর্যন্ত ঘটনাকে মনে রাখা জরুরি।
৭. হিড়িম্বা— বিবাহের পরে ভীম হিড়িম্বাকে ত্যাগ করেন। পুত্র ঘটোৎকচকে একাই বড় করে তোলেন এই নারী। তাঁর স্বাবলম্বন শিক্ষণীয় বিষয়।
৮. উলুপী— নাগরাজকন্যা উলুপী অর্জুনের প্রেমে পড়েন। এবং বিস্তর বাধা অতিক্রম করে তাঁকে বিবাহ করেন। কার্যত তিনি অর্জুনকে বিবাহপ্রস্তাব দিতে বাধ্য করেছিলেন।
৯. ঊর্বশী— ঊর্বশীও অর্জুনকে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অপ্সরা, দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় আবদ্ধা। অর্জুন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি অর্জুনকে পুরুষত্বহীনতার শাপ দেন। তিনি অর্জুনের বিক্রমের সামনে মাথা নত করেননি।
১০. সুভদ্রা— কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাও অর্জুনকে ভালবাসতেন। তিনি অর্জুনকে সহায়তা করেন তাঁকে অপহরণ করতে। এমন কাজ মহাভারতেও অভূতপূর্ব।
কৃষ্ণ কথায় মনে পড়ে গেল রাধার কথা। প্রথমেই বলে রাখা ভাল, কোনও প্রাচীন গ্রন্থেই শ্রীরাধাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, শ্রীরাধা অনেক পরের কল্পনা। শ্রীময়ীর চরিত্রে একদিকে যেমন মিশেছে পদাবলির কবিদের মরমিয়া প্রেম, তেমনই অন্যদিকে এতে পৃক্ত হয়ে রয়েছে সুফি সাধকদের মর্মভাবনাও। আবার তাতে মিলেমিশে গিয়েছে লোকজীবনের সুখ-দুঃখ। এই সব একাকার হয়েই জন্ম দিয়েছে শ্রীরাধার মতো এক আশ্চর্যময়ীর। তিনি একদিকে যেমন হ্লাদিনীশক্তির প্রকাশ, তেমনই অন্যদিকে তিনি মূর্ত প্রেম।
তাসত্ত্বেও রাধাকৃষ্ণের কাহিনীকে সর্বদাই অসম্পূর্ণ বলে মনে হয় কেন? কেন বার বার মনে প্রশ্ন জাগে, শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী কি বৃন্দাবনেই শেষ? বৈষ্ণব কবিরা অবশ্য এমন কথা মানতে নারাজ। কৃষ্ণের মথুরা গমনের পরে তাঁরা রাধার চিত্তে ভাবসম্মিলনের কথা বার বার লিখে গিয়েছেন। কিন্তু সে তো কবিকল্পনা। পুরাণ বা অন্য গ্রন্থাদি কী জানায় শ্রীরাধা সম্পর্কে? কৃষ্ণবিহনে তাঁর কী হল?
কৃষ্ণ মথুরা যাওয়ার আগে রাধাকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু সেই কথা কি আর রাখা হয়নি? অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটে গিয়েছিল কি শ্রীরাধার জীবন? মথুরায় কৃষ্ণ রুক্মীনিকে বিবাহ করেন। তিনি বিদর্ভ রাজকন্যা। ছোটবেলা থেকেই রুক্মীনি কৃষ্ণের কথা শুনে এসেছিলেন, তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বিবাহ স্থির হয় রাজা শিশুপালের সঙ্গে। রুক্মীনি কৃষ্ণকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন তাঁকে উদ্ধার করতে। কৃষ্ণ আসেন এবং রুক্মীনিকে হরণ করে বিবাহ করেন।
মহাভারতের এই কাহিনী থেকে পরে একটা প্রশ্ন উদিত হয়, যদি কৃষ্ণের মনপ্রাণ জুড়ে শ্রীরাধা বিরাজ করে থাকেন, তবে কীভাবে তিনি রুক্মীনিকে বিবাহ করতে পারেন? আসলে কৃষ্ণ ভগবান। উনি করলে লীলা আর আমরা… মজার ব্যাপার, ‘মহাভারত’-এ কোথাওই শ্রীরাধার নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই। কিন্তু গণচিত্তে রাধাকল্পকে বিচার করলে এমন কিছু বিষয় উঠে আসে, যার মানে বোঝা সত্যিই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। সেগুলি এই প্রকার—
• শ্রীরাধার জন্মদিন ‘রুক্মীনি অষ্টমী’ হিসেবে পালিত হয়।
• রুক্মীনিকে রাধারই আর এক রূপ বলে অনেকে মনে করেন।
এখান থেকে মনে হতেই পারে, রাধা আর রুক্মীনি একই চরিত্র। রুক্মীনি রাধারই আর এক রূপ। বহু পুরনো মন্দিরে কৃষ্ণ ও রুক্মীনির মূর্তি রয়েছে, যার সঙ্গে রাধা-মূর্তির কোনও পার্থক্যই নেই। ‘মহাভারত’-এ রাধার উল্লেখ না থাকলেও এক গোপিনীর কথা রয়েছে, যিনি বৃন্দাবনে কৃষ্ণের প্রিয়তম সহচরী ছিলেন। তিনিই কি রুক্মীনি ওরফে রাধা? এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, রুক্মীনি রাজকন্যা আর রাধা সাধারণ গোপবালা। তাঁরা এক হন কী করে? এর উত্তর ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পুরাণে। এখানে একটি আশ্চর্য গল্প রয়েছে। রাক্ষসী পুতনা নাকি শিশু রাজকন্যা রুক্মীনিকে হরণ করে। কিন্তু রুক্মীনির ওজন অলৌকিকভাবে বেড়ে যায়। পুতনা তাঁকে একটি পদ্মফুলের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। তখনই বৃষভানু তাঁকে খুঁজে পান এবং রাধা হিসেবে পালন করতে থাকেন। কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে যাওয়ার পরে বিদর্ভরাজ হারিয়ে যাওয়া কন্যার সন্ধান পান এবং তাঁকে তাঁর গৃহে নিয়ে যান। এই কাহিনী মানলে, রাধাই রুক্মীনি। এবং কৃষ্ণ তাঁকেই বিবাহ করেন।
সাহিত্যের দিক থেকেও নজরুলে নারী পৃথিবীর সমস্ত কল্যাণের অর্ধেক কৃতিত্বের দাবিদার হয়েছে। পুরুষের প্রেরণার উৎস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর কবিগুরু তার অসংখ্য রচনায় নিখুঁতভাবে ধরে রেখেছেন নারীর প্রতি পুরুষের লিপ্সা আর স্বেচ্ছাচারিতার চিত্রগুলো। শরৎ সাহিত্যে অনেক প্রগতিশীল নারীর সন্ধান পাওয়া গেলেও তাদের কারও ভাল পরিণতির কথা জানা যায় না। আমরা সেই সাহিত্যগুলো জানি। সেই সব সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করা প্রজন্মও পেয়েছি। শুধু পাইনি কোন রদবদল, না সমাজে, না দৃষ্টিভঙ্গি আর মূল্যবোধে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে নারীর প্রতি পুরুষের মূল্যবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গি আটকা পড়ে আছে বিষাদসিন্ধু, হেলেন অব ট্রয় আর মহাভারতে, যেখানে পৃথিবীর কিছু মহাধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী করা হয়েছে নারীকে। ফলাও করা হয়েছে নারীর হীনবল আর পরনির্ভশীলতাকে। সুচতুর ভাবে প্রচ্ছন্ন রাখা হয়েছে নারীর গঠনমূলক ক্ষমতা, অবমূল্যায়িত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। যেখানে নারী কেবলই পুরুষের অধিকার, আজ্ঞাবহ, অর্জিত সম্পত্তি আর মনোরঞ্জনের বস্তুমাত্র। অনেকে প্রগতিশীল নারীর ব্যাপারে সেই মধ্যযুগকেই প্রাধান্য দেন। ক্ষেত্রবিশেষে আদিম বা প্রাগৈতিহাসিক মূল্যবোধ বললেও অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না।
যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হিংসা-সভ্যতার যে কোন পরিবর্তন, যে কোন নিয়ামক, সর্বাধিক এবং সর্বাগ্রে আক্রান্ত করে নারীকে। ভেলেনতিনা তেরেসকোভা, মাদাম কুরি, সুলতানা রাজিয়া, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, মাদার টেরেসা এবং অগণিত নারীকে পেছনে ফেলে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে আপন গতিতে সদাধাবমান সভ্যতা। ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে। সভ্যতার মাড়িয়ে যাওয়া অতীতের নির্যাস নিংড়েই বাড়তে থাকে ইতিহাসের কলেবর। ইতিহাস সভ্যতাকে ঋণী করে রেখেছে সেই নারীর কাছে, যিনি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন বীজ থেকে চারা গজায়। আদিম যাযাবর গুহাবাসী মানবরা শিকার ও ফলমূলের প্রাচুর্য অনুসারে কোন কোন জায়গায় সাময়িক থিতু হতো। তখনও নারীর ভূমিকা ছিল সন্তান লালনপালন এবং অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণমূলক কাজ। তাই এটাই বেশি গ্রহণযোগ্য যে, এসব ভূমিকা পালন করতে করতে কোন এক সচেতন নারীরই দৃষ্টিগোচর হয়েছিল যে, তাদের আহার করা ফলমূলের উচ্ছিষ্ট থেকে গজিয়ে উঠেছে একই ফলের কচি কচি চারা। সেই থেকে আসে চাষাবাদের ধারণা। ক্রমান্বয়ে আসে স্থায়ী বসবাস, মালিকানা, সমাজ, শাসন ব্যবস্থা। সচল হয় সভ্যতা এবং প্রগতির চাকা। এভাবেই সেই চারাগাছের সঙ্গে সঙ্গে নারীর হাতেই অঙ্কুরিত হয় সভ্যতা আর প্রগতির প্রথম বীজ। তথাপি কোন এক বিচিত্র কারণে নারীর জীবন এবং সভ্যতায় প্রগতির প্রবাহ সদা বিপরীতমুখী। তার মূল কারণ দেখতে গেলে বেদ ও সংহিতার প্রতি দৃষ্টিপাত করতেই হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মিথ সময় থেকেই অবদমিত করেছে নারী চেতনাকে।
হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। এজন্য অনেকে হিন্দুধর্মকে বৈদিক ধর্ম হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। হিন্দুধর্মের বেদ চারটি; যথা ঋগবেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ ও যজুর্বেদ। এই যজুর্বেদ দুই ভাগে বিভক্ত—একটি হচ্ছে কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তরীয় সংহিতা অন্যটি শুক্লযজুর্বেদ; এই শুক্লযজুর্বেদ আবার দুই ভাগে বিভক্ত, একটি শতপথ ব্রাহ্মণ এবং বৃহদারণ্যকোপনিষদ। শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে তুলনা করা হয়েছে এভাবে, “সে ব্যক্তিই ভাগ্যবান, যার পশুসংখ্যা স্ত্রীর সংখ্যার চেয়ে বেশি” (২/৩/২/৮)। শতপথ ব্রাহ্মণের এ বক্তব্যকে হয়তো দরদী ধর্মবাদীরা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে যৌক্তিকতা দিতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু পরের আরেকটি শ্লোকে পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিতে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান; “বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে দুর্বল করা উচিত, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকতে পারে” (৪/৪/২/১৩)। এর থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্যের আর প্রয়োজন আছে? বৃহদারণ্যকোপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবাল্ক্য বলেন, “স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগকামনা চরিতার্থ করতে অসম্মত হলে প্রথমে উপহার দিয়ে স্বামী তাকে ‘কিনবার’ চেষ্টা করবে, তাতেও অসম্মত হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে নিজের বশে আনবে” (৬/৪/৭, ১/৯/২/১৪)। দেবীভাগবত-এ নারীর চরিত্র সম্পর্কে বলা আছে (৯:১): “নারীরা জোঁকের মত, সতত পুরুষের রক্তপান করে থাকে। মুর্খ পুরুষ তা বুঝতে পারে না, কেননা তারা নারীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে পত্নী মনে করে, সেই পত্নী সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য এবং কুটিল প্রেমালাপে ধন ও মন সবই হরণ করে।” বাহ্! হিন্দুরা না-কি মাতৃজ্ঞানে দেবীর (দুর্গা, কালি, মনসা, সরস্বতী, লক্ষ্মী) পুজো করে? ‘নারী’ সম্পর্কে যাদের ধর্মীয় বিধানে এমন হীন বক্তব্য রয়েছে, তারা দেবীর পুজো করলেই কী আর না-করলেই কী? ঋগবেদ বা অন্যান্য বেদ, উপনিষদে কয়েকজন বিদুষী ও শাস্ত্রজ্ঞ নারীর নাম জানা যায়, যারা বিভিন্ন শ্লোক রচনা করেছিলেন; তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হচ্ছেন লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, গার্গী, বাৎসী, বাক্, অপালা, সূর্যা, ইন্দ্রাণী প্রভৃতি। আধুনিককালে কেউ কেউ এই বিদুষী নারীদের নাম দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে চান, সেকালে নারীরা কতটুকু স্বাধীন ছিল যে, তাঁরা বেদের শ্লোক পর্যন্ত রচনা করেছিলেন! অস্বীকার করা যাবে না, সেকালে কয়েকজন নারী শ্লোক-মন্ত্র রচনা করে শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের স্বতন্ত্র্য অবস্থান প্রমাণ করে গেছেন। কারণ ধর্মগ্রন্থকে ঘিরেই ছিল সেকালের শিক্ষা। তবে একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে, তৎকালীন সমাজে এ বিদুষী নারীদের অবস্থান কি রকম ছিল? (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে রচিত) বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায়, খ্যাতনামা ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য এবং অন্যান্য ঋষিদের সাথে এক সভায় ঋষি বাচাক্লুর কন্যা গার্গী ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে তর্কে লিপ্ত হয়ে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন। একসময় যাজ্ঞবল্ক্য ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠেন, “হে গার্গী, আর বেশি প্রশ্ন করো না, তাহলে তোমার মাথা খসে পড়ে যাবে!” (৩/৬/১); যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্যে গার্গী থেমে গেলেন পরবর্তীতে স্বীকার করলেন, ব্রহ্মবিদ্যায় যাজ্ঞবল্ক্যকে কেউ পরাজিত করতে পারবে না (৩/৮/১-১১)। আবার যে নারীরা বেদের-উপনিষদের শ্লোক-মন্ত্র রচনা করেছেন, সেই নারীদের উত্তরসূরীদের জন্য মনু বেদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, “নারীরা ধর্মজ্ঞ নয়, এরা মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় (অশুভ) এই শাস্ত্রীয় নিয়ম” (মনুসংহিতা, ৯/১৮)।
হিন্দুধর্মের ইতিহাসে সেই কুখ্যাত সতীদাহ বা সহমরণের কথা প্রথম জানা যায় অথর্ববেদে, “…জীবিত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মৃতের বধু হতে” (১৮/৩/৩); “এই নারী পতিলোকে যাচ্ছে, এ প্রাচীন রীতি অনুসরণ করছে…” (১৮/৩/৩/১)। এ প্রাচীন রীতি কত পুরানো? এটি আর্য না প্রাগার্য সংস্কৃতি? কারণ আমরা ইন্দো-ইয়রোপীয় অন্য সভ্যতাগুলিতে আমরা সহমরণের কথা তো পাই না। উত্তরগুলো আমার জানা নেই। তবে পাঠক, আপনারা হয়তো ইতিহাস পাঠের কারণে জানেন, এই বাংলায় ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তের বছরে ব্রাহ্মণ্যবাদীর দল পুণ্যলাভের আশায় আর নারীর সতীত্ব (?) রক্ষার ধুয়া তুলে ৮১৩৫ জন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে সতী বানিয়েছিল! একটু ভাবুন তো, একটি নিরাপরাধ মেয়েকে টেনে-হিচড়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলছে, পাশে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সক্কলে দাঁড়িয়ে ‘বল হরি বল’ কীর্তন গেয়ে নিজেদের স্বর্গে যাবার আয়োজন করছে, ভাবতেই তো গা গুলিয়ে উঠে! মানুষ কী পরিমাণ পাষণ্ড-হারামি-ধর্মান্ধ হলে এরকম কাজ করতে পারে? ‘ধর্ম’ নামক আফিমীয় মাদক মানুষকে কতটুকু নিবোর্ধ-মানবিকতাশূণ্য বানিয়ে দেয়, তারই উদাহরণ হতে পারে উপমহাদেশের এই সতীদাহ প্রথা।
হিন্দু আইনের মূল উৎস হচ্ছে এই ‘মনুসংহিতা’ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছেও এটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য। এই ধর্মগ্রন্থে নারীর কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,”বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ/পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিক্রিয়া॥” (২:৬৭), অর্থাৎ স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহেবাস এবং গৃহকর্ম তাদের (হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা; আবারও বলে দেয়া হয়েছে নারীর কর্তব্যগৃহকর্ম এবং সন্তান উৎপাদন (৯:২৬)। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই নারী এবং সন্তান উৎপাদনার্থে পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে (৯:৯৬)। যে সকল নারী একদা বৈদিক মন্ত্র-শ্লোক পর্যন্ত রচনা করেছিলেন, তাদের উত্তরসূরীদের জন্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত-অমন্ত্রক (২:৬৬); নারী মন্ত্রহীন, অশুভ (৯:১৮)। কন্যা, যুবতী, রোগাদি পীড়িত ব্যক্তির হোম নিষিদ্ধ এবং করলে নরকে পতিত হয় (১১:৩৭)! স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে (৫:১৫৪) “বিশীলঃ কামবৃত্তো বা গুণৈর্বা পরিবর্জিতঃ/উপচর্যঃ স্ত্রিয়া সাধ্ব্যা সততং দেববৎ পতিঃ॥” বাংলা করলে দাঁড়ায়, স্বামী দুশ্চরিত্র, কামুক বা নির্গুণ হলেও তিনি সাধ্বী স্ত্রী কর্তৃক সর্বদা দেবতার ন্যায় সেব্য। পরবর্তী শ্লোকে রয়েছে, কোনো নারী (স্ত্রী) যদি স্বামীকে অবহেলা করে, ব্যভিচারিণী হলে সংসারে তো নিন্দিত হবেই সাথে-সাথে যক্ষা, কুষ্ঠ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়, শুধু তাই নয় পরজন্মে শৃগালের গর্ভে জন্ম নিবে সেই নারী (৫:১৬৩-১৬৪)। স্ত্রীদের জন্য স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো ব্রত বা উপবাস নেই, শুধু স্বামীর সেবার মাধ্যমেই নারী স্বর্গে যাবে (৫:১৫৫)। সাধ্বী নারী কখনো জীবিত অথবা মৃত স্বামীর অপ্রিয় কিছু করবেন না (৫:১৫৬)। স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের কি করতে হবে “কামন্তু ক্ষপয়েদ্দেহং পুস্পমূলফলৈঃ শুভৈঃ/ন তু নামাপি গৃহ্নীয়াৎ পত্যৌ প্রেতে পরস্য তু॥” (৫:১৫৭), সহজ ভাষায় বাংলা করলে হয়, স্ত্রী সারা জীবন ফলমূল খেয়ে দেহ ক্ষয় করবেন, কিন্তু অন্য পুরুষের নামোচ্চারণ করবেন না। কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে স্বামী কি করবেন, “ভার্যায়ৈ পূর্বমারিণ্যৈ দত্ত্বাগ্নীনন্ত্যকর্মণি/পুনর্দারক্রিয়াং কুর্যাৎ পুনরাধানমেব চ॥” (৫:১৬৮), এই শ্লোকেরও বাংলা শুনুন, দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করে স্বামী আবার বিয়ে এবং অগ্ন্যাধ্যান করবেন। সত্যি! নারী-পুরুষের মধ্যে কী চমৎকার সমতা!! কেউ কেউ বলেন, ‘মনুবাদ’ থেকেই না-কি ‘মানবতাবাদ’ এসেছে! দারুন! ধন্য মোরা মনুর প্রতি! আবার এই ‘মনুবাদ’ না-কী হিন্দু আইনের উৎস! নারীর গুণাবলী নিয়ে মনু বলেন, নারীর কোনো গুণ নেই, নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিশে লবনাক্ত (সমুদ্রের গুণপ্রাপ্ত) হয়, তেমনই নারী বিয়ের পর স্বামীর গুণযুক্ত হন (৯:২২)। নারীর স্বাধীনতা সম্পর্কে মনুর সংহিতাতে বলা আছে : “অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্য্যাঃ পুরুষৈঃ স্বৈর্দ্দিবানিশম্/ বিষয়েষু চ সজ্জন্ত্যঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে॥” (৯:২), অর্থাৎ স্ত্রীলোকদের স্বামীসহ প্রভৃতি ব্যক্তিগণ দিনরাত পরাধীন রাখবেন, নিজের বশে রাখবেন…; আবার এর পরেই আছে বিখ্যাত সেই শ্লোক : “পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে/রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥” (৯:৩) অর্থাৎ স্ত্রীলোককে পিতা কুমারী জীবনে, স্বামী যৌবনে ও পুত্র বার্ধক্যে রক্ষা করে; (কখনও) স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। এখন যারা (সনাতনবাদীরা) নারীমুক্তির বিষয়ে নিজ ধর্মের পক্ষে সাফাই গান, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই শ্লোক
দেখে তারা কী ব্যাখ্যা দেবেন? নিশ্চয়ই আমতা আমতা করে ছলনা-শঠতার মাধ্যমে যৌক্তিকতা (বাস্তব উপযোগিতা) দানের চেষ্টা করবেন, কিংবা অস্বীকার করে বসবেন, আদৌ এ ধরনের কোনো শ্লোক কোথাও নেই! নারী সম্পর্কে ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে আছে সমগ্র মনুসংহিতা জুড়েই; নারীনিন্দায় মনুসংহিতা শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে গেছে। মনুর দৃষ্টিতে নারী স্বভাবব্যভিচারিণী, কামপরায়ণা; কাম, ক্রোধ, পরহিংসা, কুটিলতা ইত্যাদি যত খারাপ দোষ আছে, সবই নারীর বৈশিষ্ট্য, এসবই দিয়ে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে! তবু সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এসব কিছুই নজরে আসে না, তাঁরা উদয়-অস্ত খুঁজে বেড়ান ইসলামধর্ম, খ্রিস্টানধর্ম, বৌদ্ধধর্ম নারীদের কোন্ অধিকার দিয়েছে, আর কোন্ অধিকার দেয়নি! আলোচনায় মশগুল কোথায় কোন মুসলিম দেশে নারীদেরকে পাথর ছুড়ে হত্যার ফতোয়া দেওয়া হল, বোরকা চাপিয়ে দেয়া হল, কিংবা কোথায় হিল্লা বিয়েতে নারীকে বাধ্য করা হল! এ নিয়েই তাদের মাথা-ব্যাথা! হিন্দুধর্মের এমন স্ববিরোধী, মানবতাবিরোধী, নারী-বিদ্বেষী চরিত্র জানার পরও কোন্ যুক্তিতে হিন্দুধর্মকে আধুনিক-প্রগতিশীল দাবি করা হয়? নারীর প্রতি এতো বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা আর কোনো ধর্মে আছে কি-না আমার জানা নেই? ধর্মগুরু, ঈশ্বরতুল্য মনু ঠিক কী পরিমাণ নারী-বিদ্বেষী হলে বলতে পারেন : “নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ/সুরূপং বা বিরূপং বা
পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে॥” (৯:১৪), অর্থাৎ “যৌবনকালে নারী রূপ বিচার করে না, রূপবান বা কুরূপ পুরুষ মাত্রেই তার সঙ্গে সম্ভোগ করে।” (বাহ্! মনে হয় তাদের নিজেদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র!); আসুন, একই রকম আরেকটি মনুর শ্লোক দেখি “স্বভাব এস নারীনাং নরাণামিহ দূষণম্/অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ॥” (২:২১৩) অর্থাৎ “নারীর ভাবই হলো পুরুষদের দূষিত করা…”!
অনেকে হয়তো ভাবছেন, নারীর প্রতি এতো অবমাননা, অশ্লীল বক্তব্য থাকার পরও নারীরা এ হীন অবস্থানকে মেনে নিলেন কেন? প্রশ্নটা আমাকেও ভাবিয়েছে অনেকদিন। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়, তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা শুধু এগুলোকে ধর্মীয়-বিধান বলেই মানতে বাধ্য হয়েছিলেন; না হলে নির্ঘাত বিদ্রোহ হত। সেকালে নারীরা কোনো ধরনের শিক্ষা পাননি; খুব পরিকল্পিত ভাবেই তাদেরকে ধর্মগ্রন্থ এবং অন্যান্য জ্ঞানার্জন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। নারীর সকল রকম মানবিক ও সামাজিক অধিকারকে অস্বীকার করে পুরুষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল ভোগের জন্য আর সন্তান উৎপাদনের জন্য; তবে সে সন্তান হতে হবে ছেলে। মেয়ে জন্মের পরই মাথায় ঢুকানো হত ‘জন্মান্তরবাদ’ ও ‘কর্মবাদ’-এর তত্ত্ব। মনুর মতো শাস্ত্রকাররা নারীদের বুঝাতেন, নারীর জন্ম হল আজন্ম পাপের ফল…! মনুসংহিতাসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণপুরুষ কর্তৃক রচিত ওগুলো একেকটা ‘পুরুষসংহিতা’; নারীদের (যে বর্ণের হোক) জন্য নয় ওগুলো। নারী যদি মুক্তি চায়, প্রগতির দিকে হাঁটতে চায়, নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে চায় পূর্ণরূপে, তবে অবশ্যই-অবশ্যই তাদের ‘ধর্মকারায়’ বজ্র হেনে বেড়িয়ে আসতে হবে।
‘সনাতন ধর্মে’র দৃষ্টিতে নারী অনন্ত বিজয় দাশ যে কোনো দেশ-কাল-প্রেক্ষাপটের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দেখা যায় অনিবার্যভাবেই নারীর অবস্থান নিয়ে আলোচনা চলে আসে; অর্থাৎ আমরা চাই বা না-চাই, নারীর অবস্থান দিয়ে বিবেচনা করা হয়, ঐ দেশ-কাল-প্রেক্ষাপট কতটা আধুনিক, কতটা প্রগতিশীল-মানব-কল্যাণকামী, কিংবা কতটা অনাধুনিক, প্রগতিবিরোধী, জড়-বন্ধ্যাগ্রস্থ; কারণ অবশ্য আছে—নারী সর্বত্রই, সর্বদা সমাজের অর্ধেক, তা সত্ত্বেও নারী যুগ-যুগ ধরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার যাতাকলে পড়ে নিষ্পেষিত-নিগৃহীত-নির্যাতিত হচ্ছে। এ সমাজে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র আর সম্পত্তির উপর পূর্ণ অধিকার স্বীকার তো অনেক দূরের বিষয়, পরিবারের অবৈতনিক দাসী, সন্তান উৎপাদনের যৌনযন্ত্র, আর পুরুষের চিত্ত-বিনোদনের খোরাক কিংবা ভোগ্যপণ্য হওয়া ছাড়া নারীর আর কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা আছে, তা মানতে এখনো সমাজের অনেকেই ইতঃস্তত বোধ করেন, দ্বিধান্বিত হন। জানি, কোথাও কোথাও ব্যতিক্রম হয়তো আছে; যেমন যাযাবর জাতি, পর্বতবাসী, বনবাসী, দ্বীপবাসী প্রভৃতি কিছু প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান ঊর্ধ্বমুখী, নারীর মর্যাদা পুরুষের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ। কিন্তু এ কথাও সত্য, পুরুষের বাহুবল, তথাকথিত লিঙ্গ-বৈষম্য, ধর্মীয় বিধি-বিধান-শাস্ত্র-পুরোহিতের প্রতাপ-প্রপাগান্ডা, উৎপাদনব্যবস্থা-প্রযুক্তির দ্রুত বিশ্বায়নের চাপের ফলে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মোড় নিচ্ছে। ফলে সারা বিশ্বেই নারীকে শোষণ-নিপীড়ন-শৃঙ্খলিত করার ব্যাপ্তি দীর্ঘতর হচ্ছে। আবার ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যেই পিতৃতান্ত্রিকতার বিপক্ষে নারীর অধিকার রক্ষা, নারী-মুক্তি-স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে উঠছে। সমাজে নারীর বর্তমান অবস্থান নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে; নারীর পরাধীনতার শিকলকে ভেঙে চুড়ে দেবার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষিত হচ্ছে দিকে দিকে; হাজার-হাজার বছরের জীর্ণ ধ্যান-ধারণা, প্রথা আর নিয়মের বেড়াজাল নির্মোহে ভেঙে নারীর ক্ষমতায়নের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চলছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই কায়েমী স্বার্থবাদীরা নিজের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত, তটস্থ। দেখা যায় সুদূর অতীতকাল থেকে কায়েমী গোষ্ঠী সমাজের কোনো না কোনো অংশকে, শ্রেণী-বর্ণ-সম্প্রদায়কে (সামগ্রিক অর্থে নারীকে) দাবিয়ে রেখে, শোষিত করে নিজের আখের ঠিক রাখার জন্য ঐশ্বরিক বিধান-শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে আসছে; বরাবরের মতো শাষকগোষ্ঠীর মন্ত্রণাদাতা (পঞ্চম বাহিনী) এ সমাজের কথিত ‘বুদ্ধিজীবী’ (অধ্যাপক, কবি, লেখক, নাট্যকার, ইতিহাস-রচয়িতা, সহজ ভাষায় আমাদের এখানে যাদের ‘সুশীল সমাজে’র প্রতিনিধি বলা হয়) এক্ষেত্রে নিরলস সহযোগিতা করেছে। কেউ বা নারীকে পূর্ণ মানবরূপে বিবেচনা না করে, জৈবিক সত্তাকে অস্বীকার করে, তথাকথিত কাব্যিক ব্যঞ্জনায় ‘অর্ধ-মানবী’ বিশেষণে ভূষিত করে নারীকে রহস্যময় বানিয়েছে! এতে পিতৃতন্ত্রেরই দারুন লাভ; ভুলিয়ে-ভালিয়ে আরো কিছুদিন নারীকে অন্তপুরে অথবা অধঃস্তন করে রাখা সম্ভব। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে পিতৃতন্ত্রের গর্বিত প্রতিনিধি আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুল প্রচলিত গানের কলি : ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী!/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি।’ কিংবা ‘অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা’। কবিদের চোখে নারী অর্ধেক কল্পনা তো বটেই, সাথে ওই ‘মানবী’টুকুও কল্পনা; অর্থাৎ নারী এক সম্পূর্ণ অবাস্তব সত্তা বা ভাব। নারীর জৈব সত্তার কোনো স্বীকৃতি তাঁদের কাছে নেই। ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১৯) বলেন— “পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা নারী সৃষ্টি না করলেও নারী ধারণাটি পুরোপুরি পুরুষের সৃষ্টি : পুরুষ নারীকে নানা শব্দে শনাক্ত করেছে, নারীর সংজ্ঞা রচনা করেছে, সংজ্ঞার ভাব ব্যাখ্যা করেছে, নারীর অবস্থান নির্দেশ করেছে, নারীর জন্য বিধি প্রণয়ন করেছে, এবং নিযুক্ত করেছে নিজের কামসঙ্গী ও পরিচারিকার পদে।”
আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে জৈবিক নারীকে এমনভাবে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া হয়, জন্মের পর থেকেই, যাতে তাদের মধ্যে নারীত্ব বা নারীধর্ম প্রবলরূপে বিকাশ লাভ করে। নারীত্ব বা নারীধর্ম বলতে কী বোঝায়? সোজা ভাষায় বলা যায় : ‘পুরুষের (পিতা, ভাই, স্বামী) আজ্ঞাবাহী সদাসেবায় নিয়োজিত এক জীব।’ আর আমাদের সমাজে নারীদের ক্ষেত্রে ‘সতী’ বা ‘চরিত্র’ বলতে শুধুমাত্র যৌনশুচিতাকেই বোঝায়, কিন্তু পুরুষের যৌন মাধুকরীবৃত্তিকে বহুভাবে প্রশয় দেয়া হয় (এ সমাজে ‘সতী’ শব্দের অনুরূপ অর্থে পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ আগেও ছিল না, এখনো নেই); সেখানে নারীর সামান্যতম পদস্খলন বরাবরই চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত হয়ে এসেছে। আমাদের সমাজে যে ‘অর্ধমানবী’ নারী দেখা যায়, কোনও জৈব, মনস্তাত্ত্বিক বা অর্থনৈতিক ভাগ্য তার রূপ স্থির করে না; সমগ্র সভ্যতাই উৎপাদন করে, তৈরি করে পুরুষ ও খোজার মাঝামাঝি এ প্রাণিটিকে, যাকে বলা হয় ‘নারী’। তাই তো বিখ্যাত নারীবাদী সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর দ্বিতীয় লিঙ্গ গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।’ ধর্মবাদীরাসহ অনেক সাধারণ মানুষ প্রায়ই জোর গলায় বলে থাকেন সকল ধর্মেই নারীকে জননীর (সর্বোচ্চ) সম্মান দেয়া হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেই ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’ বহুল উদ্ধৃত-পঠিত বাক্যটি) এবং তার প্রতি সম্মান-কর্তব্য-দায়িত্বের ওপর কম-বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে! তারা একে নারীর অধিকারের স্বীকৃতি বা নারীর মর্যাদার সাথে সমার্থকরূপে দেখেন বা দেখিয়ে থাকেন। এই দেখা বা দেখানোর পেছনে হয়তো বা তাদের মধ্যে নারী সম্পর্কে সদর্থক প্রেরণা কাজ করে। কিন্তু এটাও সত্য, নারী সম্পর্কিত এ ধরনের ভালো-ভালো (!) বক্তব্যের পাশাপাশি সুদীর্ঘকাল থেকে আজকের দিনেও আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, সব ধর্মীয় বিধিবিধানে-উপাখ্যানে নারী সম্পর্কিত নানা কুসংস্কার-অপসংস্কারের ফলগুধারা বহমান; নারী অশুভ, মানুষের (পুরুষদের) স্বর্গ থেকে পতনের কারণ এই নারী, নারী শয়তানের ফাঁদ, নারী নরকাগ্নির ইন্ধন, রূপবান বা কুরূপ বিচার না করেই পুরুষ দেখলেই কামক্রিয়ায় রত হওয়ার জন্য নারীর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে, সৃষ্টিগত ভাবে নারী বক্রস্বভাবের, নারী পুরুষের পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি—ইত্যাদি কুৎসিৎ ধ্যান-ধারণা-কুসংস্কার আজকের একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের চূড়ান্ত উৎকর্ষতার যুগে এসেও বেশিরভাগ মানুষ (ধর্মবাদীরাসহ) মেনে নেয় বিনা প্রশ্নে, বিনা যুক্তিতে! তাঁদের দৃষ্টিতে নারী কখনোই স্বাধীনতার যোগ্য নহে (…ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি)! মজার বিষয় হচ্ছে, প্রায়শই ছদ্ম-প্রগতিশীলরা নারী সম্পর্কিত ভালো ভালো কথাগুলো বুক ফুলিয়ে প্রচার চালালেও সমাজ-জীবনে, ব্যক্তি জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারী সম্পর্কিত নঞ্চর্থক ধারণাকেই প্রাধান্য দ্যান বেশি! (তবে রক্ষণশীল এবং মৌলবাদীরা যেমনটা বিশ্বাস করেন, দৃষ্টিভঙ্গি যেমন, তেমনটি প্রচার চালান, প্রয়োগও করেন ব্যক্তিগত জীবনে তেমনটিই) কেন ছদ্ম-প্রগতিশীলদের এরকম স্ববিরোধী আচরণ? কারণ—যাবতীয় ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি তো এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামো থেকে সামাজিকীকরণের সময় ব্যক্তির ভিতর বিকশিত হয়; পরিবার-আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীর কাছ থেকে সে যা দেখে, শুনে, বুঝে তাই সে শেখে, তার বিশ্লেষণের ক্ষমতা-দৃষ্টিভঙ্গিও সেরকমই হয়। মাঝে কিছুকাল তথাকথিত ‘আধুনিক শিক্ষা’ লাভের ফলে ব্যক্তির এতদিনকার ধ্যান-ধারণা-দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈপরীত্ব বা দ্বন্দ্ব শুরু হয়। যার কারণেই ব্যক্তির মধ্যে এরকম স্ববিরোধী আচরণ লক্ষ্য করা যায়। আজকের দিনে আমাদের দেশে বা অন্যত্র নারী-মুক্তিবিরোধী বা প্রগতিবিরোধীরা তাঁদের বক্তব্যের পক্ষে সবচেয়ে বেশি যে যুক্তি দেন, তা-হল নারী সম্পর্কিত ধর্মীয় বিধি-বিধানের। সনাতন হিন্দু ধর্মের তথাকথিত প্রগতিশীল লোকেরা সময়-সুযোগ পেলেই বড়াই করে বলে বেড়ান, হিন্দু ধর্মে না-কী নারীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা-সম্মান দেওয়া হয়েছে; নারীদের মাতৃজ্ঞানে এ ধর্মে পুজো করা হয়; হিন্দু নারীরা অন্যান্য ধর্মের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল! এ ধরনের বক্তব্য প্রচারের কারণ আছে; পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান চক্ষুশুল ইসলামি মৌলবাদ নিয়ে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত থাকার ফাঁক দিয়ে সুযোগ বুঝে সমস্ত ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের ধর্মকে প্রগতিশীল, যুগোপযুগী, নারী স্বাধীনতার পক্ষে—ইত্যাদি তকমা ব্যবহার (মগজধোলাই!) করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। সন্ত্রাসবাদী আইসিস চেতনা থেকে মুক্তো হয়ে, নারী অবহেলার কথায় দুঃখ না করে আসুন একটু অন্য মহাভারতের আলো খুঁজি–
ভগবান(!) কৃষ্ণের নারী হয়ে ওঠার গপ্প দিয়ে মনের কলুষতা কিছুটা লাঘব করি। মহাভারতে ইরাবনের আত্মত্যাগ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে মা কালীর কাছে কাউকে আহূতি দিতে হত যাতে যুদ্ধে জেতা নিশ্চিত হয়। অর্জুন পুত্র ইরাবন নিজের প্রাণ তাতে উৎসর্গ করেন। তবে ইরাবনের ইচ্ছা ছিল বিয়ের আগে বিয়ে করার। এই ইচ্ছা পূর্ণ করা কঠিন ছিল কারণ কোনও মহিলাই বিয়ের পর বিধবা হতে রাজি ছিল না। ফলে শ্রীকৃষ্ণ মোহিনীর বেশে হাজির হয়ে ইরাবনকে বিয়ে করেন। তামিলনাড়ুর কোভাগম গ্রামে প্রতিবছর ইরাবনকে মাথায় রেখে উৎসব হয়। ১৮ দিনের এই উৎসবে রূপান্তরকামীরা জড়ো হয়ে একদিনের জন্য ঈশ্বরকে বিয়ে করেন। এই ঘটনাও আধুনিক মহাভারতের উত্তর হিসেবে বিবেচনা করা যেতেই পারে।
শেষ করি মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ নারী দ্রৌপদীর চেতনায়। দ্রৌপদী কীচকের শবযাত্রা দাঁড়িয়ে দেখছেন, সুভদ্রা-অর্জুনকে হিংসা করছেন, পক্ষপাত করেছেন স্বামীদের মধ্যে, ভীমের দুর্বলতা জেনে ভীমের থেকে নিয়েছেন সবটুকু আর নিজের সবটুকু দিয়েছেন অর্জুনকে। পাঁচটি ভাইকে এক সুতোয় গেঁথেছেন দ্রৌপদী। দ্রৌপদীর চূড়ান্ত অপমানের পর ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে তিনটি বর দিতে চেয়েছিলেন। মজাটা হল নারী দ্রৌপদী মেয়েলি স্বভাবে আক্রান্ত হয় দুর্যোধন-দুঃশাসনের শাস্তি চায়নি, যুধিষ্ঠিরের দাসত্ব মুক্তি ও পান্ডবদের অস্ত্রসহ মুক্তি প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁর সম্মান ও গভীর বুদ্ধির জোড়ে তিন নম্বর বর চাইলেন না। পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি নিয়ে যে পারিবারিক কলহ, সেখানে দ্রৌপদীর স্থান জ্বলন্ত আগুনে এক চিলতে কাগজের মতো। তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছে কেবল ভীম, একা ভীম। তাই পুরাণ যাই বলুক, ইরাবতী কার্বের ভাবনায় দ্রৌপদী-ভীমের শেষ কথোপকথনটুকু কেবল দিতে অভ্যস্ত – প্রেমিকের সঙ্গে তার প্রেমিকার কথা, সে প্রেমিকা কৃতজ্ঞ, সে প্রেমিকা কৃতজ্ঞ, তৃপ্ত আর সম্পৃক্ত।
‘তোমার জন্য কী করব’ তিনি (ভীম) স্খলিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন। সারা জীবন ধরে বার বার করা প্রশ্ন, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে একেবারে নিরর্থক, অপ্রাসঙ্গিক। দ্রৌপদী প্রসন্ন হাসলেন। ভীমের মুখ নিজের মুখের কাছে নিয়ে এসে নিজের শেষ-শ্বাসের সঙ্গে তিনি বললেন, ‘সামনের জন্মে পাঁচজনের বড়ো ভাই হয়ো ভীম! তোমার আশ্রয়তলে আমরা সকলে নির্ভয়ে আনন্দে থাকব।’
ধর্মগ্রন্থের যতই সাহিত্যিক মূল্য কিংবা দার্শনিক তত্ত্ব লুকানো থাকুক না কেন, নারীগণ নিজেদের ভার বহন করতে জানেন। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা, যুক্তিবাদ আর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবই পারে নারীর সার্থক মুক্তি ঘটাতে; এতেই নারীর ব্যক্তিত্বের পূর্ণ মর্যাদা বিকাশিত হয়েছে – হবে – হচ্ছে।
রচনার ভূমিকায় লিখেছি নারী অবহেলার উপসংহার কথা
নারী ধারণ করে দশমাস–পুরুষ জেনো এটাই উদারতা…
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
(১) শ্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ (সম্পাদিত), ১৯৯৭, শ্রীমদ্ভগবদগীতা, প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী, কলকাতা।
(২) কল্যাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৯৮, ধর্ম ও নারী, এলাইড পাবলিশার্স, কলকাতা।
(৩) সা’দ উল্লাহ্, ২০০২, নারী অধিকার ও আইন, সময় প্রকাশন, ঢাকা।
(৪) সুকুমারী ভট্টাচার্য, ২০০২, প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
(৫) প্রবীর ঘোষ, ১৯৯৪, যুক্তিবাদের চোখে নারী-মুক্তি, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
(৬) সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (ভূমিকা, অনুবাদ, টীকা), ২০০২, মনুসংহিতা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
(৭) কঙ্কর সিংহ, ২০০৫, মনুসংহিতা ও নারী, ব়্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা।
(৮) মাহমুদ শামসুল হক, ১৯৯৬, নারীকোষ, তরফদার প্রকাশনী, ঢাকা।
(৯) নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, ভীম, মহাভারতের ছয় প্রবীণ, দ্রৌপদী।
(১০) সুবোধ ঘোষ, ভারতপ্রেম কথা।
(১১) কঙ্কর সিংহ, ধর্ম ও নারী – প্রাচীন ভারত।
(১২) হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ (২য় ও ৩য় পর্ব)।
(১৩) যুগান্ত – ইরাবতী কার্বে (অনুবাদ – অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায়)।
(১৪) সংকলক সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান।
(১৫) সারানুবাদ রাজশেখর বসু, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত।
ঋণস্বীকার – বিভিন্ন ওয়েবসাইট।