তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না করে শুধু মিছে কোলাহল

0

– আশিস চৌধুরী

আমরা যখন ‘সহজপাঠ’ পড়েছি তখন ওই বইয়ের লিনোকাটের ছবি এবং লেখা আমাদের যেন অন্য একটা জগতে নিয়ে যেত। সে কী আনন্দ! তারপর একটু বড় হয়ে যখন’নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কন্ঠে তুলে নিলাম সে এক অদ্ভুত শিহরণ। পঁচিশে বৈশাখ পাড়ার ক্লাবে ও আরও নানান জায়গায় অনুষ্ঠানে তাঁর কবিতা আবৃত্তি করতে করতে কখন যেন তিনি বড় আপনজন হয়ে উঠলেন। তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে কেউ তা জানে না। আমাদের অনেকের জীবন জুড়েই হয়ত রবীন্দ্রনাথ আছেন তবু যতবার বৈশাখ মাস আসে ততবার তাঁকে যেন নতুন করে বরণ করি। এই গ্রীষ্মে যখন প্রখর তপন তাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে তখন বৈশাখের এই ভোরের হাওয়ায় তাঁকে খুব বেশি করে মনে পড়ে। এই বৈশাখ এলেই আমাদের মনের কোণে যেন তঁর চরণের ছন্দ অনুভব করি। আমাদের অন্তরে যেন এই প্রার্থনা ধ্বনিত হতে থাকে—‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।’

কবিতার পর তাঁর গান দারুণ প্রিয় হয়ে উঠলো। মনে পড়ে তখন সকাল ৭-৪০ মি.এ রেডিওয় কলকাতা ক কেন্দ্রে রবীন্দ্রসংগীত শোনার কথা। সেই প্রথম। তখন তো স্কুলেই পড়ি। তখন গান শোনার এত উপকরণ ছিল না। তারপর একে একে তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প, নানান বিষয়ে লেখা প্রবন্ধ, পত্রগুচ্ছ, নাটক আরও কত লেখা পড়তে পড়তে তিনি কখন যে ‘আপন সখা’ হয়ে গেলেন তা টের পাইনি।

শুধু শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেই নয় তাঁর অন্যান্য বিপুল কাজকর্মের দিকেও যদি আমরা একটু ঝাপসা চোখে তাকাই তাহলে অবাক হতে হয়। তিনি শিক্ষা, কৃষি, সমবায় ব্যাঙ্ক, কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যেভাবে চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করেছিলেন তা জেনে আমরা আশ্চর্য হই। তিনি অপরিমেয় জীবনীশক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সারাজীবনই বিপুল কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। আমরা কিছুটা কর্মবিমুখ বলেই তাঁর সেই কাজকর্মকে অনুসরণ করার কথা ভাবিনি। সেই কারণেই হয়ত এই দিকটি আমাদের রবীন্দ্রচর্চায় আজও উপেক্ষিত। পরিবর্তে তাঁর জীবনের এই বিষয়গুলির প্রতি আমাদের কৌতূহল বেশি। যেমন তঁর জীবনে নারীদের নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প, তাঁর যৌনজীবন, বউদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, লেডি রানুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক-এইসব। তাঁর জীবনদর্শন এবং কর্মপদ্ধতি আমরা কেউই বোধ হয় আন্তরিকভাবে গ্রহণ করিনি। যদি তা করতাম তাহলে এত রক্তপাত, হানাহানি, দেশ ও জাতির প্রতি এই বিশ্বাসঘাতকতা দেখতে হত না। চারিদিকে যেন ‘হিংসার উৎসব’ চলছে। এই সমাজে নারীদেরই বা এত অসম্মান কেন?অথচ রবীন্দ্রনাথ জীবনভর তাঁর সাহিত্যে এবং বাস্তবজীবনে নারীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রমের পরিচয় দিয়েছেন। তাই বলতে ইচ্ছে করছে তিনি যে আলোর সন্ধান দিয়ে গেছেন সেই তাঁর দেশে জীবনানন্দ কথিত এই ’ অদ্ভুত আঁধার’ কেন? আমরা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথকে ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারিনি বা বলা ভাল উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি, পরিবর্তে জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনে ভিড় জমিয়েছি।

একথা আজ অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই যে আমাদের জাতীয় জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবন গভীর সংকটের সম্মুখীন। আধুনিক ভারত গড়ার কাজে যারা নিজেদের মোড়ল বানিয়েছেন হয় তারা রবীন্দ্রনাথের সেইসব চিন্তাভাবনার ব্যাপারে অজ্ঞ নতুবা উপেক্ষা করছেন। তাই দেশের এই হাল। আমরা যদি ভালোমানুষ হতে পারি তাহলে এই সংকট অনেকটাই কমবে। ভালোমানুষ হওয়ার পথ তো রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা সে পথে গমন করতে ইচ্ছুক নই মোটেই। আমরা এই ‘ছোটো আমি’ থেকে ‘বড়ো আমি’ র দিকে অগ্রসর হতে মোটেই উৎসাহী নই। ব্যক্তি মানুষের আত্মিক সংকট থেকেই সামাজিক সংকটের উদ্ভব ও বিকাশ। কিছু স্বার্থপর অর্থলোভী মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় পুরো সমাজটাই বিশ্বাহীনতায় ভুগছে। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আজ যে জীবনযাপনে আমরা অভ্যস্ত তার বেশিরভাগটাই যেন ভেজাল, মেকি আর প্রবঞ্চনাময়। প্রকৃত শিক্ষার অভাবেই আমাদের আজ এই অবস্থা। আমরা বিদ্যা অর্জন করছি কিন্তু প্রকৃত শিক্ষালাভ করছি না। সর্বজনীন শিক্ষাই যে আমদের মুক্তির পথ একথা বারবার বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।

প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে তা আমরা ভুলে যাই তাই তিনি বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, বসন্তোৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না এগুলি নিছক অনুষ্ঠানই ছিল না। আজ আমরা জেন বুঝে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছি ব্যক্তিগত লাভের লোভে। যে পরিবেশকে আমাদের দু’হাত দিয়ে আগলে রাখার কথা লাগামছাড়া ভোগবিলাসের স্বার্থে সেই পরিবেশকে ধ্বংস করছি।

 তিনি সারাজীবন মিলনের জয়গান গেয়েছেন বলেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ তাঁকে সর্বতোভাবে পীড়িত করেছে। তাঁর কন্ঠ এবং লেখনী সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিরুদ্ধে বারবার সোচ্চারিত হয়েছে। অতীতে শুধুমাত্র ধর্মীয় অমিলের কারণে এক প্রতিবেশি আর এক প্রতিবেশির ওপর চড়াও হয়েছে, এই ধর্মীয় সংঘাতে অনেক প্রাণ বলি হয়েছে। আজও সেসব থামেনি বরং তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তিনি হিন্দু-মুসলমান নামক প্রবন্ধে লিখেছেন-‘যে দেশ প্রধানত ধর্মের মিলে মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। যে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটে সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেটিকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে দেশে ধর্ম সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁধতে পারে?’আজ রাজনীতির সংকীর্ণ চিন্তা-ভাবনা অনেক সময় আমাদের সত্যের বিপরীত অভিমুখে চালিত করছে। কিন্তু তিনি বারবার বলেছেন কোনও সংকীর্ণ ভাবনা দ্বারা আমরা যেন চালিত না হই। কে শোনে তাঁর কথা।

    আমরা তাঁর কবিতা পড়ি, তাঁর গান গাই, শুনি, তাঁর নাটক পড়ি, দেখি কিন্ত তাঁকে আমরা পড়ি না। শুধু তাঁকে নিয়ে হুল্লোড় করি। তাঁকে যদি ভালোবাসাতাম তাহলে তিনি যে জীবনচর্যার কথা নানাভাবে বলেছেন তা অনুসরণ করার চেষ্টা করতাম। তাঁকে নিয়ে আমদের হুল্লোড়পনা দেখেই কবি বিষ্ণু দে আক্ষেপ করে বলেছিলেন-‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ?’ বিষ্ণু দের কণ্ঠস্বর আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করেনি। তাই রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই আজ বলতে হচ্ছে-‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল/সুধা সাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল/আপনি কেটেছে আপনার মুল- না জানে সাঁতার, নাহি পায় কুল/স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে, করে দিবানিশি টলোমল।’

Leave a Reply

error: Content is protected !!