ফিরোজ আখতার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নামটাই একটা আলাদা রসায়ন ও শ্রদ্ধা বহন করতো তৎকালীন চীনদেশে। রবীন্দ্র-সমসাময়িক ভারতীয় তথা এশীয় কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাঁর গ্রন্থগুলি চীনাভাষায় অনুদিত হয়েছিল তিনি হলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ ১৯২৩ সালে জুলাই মাসে চীনের পিকিং-এর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৎকালীন আচার্য্য রবীন্দ্রনাথকে পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণ করেছিলেন৷ কবিগুরু সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ঠিক করেন একইসাথে জাপান, সুমাত্রা, বালী ইত্যাদি বৌদ্ধধর্মবহুল দেশগুলি পরিভ্রমণ করবেন৷ কিন্তু, ইতিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং চীনযাত্রা মুলতুবি রাখলেন৷

আগে ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান গেছিলেন৷ তাই তিনি চীন-ভ্রমণের জন্য ভীষণ ব্যগ্র ছিলেন৷ এর মধ্যে পিকিং-এর ‘লেকচার অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে তাঁকে আবার আমন্ত্রণ জানানো হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৪ সালে আবার আসার জন্য৷ সেই অনুযায়ী কবিগুরু ঠিক করেন তিনি ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।

২১ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রেঙ্গুনে পৌছান৷ বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে পুরাতত্ত্ব বিভাগের পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী আর কলা ভবনের অধ্যক্ষ চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু তাঁর সঙ্গে ছিলেন৷ ছিলেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অধ্যাপক ডক্টর কালিদাস নাগ৷ তিনি অবশ্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে গেছিলেন৷

২৮ মার্চ কবিগুরু রেঙ্গুন থেকে সিঙ্গাপুর যাত্রা করেন৷ ৩০শে মার্চ তাঁরা পেনাং পৌছান৷ ‘ইথোপিয়া’ জাহাজে চেপে তাঁরা প্রথমে পৌছান সোয়েটেনহাম, তারপর মালয়ের রাজধানী কুয়ালালায়ামপুর৷ এরপর সিঙ্গাপুরে এসে তাঁরা জাহাজ পরিবর্তন করেন৷ ‘অাস্তু মারু’ নামক তুলনামূলক একটি ছোট জাপানী জাহাজে চেপে সাংহাইয়ের দিকে রওনা দেন৷

পিকিং-এ বক্তৃতা দেবার অাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাংচোতে একটি বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতায় তিনি চীন ও ভারতের সৌভার্তৃত্ব ও বিশ্বমানবতা নিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন তা চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিল৷

পিকিং-এ শেষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “ইউরোপ খণ্ডে যে যুদ্ধবিগ্রহ আজ সমস্ত জগতে ব্যাপ্ত হইতে চলিয়াছে, বাহির হইতে উহার উৎপত্তি হয় নাই৷ এই বিষ ভিতর হইতে জন্মিয়াছে। এইখানে কিন্তু এশিয়ার সুযোগও নিহিত। এশিয়া পশ্চিম হইতে যাহা গ্রহণ করিবে, উহার কতখানি সে হজম করিতে সমর্থ তাহা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে। অবশিষ্টটা বর্জন করিতে হইবে। এই পর্যন্ত  আমাদের এই বিচার বুদ্ধিটা খুবই কম ছিল৷ চীনে উহার সম্পূর্ণ অভাবই লক্ষিত হয়। যেন জগতে শিল্প ও কারুকার্য্যে বিশিষ্টতারকারিকর দিয়াছে উহাই নির্ব্বিচারে পাশ্চাত্য শিল্পকলার বহু নকল করিতেছে৷”

২৮ জুন রবীন্দ্রনাথ সাংহাই থেকে হংকং রওনা দেন। কোলকাতা ফেরার পথে ১২ জুলাই তিনি রেঙ্গুনে নামেন। “যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্‌”- মৈত্রীর এই বাক্য তিনি চীন তথা এশিয়াবাসীর মননে প্রোথিত করতে চেয়েছিলেন৷ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তাঁর বক্তৃতার মর্মকথা চীন ও জাপানে বহুলাংশে প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে৷ এশিয়া সম্পর্কে তাঁর যে আধ্যাত্মিক অনুভূতি তা অদূর ভবিষ্যতে এশীয়বাসীদের বহুকালের চেতনার আড়ষ্টতা দূর করবে৷

Leave a Reply

error: Content is protected !!