– পিয়াংকী মুখার্জী

আমাদের পরিবারটা ছিলো বড্ড রবীন্দ্র ঘেঁষা, সারা বাড়ির সবখানে তিনি আটকে থাকতেন সবসময়, হয় ক্যালেন্ডারে নয় শত পুরোনো বাঁধানো ছবিতে নতুবা মায়ের রান্নাঘরে আটা মাখার গামলায়। মেখে থাকতেন তিনি আমাদের সব্বার আনাচে কানাচে। মাখিয়ে দিতেন আমায় আদরে-আবদারে-ভালোবাসায়। প্রতিদিনের প্রভাতী গানের আসরে রেডিওতে নামী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের উদাত্ত দরাজ আওয়াজে তাঁকে শুনে শুনে জ্বলন্ত হতাম রোজ !

মায়ের ধড়ফড় করা সাংসারিক নিঃশ্বাসের সাথে তালে তাল মিলিয়ে নৃত্য করতো “আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে” অথবা বাবার নামমাত্র ইলেকট্রিক ব্যবসার দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে “চরণ ধরিতে দিও গো আমারে নিও না নিও না সরায়ে “ বাজতো সুমধুর প্রত্যয়ী ধ্বনিতে!

প্রতি সন্ধেতে দেখতাম মা আমাদের বংশের শত পুরোনো শালগ্রাম শিলার সাথে তাঁকেও ধূপধুনো দেখাচ্ছেন, ভাবটা ঠিক এমন যেন কূলদেবতার পুজো করছেন…

বারবার একই প্রশ্নে মাকে জর্জরিত করেছি, “মা কে ইনি?” মা বলতেন, “গুরুজন, তুমি দাদু বলেই ডেকো”

বড্ড মুশকিল চিনি না জানি না কোন কাজে তাঁকে দাদু ডাকবো? পারবো না, ওসব হবে না আমার দ্বারা, ভীষণ জেদী আর একগুঁয়ে ছিলাম কিনা!

একদিন বাবা বললেন, “ইনি ঠাকুর, নাম শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ, ওঁর মৃত্যুদিনে তোমার জন্ম তাই যা ইচ্ছে বলে ডেকো, তবে কিছু একটা সম্বোধন ওনার প্রাপ্য, সেটা মনে রেখো” সেবার বাবা আমার জন্মদিনে একটা গীতবিতান আমায় উপহার দিলেন, বললেন, “পড়বে রোজ একটু একটু করে একসাথে পড়ার বৃথা চেষ্টা কোরো না, অথৈ সমুদ্র কিন্তু খেই পাবে না!”

না, গান আমি গাইনি কোনদিন, কারণ কন্ঠস্বর সেই স্বীকৃতি দেয় না তবে যত বড় হতে হতে চলেছি, প্রতিদিন নেশার নামে ওঁকেই খুঁজেছি, গীতবিতান আমি পড়িনা ওর কাগজগুলো চিবিয়ে জল দিয়ে গিলি সংসারের যে কোন ওঠানামাতে, পথচলতি সাংসারিক অবসাদ-আনন্দ-প্রেম -বিরহ প্রতিক্ষণের প্রতি পদক্ষেপে আশ্রয় দেয় তাঁর গান কবিতা গল্প উপন্যাস!

প্রথাগত আবৃত্তি শিক্ষা নিই নি কোনদিন, অথচ ‘সঞ্চয়িতা’র ক্ষমতা এতখানি যে, যখন তখন যাকে তাকে অগোছালো কবিতা পাঠে সে বাধ্য করে, আজ এতগুলো বছর কাটিয়ে আসার পরও সহজপাঠ দৌড়োয় মস্তিস্কের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে! নতুন কোনো কাজে ভয় পেতে গেলে যিনি বলে ওঠেন, “অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে ছিলো আমার মা অচেনা “এভাবেই রোজ তাঁকে নব নব রূপে দেখি, একই গান বা কবিতা নতুন নতুন অর্থে ধরা দেয় আমার মননে প্রতিদিন!

বাবা সামান্য আয় থেকে আজও প্রতি জন্মদিনে আমায় একটা করে রবিপ্রেম গিফ্ট করেন, হ্যাঁ, দায়িত্ব নিয়ে বলছি প্রেম এর সমার্থক এক এবং একমাত্র রবীন্দ্রনাথ-ই!

আর আমি তাঁকে তার জন্মদিনে কয়েকটা অক্ষরে বাঁধা কিছু শব্দগুচ্ছ দিই, জানি সেগুলো না কবিতা না গান, কিচ্ছু না, কিন্তু মন বলে তিঁনি উদার একটা আকাশ যে আকাশকে আঁকড়ে ধরে পার করা যায় জীবন নামের একটা আস্ত জগদ্দল পাথর!!

তুমি রবীন্দ্রনাথ, তুমিই আমার সব পেয়েছির আসর!

Leave a Reply

error: Content is protected !!