স্বাভাবিক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – দেবব্রত সান্যাল
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদি কবিতা নাও লিখতেন তবুও বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে গন্য হতেন। বুদ্ধদেব বসুর মতে ইংরেজি জিনিয়াস শব্দে অলৌকিকের যে-আভাস আছে, তা স্বীকার্য হলে প্রতিভা একধরনের আবেশ। সংস্কৃত ‘প্রতিভা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ অনুসারে তা হবে বুদ্ধিদীপ্ত মেধার নামান্তর। বাংলা কাব্যে সুধীন্দ্রনাথ সেই বুদ্ধিদীপ্ত মেধা। অথচ প্রতিভার প্রাচুর্য নিয়ে সুধীন দত্ত গভীর নিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন কবিতা রচনার কর্মযজ্ঞে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কবিতা লিখতে শুরু করেন ১৯২২ সালে, যখন তাঁর বয়েস ছিল একুশ। সে সময়ে তাঁরকবিতায় পরিপক্বতার অভাব খুব পরিষ্কার। তার কারণ তাঁর বাল্যশিক্ষা ঘটেছিল কাশীতে। সংস্কৃত ওইংরেজীতে সচ্ছন্দ হলেও বাংলা ভাষায় তেমন পারঙ্গম ছিলেন না।
সুধীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল ৩০শে অক্টোবর ১৯০১ সালে কলকাতার হাতিবাগানে। বাবা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বৈদান্তিক। আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্তক্ত হয়ে সুধীন্দ্রনাথ অল্প বয়েসেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন। মা, ইন্দুমতী বসু মল্লিক, রাজা সুবোধচন্দ্র বসু মল্লিকের বোনছিলেন।
সুধীন্দ্রনাথ ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত কাশীর থিয়সফিক্যাল হাইস্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৯১৮) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আইএ (১৯২০) ও বিএ (১৯২২) পাস করে তিনি কিছুদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। এখানকার পাঠ অসমাপ্ত রেখেই তিনি ল’ কলেজে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন, কিন্তুতাও সমাপ্ত করেননি।
পিতার ল’ফার্মে শিক্ষানবিস হিসেবে সুধীন্দ্রনাথ কর্মজীবন শুরু করেন; পরে কিছুদিন ইন্সুরেন্স কোম্পানিতেও চাকরি করেন।
কবিতা সুধীন্দ্রনাথের কাছে স্বাভাবিক মাধ্যম ছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন, “কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের একবিরামহীন মল্ল যুদ্ধ।”( বুদ্ধদেব বসু)
এরপর সাত বছরের নিরলস পরিশ্রম ও প্রয়োগে তিনি তাঁর প্রথম কাব্য পুস্তক তণ্বী প্রকাশ করলেন। কাব্যগ্রন্থটি কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত উৎসর্গ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রীচরণে।
“ঋণ শোধের জন্য নয়, ঋণ স্বীকারের জন্য”।
এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের গ্লানি ও বিষণ্ণতাক্লিষ্ট।
“ কী যেন হারায়ে গেছে জীবন হতে ,/ কী যে তা বুঝিবে কে বা কেমন মতে/ শুধু জানি এইটুক,/ কী একবিপুল দুখ/ ভ’রে দেছে সারা বুক গোপন ক্ষতে।” ( পলাতকা- তণ্বী : ১৯২৫)
তণ্বী কাব্যগ্রন্থে আমাদের পরিচিত প্রাজ্ঞ সুধীন্দ্রনাথকে অপরিণত কিশোর মনে হয়।
কাব্যগ্রন্থথটিতে মোট উনত্রিশটি কবিতা ছিল ।
অসাধারণ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সুধীন্দ্রনাথের আবির্ভাবকে রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখচি সেটাকে অনাদর করা যায় না।’
কিন্তু সুধীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা থেকে শুরু করে জীবনদর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সহমত প্রকাশ করতে পারেননি।
১৯২৯ সালে তিনি বিদেশ যাত্রা করেন রবীন্দ্রনাথের সাথে যান জাপানে ও আমেরিকায় । এই সময়ে সুধীন্দ্রনাথের জীবনে বিপ্লব ঘটে যায়। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি ও অনুশীলন লব্ধ সাহিত্যচেতনায় অভিজ্ঞতা যুক্ত হলো। নিয়মিত লিখতে শুরু করলেন এবং নিরন্তর ঋদ্ধ হলেন।
একা ইউরোপ ভ্রমণ করলেন । কখনও জাহাজে বসে কখনও রাইন নদীর তীরে কোনও শহরে ।
১৯৩১ সাল থেকে দীর্ঘ বারো বছর তিনি পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৫-৪৯ সময়কালে তিনি স্টেটসম্যান পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৫৭-১৯৫৯ সময়কালে তিনি আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং পরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের বিভাগ শুরু হলে, অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসুর আমন্ত্রণে তিনি সেখানে অধ্যপক হিসাবে যোগ দেন। এক অস্থির ও অসন্তুষ্ট কর্মজীবন ছিলতাঁর।
সৃজনশীল জীবনের দিক থেকে ইউরোপ থেকে ফিরে পরবর্তী দশ বছর সুধীন্দ্রনাথ তাঁর সেরা কাজ গুলি করেছেন । প্রায় সমগ্র অর্কেস্ট্রা, ক্রন্দসী, উত্তর ফাল্গুনী, প্রায় সমগ্র সংবর্ত, সমগ্র কাব্য ও গদ্য স্বগত, কুলায় ও কাল পুরুষের প্রবন্ধাবলি – এই একটি মাত্র দশকের মধ্যে তিনি সমাপ্ত করেন। তাঁর সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, ১৯৩১-৩৬ – তাও এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
শোনা যায় একদিন কবিতার বিষয় কী হওয়া উচিত সেই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর মত বিরোধহয় । রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁকে মুরগীর ওপর একটি কবিতা লিখে আনতে বলেন। সুধীন্দ্রনাথ লিখলেন,
“শূণ্যগর্ভ নভস্তল অকস্মাৎ অনুনাদে ভরি / তরঙ্গিল সারা বিশ্বে, হে কুক্কুট, তোমার মাভৈ; /আশারঅলকনন্দা বহায়িলে, অশুচি বিজয়ী;/
বাঙ্ময় উদ্ধার এল, প্রেতমুক্ত হলো বিভাবরী॥
সে-জয়গাথায় মাতি মোর শঙ্কাস্তম্ভিত রুধির/
দ্রুত-বিলম্বিত নৃত্য আরম্ভিল চমকিত হৃদে;/
অহৈতুক কৃতজ্ঞতা গুঞ্জরিল, বাণী দে, বাণী দে; /
রোমাঞ্চিত বন্যতায় মুগ্ধ হল উদ্দীপ্ত শরীর।
কবিতাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে নিজের পরাজয় স্বীকার করেছিলেন। এটাই তাঁর প্রথম প্রকাশিতকবিতা “কুক্কুট” ( প্রবাসী – ১৯২৮)
পরবর্তী কালে কবিতাটি ক্রন্দসী (১৯৩৯) কাব্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কাব্যগ্রন্থটি সুধীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয়বন্ধু হমফ্রে হাউসকে উৎসর্গ করেন। বইতে মোট চব্বিশটি কবিতা আছে যার মধ্যে ‘উটপাখি’ সবচেয়েবেশি জনপ্রিয়।
“আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/
আমরা দুজনে সমান অংশিদার/
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার |/
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি |/
অন্ধ হ’লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ?/
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি / ( উটপাখি)
কুক্কুট কবিতাটির জন্ম বৃত্তান্ত শুনে কেউ কেউ তাঁকে স্বভাব কবি বলেছেন। কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাভাবিক কবি । নয়তো তাঁর মেধা, শিক্ষা, সুযোগ অপর্যাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি জগতের অন্যান্য প্রকৃত কবির মতো জন মানসে শুধু কবি হয়ে থাকতেন না।
১৯৩৫ এ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রেম বিষয়ক কাব্য গ্রন্থ “অর্কেষ্ট্রা”। বইটিতে মোট পঁচিশটি কবিতা আছে ।অর্কেস্ট্রা’র ভূমিকায় কবি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগত মণীষার জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবি জীবনের পরম সার্থকতা।’ এই কাব্যগ্রন্থের সর্বচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা “শাশ্বতী”।
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখিসম ;/
সে-রোমরাজি কোমলতা ঘাসে-ঘাসে ;/
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম ;/
আজ সে কেবল আর কারে ভালবাসে।/
স্মৃতিপিপিলিকা তাই পুঞ্জিত করে/
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা ;/
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে/
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিবো না॥
বিষ্ণু দে-র চোরাবালি-র আলোচনা করতে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার বিচারে কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দঃস্বাচ্ছন্দ্য।” ছন্দ সম্বন্ধে অতিসচেতন কবি লিখছেন, “গদ্যের অবলম্বনবিজ্ঞান, কাব্যের অন্বিষ্ট প্রজ্ঞান। তাই গদ্য চলে যুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে, আর কাব্য নাচে ভাবের তালেতালে, গদ্য চায় আমাদের স্বীকৃতি আর কাব্য খোঁজে আমাদের নিষ্ঠা, রেখার পর রেখা টেনে পরিশ্রান্ত যেছবি আঁকে, গোটা কয়েক বিন্দুর বিন্যাসে কাব্যের যাদু সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তোলে আমাদের অনুকম্পার পটে। কাব্যের এই মরমী ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীকের সাহায্যে।”
১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় উত্তর ফাল্গুনী। বইটি সুমন্ত্র মহালনবিশকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। উত্তরফাল্গুনীকে ক্রন্দসীর পরিপূরক কাব্যগ্রন্থ বলা হয়। এখানে প্রেমের প্রত্যাবর্তন হলো বহুস্তর আধুনিকতায় ভরপুর উৎসুক ও গভীর হয়ে। যেখানে, “বিজয়ী মন তথাপি সেথা থামি / মোক্ষ মাগে পরম পরাজয়ে”।
কিম্বা,
“তবু পরিহরি বিত্তের মোহ/ রিক্ত অয়নে দাঁড়াও নেমে।/ তোমার ত্যাগের দাম ধ’রে দেব/ অনির্বচন অমরপ্রেমে ;/
নিয়ে যাব যেথা নেই দেশ-কাল,/নেই ব্যাধি-জরা, ক্ষয়-জঞ্জাল,/সত্য যেখানে স্বপ্নসুষমা,/ভেদ নেই যেথাসীসায় হেমে।/স্বার্থপরের অর্ঘ্যের লোভ/
ত্যাগ ক’রে এসো নিভৃতে নেমে॥/”
(‘প্রতিদান’, উত্তর ফাল্গুনী)
১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকেই কবি সুধীন্দ্রনাথ খুব কম লেখেন বা প্রায় লেখেনই না বলা যায়। শঙ্খ ঘোষ তাঁর “ছন্দের বারান্দা” গ্রন্থে বলেছেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মৌলিক কবিতার সংখ্যা ১৩০।১৯৩৪-৩৭ এই চার বছর কোনও কবিতা লেখেননি সুধীন্দ্রনাথ, এরপর ‘৪২-৪৪-এ লিখলেন না, ১৯৪৬-৫২ ও না।
সংবর্তর মুখবন্ধে লিখে ছিলেন, “আমার দীর্ঘসূত্র স্বভাবে অনু ব্যবসায়ের আধিক্যবশত গত পনেরো বছর কোনও লেখাকে আমি গ্রন্থস্থ করিনি।”
কাব্যগ্রন্থ সংবর্ত প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। কাব্যের মুখবন্ধে কবি লিখেছেন – ‘মালার্মে প্রবর্তিত কাব্যাদর্শই আমার অন্বিষ্ট। আমিও মানি যে কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ; এবং উপস্থিত রচনাসমূহ শব্দ প্রয়োগের পরীক্ষা রূপেই বিবেচ্য।’
সংবর্তে প্রবেশ করল তপ্ত ও স্পন্দিত সমকাল তাঁর ভাস্কর্যের অবয়বে। এখানে প্রেয়সী, প্রকৃতি ও রাজনীতি একাকার হয়েছে – এলোমেলো জীবনের বিন্যাসে নির্মাণে, পুনর্বিন্যাসে পুনর্নিমাণে। ‘নান্দীমুখ’ কবিতায়তার উদ্বোধন,
“তোমার যোগ্য গান বিরচিব ব’লে,/
বসেছি বিজনে, নব নীপবনে,/
পুষ্পিত তৃণদলে |/
শরতের সোনা গগনে গগনে ঝলকে ;/
ফুকারে পবন, কাশের লহরী ছলকে ;/
শ্যাম সন্ধ্যার পল্লবঘন অলকে/
চন্দ্রকলার চন্দনটিকা জ্বলে |/
মুগ্ধ নয়ান, পেতে আছি কান,/
গান বিরচিব ব’লে ||/
বিন্যাস হলো ‘সংবর্ত’ কবিতায় :
‘কিন্তু তার দিব্য আবির্ভাবে/
প্রেতার্ত অভাবে/
জাগে যেন প্রজ্ঞাপারমিতার অভয় ;/
ক্লেদ-মেদ-খেদের আলয়—/
জঘন্য জান্তব দেহে দেশ-কাল-সংকলিত মল/
সংসক্ত থাকে না আর ; তন্মাত্রাসম্বল/
হয় তনু আচম্বিতে |/
বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন ১৯৪০ সালে এই কবিতাটি রচনা করার পর তিনি যেন মুক্তি লাভ করেন।
অনুবাদ গ্রন্থ প্রতিধ্বনি প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ । “প্রতিধ্বনি” পঞ্চান্নটি অনুবাদ কবিতার সংকলন। ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান – এই তিন ভাষায় লেখা এগারোজন কবির অনুবাদে সমৃদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থ। প্রতিধ্বনিরমুখবন্ধে নিঃশঙ্কোচে লিখলেন, “ আমার মতে কাব্য যেহেতু উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈত, আমি এও মানতেবাধ্য এর রূপান্তর অসম্ভব।”
শেষ কাব্যগ্রন্থ দশমী প্রকাশ পায় ১৯৫৬ সালে
দশমীর কবি পৌঁছে গিয়েছেন কাব্যিক পূর্ণতায়,
“দিনমানে তাই চতুর চিত্রভানু/
লোভায় না লঘু মরীচিকা-নির্মাণে :/
অন্ধ আলোর পলাতক পরমাণু/
অমারাতে তাকে ছায়াপথে মিছে টানে ||/
একা সে এখন, বাঁধা অধুনার তালে ;/
ত্রিসীমায় নেই আদ্যন্তের দিশা :/
ঢলঢল জল সচল চক্রবালে ;/
সন্ধিলগ্নে সংগত দিবা-নিশা ||/ (ভ্রষ্ট তরী)”
এরপর তিনবছর আর কোনও কাব্যগ্রন্থ এলো না।
১৯৬০-এর ২৫ জুন হঠাৎই চলে গেলেন সুধীন্দ্রনাথ।
এই উনষাট বছরের জীবনে ছ’টি কবিতার বই, দুটিমাত্র গদ্যের বই। ইংরেজিতে একটি আত্মজীবনী, সেওঅসমাপ্ত।
শব্দ ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ ও তার জন্য অনেক সময় ব্যয়করতেন। নিজের সমাদৃত কবিতাকে সংশোধন করতে দ্বিধা করতেন না। বিখ্যাত কবিতা ‘উটপাখী’ নাকিদু’বছর ধরে ত্রিশ বার পাল্টেছিলেন! তাঁর কবিতার বই ‘সংবর্ত’র প্রকাশক, সিগনেট প্রেস-এরদিলীপকুমার গুপ্তকে লেখা চিঠিপত্র থেকে বোঝা যায় , নিজের কবিতার ব্যাপারে কী রকম আপসহীন, নিখুঁত ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ। বইয়ের প্রুফ দেখতে গিয়েও তিনি কবিতা সংশোধন করেন নতুন করে, চিঠিতে লেখেন ‘পাণ্ডুলিপি আর এই প্রুফ দুটোই প্রামাণ্য… যদি সব শেষের পেজ প্রুফটা একবার পাঠান, এক দিনেই দেখে ফেরত দেব।’ এও লিখছেন, ‘দুর্বোধ্য বলে আমার দুর্নাম থাকাতে সাধারণ প্রুফপাঠক আমার লেখার ভুল শোধরাতে অনেক সময় ইতস্তত করেন। অতএব যদি দরকার মনে করেন, তাহলেআমিই সারা বইয়ের সর্বশেষ প্রুফ প্রেসে গিয়েও দেখে দিতে পারি, যাতে কোথাও অর্থহানি না ঘটে।’ নিজের লেখা কেটে, ছেঁটে, জুড়ে পাল্টেছেন সারা জীবন; এমনকি যে দীর্ঘ বছরগুলিতে নতুন কিছুলেখেননি, তখনও ক্রমাগত কলম চালিয়েছেন নিজেরই পুরনো লেখায়। তাই ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তেরকাব্যসংগ্রহ’ ও ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’, এই দুটিমাত্র বইয়েই তাঁকে বেঁধে ফেলা গেল ভেবে নিলে এই শব্দশিল্পীরক্রমাগত ভাঙা-গড়া আর ‘হয়ে ওঠা’র ইতিহাস কিন্তু জানা হবে না।
অধুনা বাংলা কবিতায় অনায়াসে ব্যবহৃত অনেক তৎসম শব্দের প্রবর্তক তিনি। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বাংলা কবিতায় ‘ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক’ বলার সময় এও জানা উচিত ধ্রুপদী শব্দটি প্রথমবার তিনিই ব্যবহার করেছিলেন।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন – “তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা”।
কবির কথায় পরিশেষে বলি,
“যারা ছিল এক দিন ; কথা দিয়ে, চ’লে গেছে যারা ;/
যাদের আগমবার্তা মিছে ব’লে বুঝেছি নিশ্চয় ;/
স্বয়ম্ভু সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়/
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ||”
Our Visitor
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (একাদশ কিস্তি)বৃষ্টির শুরুতেই সামান্য ঠান্ডা পড়তে শুরু করলো। ক্লাবে লোক আসা একটু কমলো। বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (দশম কিস্তি)(৮) শিফট ডিউটি আরম্ভ হতেই জীবনটা জীবিকার প্রয়োজন মাত্র হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত সময়ে ঘুম থেকে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (নবম কিস্তি)আমাদের পুরো ব্যাচটাকে কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করা হলো। আমাদের দলে আমি, কর, সিং…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (অষ্টম কিস্তি)আমার মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে বিপদভঞ্জন দুঃখ দুঃখ মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেড়ে দিলো?’ ‘কান…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (সপ্তম কিস্তি)নিকলের নিয়োগপত্র বার পাঁচেক খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে, আমার টুইডের কোটটা গায়ে দিয়ে অফিসে গেলাম।…