চারধাম যাত্রা : পর্ব ২ – সৌম্যেন কুন্ডা
সপ্তমীতে গিয়েছিলাম গঙ্গোত্রী (উচ্চতা ৩০৪৮মিটার, GMVN অনুযায়ী)। উত্তরকাশী থেকে দূরত্ব প্রায় ১০০কিমি। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রওনা হলাম গঙ্গোত্রীর উদ্দেশ্যে। রাস্তাটি বেশ,যেমন চলতে তেমনই দেখতে চারপাশ। ঠান্ডা ক্রমাগত বাড়ছিল। হরশিলের (গঙ্গোত্রীর থেকে কিলোমিটার ৩০ আগে) কাছে এসে হাত মুখ প্রায় অবশ হওয়ার উপক্রম। রাস্তার পাশের আপেল ধরা গাছের রূপও ঠান্ডা সরাতে পারছিল না। সারথীকে অনুরোধ করে গাড়ি দাঁড় করালাম এক আপেল বাগানের পাশের রেস্টুরেন্টে। মালিক এবং কর্মীদের ঘুম ভাঙানো হলো গরম চা ও কফির জন্য। পরিষ্কার টয়লেট ব্যবহার করতে দিল, আর দিল অনুমতি আপেলের বাগিচায় যাওয়ার এবং সেখানে ফোটো তোলার। তবে শর্তসাপেক্ষ। আপেল ছিঁড়তে পারবে না। আর একশো টাকা দিতে হবে ছবি তোলার জন্য। গরম কফি খাওয়ার পর শর্ত মেনে বাকিরা গেল আপেল দেখতে, আমি রইলাম মালিকের সাথে গল্পে,সিগারেটে। হাত পা সচল রাখতে বাইরে একটু হাঁটাচলা করছিলাম, হঠাৎই সামনে একটু বাঁদিকে তাকাতেই পলকহীন স্তব্ধতা আমার চোখে, মুখে, সমস্ত শরীরে। কালচে সবুজ দুই পাহাড়ের মাঝে প্রথম সূর্যালোকে হাসছে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ। এমন নয় যে বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গ এই প্রথমবার দেখলাম। কিন্তু এই সময়টা যেন অন্যরকম, শুধু আমার জন্য। মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনে পড়ল সেই সুনীলকথা, “ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।” কবে যে সে ডাক দিয়েছিল, আজ এসেছি উপত্যকায় তাঁর কাছে, চন্দন চন্দন। কথা রইল ফিরতি পথে সময় দেব হরশিলে। গরম কালো কফির উষ্ণতা নিয়ে ফের পথে নামা। ছবি তোলার জন্য ১০০ নয় ২৫ টাকা নিলেন বাগিচার মালিক, কারণ, ওনার মতে আমার সঙ্গীরা ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন, নিয়ম ভাঙেননি। আগের দিন রাতে কিছু বাঙালি পর্যটক ওর দোকানের পাশের ঘরটি ভাড়া নিয়েছিলেন রাত কাটানোর জন্য। ভোর রাতে উঠে বাগিচার বেশ কিছু আপেল তারা নাকি না বলে ছিঁড়ে নিয়ে পালিয়ে গেছেন! অথচ বাগিচার মালিকরা ওদের জানিয়েছিলেন যে এক বিশেষ পূজার পরেই গাছ থেকে ফল ছেঁড়েন ওরা। সহানুভূতি জানান ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। জন্মসূত্রে বাঙালী হওয়ায় লজ্জা বোধ করেছিলাম।
গঙ্গোত্রী পৌঁছে পার্কিং থেকে ৫০০মিটার মতো দূরত্বে মন্দির, নদী, ঘাট। মন্দিরের সামনে বাঁধানো চাতাল। ফোটো তোলার হিড়িক চলছে। অনুরোধে আমিও দু-এক দলের ছবি তুলে দিলাম। মারাত্মক ঠান্ডা শরীর গঙ্গার। জীন্স, সোয়েটারে আবৃত দুই হরিণীকে দেখলাম লাফিয়ে লাফিয়ে নদীর কাছে গিয়ে জলে হাত দিয়েই তুরুক লাফ “OMG!!” সারথীকে (তার বাড়ি কিন্তু হরিদ্বারের কাছে) দেখলাম দুলিটারের দুই জলভর্তি বোতল নিয়ে যাচ্ছে গাড়ির দিকে “ঘর কে লিয়ে, গঙ্গাজী কি পানি।” হরিদ্বার থেকে গঙ্গোত্রী, স্থানীয় যারা তারা সবাই গঙ্গাজী বলেন। পূজো হলো। পান্ডা আছে তবে উৎপাত তেমন নেই, বরং যমুনোত্রী তে একটু বেশি। মন্দিরের পুরোহিত কুবের মুদ্রা দিলেন আমার ছায়া সঙ্গিনীকে। আধুনিক মুদ্রা। একপিঠে গঙ্গামাইয়া, অন্যদিকে মন্দির সমিতির নাম মুদ্রিত। সারথীর ইচ্ছায় গঙ্গোত্রীতে না খেয়ে নেমে এলাম একটু নীচে ভৈরো ঘাটি। এখানেও এক মন্দির, কালভৈরবের। মন্দিরের বাইরে পোকাধরা আপেল বিক্রি হচ্ছিল ২০ টাকা প্রতি কেজি। রুটি, ডাল আর প্রায় কাঁচা বাঁধাকপির সব্জি কোনরকমে গলাধঃকরণ করে ফিরতি পথে রওনা। হরশিলের কিছু আগে, বোধহয় ধরালি, এক ছোট জনপদে ফ্রেশ আপেল কেনা হলো, এক ক্রেট ১০ -১১ কেজি, দাম ৫০০ টাকা। সুস্বাদু। পাশেই রাখা ছিল নাশপাতি আকৃতির ফল, নাশপাতি বলেই বিক্রি করছে প্রতি কেজি ৩০ টাকা। এটাকে বোধহয় বাবুগোসা বলা হয়। অসাধারণ খেতে। বলেছিল গাছপাকা কিছুক্ষণ আগে পেড়ে আনা। মিথ্যে বলে নি। হরশিলে নেমে নদীর তীরে কাটালাম বেশ কিছু সময়। কিছু ফৌজী ভাই এর সাথেও দেখা হলো এখানে। মন কেড়ে নিল হরশিল তার চোরা চাউনি দিয়ে। এখন ফেরা নদীর পারের ঘরে, উত্তরকাশী। কাল, মহাষ্টমী, রওনা হব কেদারনাথের দিকে। আপাতত পথ চলা আর নির্বাক আবৃত্তি “ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।”