বেনামী গল্পরা – মৌসুমী রায়

0
green leafed plant on sand

আশা, খুব শখ করে দিদা নাম রেখেছিলো। দিদার মনে হত তাঁর নাতনি বড় হয়ে বিশাল কিছু একটা করে দেখাবে। তা সে বিশাল কিছুই করেছে বটে। আশা তার গ্রামের ছেলে তপুকে বিয়ে করে মুম্বাই চলে আসে। বাড়ির লোক জানতো তপুর কাটা কাপড়ের বড় ব্যবসা রয়েছে মুম্বাইতে।  আশা ভালোই থাকবে।

মুম্বাই এসে অটো করে পৌছে গেলো আশা তার নতুন সংসারে। খুব অবাক হয়ে গেলো প্রথমেই। বাড়ি এমন হয়! দশ বাই দশের ঘর, তার মধ্যে খাট আলমারি ছোট টিভি সবই রয়েছে। একফালি রান্নার জায়গাও। প্রথম কয়েকটা মাস কাটার পর আশা বুঝলো জীবনে অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। প্রতিদিন রাতে ঘরে তার মদের আসর বসে। সেই সময়টুকু সে ছাদে একা বসে কাটায়। তারপর সারারাত চলে অকথ্য শারীরিক অত্যাচার। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই বাড়িতে আরো চারটে বোন অবিবাহিত। এদিকে পেটের ভিতর নতুন প্রাণের নড়াচড়া টের পাচ্ছে। তপু বেরিয়ে গেলে সকালে, ঘরের কাজ  শেষ করে সেলাইয়ের কাজ করে কিছু টাকা কামায় তাও যৎসামান্য। মাঝে মাঝে তপু সেটাও কেড়ে নেয়। পেটেরটা বাড়ছে দিন দিন, আশার অবস্থাও খুব একটা ভালো না। ভালো করে খাওয়াই জোটেনা  দুবেলা।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মেয়ে জন্মালো। খুব কম ওজন কিন্তু খুব মিষ্টি মুখটা। হসপিটাল থেকে মেয়ে নিয়ে ফেরার পর আশেপাশের মাসি বৌদিরা দুজনকে বরণ করে ঘরে তুলল। তারা সবাই আশাকে ভারি ভালোবাসে। মোটামুটি সব মহিলাদের জীবন প্রায় একই। মেয়ের নাম রাখলো সবাই স্নেহা। আশার বাড়ি থেকে ফোন করলে সব সময় বলত সে খুব সুখেই আছে। তবে এখানে ঘর খুব ছোট তাই কেউ যেন আসে না এখানে থাকতে।

মেয়ের যখন ছয়মাস বয়স একদিন হঠাৎই পুলিশ এসে জানিয়ে গেলো তপুর লাশ পাওয়া গেছে আশা গিয়ে যেন সনাক্তকরণ করে আসে। আশার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হল।

 পাশের ঘরে মাসি একাই থাকতো তার ছেলে দুবাইয়ে থাকে। মাসে মাসে মাকে মোটা টাকা পাঠায়। আশা একটা কাজ পেলো,কিন্তু নাইট সিফটে। মাসি নিজেই বলল স্নেহাকে মাসির কাছে রেখে আশা যেন কাজ টা করে নয় মেয়েকে মানুষ করবে কি করে। আশা কাউকে বলতে পারেনি নাইট সিফটে তাকে কি কাজে যেতে হয়।

খালি পেট মেয়েকে মানুষ করা একটা ক্লাস সেভেন পাস করা মেয়ে কি করে সামলায়? সন্ধ্যে ছয়টা থেকে রাত নটা সেলাই এর কাজ করত। তারপর মালিকের রাত রঙিন করত। ভোর রাতে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে পাপ ধুয়ে দিন শুরু করত। একদিন আর না পেরে মাসিকে সব বলেই বসল সে সব কথা,সে কি কাজ করে। মাসি চুপচাপ বসে থেকে কিছুক্ষণ পর বলল। মুম্বাইতে এমন মহিলা প্রচুর রয়েছে, তারা না পেরেছে মরতে আর না মাথা উঁচু করে কিছু করতে। মাসি নিজেও তার ছেলেকে এইভাবেই লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে। তার আর কোন উপায় ছিলো না।

 বছর দুয়েক পর আশা লাখ খানেক টাকা জমিয়ে ফেলতে পারে। একদিন ওই নোংরা মালিককে না জানিয়ে সে গ্রামে ফিরে আসে মেয়েকে নিয়ে। না বাবার বাড়িতে ওঠেনি সে ছোট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে, ঘরেই একটা দর্জি দোকান খুলে বসে। আর রবিবার করে সেলাই শেখানোর কাজ। মুম্বাইতে থাকাকালীন সে সেলাইয়ের মাস্টার হয়ে উঠেছিলো। মেয়ের নাম পালটে দেয় স্নেহা হয়ে যায় আলো। আশার, আলো। তার অতীত কেউ জানেনা এখানে। এক এক করে বোনেদের বিয়েও দেয় আশা।

জীবনে প্রচুর ভয়ে ভয়ে বেঁচেছে আশা, আজ আর নয়। এখন সে অনেক মেয়েকে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার পথ দেখায়। সে নিজেই ভয়কে জয় করতে শিখেছে যে।

Leave a Reply

error: Content is protected !!