কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (ষষ্ঠ কিস্তি)

বম্বেতে গিয়ে জীবনে প্রথম কোনও নারীর কাছ থেকে বাংলায়, ‘আমি (তোমাকে) ভালবাসি’ শুনলাম। মেয়েটির মারাঠী, নাম মঙ্গলা, মঙ্গলা দেশপান্ডে। কাজ করে বম্বে হেড অফিসের রিসেপশনে। সালোয়ার কুর্তা পরা সপ্রতিভ চেহারা, মুখে একটা হাল্কা হাসির ছোঁয়া থাকে। সময়টা সকাল দশটা মতো। আমার বম্বে অফিসে প্রথম দিন। আমার সাথে দেখা হতেই একটু হেসে আমার চোখে চোখ রেখে বলল ‘চ্যাটার্জি, বেঙ্গলি। আমি ভালবাসি।’ তোমাকেটা না হয় নাই বলল। প্রথম দেখাতেই এতটা কী কম!

তবে আমার বোধবুদ্ধি মাথায় চড়ে বলে উঠল, ‘তুমি বোধহয় বলতে চেয়েছো, আমি ভালো আছি। তাই নয় কী?’  ঠিক তাই। অমিতাভ বলতো, ‘এ দুনিয়ায় সময় মতো গাধা হয়ে যাবার একটা বিশেষ সুবিধা আছে। না বোঝার ভান করে এগিয়ে যা, গাধা ঘোড়ার ঘাস আলাদা হয় না।’

বম্বেতে বর্ষাকালটা মোটেই উপভোগ্য মনে হল না। নগরটা কেমন যেন অপরিষ্কার লাগছিল। আমি চান্নি রোড বলে একটা জায়গায় যে হোটেলে থাকি, সেটাও একেবারেই সাধারণ। চান্নি রোড, ভি.টি. র থেকে কটা স্টেশন পরেই। বম্বে অফিস ভি. টির থেকে হাঁটা পথ। হেঁটে হেঁটে স্টেশনে আসতাম আর তারপর ট্রেনে মিনিট পাঁচেক। এর মধ্যে মধুপায়ি ঘোষদার কোনো অনুপ্রেরণা ছিল না, নেহাতই সময় বাঁচানো। এ বিরাট শহরে আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তেমন চেনাও কেউ নেই, তাই দূরে কোথাও না গিয়ে অফিসের পর বিকেলে মেরিন ড্রাইভের পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। এখানেই প্রথম সমুদ্র দেখলাম। পুরী দিঘা এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বর্ষার সমুদ্রের ঢেউ পাথরে আছড়ে পড়ে আমাকে আলিঙ্গন করতে চাইতো, আমি নিরুত্তাপ উদাসিনতায় সে আলিঙ্গন এড়িয়ে চলতাম।

শনিবার আমার অভ্যাস মতো সকাল সকাল অফিস গিয়ে দেখি প্রায় ফাঁকা। অভ্যর্থনায় বসে একা মঙ্গলা। তাড়াতাড়ি এসে যেন ভীষণ ভুল হয়ে গিয়েছে এমন মুখ করে হ্যালো বলল। দুতিনটে কথার পর জিজ্ঞেস করল, ‘বম্বেতে কী কী দেখলে?’

উত্তর হওয়া উচিত ছিল, ‘এখনো তোমাকে দেখাই শেষ হয়নি, আর যা কিছু, তা না দেখলেও চলবে।’ বলতে আর পারলাম কোথায়!

গাধার মতো বললাম, ‘এই মেরিন ড্রাইভ, গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া ব্যাস। এলিফ্যান্টা যাবার ইচ্ছে ছিল…’

‘এলিফ্যান্টা! এই বর্ষাকালে! মোটেও ভালো কাজ হবে না। তারচেয়ে বম্বের চারদিকে একটা কন্ডাকটেড ট্যুর হয়, সাবার্বান ট্যুর বলে, কাল সানডে চলে যাও। সারাটা দিন ভালো কাটবে।

‘আমার তা মনে হয় না। একা একা, ভালো লাগবে না।

‘এত বড়ো শহরে বন্ধু তো পেয়েই যাবে।

‘বন্ধু কোথায় পাবো? আমি তো কাউকে চিনি না, তুমি আসবে?

‘এ মা, তুমি যেন কী? একজন অল্প পরিচিত মহিলাকে এভাবে বলে নাকি!

তুমি আমার হাজার বছরের চেনা,

তুমি সুর দিয়েছো

তাই আমার কবিতা গান হয়ে উঠেছে

অজন্তার গুহায় তুমি রঙ দিয়েছো বলেই আমি ছবি এঁকেছি,

বালুকাবেলায় পাশাপাশি দুই সারি পদচিহ্ন

শুধুই তোমার আর আমার।

‘ও সরি আমি ঠিক…’

‘সরি হবার কিছু নেই, আমি আসব।’

আমি মহারাষ্ট্র ট্যুরিজিমের অফিসে গিয়ে সেদিন বিকেলেই রবিবারের পুরোদিন বম্বে সাবার্ব ট্যুরের দুখানা টিকিট কেটে ফেললাম। পরে যদি টিকিটের অভাবে সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়? সুযোগ? হাতছাড়া? কিসের সুযোগ, কী হাতছাড়া হবার ভয়? এক ছুটির দিনে প্রায় আমারই বয়েসের এক নারীর সাথে সারাদিন কমলা নেহরু ন্যাশনাল পার্ক, বিহার লেক, ক্যানারি কেভসে ঘুরে বেরানো, এই বিরাট শহরে এক ভালো সঙ্গী পাওয়াই কী প্রাপ্তি নয়?

বন্ধুরা শুনলে প্রথমেই বলবে, ‘ফালতু কথা ছেড়ে, কী কী হলো বল।’

‘কী আবার হবে’ বললে, কথা প্রসঙ্গে বহুদূর গড়াবে। ‘চুমু টুমু খাসনি? হাতও ধরিসনি? তবে করলিটা কী?’

অর্থাৎ এমতাবস্থায় কিছু প্রথাগত অবশ্য কর্তব্য আছে, যা পালন করলেও ঈর্ষার বিষয়, না করলে, ‘তোর দ্বারা কিছুই হবার না। ভগবানও মাইরি, দুনিয়ার সব ইয়েদেরই এসব চান্স মেলে। আমি হলে তো সোজা হোটেলের ঘরে নিয়ে গিয়ে…’

আমার এক মামা আছেন, যৌবনকালে প্রখ্যাত নারী শিকারী ছিলেন বলে প্রকাশ। তাঁর মতে, মেয়েরা সেন্টুটা ভালো খায়। কায়দা করে পরিবেশন করতে হয়। মানে একটু হতাশা, একটু দুঃখী দুঃখী ভাব, ‘জীবনে কিছু পেলাম না, কিছু হল না, একটু সহানুভূতির জন্য ভিতরটা একেবারে হু হু করে।’ ইত্যাদি বলতে বলতে টুক করে মেয়েটির হাতটা ধরে ফেলতে হবে এবং ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে হবে। পথে বাধা পেলে একই রাস্তায় নেমে আসতে হবে। আর বাধা না পেলে বলাই বাহুল্য। এদের কারোর কথা না শুনেও দিনটা ভালো কাটল। গাড়িতে বন্দী থেকে বাইরে খোলা পশু দেখলাম। এই শহরে যে এতো পুরোনো একটা বৌদ্ধ বিহার আছে জানা ছিল না। বিহার লেকটাও যথেষ্ট বড়ো আর সুন্দর। মঙ্গলা কথা বলতে ভালবাসে। আমি শুনছিলাম। বাড়ি পুনেতে। থানের কাছে এক ফ্ল্যাটে অন্যদের সাথে ভাগ করে থাকে। এখানে থাকার জায়গার খুব সমস্যা আর খরচও নাকি বেশি। রোজ অনেকটা পথ লোকাল ট্রেনে চেপে আসে, নিজের কাজ ভালবাসে। আমাদের সেদিনের যাত্রা শেষ জুহুতে এসে। আমি প্যান্টটা সামান্য গুটিয়ে মুখ তুলে দেখি ও জলে নেমে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সে হাত ধরে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে হয় না, সাথে সাথে চলতে হয়।

ফেরার পথে মঙ্গলা হঠাৎই জিজ্ঞেসা করল, ‘এই চাকরিতেই থেকে যাবে না কী? অন্য চাকরির চেষ্টা করছ না?’

আমার সবে তো পায়ের তলায় মাটি শক্ত হতে শুরু করেছে, এখনই?

‘কেন? আমি এন.টি. তে বেশ আছি। খারাপ তো কিছু দেখি না। একটু আধটু যা, তা তো সবখানেই থাকে।’

‘আমাকে বিশ্বাস করো। আমার কাজের সুবাদে আমি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই জানি। অন্য চাকরি নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যাও।’

‘বুঝতে পারলাম না। একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয়।’

মঙ্গলা আর মুখ খুলতে চাইল না, কিন্তু একাধিক বার বন্ধুত্বের দোহাই দিলো। আবার আর কাউকে না জানানোর দিব্যিও দিয়ে নিল। আমি একটু রোমান্টিক হবার চেষ্টা করে বললাম, ‘যদি অন্য কোথাও চলে যাই, তবে তোমার সাথে আবার দেখা হবে কী ভাবে?’ মঙ্গলা সামান্য হেসে প্রসঙ্গটা পাশে সরিয়ে রাখলো। রহস্যময় হাসি হাসাটা তো শুধু মোনালিসারই পেটেন্ট নয়। বীণা যেমন বাজেনি, মঙ্গলারতিও হল না।

সোমবার থেকে আমার গন্তব্য ছিল কুরলা – আন্ধেরী রোডে, সাকিনাকায়। লোকাল ট্রেনে বেশি সময় লাগলো না। ওখানেই এন টি র প্লাস্টিক ডিভিশন। অফিসের একটি ছেলে সাথে থেকে এদিক ওদিক নিয়ে গেলো। ওখানে কয়েকটা নাম করা মোল্ডেড লাগেজের কারখানা আছে, যারা এন.টি.র মেশিন ব্যবহার করে। কত অল্প পরিশ্রমে, অল্প লোকবলে ভারত বিখ্যাত সুটকেশগুলো তৈরি হচ্ছে দেখে অবাক লাগে। দুটো কারখানায় দুদিন করে কাটিয়ে মনে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম। এন.টির কিছু ব্যাপার আছে যা বুদ্ধিগ্রাহ্য হয় না। ইঞ্জেকশন মোল্ডিং, ব্লো মোল্ডিং এর যথেষ্ট ভালো ভবিষ্যৎ থাকা সত্ত্বেও সে সব ব্যবসায় কোম্পানির কোনও উৎসাহ দেখি না। আহমেদাবাদে একটা ডিভিশন আছে যেখানে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগের ট্যাঙ্ক ইত্যাদির জন্য ব্লোয়ার বানানো হয়। তাছাড়া ভ্যাকুয়াম পাম্পও বানানো হয়, তবে কোথায় ব্যবহার হয় জানতে পারিনি। এই ডিফেন্স কাজকর্মের সাথে যারা যুক্ত, তারা একটু আলাদা। আলাদা মানে যেন এরা সবাই অন্য এক কোম্পানিতে কাজ করে। বম্বেতেও দেখলাম একই রকম, কোম্পানির অংশীদার খোদ দিলীপভাই নিজে ব্যবসাটা দেখেন। এ সব নিয়ে কেউ কখনও মন্তব্য করে না, প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যায়। মঙ্গলা কী ভেবে আমাকে চাকরিটা ছাড়তে বলল বুঝে উঠতে না পারলেও, ওর পরামর্শটাকে একটু গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে লাগলাম। পরের বছরের পাবলিক সেক্টরের সব চাকরির বিজ্ঞাপন আসতে শুরু করছে, এখন তো সুবিধা, কলকাতাতেই পরীক্ষা দেওয়া যাবে। পোস্টাল অর্ডার চাইলেও দেওয়া যাবে। বেকার নই, একটা চাকরি তো আছে।

এবছর পুজোর সময় ছুটি পাওয়া গেলো না। এমনিতে সপ্তমী থেকে দশমী অফিস ছুটি, তাতে আবার দশমীটা রবিবারে। ‘এই তো চার পাঁচ মাস চাকরিতে ঢুকেছো, এখনই ছুটি ছুটি করলে হয়।’ এদিকে মা বাবার জন্য পুজোর গিফট কিনে বসে আছি। দিদি বললো পুজোর ক’দিন আমাদের বাড়িতে এসে থাক। দিদির শশুরবাড়ি কলকাতার কাছেই, কল্যাণীতে। পুজোর ক’দিন দিদির শশুরবাড়ি পুরো গ্যাঞ্জাম থাকে, সবাইকে চেনাই সম্ভব না। সত্যিটা হলো জলপাইগুড়ি ছেড়ে পুজোর সময় সেখানে থাকা পোষায়! ট্রেন তো বেশি নয়। একটাতেও টিকিট নেই। যা থাকে কপালে বলে ষষ্ঠীর দিন এসপ্ল্যানেড থেকে শিলিগুড়ির বাসে উঠে বসলাম।

সপ্তমীর দিন বাড়ি পৌঁছে পাড়ার পুজোয় গিয়ে প্রথমে মনে হলো, এবার তো কিছুর মধ্যেই আমি থাকতে পারিনি, পরিচিতরা অবহেলা করবে না তো! ব্যাপারটা অন্য রকম হলো। কলকাতায় চাকরি করার সূত্রে সামান্য সম্ভ্রম আদায় করে নিলাম। মার পাশে দাঁড়িয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলি দেওয়ার সময় দীপা কাকিমা বললেনও ‘শান্তকে বেশ জামাই জামাই লাগছে।’ দীপা কাকিমা হলো শর্মিষ্ঠার মা। আমাদের পাড়ার মধ্যে হৃদয়গত সম্পর্কস্থাপনের আর্ষ ছিলো না। তবুও ওই আর কী!

জলপাইগুড়িতে সব প্রায় আগের মতোই আছে। অমিতের বাড়ির সাথে ওর দিদির বাড়ির মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অমিত চৈতালিকে ছেড়ে এখন ওর বৌদির বোনকে অঙ্ক করাচ্ছে। তুহিনের কিছুদিন সন্দীপন চ্যাটার্জির মতো এখন কোনো অসুখ মানে প্রেম নেই।

যেটা একদম আশা করিনি সেটা হলো নবমীর রাতে পাড়ায় গানের জলসায় কাকলি বোসকে দেখলাম। গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। তুহিন তো বলেছিল ও জলপাইগুড়ির বাইরে কোথাও পড়তে গিয়েছে। কাকলি গানটা আগের থেকেও অনেক ভালো গায়। ‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে…’ গানটা আসলের থেকেও ভালো গেয়ে হাতে মেমেন্টো আর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে, যারা যারা ‘সুন্দর গেয়েছো ’ বলছিল তাদের স্মিত হাসির ধন্যবাদ দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

‘শান্তনু বাবু, ভালো আছেন? শুনেছিলাম কলকাতায় থাকেন। নতুন চাকরি, দারুণ ব্যাপার!’

আমি একেবারে কাঁটা চচ্চড়ি হয়ে গেলাম। একে তো শান্তনু বাবু বলে সম্বোধন, তার ওপর আমার কলকাতায় যাবার খবর রাখা। কী যে বললাম, নিজেই বুঝলাম না। মার হিসেবে পুজোয় নতুন জামা না পড়ার মতো লায়েক হয়ে যাইনি, তাই বেশ সেজেগুজেই ছিলাম। শাড়িতে কাকলিকে নারী লাগছিলো। আত্মপ্রত্যয় ওর চেহারায় রূপটানের কাজ করে। মঞ্চ থেকে তখন জলপাইগুড়ির হেমন্ত কালুয়াদার গান ভেসে আসছে, ‘একে তো ফাগুন মাস দারুন এ সময়।’

কতজনে তো চাকরি পাবার সুখবরের সাথে খেতে চেয়েছে। কাকলিকে কোথাও খেতে নিয়ে যেতে পারলে কী দুর্দান্ত হতো। কিন্তু কাকলি সে দিক দিয়ে গেলো না।

‘একটা রিকশা ধরে দিন না, বাড়ি যাই।’

আমি অত্যুৎসাহী গাধার মতো রিকশা ধরে দিলাম। কাকলি হাত নেড়ে চলে গেল। কেন জানি না, সবসময়েই হাত নাড়ানোর পরই মনে হয় হাতটা ধরা উচিত ছিল। বলতেই পারতাম, ‘হাকিম পাড়াতো তেমন কিছু দূরে নয়, পুজোর দিন। চলোনা মানে চলুন না, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে দিয়ে আসি। পথে সমাজপাড়ার ঠাকুরটাও দেখা হয়ে যাবে।’ বন্ধুরা আওয়াজ দিলে দিতো! 

()

আমার এই বেচারামের চাকরির জীবনে যে বড়সড় পরিবর্তন এলো তার জন্য দুটি নারীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে প্রমাণ হয় দুই সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বাসিন্দা দু’জন, একই সময়ে একই ঘটনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারেন, যদি তাদের একটি মাত্র কমন ফ্যাক্টর থাকে যে তাঁরা নারী। প্রথমটি আমাদের অফিসেরই শ্রীমতি দাস এবং দ্বিতীয়টি, এক বিদেশীনি, নাম বো ডেরেক (দুর্ভাগ্যবশত ইনিও শ্রীমতি)।

সময়টা উনিশশো চুরাশি সালের জানুয়ারির শেষের। ভুটিয়া সোয়েটার বিক্রেতার দল ওয়েলিংটন থেকে পাততাড়ি গোটানোর মুখে। পার্কে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর রাতের বেলা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে উত্তাপ নেবার প্রয়োজন এবছরের মতো ফুরিয়েছে। দুপুরের স্টুতে বাধাঁকপিটা ঘাস ঘাস লাগতে শুরু করেছে। সেই সময় কোনও এক শারীরিক অসুস্থতার জন্য, মিঃ দত্ত সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিলেন। কিন্তু তেমন ভাবে কাউকে অফিসের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন না। মিঃ বিশ্বাস পুরোপুরি নির্লিপ্ত থাকলেন। ওনার নিজের রেলের অর্ডারের বাইরে কিছু জানতে চাইলেন না। অফিসে একটা ছুটির আমেজ চলে এলো। বিকেলে সামবায়িক পদ্ধতিতে মুড়ি তেলেভাজা খাওয়া হতে লাগলো। সবার গলা নামিয়ে কথা বলার দীর্ঘদিনের অভ্যাসটা বেশ পাল্টাতে থাকলো। আমি ঘোষদার মজা করে কাটাবার উপদেশ উপেক্ষা করে অল্প স্বল্প কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। বৈপ্লবিক কিছু না, চিঠির উত্তর দেওয়া, ছোটোখাটো কোটেশন বানানো এসব আর কী। ঘোষদা সাবধান করেছিলেন, ‘সিন্সিয়ারিটি কমপ্লেক্স ভালো নয়।’ আমার এই কাজ করার পাকামোটা মিসেস দাসের বিশেষ হজম হচ্ছিল না। পদে পদে জিজ্ঞেস করতেন, ‘দত্ত সাহেবকে জানিয়েছেন তো?’ পঞ্চমবার সেই একই প্রশ্নটা শুনে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আমি আমার কাজটা জানি, আপনি আপনার কাজ করুন।’ শ্রীমতি দাস ডারউইনের তত্ত্ব নির্ভুল প্রমাণ করার মতো মুখ করে আমার বানানো কোটেশনটাকে পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, ‘আমি দত্ত সাহেবের পি.এ., আপনার টাইপিষ্ট নই।’

শেষবার আমার খাতা ছুঁড়ে ফেলেছিলেন ক্ষিরোদ স্যার, আমি তখন জলপাইগুড়ি জেলাস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাংলা রচনা খাতায় ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার নিদেন শিক্ষক না লিখে ‘অভিনেতা হতে চাই’ লেখার অপরাধে খাতাটা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘য়েঃ! উনি উত্তম কুমার হবেন – অপদার্থ।’ সেদিনও আমি খাতা কুড়িয়ে নিয়ে বলেছিলাম, ‘খাতা বই ছুঁড়বেন না স্যার, সরস্বতীর অপমান হয় আর খাতাটা ছিঁড়ে যায়।’ এখন আমি আর ক্লাস সিক্সের বাচ্চা নই, আর পুরো অফিসের সামনে এহেন অভদ্রতা বরদাস্ত করলে আর এখানে কাজ করা যাবে না। সঙ্গত কারণেই আমি মিসেস দাসকে ছেড়ে কথা বললাম না, অফিসে একটা বিশ্রী নাটক হলো। মিসেস দাস চোখে রুমাল চাপা দিতেই আমি চেপে গিয়েছিলাম। তবে তার ফলটা টের পেলাম পরে। দত্ত সাহেব ফিরে আসার পরের দিন থেকে আমি অফিসে অচ্ছুৎ হয়ে গেলাম। কাছে গেলে সবাই প্রায় সাতকর, বাঘের আঁচড় এবং লাল নিয়ে থাকতো। দু বেলা যে দু কাপ চা আসতো, সেটা চালু থাকল। দুপুরে একা একাই খেতে যেতে হতো, টেবিল থেকে সব ফাইল কোন মন্ত্রবলে হাওয়া। ততদিনে কিছু কাস্টমারের সাথে আমার কিছুটা পরিচয় গড়ে উঠেছে। তারা অফিসের ফোনে কল করে আমাকে চাইলে বলা হত ‘অফিসে নেই।’ অফিসে কেউ দেখা করতে এলে, অন্য কারোর সাথে ভিড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল। আমার সব পাকিয়ে আনা অর্ডারগুলো ঘোষদা দক্ষ হাতে পেড়ে আমার নামের খোসা ছাড়িয়ে, নিজের প্লেটে সাজিয়ে নিতে থাকলেন। ‘চলে ভাই, সব চলে।’

বিকেলে সেই কায়দা করে ঘোষদের সাথে একসাথে ফেরার ব্যাপারটাও বন্ধ হয়ে গেল। এ ধরনের শাস্তির সাথে পরিচয় ছিল না, এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। ক’বার দত্ত সাহেবের সাথে দেখা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে বুঝলাম উনি আমার মুখ দেখতে ইচ্ছুক নন। খবরের কাগজ তো পড়ার অনুমতি নেই, তাই সময় কাটাবার জন্য, কলেজের বইগুলোই দেখতে থাকলাম। বুধবারের স্টেটসম্যান দেখে আর্জি পাঠানো তো বম্বে থেকে ফিরেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন চোখ বুঁজে সর্বত্র আর্জি পাঠাতে শুরু করে দিলাম। তার ফলও ফলতে শুরু করলো। মাসের প্রথম রবিবার একসাথে দু দুটো লিখিত পরীক্ষার চিঠি এলো। একটি ন্যাশনাল আয়রন ওর কোম্পানি লিমিটেডের সকাল সাড়ে আটটায়, অন্যটি স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের, সকাল সাড়ে নটায়। প্রথমটির নাম ছাড়া অন্য কিছু জানি না, কবে কেন আবেদন পাঠিয়েছিলাম মনে নেই, চাকরিটাও ভারতের আর এক প্রান্তে, কর্ণাটকায়। অন্যটি বাংলায় তো বটেই, ঘরের কাছেও হতে পারে। এসব জানা সত্ত্বেও আমার নিকলের পরীক্ষায় বসার একমাত্র কারণ ও প্রেরণা বো ডেরেক নামক এক বিদেশীনি। আমার হাতে ‘টারজান দ্য এপ ম্যান’ ছবির রবিবারের বারোটার শোএর দূর্লভ টিকিট। বাজারে শুনেছিলাম, জেন রূপী বো ডেরেকের বস্ত্র স্বল্পতা বা অনুপস্থিতি এপম্যানকে হীম্যান বানিয়ে তুলেছে। এমতবস্থায় সাড়ে নটার পরীক্ষায় ঝুঁকি নেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়, বিশেষত স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের পরীক্ষার জায়গা থেকে নিউ অ্যাম্পায়ার বেশ কিছুটা দূরে। সাড়ে আটটায় নিকলটাই সব দিক দিয়ে ঠিক লাগল। অফিসে বসে পড়াশুনোর ফলে নিকলের পরীক্ষা দিব্যি হলো আর ‘বো ডেরেকের জেনের জন্য গুরু পাঁচটা চাকরির পরীক্ষা ছাড়া যায়।’ সেই পরীক্ষা দেবার সময় দেখা হল বিপদ ভঞ্জন করের সাথে। আমার সাথে কোনো রকম পরিচয় বা যোগসূত্র ছিল না। এর আগে কখনো দেখিনি, পরীক্ষার সময় আমার বাঁ দিকে পিছে বসেছিল। বিনা ভূমিকায় বলল, ‘শর্ট শার্কিট করব, বুঝলি তো?’ অচেনা লোকের মুখে তুই শুনে একটু অবাক হলাম। শর্ট শার্কিট পদ্ধতির সাথে পরিচিত না থাকলেও করের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধে হয়নি। তবে করের খাতা থেকে নকল করার প্রবৃত্তি অথবা প্রয়োজন কোনোটাই আমার ছিল না। নিজের সিটের ভৌগোলিক অবস্থানের দরুন করের আমার উত্তর পত্র নকল করতে অসুবিধে হচ্ছিলো না, তবে বো ডেরেকের তাড়নায় আমি তাড়াহুড়ো করাতে শেষের কটা উত্তর দেখতে পারেনি। ‘তাড়াহুড়ো করছিস কেন, সময় তো আছে।’ সে অপদার্থকে কেউ কী বলে দেয়নি, সময় আর বো ডেরেক কারো জন্য অপেক্ষা করে না।

আমার নিকলের ইন্টারভিউটা এলো বেশ কদিন পর, অফিসের মানসিক অত্যাচারে আমার মনোবল তখন একেবারে তলানিতে। ইন্টারভিউ হবে ওদের হেড অফিস ব্যাঙ্গালোরে। থাকার ব্যবস্থাও ওরাই করবে। ইন্টারভিউ দিতে যেতে আসাতেই পাঁচ ছ দিনের ধাক্কা, স্লিপার ক্লাসের ভাড়াটা অবশ্য দেবে। সত্যি বললে তো অফিসে আর ছুটি দেবে না, নাকি আপদ বিদেয় হোক বলে মালা পড়িয়ে ট্রেনে তুলে দেবে কে জানে? তাই ঝুঁকি না নিয়ে জ্বর বলে অনুপস্থিত থাকলাম। মনে একটা ভয় থেকেই গেলো, যদি দেখতে চলে আসে? বাড়িটাতো আহমেদের চেনা। ব্যাঙ্গালোরে সেই প্রথম বার, কিন্তু একফোঁটা উল্লাস অনুভব করিনি। চাকরিটা যে আমার চাই, আর কিছুই কিছু না। পৌঁছে গিয়ে শুনি গতকাল থেকে নাকি ইন্টারভিউ চলছে, আগামীকাল দুপুর নাগাদ আমার ডাক আসবে। মোট জনা কুড়ি নেবে আর ডেকেছে একশোর বেশি। তাছাড়া সংরক্ষণ তো আছেই। সবজান্তা শর্টসার্কিট করের বিশেষজ্ঞ মতামত, ‘শেষের দিকে তো ধরবে আর ছাড়বে, কেন মরতে তাড়াহুড়ো করে উঠে গেলি!’ আমার তাড়াহুড়োতে আমার ক্ষতি হবার কথা তো নয়, তবে মনটা একেবারে দমে গেল। একে তো অফিসে এক অসহনীয় অবস্থা, তার ওপর এতদূরে এসে, এতদিনের ছুটি নষ্ট করে, খালি হাতে ফিরে যাওয়া। পুজোর সময়েই মাইনে কেটেছিল, এবার তো কাটবেই কাটবে। আমার ডাক পড়লো একেবারে শেষে। ঘরে জনা পাঁচেক বসেছিলেন। সবারই কমবেশি সিরিয়াস চেহারা। এক জন লম্বা সৌম্যদর্শন পঞ্চাশোর্দ্ধ ভদ্রলোক মাঝে বসেছিলেন, আমাকে বসতে বলে প্রথমেই বললেন, ‘অভিনন্দন মিঃ চ্যাটার্জি! আপনি আমাদের সর্বভারতীয় লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। আপনার সাফল্যের চাবিকাঠিটা কী? নিজেকে কী সবার সেরা মনে করেন?’

দুপুরে খাবার পর, ডাক্তারি পরীক্ষা, সেখানে আবার করের সাথে দেখা। শর্টশার্কিটের সুফল ফলেছে তা দেখতেই পেলাম। চোখ গোলগোল করে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, এরা কী প্যান্ট ফ্যান্ট খুলে টুলে টেস্ট করবে?’

কলকাতায় ফিরে এন.টি.-র অফিসে আর অতটা খারাপ লাগছিল না। মনের মধ্যে তবলা বাজছিল, আর তো কটা দিন। ইচ্ছেমতো ফোন ব্যবহার করতে থাকলাম, দু তিনবার তো ‘পিকু পিকু’ খেলে নিলাম। সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে খবরের কাগজ পড়তে লাগলাম, যখন তখন অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলাম, এক কথায় যাচ্ছেতাই। আমি খুব চাচ্ছিলাম, মিসেস দাস ভিতরে গিয়ে আমার নামে সাতকাহন করে লাগাক আর মিঃ দত্ত আমাকে একবার ঘরে ডেকে (সবার সামনে হলে আরও ভালো) কিছু বলুক। ওঃ! একেবারে গায়ের ঝাল মিটিয়ে নেওয়া যাবে। কলকাতা ছেড়ে যাবার দুঃখের চেয়ে এই অফিস ছেড়ে যাওয়ার আনন্দ অনেক বেশি মনে হচ্ছিল।

সেদিন দুপুরে দু টাকার লাঞ্চ সেরে অফিস বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নতুন কী বাঁদরামো করা যায় ভাবছি, হঠাৎ একজন অচেনা লোক এসে আমাকে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করে হাতে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে, পিওন বুকে সই পালিয়ে নিলো। চিঠিটা কোনও এক মুন্ড শিকারি সংস্থার, আগামী রবিবারে সকাল এগারোটায় এক নামজাদা হোটেলে চাকরির ইন্টারভিউ। আমি একটু অবাক হলাম, যদিও গোছাগোছা আবেদন পাঠিয়েছিলাম, তবুও এই কোম্পানিটির নাম কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। এই জন্য বাবা বলেন ফাইল বানাতে, রেকর্ড রাখতে। যাহোক রবিবার, কাজটা কী আছে ভেবে ঠিক ঠাক জামা জুতো পরে সেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আমি ছাড়া আর কোনও প্রার্থী দেখলাম না। হোটেলের ঘরে একজন অবাঙালি ভদ্রলোক। চা আর কাঁচা পাঁউরুটির স্যান্ডউইচ খাওয়ালেন আর চলল প্রশ্ন বর্ষা। সবই আমার বর্তমান কোম্পানির কাজ সম্বন্ধে। কলকাতা, আহমেদাবাদ আর বম্বে এমনকি দিল্লি অফিস সব নিয়ে, লোক, কাজ কর্ম, অতি বিস্তারিত এবং বিরক্তিকর। যতটা জানা ছিল বললাম। আরেকটা অস্বস্তিকর ব্যাপার হলো উনি আমার সম্মতির পরোয়া না করে আমাদের সব কথা রেকর্ড করে রাখছিলেন। দেড়ঘন্টা পর যখন হাত ঝাঁকিয়ে মুক্তি দিলেন, আমি তখনও বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে চাকরিটা কিসের এবং আমাকে ওনার পছন্দ হয়েছে কি না! সাধারণত ইন্টারভিউ এর শেষে ‘পরে জানাবো’ মানে চাকরিটা হল না, এখানে তেমন কোনও বাঁধা ধরা উত্তরও পেলাম না। তবে নিকলের চাকরিটা প্রায় পকেটে থাকায় আমার ওপর এই ঘটনার বিশেষ কোনও প্রভাব পড়ল না। সুখের কথা হল সামনেই মেট্রো সিনেমা আর শো শুরু হতে তখনও পনেরো মিনিট বাকি।

এপ্রিলের শুরুতেই দুদিনের মধ্যে তিনজন পদত্যাগ পত্র জমা দেওয়ায়, এন.টি-র কলকাতা অফিসে বেশ হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। বিশেষত ঘোষদার পদত্যাগটা তো কেউ আশা করেনি। প্রথমে ভেবেছিলাম পদত্যাগ পত্রে বার্ণিকের সম্পাদকীয়র মতো জমজমাট কিছু একটা লিখবো। সুবীর দত্ত, যতদিন বেঁচে থাকবে, মনে রাখবে। ধীরে ধীরে মনে হতে লাগলো লিখিত প্রমাণ রেখে কাজ নেই। যা হবে সামনা সামনি। তাই আমি একটাকা খরচ করে একটা অতি সাদামাটা পদত্যাগ পত্র অফিসের বাইরে থেকে টাইপ পালিয়ে পকেটে রেখে নিকলের চিঠির অপেক্ষা করে যাচ্ছি এবং পদত্যাগ পত্র দেবার সময় কী বলা যায় তার সংলাপগুলো ভেবে যাচ্ছি। ব্যাপারটা নাটকীয় হবার সাথে সাথে আমাকে আমার অভিনয় প্রতিভা দেখানোর পুরো সুযোগ দেবে সেই আশায় আছি। রোজ বিকেলে ফিরে গিয়ে খোঁজ করি, না নিকলের চিঠিরও পাত্তা নেই। অফিসেও নিত্য নতুন কত আর বাঁদরামো করা যায়! বাঁদরামো করেও যে বিশেষ তৃপ্তি হচ্ছে তাও নয়। একদিন অফিসে এলামই না, নদীর পাড়ে রোদ পোয়ানো কুমীরের মত ঘরে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম।

কাঁপতে থাকা ঘরটা আমার বিনে পয়সার ঘড়ি

পেটের মধ্যে খিদের ভোচকানি ফাউ পাওয়া অ্যালার্ম

তোমার প্রতীক্ষায় আমার ক্যালেন্ডারের পাতা ছটফট করছে,

হাওয়া ফ্রিতে মজা দেখছে। 

দু-তিন দিন যত সব পাতে দেবার অযোগ্য ছবি দেখে, রাস্তা ঘাটের মুখরোচক অখাদ্য খেয়ে দেরি করে ঘরে ফিরতে লাগলাম। এরপর ভয় পাওয়া শুরু হলো। বাড়িতে চিঠি লেখার সময় কী লিখবো ভেবে পেলাম না। মা গত চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তোর সরকারি চাকরির কী হলো?’ এক এক করে নিকলে ইন্টারভিউয়ের সময়, আগে পরে, কী কী হয়েছিল মনে করার চেষ্টা করে গেলাম। ওরা তো হ্যাঁ বলেও দিয়েছিলো, ডাক্তারি পরীক্ষাও তো হয়ে গেছে। তবে? চিঠিটা যদি হারিয়ে যায় তাহলে কী করে জানতে পারবো? ওরাই বা কী করে জানবে আমি চিঠিটা পাইনি? ওদের অফিসে একটা ট্রাঙ্ক কল করে দেখবো? জানি ও না তো যে কার সাথে কথা বলতে হবে? একবার মনে হল সেই বিপদ ভঞ্জন করের ঠিকানাটা রেখে দিলে হয়তো জানতে পারতাম ওর চিঠি এসেছে কিনা। সেই অস্থিরতার সময়ে অন্যমনস্ক থাকার জন্য কিছু চরিত্র বিরুদ্ধ কাজ ও হয়ে যেতে থাকলো। সেদিন সকালে অভ্যাস মতো শিয়ালদা থেকে হেঁটে অফিসে আসছিলাম। তাড়াতাড়ি হাঁটা আমার বরাবরের অভ্যেস। সেই তাড়াহুড়োতে অপর দিক থেকে আসা একজনের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো। ব্যথা লাগেনি, কিন্তু খুব বিরক্ত হলাম।  অভদ্রের মতো চেঁচালাম, ‘দেখে চলতে পারো না? অন্ধ নাকি?’ আমাকে লজ্জায় মাটিতে মিশিয়ে লোকটি হাত জোর করে বললো, ‘হাঁ বাবু, আমি সচমুচ আন্ধা আছি, মাফ করে দিন।’ এই কলিযুগে মাটি ধসে না তা তো নয়, কিন্তু প্রয়োজনে ধরণী দ্বিধা হয় না। আমি যত বলি, ‘সরি ভাই বুঝতে পারিনি।’ লোকটি আরও বলতে থাকে, ‘না বাবু, ভগবান হামাকে মেরে দিলো তো আপনার কী গলতি!’

একদিন রাত করে ফেরার পথে পাশের চায়ের দোকানের ছেলেটা খবর দিল, ‘দাদা তোমার এগটা চিটি এসেচে, কাল সোকালে পুস্টাপিস থিকে নিতে হবে।’

error: Content is protected !!