কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (পঞ্চম কিস্তি)

()

এন. টি-র চাকরিতে আমার কলকাতার বাইরে প্রথম ট্যুর এলো, আহমেদাবাদ আর বম্বে। সব মিলে প্রায় দিন পনেরো। প্রথমে সাত দিন আহমেদাবাদ, পরের সপ্তাহটা বোম্বে। এই আমার একদম একা বাংলার বাইরে যাওয়া নয়, কিন্তু বিজনেস ট্যুর নামটাতেই যে সম্ভ্রম মেশানো আনন্দ আছে তা আগে কে জানতো! আহমেদাবাদ শহরের বাইরে ভাটবা বলে এক শিল্পাঞ্চলে এন.টির কারখানা আর বম্বেতে হলো হেড অফিস, একেবারে নগরীর মধ্যে। এ.সি. টু টায়ারে যাবো, এই প্রথমবার। ঘোষদা বললেন, ‘আহমেদকে দাও, ও টিকিট ফিকিট সব করে দেবে।’ আহমেদেরও আক্কেল, স্লিপার ক্লাসের টিকিট করে এনেও লজ্জা নেই, দাঁত বের করে বলে, ‘এহি ঠিক আছে। ঘোষসাহেবকে পুছে নিন।’

ঘোষদা বললেন, ‘স্লিপার ক্লাসে জনগণের সাথে যাও, কোম্পানিকে এ.সি. টু টায়ারের বিল ধরাও, যা বাঁচবে সেটা পকেটে। সবাই তাই করে। কোম্পানিও জানে, তাই প্রমাণ চায় না। টি.এ. বিল হলো সেলসের মধু। মাইনের টাকায় কী আর পোষায়! ধীরে ধীরে সব জানবে।’

তার সাথে আরও উপদেশ, ‘দেখো ভাই, এই টি.এ. বিল আছে বলেই আমরা আছি। এই বাজারে সংসার চালানো কী সোজা। এতে অন্যায়ের কিছু নেই, তুমি কষ্ট করে কেষ্টোটা পকেটে পুরছো, ব্যাস। তোমার সংসার নেই কিন্তু আমাদের তো আছে। অন্যরকম কিছু করে বাকিদের বিপদে ফেলো না।’ ‘বাকিদের বিপদে ফেলো না’ টা শুধুই উপদেশ নয়, একটু আদেশের মতো শোনালো। ব্যাপারটা শুধু তো একবার আহমেদাবাদ বা বম্বে যাওয়া নয়, কলকাতার মধ্যেই ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করতে গিয়ে, বাসে ঘুরে এসে কোম্পানিকে ট্যাক্সির বিল ধরানোটাও মধুপানের অংশ এবং স্যাঁকরা গয়নার সোনায় খাদ দেবেই গোছের সতঃসিদ্ধ।

বেড়াতে আমার ভালো লাগে, তাছাড়া গুজরাত, মহারাষ্ট্রের দিকে কখনও যাওয়া হয়নি। একা একা বেড়াতে গেলে মজাটা কম হয় কিন্তু নিজের মুখোমুখি হবার সুযোগটা অনেক বেশি থাকে। অফিসের ট্যুরকে বেড়াতে যাওয়া ভেবে নিয়ে খুশি হবার বিশেষ প্রয়োজন নেই। তবে বস, তোমার ভাড়া, তোমার থাকা খাওয়ার পয়সা কোম্পানি দিচ্ছে, সেটা তো সুখের বিষয় বটেই, তাছাড়া সব সময় অফিসেই থাকব, তা তো নয়, ঘুরবো, দেখবো।

গুজরাটিরা বড়দাকে ‘মোটা ভাই’ বলে ডাকে, প্যান্ট শার্টের কাপড় সস্তা তবে ওজন করে কিনতে হয়, আহমেদাবাদ ওয়ার্কসের পাঞ্চাল লোকটি একটি অশ্বেতর ইত্যাদি অত্যাবশ্যক নানা জ্ঞানের প্যাকেট সুটকেশে পুরে আহমেদাবাদে পৌঁছলাম। পথে স্টেশনে যতবার জল ইত্যাদি নিতে নেমে এ.সি. কোচের দিকে চোখ যাচ্ছিল, এক অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছিল। আহমেদাবাদে একটা ব্যাপার দেখলাম, স্থানীয় সবাই গুজরাটকে শান্তির জায়গা বলে সার্টিফিকেট দিয়ে বিশেষ গর্বিত। তার সাথে মদ্যপান নিষেধ নিয়েও। ভাবটা কলকাতা থেকে এসেছো? তবে তো নরক থেকে স্বর্গে এসেছো। অথচ মজার কথা হলো পরে ঘরে সুটকেশ পৌঁছে দিয়ে তাদেরই মধ্যে একজন ফিসফিসিয়ে বললে, ‘সাব, বেশি পয়সা খরচ করলে কী ই না পাওয়া যায়, লাগলে বলবেন।’ আমি একটা এসি ঘর নিলাম, ভাড়া একশো টাকা, ঠান্ডা না হলে ষাট টাকা হতো। ট্রেনে না হোক, হোটেলে তো মজা করে নিই। এখানে তো আর মধুর হিসেব নিয়ে খবরদারি করতে ঘোষদাও নেই। মজা টের পেলাম রাতে, এসিটা কমবেশি করার সুইচটা কাজ করছে না, তার ফলে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কম্বল মুড়ি দিয়ে রাত কাটাতে হলো। তবুও এ.সি. বন্ধ করার কথা ভাবিনি, করলে চল্লিশ টাকা ডাঁহা লোকসান যে।

আহমেদাবাদ অফিসের ব্যাপার স্যাপারও আজব। শ্রেণি বিভাজন সর্বত্র। টয়লেট অবধি আলাদা। কর্মচারীদের জন্য পঁচিশ পয়সার দুপুরের খাওয়া। নিরামিষ হলেও বেশ ভালো, একদিন না জেনে চলে গিয়েছিলাম। আর অফিসারদের জন্য পুরো আলাদা ব্যবস্থা, ঠান্ডা ঘর, অনেক উন্নত বসবার ব্যবস্থা, তাও বিনে পয়সায়। একটা অসুবিধে, সব রান্নাই বেশ মিষ্টি। কখনও বাংলাদেশ না গেলেও আমি বাঙাল, তাই মিষ্টি মিষ্টি খাওয়ার বিনে পয়সায় হলেও খেতে উপাদেয় লাগছিল না।

পাঞ্চালের যতটা বদনাম শুনে গিয়েছিলাম, লোকটাকে ততটা খারাপ মোটেই লাগল না। তাছাড়া ওর সেক্রেটারি তো খুবই ভালো মানে ভদ্র। ঠিক কে বলে বরাবর, দিক কে বাজু। বেশ অল্প বয়েস আর বেশ মিষ্টি। গুজরাটের সব মিষ্টিই তো আর অসহ্য নয়। সু ছে, কেম ছো ইত্যাদি শিখতে লাগলাম। আলাপটাকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা ভাবতে ভাবতে একটা ছোটো ঘটনা ঘটল। সেদিন দুপুরে পাঞ্চালের অফিসে বসে রিপোর্ট বানাচ্ছিলাম। মিষ্টিজনিত কারণে খেতে যেতে একটু দেরিই করছিলাম। বীণা, নামটা পরে জেনেছিলাম, দুপুরের খাওয়ার সাথে নিয়ে আসতো। টিফিন কৌটো খুলে আমাকে ডাকল, মানে একসাথে খেতে আমন্ত্রণ জানালো। নিরাশাবাদীরা হিংসে করে বলতেই পারে, ‘বেশি হাওয়ায় উড়তে নেই। এটা নিছক ভদ্রতা ছাড়া কিছু না।’ ওসব সম্ভাবনায় কান না দিয়ে, সুনীল গাঙ্গুলির সময়ে শরৎচন্দ্র সুলভ রোমান্টিক ঘটনায় আমি বেশ উৎসাহিত। সামান্য না না করে জুটে গেলাম। আঁচার বস্তুটা খাই না, মানে খেতাম না। সেদিন জানলাম, রুটির সাথে আঁচারের কী স্বাদ।

পরদিন ভাবলাম এবার আমার ওকে খেতে বলা উচিত। নিশ্চয়ই নিরামিষ খায়। একটা ভালো নিরামিষ রেস্তরাঁর  খোঁজ খবর করে রাখলাম। অন্য বাঙালিদের মতো নিরামিষ আমার চোখের বিষ নয়। আর এখন তো নয়ই। আমার সাথে খেতে যেতে রাজী হবে কী না ভাবতে ভাবতে মনে হল, সবার প্রথমে নামটা অন্ততঃ জেনে রাখা উচিত। তারপর না হয় খেতে যাবার প্রস্তাব পেশ করা যাবে। সদ্যলব্ধ গুজরাটি ভাষাজ্ঞান উজাড় করে নাম জানতে চাইলাম। উত্তর এলো, ‘নাম বীণাবেন ছে।’ যাঃ বাবা! বেন মানে তো বোন। বাচ্চাবেলায় শিশুনিকেতনে একটা ইন্দি বিন্দির গান শিখিয়েছিলো। ইন্দির খিদে পেতে সে খিচুড়ি খাবার ইচ্ছেয় গাছ থেকে নেমে এলো। পরিণামটা ট্র্যাজিক, ‘মা এসে দুঘা দিলো, খাওয়া টাওয়া ঘুঁচে গেলো।’ আমার অবস্থাটাও তেমন দাঁড়ালো। বিকেলে দুঃখী মন নিয়ে সদমা বলে একটা হিন্দি ছবি দেখে দুঃখী মনকে আরও দুঃখী করে হোটেলে ফেরৎ এলাম। গুজরাটি শিক্ষা অভিযানের সেখানেই সমাপ্তি। তবে বেশ কিছু দিন পরে এক বন্ধু বলেছিল, ‘তুই একটি গাধা। বেনটা নামের অংশ, বোন না ভাবলেই হোলো।’ তখন আমি গুজরাটি মিষ্টির স্বাদ হারিয়ে ফেলেছি।

আহমেদাবাদ থেকে বম্বে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। ট্রেনে আট ঘন্টার পথ, সক্কাল সক্কাল পৌঁছে গেলাম। বম্বের ভি.টিতে চোর জোচ্চরের প্রাদুর্ভাব নিয়ে যতগুলো হিন্দি ছবি দেখেছি সবগুলো একসাথে মনে পড়ায় কী করে কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ট্যাক্সিওয়ালা যত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে সন্দেহ, ভয় ততই বেশি হয়। হোটেল ঠিক করা নেই, তাই ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের লোকেদের সাথে কথা বলতে হচ্ছে আর ‘ট্যাক্সিতে মালপত্র আছে’ সেই ভয়েও গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই যা থাকে কপালে বলে কাছাকাছি একটা হোটেলে উঠে পড়লাম।

error: Content is protected !!