মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, গুপ্তধনের সন্ধানে – দেবব্রত সান্যাল

‘‘আমার কবিতা চাহিছ বন্ধু আমি তো কবি নই” বরেণ্য সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় অটোগ্রাফ দেবার সময় চারলাইন ছড়া  লিখে দিয়েছিলেন, যার শুরুতেই নিজেকে স্পষ্ট করে কবি নই বলেই ক্ষান্ত হননি, অন্য কবিদের সুস্বাদু ব্যাঞ্জনের সাথে তুলনা করে, নিজেকে টক  দই বলেছিলেন। মজার কথা হলো আজকাল বাজারে না পাওয়া গেলেও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার বন্ধু নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাথে একটি কবিতার বইও প্রকাশ করেছিলেন। তেমনি শুরুতে কবিতা লিখলেও শিবরাম চক্রবর্তী বা হেমেন্দ্রকুমার রায়কে কেউ কবি বলবেন না। নীরেন্দ্রনাথ বাবু কবিতার ক্লাস খুলে সবাইকে কবি বানানোর চেষ্টা করলেও, এ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য, যে সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গদ্যসাহিত্য নিয়ে বিপুল আলোচনা হলেও তাঁর কবিতা নিয়ে কথা খুব কম হয়েছে। তার প্রথম কারণ, কবিতার সংখ্যা খুব কম এবং তাঁর বিপুল গদ্য সাহিত্য কীর্তির তুলনায় সামান্য। অন্যটি হলো তাঁর নিজস্ব সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত।

“আমার বিজ্ঞানপ্রীতি, জাত-বৈজ্ঞানিকের কেন-ধর্মী জীবন জিজ্ঞাসা, ছাত্র বয়সেই লেখকের দায়িত্বকে অবিশ্বাস্য গুরুত্ব দিয়ে ছিনিমিনি লেখা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি কতগুলি লক্ষণে ছিল সুস্পষ্ট নির্দেশ, যে সাধ করলে আমি কবি হতেও পারি; কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটাই আমার পক্ষে হবে উচিত ও স্বাভাবিক |”

তাই  সচেতন ভাবে একটি  ধারায় বিচরণ করার দায়বদ্ধতা থেকে  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একই সাথে কবিতা ও গদ্য রচনা করে গেলেও, কিন্তু নিজের কবি পরিচিতিকে কখনও প্রাধান্য পেতে দিতে চাননি।   তাঁর প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্যকে অনেকেই একটি দীর্ঘ কবিতা বলে অভিহিত করেছেন।  উপন্যাসটি তিনটি বিভাগে বিভক্ত আর প্রত্যেকটি বিভাগ শুরু হয়েছে একটি কবিতা দিয়ে।

প্রথম ভাগ : দিনের কবিতা

“প্রাতে বন্ধু এসেছে পথিক,

পিঙ্গল সাহারা হতে করিয়া চয়ন

        শুষ্ক জীর্ণ তৃণ একগাছি।

ক্ষতবুক তৃষার প্রতীক

রাতের কাজল-লোভী কাতর নয়ন,

        ওষ্ঠপুটে মৃত মৌমাছি ।”

দ্বিতীয় ভাগ : রাতের কবিতা

“প্রেমে বন্ধু পঞ্জরের বাধা,

আলোর আমার মাঝে মাটির আড়াল,

           রাত্রি মোর ছায়া পৃথিবীর |

বাষ্পে যার আকাশের সাধা,

সাহারার বালি যার ঊষর কপাল,

            এ কলঙ্ক সে মৃতা সাকীর।”              

তৃতীয় ভাগ : দিবারাত্রির কবিতা

“অন্ধকারে কাঁদিছে ঊর্বশী,

কান পেতে শোন বন্ধু শ্মশানচারিণী,

    মৃত্যু-অভিসারিকার গান ;

‘সব্যসাচী! আমি উপবাসী।’

বলি অঙ্গে ভষ্ম মাখে সৃষ্টির স্বৈরিণী,

      হিমে তাপে মাগে পরিত্রাণ।”

ব্যক্তিগত ভাবে আমি মেঘনাদ বধ কাব্যর তুলনায় ( এমন তুলনার ঔচিত্য সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতেই পারে ) দিবারাত্রির কাব্যকে অনেক বেশি কাব্যিক মনে করি।

কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা বেশি ছিল না। কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন লেখক জীবনের শুরুর সময়েই, ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে। সে কবিতা ভাবনার দিক দিয়ে সুন্দর হলেও ব্যতিক্রমী নয়। কবি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনে রাখা হবে হয়তো তাঁর শেষের দিকে লেখা কবিতার জন্য, যা  ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ মধ্যে লেখা।  তাঁর মৃত্যুর চোদ্দ বছর পর ১৯৭০ সালে, উনিশে মে তাঁর জন্মদিনে কবি সম্পাদক যুগান্তর চক্রবর্তী অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা পুস্তকাকারে সংকলন  করলেন।

যদিও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, ‘ত্রিশ বছর বয়সের আগে কারও লেখা উচিত নয়।’ কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি লিখেছেন তিরিশ বছরের আগেই। তাঁর নিজের কথায় ‘হঠাৎ কোনো লেখকই গজান না। রাতারাতি লেখকে পরিণত হওয়ার ম্যাজিকে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক কাল আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে। লেখক হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে আসতেই কেবল একজনের পক্ষে হঠাৎ একদিন লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব।’

ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথিবীর সামনে তাঁর প্রকাশ্য রূপ, আর কবি সত্তাটি মূলত গোপন ও ভাঁড়ার খাতায় নানা কথা বিবরণ ইত্যাদির মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছিল।  পুতুল নাচের ইতিকথায় উনি কথাচ্ছলে বলেছেন, “ ঠিকমতো বাঁচতেই জানিনা, কবিতা লিখব। লিখতে লজ্জা করে। “

বাংলা সাহিত্যে প্রতিবাদী কবিতা স্বাধীনতা আন্দোলনের কাল থেকে নানান রাজনৈতিক চড়াই উতরাই পার হয়ে তেভাগা আন্দোলনের হাত ধরে লালিত ।  ১৯৫৩ সালে, এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতা জ্বলে উঠেছিল । সেই প্রসঙ্গে মানিক বাবু লিখলেন ।

“আমরা শুনেছি তার

পুলিসী ঝঙ্কার,

মিলিটারী হুঙ্কার,

অনেক অনেক বার—-

সাদা রাজা কালো দাস

মিলে যিনি অবতার,

 স্বাধীনতা হীনতার !” ( ছড়া)

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুকান্ত ভট্টাচার্যর উদ্দেশ্যে লেখা কবিতায় নিজের উপন্যাসের চরিত্রের ভাষায় জিজ্ঞেস করেন, “তোমার টিবি হয়েছে ?” আবার একই কবিতায় উচ্চারিত হয় সেই অমোঘ পংতি মালা,

“কবি ছাড়া আমাদের জয় বৃথা।

বুলেটের রক্তিম পঞ্চমে কে চিরবে

ঘাতকের মিথ্যা আকাশ?

কে গাইবে জয়গান?

বসন্তে কোকিল কেসে কেসে রক্ত তুলবে

সে কিসের বসন্ত!”

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে কবি চরিত্র ও তার যন্ত্রণা বারবার ফিরে এসেছে। তাঁর স্বাধীনতার স্বাদের গোকুলকে খুব চেনা লাগে যখন সে বলে, “প্ৰাণে আমার আগুন ধরে গেল। রাত্রে কবিতা লিখতে বসলাম, প্রাণের সেই আগুনকে একটি কবিতায় পরিণত করি । ঘরের কোণে রাত দুটো পর্যন্ত ধস্তাধস্তি করে কবিতা একটা দাঁড় করালাম, জগৎটাকে যেন জয় করেছি। এমনি তৃপ্তি নিয়ে ঘুমোলাম। অনেক বেলায় উঠে চা-টা খেয়ে কবিতাটা পড়ে নিজেকে চাবকতে ইচ্ছা হল.কি উপমা, কল্পনার কি তেরচা গতি-” 

মানিকবাবু  শব্দসুরা পরিবেশনকারী সাকি হতে চাননি।  কবিতা নিয়ে কোনো উপদেশ তিনি শুনতে চাননি । জীবন তাঁর কাছে কল্পনার জগৎ নয়, কঠোর বাস্তব । তাই  প্রথম কবিতার কাহিনিতে লিখেছেন, “ আমি তো ভুগেছি রোগ চাষী মাঝি মজুরের সাথে, / অকারণে আমি তো মরেছি লক্ষবার।”

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিজ্ঞান মনস্ক ছিলেন।  তিনি প্রচলিত কোনো কিছুকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিতে পারেন নি। জীবনমুখিতা তাঁর কবিতার  একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।  ‘জীবন মরণ’ কবিতায় তিনি লেখেন  – “মরণেরে বাদ দিয়ে / জীবনের মানে খোঁজা দায়/….মরে মরে বেঁচে থাকা/ জীবনের সেরা অহংকার।”

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা সম্পাদনা করতে গিয়ে যুগান্তর  চক্রবর্তী বেশ কিছু কবিতা বাদ দিয়েছেন। কবির সার্বিক মূল্যায়ন ও কাব্যিক উত্তরণকে বোঝার জন্য তাঁর কবিতা সমগ্র রূপে প্রকাশিত হওয়া উচিত এবং কেউ সেই কঠিন কাজটি হাতে তুলে নেবেন এই আশা রাখি ।

(ঋণ ঃ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, বিভিন্ন সময়ে লেখা ওঁর নানান লেখার  অংশ, আরও অনেকের কাছে)

Our Visitor

0 1 6 0 4 6
Users Today : 7
Users Yesterday : 23
Users Last 7 days : 92
Users Last 30 days : 339
Users This Month : 56
Users This Year : 377
Total Users : 16046
Views Today : 10
Views Yesterday : 39
Views Last 7 days : 149
Views Last 30 days : 566
Views This Month : 88
Views This Year : 629
Total views : 24964
Who's Online : 0
Your IP Address : 3.15.232.244
Server Time : 2025-02-05
error: Content is protected !!