দুশো একুশের বি বেকার স্ট্রিটে একবেলা – দেবব্রত সান্যাল

মাদাম ট্যুসোর মোমের জাদুঘর থেকে একটু হেঁটে এলেই শার্লক হোমসের মূর্তি চোখে পড়বে। শার্লক হোমস ছ’ফুটের মতো লম্বা ছিলেন, রোগা ছিলেন বলে আরো লম্বা লাগতো। এই প্রায় দশ ফিট লম্বা মূর্তিটি সেই কথাই মনে করায়। অ্যাবে সংস্থার ইচ্ছে ছিল মূর্তিটি বেকার স্ট্রিটে স্থাপনা করা হোক, কিন্তু  বেকার স্ট্রিটে তখন জায়গা ছিল না, তাই বাধ্য হয়ে ১৯৯৯ সালে বেকার স্ট্রিটের কাছাকাছি মেরিলিবোন রোডে মূর্তিটির স্থাপনা করা হয়। এর আগে এই মূর্তির ভাস্কর জন ডাবলডের বানানো হোমসের আর একটি মূর্তি সুইটজারলান্ডের মেইরিন জেনের রেইখেনবাখ ফলসের নীচে স্থাপিত হয়েছিল,ঠিক সেইখানে যেখানে ১৮৯৩ এ লেখা দ্য ফাইনাল প্রবলেমে হোমসের তথাকথিত মৃত্যু হয় বলে লেখা হয়েছিল। তথাকথিত লেখার প্রেক্ষাপটটি হল, স্যার ডয়েলের একবার মনে হয়েছিল যথেষ্ট হয়েছে এবার হোমসের গল্প ছেড়ে অন্য লেখায় মন দেওয়া যাক। বলে রাখা ভালো তখন হোমসের গল্পের খ্যাতি ও চাহিদা তুঙ্গে। বর্তমান মানসিকতায় এমন সোনার ডিম পাড়া হাঁসের সাথে সম্পর্ক ঘুঁচিয়ে দেওয়ার কথা ভাবা যায় না। তবে স্যার ডয়েলের লেখক সত্বাটি শুধু গোয়েন্দা গল্পের লেখক হিসেবে বেঁচে থাকবে সেটা তাঁর পছন্দ ছিল না। তবে নারায়ণ গঙ্গাপাধ্যায়ের পরিচয় যদি কেবল টেনিদার স্রষ্টা হিসেবে হয় বা সত্যজিৎ রায়কে যদি ফেলুদার পরিচয়ে পরিচিত হতে তাহলে তা পীড়াদায়ক তো বটেই।

স্যার ডয়েল বিষয়টির একদম পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে পাহাড়ের চুড়া থেকে হোমসকে ফেলে দিয়ে প্রোফেসর মরিয়ার্টির সঙ্গে হোমসেরও কাহিনি ও জীবনে ইতি টানতে চাইলেন। উনি চাইলে কী হবে পাঠকরা বেজায় অসন্তুষ্ট হয়ে পত্রাঘাত করতে থাকলেন। যে স্ট্রান্ড ম্যাগাজিনে হোমসের কাহিনি ছাপা হতো, তার হাজার হাজার পাঠক এই কারণ দেখিয়ে তাদের গ্রাহক পদ ছেড়ে দিলেন । এমন করে প্রায় এক দশক কাটার পর কিছুটা পাঠকের আবদারে কিছুটা প্রকাশকের চাপে ১৯০২ সালে হাইন্ড অব বাস্কারভিলস উপন্যাসে হোমসের কাহিনি ফিরে এলো। সেদিক দিয়ে দেখতে হলে পরে লেখা হলেও গল্প হিসেবে হাউন্ড অব বাস্কারভিলসের ঘটনাটা দ্য ফাইনাল প্রবলেমের আগের সময়কার। এই বইটির অদ্ভুত সাফল্যর পর স্যার ডয়েল হোমসকে পাকাপাকি ভাবে ফেরত আনেন দ্য এম্পটি হাউস গল্পে এবং হোমসের মৃত্যুর মিথ্যা রটনা কেন হয়েছিল তার একটা কারণ দেখালেন। তিনবছরের একটা ফাঁক রয়েই গেলো।       

   

বহু প্রতিক্ষীত বেকার স্ট্রিট দর্শনের আগে হোমসের এই মূর্তির সামনে দাঁড়ালে অনুভূতি হয় কীভাবে সৃষ্টি শ্রষ্টার ভাবমূর্তিকে ছাপিয়ে ওঠে। হোমসের মূর্তির পরনে হাতছাড়া ওভার কোট, মাথায় ডিয়ারস্টকার টুপি, হাতে বিখ্যাত পাইপ। এখান থেকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই বেকার স্ট্রিট মেট্রো স্টেশন এখন বলে আন্ডারগ্রাউন্ড। কাছাকাছি একটি বাড়িতে ছ’বছর থেকে গিয়েছেন বিখ্যাত কল্প বিজ্ঞানের লেখক টাইম মেশিন গল্পের স্রষ্টা এইচ জী ওয়েলস। আরেকটু হাঁটলেই হঠাৎ করে টাইম মেশিন ঘুরে যাবে, আপনি এসে দাঁড়াবেন ১৮১৫ সালে তৈরি একটি চারতলা জর্জিয়ান বাড়ির সামনে, যেখানে জ্বলজ্বল করছে পৃথিবীর বিখ্যাততম ঠিকানার একটি ২২১বি বেকার স্ট্রিট।এই ঠিকানায় ১৮৮১ থেকে ১৯০৪ অবধি মিমেস হাডসনের ভাড়াটে হিসেবে বাস করতেন পৃথিবীর সেরা গোয়েন্দা শার্লক হোমস আর তাঁর সহযোগী ডাঃ ওয়াটসন । ঠিকানায় বলার কারণ হলো, ১৮৮৭ সালে যখন স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘আ স্টাডি ইন স্কার্লেট’ প্রকাশিত হয় তখন বেকার স্ট্রিট ছিল একটি অভিজাত অঞ্চল আর তখনো বাড়ির নম্বর আটানব্বই পার হয় নি। আজকের দিনে বেকার স্ট্রিট দোকানে দোকানে ভর্তি।উনিশ শো তিরিশ সাল নাগাদ যখন অ্যাবে সংস্থা বেকার স্ট্রিটের ২১৯ থেকে ২২৯ এ তাঁদের অফিস বানান তখন ওখানে প্রায়ই ওখানে হোমসের নামে চিঠি আসতো, অনেকে খোঁজ খবর করতেও চলে আসতেন। কোম্পানির তরফ থেকে একজনকে নিযুক্ত করা হলো, যিনি এসব সাহিত্যপ্রেমীদের প্রশ্নের ও চিঠির জবাব দিতেন। এই ভাবেই কল্পনার মানুষগুলো রক্ত মাংসের হয়ে উঠলো। ১৯৯০ সালে এই ঠিকানায় সরকারি স্বীকৃতি এলো। অ্যাবের সাথে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষর লড়াই নিজের থেকে সমাপ্ত হয়ে গেলো।বাড়িটি এখন দ্য শার্লক হোমস মিউজিয়াম বলে পরিচিত। এদেশে মিউজিয়ামের সংখ্যা ও ঐতিহ্যকে যত্ন করে ধরে রাখা একটি জীবন শৈলী। লন্ডন শহরে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে একশো সত্তরের বেশি মিউজিয়াম আছে। কোনও জায়গায় কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলে সেটি অন্তত উল্লেখ করে একটি ফলক লাগানো থাকে। আমাদের রাজ্যে শরৎচন্দ্রের বাড়িতে শ্রীকান্ত ইন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিতে ভবানী পাঠক বা বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে হরিপদ কেরানীর সাথে দেখা হলে কী পাঠকদের ভালো লাগতো না?এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই দুশো একুশের বি থেকে যিনি ভিতরে ডেকে নিলেন তাঁর পোষাক ও হাবভাব সেই পুরনো সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। বাড়িটায় ঢুকতেই ছাতা টুপি রাখার স্ট্যান্ড পেরিয়ে দোতলায় আসতে সতেরাটা সিঁড়ির ধাপ, যে ধাপ পেরিয়ে কখনো উঠে এসেছেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর লেসট্রেড, কখনো বোহেমিয়ার রাজা!দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘর, যেখানে দুই বন্ধু ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কোনান ডয়েলের বর্ণনায়, দুটি আরামদায়ক শোয়ার ঘর আর একটি খুশিয়াল মেজাজের বসার ঘর, আকারে বড় না হলেও, দুটো চওড়া জানলা থাকবে, যা দিয়ে আলো বাতাস খেলবে।একজন গাইড মিউজিয়াম ও স্যার আর্থারের সৃষ্টির কথা শোনাচ্ছিলেন, নানান তথ্য দিচ্ছিলেন, যার কিছু জানা ছিল, কিছু নতুন। হোমস তাঁর ব্লু কার্বাঙ্কল কান্ডে নিজের মিউজিয়ামের কথা উল্লেখ করেছিলেন। নিজের নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা গবেষণার জন্য হোমস বাসাটিকে প্রায় মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলেছিলেন। এখানে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ কোনান ডয়েলের উপন্যাস ও গল্প মিলিয়ে ষাটটি লেখার সাথে সঙ্গতি রেখে বাড়িটিকে সাজিয়েছেন। ভেবে দেখলে, যা ছিল তা সংরক্ষণ করা শ্রমসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়, কিন্তু যা শুধু কল্পনায় ছিল তা বাস্তবায়িত করা বড় কঠিন কাজ।দোতলায় প্রথমে সেই দুজনের বসার ঘর আর পাশের ঘরটি হোমসের শোবার ঘর। বসার ঘরটি হোমসরা যেভাবে রাখতেন সে ভাবেই আছে গবেষণার জায়গাটি। তাদের ফায়ার প্লেস, ভায়োলিন, ক্যাটাবাস পাইপ, পার্সিয়ান চপ্পল, নোটখাতা, বই আরো কত কী!হোমসের শোবার ঘরে সাজানো টেবিল তাদের অপেক্ষায় আছে। ধুমপানের ক্ষেত্রে সিগারেট, সিগার আর অবশ্যই পাইপ ছিল ওঁর পছন্দ। বেশির ভাগ সময়েই কালো পাইপটি বিশেষত যখন ধ্যানস্থ হতেন। তাছাড়া কখনো ব্রায়ার রুট পাইপ বা চেরিউড। সব তেমনি রাখা আছে গোয়েন্দা চূড়ামনির ইচ্ছের অপেক্ষায়।তার উপরের তলার দুটি ঘর একটি ওয়াটসনের আর অন্যটি মিসেস হাডসনের শোওয়ার ঘর। ডাঃওয়াটসনের বই তাঁর শয়নকক্ষের সেলফে রাখা। সেখান থেকে বাড়ির পিছনের খোলা প্রাঙ্গনটি দেখা যায়। এখন এই ঘর গুলিতে নানান দর্শনীয় বস্তু সাজানো আছে। প্রথমেই চোখে পড়লো মি: হোমসের ব্রোঞ্জের তৈরি একটি আবক্ষ মূর্তি। এছাড়াও সাজানো আছে বই, ছবি, ফটোগ্রাফ আর সেই সময়ের খবরের কাগজ। এছাড়াও আছে হোমসকে লেখা বা হোমসের লেখা কিছু চিঠি। সেই সাইকেল আরোহী নারীর এক সুন্দর মূর্তিও সাজানো রয়েছে। ( দ্য সলিটারি সাইক্লিস্ট)


হঠাৎ দেখি একজন টকটকে লালচুলো ভদ্রলোক চেয়ার টেবিলে বসে এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে একটা কাগজে নকল করছেন। ইনি তো সেই বন্ধকীর কারবারি মিঃ জ্যাবেজ উইলসন। সপ্তাহে চার পাউন্ডের লোভে লাল চুলো সঙ্ঘের অফিসে বসে দুমাস ধরে এই অর্থহীন কাজটি করছিলেন। হঠাৎ একদিন বিনা নোটিশে অফিস ও সংস্হাটি উঠে গেলো। এই আপাত নিরীহ অভিযোগ নিয়ে মিঃ উইলসন এলেন হোমসের কাছে। ( দ্য রেড হেডেড লীগ) । উদ্ঘাটিত হলো এক অভূতপূর্ব ব্যাক ডাকাতির ষড়যন্ত্রর রহস্য।আবার চমকে দেখলাম এক বয়স্ক ভদ্রলোকের মৃতদেহ পড়ে আছে। ইনিই সেই ডাঃ রয়লট, যাঁর সাথে কলকাতার নাম জড়িয়ে গিয়েছে। (দ্য স্পেকলড ব্যাড) । নিজের সৎ কন্যাদের খুন করার জন্য ডাঃ রয়লট একটি ভয়ঙ্কর বিষধর ভারতীয় সাপকে ব্যবহার করতেন। কিন্তু হোমসের হস্তক্ষেপে নিজের অস্ত্রে নিজেই মৃত্যুবরণ করলেন ডাক্তার।এখানে এমন দর্শকও আসেন যিনি দেখে নেন হোমসের তামাক তাঁর পার্সিয়ান চপ্পলে রাখা আছে কিনা, যেমনটা দ্য মাসগ্রেভ রিচ্যুয়ালে লেখা আছে।স্যার ডয়েল তাঁর লেখনীতে কোনও অতিমানবীয় চরিত্র নির্মাণ করেন নি। চারটি উপন্যাস আর ছাপ্পান্নটি ছোট গল্পে হোমস সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য দিয়েছেন তার সাথে রয়েছে সিডনি প্যাজেটের আঁকা ছবিগুলি।

সেই সব নিয়েই তৈরি হয়েছে মিউজিয়ামটি। লেখক কন্যার শঙ্কা ছিল যে মিউজিয়াম দেখে ভবিষ্যতের পাঠকরা হয়তো বিশ্বাস করে বসবেন, হোমস বলে সত্যিই কেউ ছিলেন এবং সেটা তাঁর পিতার সৃজন প্রতিভাকে খর্ব করবে। সেটি হয়তো কিছুটা বাস্তব। দর্শনার্থী আর ওখানকার লোকেরা এমন ভাবে কথা বলেন যেন মানুষটিকে তাঁরা বড় কাছ থেকে দেখেছেন।“ কদাচিৎ রাত দশটার পর জাগতেন। আর সকালে ওয়াটসন ঘুম থেকে ওঠার আগেই ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে যেতেন। কখনো তো ওই নিজস্ব রসায়নাগারেই দিনটা কাটিয়ে দিতেন।”হোমস শরীর চর্চার জন্য ব্যায়ামে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই বাড়িতে শরীর চর্চার উপকরণ নেই। তবে উনি বক্সিং যথেষ্ট ভালো জানতেন আর প্রয়োজনে মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারতেন।

হোমস বিশ্বাস করতেন সত্যান্বেষণ একটি পরিপূর্ণ বিজ্ঞান আর তাই কাজটি পুরোপুরি ঠান্ডা মাথায়, আবেগশূণ্য ভাবে করতে হবে। শুধু নয়ন মেলে দেখলে হয় না, মন দিয়ে খেয়াল করতে হয়। সেটাই অধিকাংশ লোকে করে না। ওঁর বিচারে মানুষ নিজে কিছু না, মানুষের কাজটাই সব কিছু। এমনকি তিনি কাজকে দু্:খ শোকের ওষুধ ভাবতেন।ওয়াটসনের জবানিতে হোমস সাহিত্য, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান কিছুই জানতেন না, রাজনীতির জ্ঞানও সামান্য। রসায়নের জ্ঞান খুবই ভালো, বটানি বলতে নেশা বা বিষাক্ত গাছ গাছড়া ব্যস, বাগান করার শখ ছিলনা।ষাট বছর বয়েসে হোমস সাউথ সাসেক্সের গ্রামে অবসর জীবন যাপন করতে চলে যান।

আর সে সময়ে মাত্র তিনটি গল্প লেখা হয়েছে।মিউজিয়ামের একতলায় অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে স্মরণিকা বিক্রয়ের কেন্দ্র। শার্লক হোমসের মতো পোষাক, তাঁর টুপি, পাইপ বা বইয়ের বড় সংগ্রহ রয়েছে।একটি গল্পের চরিত্রকে এতো ভালোবাসা, এতটা শ্রদ্ধা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। বারবার একটা কথাই মনে হয়, ওরা পারলে আমরা পারি না কেন!

error: Content is protected !!