হারিয়ে যাওয়া নয়নজুলি – তরুণ কুমার গিরি
আমার ছোটবেলায় গ্রামের সব বড় রাস্তার দুধারে নয়নজুলি দেখতে পেতাম। তখন নিজে নিজে ভেবেছি এই নামের মধ্যে বুঝি চোখের জলের কোন সম্পর্ক আছে, আসলে তা না। নয়নজুলি হল বড় রাস্তা তৈরি করতে সেই রাস্তার দুইধারের জমি কেটে মাটি নিয়ে নেওয়া হত, সেই গর্তে বর্ষার জল জমে যে নালার সৃষ্টি হত সেটাকেই নয়নজুলি বলে। ক্রমে এটি ইকোলজির স্থায়ী অংশ হয়ে যায়। এর জমি মূলত সরকারী অধিগৃহীত, অন্য কারো এতে অধিকার থাকার কথা নয়, কিন্তু আমাদের দেশে সরকারী মানে হল পাবলিক, ফলে সব পাবলিক একে যে যার সুবিধামত ভোগ করতে চায়, কেউ কেউ গাপ করতে চায়।
আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বর্ষার আগের দুমাস ছাড়া সারা বছর এতে জল থাকত, এবং সেই জলে দেদার জলজ সম্পদ ফুলে ফলে থাকত। বাংলার মাটি শুধু যে সোনার ফসল ফলায় তা নয়, এই মাটির ছোঁয়া পেলে জলে রূপা ফলে। প্রচুর মাছ, নানা জাতের মাছ। যে নয়নজুলি দু মাসের উপর প্রায় জলশূন্য হয়ে পড়ে থাকত, তাতে বর্ষায় জল জমে মাস ঘুরতে না ঘুরতে কত রকমের মাছ কিলবিল করত কি করে সে এক রহস্য। মিষ্টি জলের জীয়ল মাছ হত প্রচুর। আবার যেখানে যেখানে এর সঙ্গে খালের লতায় পাতায় সম্বন্ধ হয়েছে, সেখানে লোনা জলের মাছ, যেমন চিংড়ি, বোয়াল, ভেটকি, আড়, পাওয়া যেত অনেক। শাপলা কচু হেলঞ্চা শুশনি আর কলমির ফ্রি জোন ছিল নয়নজুলিগুলি। যত ইচ্ছা কেটে নিয়ে যাও, শাকম্ভরির অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে। অলস বিকেলে এর জলে ছিপ ফেলতে ফেলতে এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াত ছেলে বুড়ো মাছ ধরিয়েরা। কেউ কেউ কোন নির্দিষ্ট জায়গায় একটা মাচা মত বানিয়ে নিয়ে নিবিষ্ট হয়ে ছিপ নিয়ে বসে যেত। পাশে থাকত ফিলিপস এর ট্রানজিস্টার, বিবিধভারতীতে বাজত অনুরোধের আসর। চোখ থাকত ফাতনায়, কান রেডিওতে। যদি নিজের নামটা একবার বলে ওঠে সঞ্চালক। স্কুল ফেরত আমাদের বদ খেলা ছিল সেই সব লোকেদের মনোনিবেশের ব্যাঘাত ঘটানো, আচমকা বড় ঢ্যালা জলে ছুঁড়ে বা শাপলার ফুল তুলার অছিলায় হাঁটু জলে নেমে হুটোপাটি। বস্তুত নয়নজুলি আমাদের গ্রাম্যজীবনের কালচারের সঙ্গে জুড়ে ছিল।
কিন্তু মানুষের লোভ, সর্বগ্রাসী লোভ ধীরে ধীরে নয়নজুলিগুলিকে আত্মসাৎ করতে শুরু করল। যেখানে যেখানে বড় রাস্তার ধারে বাজার বা বাসস্ট্যান্ড, যেখানে যেখানে জনসমাগম বেশী হওয়ার সম্ভাবনা, সেখানে সেখানে এর গলা টিপে দোকান দেওয়া শুরু হল। প্রথমে মাটি অথবা রাবিস এবং জঞ্জাল ফেলে পরিসর ছোট করে দেওয়া হল বাকি যেটুকু সরু নালা বাঁচল সেটি কাঠ বা কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে তার উপরে ঘর তুলে দেওয়া হল। এক সময় রাস্তার ধারে অঙ্গাগি হয়ে চলত নয়নজুলির বিস্তার, এখন পদে পদে বাঁধা পড়ে তার জৌলুশ হারিয়ে মৃতপ্রায়। বর্ষার সময় জায়গাগুলি জলে ভাসে। বড় রাস্তা শরীরে আরও চওড়া হয় কিন্তু তার ধারক নয়নজুলির কথা কেউ ভাবে না।
এই আখ্যান শেষ করব একটা ঘটনার কথা দিয়ে। সেবার গ্রামে গিয়ে দেখলাম শ্রীধর রাস্তার ধারে বেশ ফলাও করে গ্যারেজ বানিয়েছে। পুরু কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে আড়াল করা হয়েছে রাস্তা আর গ্যরাজের মাঝের নয়নজুলি। সে এখন মৃত। কিন্তু কোন ভাবে একটা পুরানো আড়-শ্যাওড়ার গাছের গুঁড়ি থেকে গেছে নীচে। যেটা নয়নজুলির কিনারে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকত একদিন। গলা কাটা গেছে, গোড়াটি রয়ে গেছে, সেই গোড়া থেকে তার অপ্রতিরোধ্য প্রান কচি প্রশাখা হয়ে স্ল্যাবের ফাঁক গলে উপরে উঠে আসে। বার বার সেগুলকে কেটে ফেলে দেয় শ্রীধর, কিন্তু আবার নতুন করে ফিরে আসে সে। তাকে সম্পূর্ণ করে মারতে গেলে স্ল্যাব তুলে গর্ত খুঁড়ে গোঁড়া তুলে ফেলতে হবে, যেটা এখন আড় সম্ভব নয়। আমি অবাক হয়ে দেখি কঠিন কংক্রিটের ভেতর থেকে বেড়ে ওঠা প্রকৃতিকে। প্রকৃতি সহজে বশ মানে না। মনে পড়ে সাবেক সভিয়েত রাশিয়ায় এপ্রিল ১৯৮৬ সালে চেরনবিল আনবিক কেন্দ্রের বিপর্যয়ের কথা। ভয়ানক ঘটনাটির পর ঘোষণা করা হয়েছিল আগামী কুড়ি হাজার বছর এখানে কোন জীবসম্পদ গড়ে উঠবে না। কিন্তু মাত্র ৩৫ বছরের অবসরে এখন সেখানে রীতিমত অরন্যভূমি। মানুষের স্পর্শ রোহিত হয়ে নিজের মত করে বেড়ে উঠেছে প্রকৃতি। বিশাল বিশাল ইমারৎ জুড়ে সবুজ গাছ গাছালির জঙ্গল। কোথা থেকে এসে নানান জন্তু জানোয়ার পাখপাখালিতে ভরে গেছে জায়গাটা, তার মধ্যে আবার কয়েকটি লুপ্তপ্রায় প্রজাতির। প্রকৃতি পারে, একটু সুযোগ পেলে নিজেকে নিজে আবার গড়ে নিতে পারে সে।
আমাদের শৈশবের হারিয়ে যাওয়া নয়নজুলিগুলি কোন ভাবে যদি আবার ফিরে আসে তার মত করে এই আশা করতে ভালো লাগে।