কবিতার রক্তপাত – দেবব্রত সান্যাল
আমি নিজের ছাড়া, অন্য সবার কবিতার বইয়ের নাম দেখে চমৎকৃত হই ৷ কী সব দূর্দান্ত নাম৷ আর নামকরণে আমি একদম অপটু৷ কিছুতেই ভালো কিছু মাথায় আসে না ৷ আমার ঘরের কোণে মাটির ভাঁড়ে টুকটাক কবিতা ফেলে যাচ্ছি ৷ না জমিয়ে রাখলে জীবিকার তাগিদের বিশাল বল মিলে সেগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কোথায় হারিয়ে যাবে জানতেও পারবো না৷ নামহীন পাঁচ টাকার কয়েনের মতো কবিতা, একত্র হলে যদি একদিন মুঠো ভরে উঠবে এই আশায়৷ নামকরণ করার বদলে, সব নম্বর দিয়ে রাখছি৷
এক
তোমার প্রেমের কবিতা ভালো লাগে,
সুগার ফ্রি দেয়া নিরাপদ মিষ্টি মিষ্টি কবিতা ৷
বাস্তবের আধপোড়া পাউরুটির গায়ে
পরাবাস্তব মাখন৷
মন কেমনিয়া বিরহদুপুর অমলতাস৷
কিন্তু আমার যে সর্বদাই একপেট খিদে,
আর প্রেম খেলে আমার পেট ভরে না ৷
দুই
প্র্যাকটিস করতে করতে
ভাবাটা তোর রপ্ত হয়ে গেছে ৷
রক্তে ভেজা সাদা চাদরটার দিকে তুই একদৃষ্টে
তাকিয়েও ভেবে যাচ্ছিলি ৷
তখনই জানতাম এবার পুজোর থীম কালারটা
লাল সাদা হবে ৷
তিন
আমার দূরত্ব জিনিসটা ভালো লাগে,
বিশেষত দূরত্ব যখন
নতুন বউয়ের অবগুণ্ঠনের আড়ালে
স্বপ্নসম্ভবা হয়ে থাকে ৷
পা দুটোকে স্তোক দেয়া যায়,
আর একটু হাঁটলেই ব্যাস
ওখানে পৌঁছে , জল, রুটি আর আশ্রয়৷
চার
তুই বললি চল চল মুখোশ লাগিয়ে নে,
অনেক কটা লাস পড়েছে
টুক করে ছবি তুলে আসি৷
ভীড় জমার আগেই পৌঁছে গেলাম ৷
এটা মানতেই হবে,
গতকালের মুখ ঢাকা
খেতে না পাওয়াগুলোর থেকে
আজকের মুখোশ খোলা,
গুলি খাওয়াগুলো
দেখতে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং ৷
পাঁচ
বাবা মিনতিকে বলেছিল, হারামজাদি
তুই আমার মুখটা পোড়াবি৷
বাবা এখন সটান শুয়ে৷
সবাই মিনতিকে বললো,
ভাইদের জন্য আর অপেক্ষা না করে,
মুখাগ্নিটা তুমিই করে দাও৷
ছয়
যারা আমাকে শুয়োরের বাচ্চা বলেছিল
আমি তাদের হুজুর বলে
সেলাম করেছি৷
শুধু তাদের অনুকম্পায় বড় হয়ে
শুয়োরের কর্দমাক্ত সুখে বেঁচে বত্তে থাকবো বলে ৷
তখন জানতাম না,
খাবার প্লেটে এরা
শুয়োরের বাচ্চাগুলোকেও ছাড়বে না ৷
সাত
ব্যান্ডেজের তলায় যে লাল রঙটা
ফুটে উঠছে
সেটা কোনও রক্তকরবী নয়৷
যতক্ষণ ব্যান্ডেজ আছে,
ততক্ষণ ক্ষত আর কবিতার মাঝখানে
একটা অসহায় কাপড়ের টুকরো থাকবে ৷
আট
ছোটবেলায় লাথি ঝাঁটা খেলেও,
কখনো ক্যালসিয়ামও পাই নি,
তাই শিরদাঁড়ায় তেমন জোর নেই ৷
এমনি ভাবে মোটামুটি বেঁচে থাকাটা
চালিয়ে যাচ্ছি৷
ক্যালসিয়ামের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে
সব সময় ঝুঁকে দাঁড়াই,
হাত জোড়টা বাড়তি অভ্যাস ৷
নয়
এক কৌটো সিঁদুরের দাম পঞ্চাশ টাকা মতো,
মনিহারী বা দশকর্মার দোকানেই পাওয়া যায় ৷
বেশি খরচ করলে নিরাপদ সিঁদুরও মেলে আমাজনে৷
রমেশ বাবু এ সব জানেন বলেই
না জানার ভান করতে সাহস পান ৷
দশ
এতোদিন মাস্কে মুখ ঢেকে রেখেছি
শুধু তোমাকে হাসিমুখটা দেখাবো বলে৷
আঙুল ভাঁজ করে গভীর স্পর্শ
তোমার জন্য জমিয়ে রেখেছি৷
আরেকটু মানে কতটা প্রশ্ন কোরো না ৷
প্রশ্নরা হারিয়ে যাওয়া মোবাইলের মতো
ছবির সাথে ঠিকানাও নিয়ে যায়৷
শুকিয়ে যাওয়া টবের গাছটার পালস না পেলেও
একবার জল দিয়ে তো দেখো,
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জোৎস্না মরে গেলে কী
তাকে খাটে তুলে বল হরি বলতে আছে?
এগারো
কত অপরাধ হয়ে যায় শুধু
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে,
মাথা ভাসিয়ে রাখতে
আঙুলের কড়ের বেশি পাপ !
খোসা বলে যাদের ফেলে দিয়েছি,
ফেলে হাত ধুয়ে পরিষ্কার করেছি,
তাদের মনে নেই ৷
বারো
প্রাত্যহিক অশৌচান্তে
বাটি ভরা মুড়ি চা রাসমনি৷
নিজের বাঁশের কেল্লায়
সপরিবার আপাত নিরাপত্তায়৷
কাঞ্চনজংঘা এখন সুপ্রভাতের মত সুলভ৷
কবিতায় ফেক অর্গাজমকে
লাইক দিয়ে নুব্জ পুরুষত্বর পিঠ চাপড়াই৷
সাথে থাকার একমাত্র লাভ,
আর চিঠিতে ‘আশাকরি ভালো আছো’
নামক মিথ্যেটা লিখতে হয় না ৷
এই তালেগোলে
আমাদের ভালোবাসাটা মরে গেলে,
কোমর্বিডিটির কথাটা কেউ জানতেও
পারবে না ৷
সব কবিতা আবার পড়লাম। বেশ লাগলো। কেউ বলতে সাহস পাবেনা নিকুচি করেছে কবিতা।
বাকরুদ্ধ করে দেওয়া রক্তাক্ত কবিতাগুচ্ছ। যতবার পড়া যায়, নতুন করে পড়ার ইচ্ছে জাগায়। অভিনন্দন।