কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (চতুর্থ কিস্তি)
(৩)
চাকরির সাথে থাকার জায়গাও একটা পাওয়া গেলো, যাদবপুর স্টেশনের কাছেই। চাকরির সাথে মানে এই না যে থাকার জায়গাটাও অফিস থেকেই দিয়েছিল। তবে খোঁজটা আহমেদই এনে দিয়েছিল। স্টেশন পেরিয়ে একটা সন্ধ্যা বাজার আছে, তারপর লেভেল ক্রসিং পার করার পরেই ঘরটা। এক কামরার ঘর, সাথে বাথরুম ঠিকঠাক পরিষ্কার। একটা ছোটো সস্তার চৌকি, এক জোড়া ততধিক সস্তা চেয়ার টেবিল ব্যাস, খুব বেশি শব্দ না করা ফ্যান। তৈরি হয়ে তো আসিনি, তাই যাদবপুরের অন্নপূর্ণা বেডিং হাউস থেকে বিছানা বালিশ তোয়ালে কিনতে হলো। আর কী চাই। তবে রান্নাঘর নেই, রান্নাঘরের তেমন দরকারও নেই, রান্না ব্যাপারটা আমার মোটেই আসে না। আর এ কলকাতা শহরে কী আর খাওয়ার জায়গার অভাব, বিশেষত আমি খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ খুঁতখুঁতে নই! অনেক রাত অবধি ইলেক্ট্রিক ট্রেনের আওয়াজ আসে, ঘরটাও তখন কাঁপতে থাকে। ভোরেও সেই একই ব্যাপার। অভ্যেস করতে হলো। আর মাইনেটাও যে কেটে কুটে হাতে আটশো ছেষট্টি টাকা, ভুললে চলবে কেন! এর থেকেই তো পুজোর সময় বাবার জন্য ধুতি পাঞ্জাবি, মার জন্য শাড়ি কিনবো ভাবছি।
সময় মতো আসা যাওয়া আমার স্বভাব, সে জন্য সারাজীবন কথা শুনতে হয়েছে, ‘ঝাঁট দিতে আসে!’ স্বভাবত আধ ঘন্টা দেরিতে এসে, ‘বাঙালির টাইম’ নামক এক অপবাদের জুতোর মালা আমরা বাঙালিরা স্বেচ্ছায় সগৌরবে বরণ করে থাকি, এমন কী জাতীয় পরিচয়ের তকমা লাগাতেও পিছপা হই না। নটায় অফিস শুরু, শেষ পাঁচটায়। কাজ পড়লে শুরু থাকলেও শেষ নেই বলাই বাহুল্য। আমার যাদবপুরে থাকার জায়গাটার পাশেই চা-টার দোকান, স্নান সেরে ‘টোস, মামলেট চা’ দিয়ে পেট ভরিয়ে, নিয়ম করে রোজ সকালে যাদবপুর স্টেশন থেকে আটটা সতেরোর সোনারপুর লোকাল ধরতাম। এর পরের ক্যানিং লোকালে ভীড় বেশি আর তাড়ির হাঁড়ির সমাবেশ। তাছাড়া দেখতাম কিছু নারী পুরুষ অবিশ্রাম দু হাতে দুই হাঁড়ির মধ্যে জল ছপছপ করে মাছের পোনা নিয়ে যাচ্ছে। যাদবপুর থেকে শিয়ালদা তেরো – চোদ্দো মিনিট, বালীগঞ্জের থেকে ভিড়টা বাড়তো, পার্কসার্কাসের কাছে এক অসহ্য দুর্গন্ধ, পশু চামড়ার হবে। শুনেছি কোনো জিনিস লাগাতার একুশ দিন নিয়মিত করলে অভ্যাস হয়ে যায়। সত্যি! আমি তাহলে ব্যতিক্রম। একদিন অফিস যাবার পথে, একটা তাড়ির হাঁড়ি ভেঙে কামরায় সুরার ঢেউ খেললো, জুতোয় – প্যান্টে তাড়ি, সে এক অবস্থা। ঘরে তো ফিরে আসতেই হল, উপরি পাওনা ফিরতি ট্রেনে সহযাত্রীদের ভ্রুকুটি। ‘জামা কাপড় দেখে তো মনে হয় না, সক্কাল সক্কাল কী দিনকাল পড়েছে ইত্যাদি…!’
এসবের পরেও আটটা তেরোতে রোজ একজনকে দেখতাম। বোধহয় বাঘাযতীন থেকে উঠতো, প্রথমে ভেবেছিলাম কোথাও পড়ে টরে। বয়েস নিজের থেকে কিছু কম লেগেছিল তাই এই ভাবনা। নয়তো হাতে কোনও নোট খাতা থাকতোনা আর নিয়মিত এক ট্রেনে যেত, একা। যেটা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েদের প্যাটার্নে পড়ে না। ফেরার পথে কখনও দেখা হয়নি। কথাও না। তাই নাম পরিচয় কিছুই জানা হয় নি। চোখে চোখ পড়লে একটা পরিচয়ের হাসি। এই সব। রোজ শিয়ালদা স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে ওয়েলিংটন স্কোয়ার আসা যাওয়া করতাম। হাঁটাটা সাশ্রয় বা স্বাস্থ্যের জন্যে নয়, ভিড় এড়াতে। আহমেদ দরজা খুলতো আর প্রায় পিছে পিছে আমি ঢুকতাম, মিঃ দত্ত আসতে আসতে প্রায় সাড়ে দশটা, তার আগেই সবাই পৌঁছে যেতো। বের হতাম মিঃ দত্ত যাবার পর। আমার আগে আগে আসাটাকে আমার অসাক্ষাতে ‘বেশি কাজের আঠা’ বলে অভিহিত করা হতো। কাজ নাকি ততটাই করতে হয় যতটা বসের চোখে পড়ে, বাকিটা টাইমপাস। ওই বারো জনের অফিসে তিনটে ভাগ ছিল, মিঃ দত্ত হলেন সেলস ম্যানেজার, বাঁদিকের বড় কেবিনটা তাঁর আর ডান দিকের ছোটো কেবিনটায় বসেন মিঃ বিশ্বাস, রেলওয়ের ব্যাপারগুলো দেখতেন। নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন। কথা যতটা না বললে লোকে বোবা ভাববে ততটাই বলতেন। মাঝখানে আটটা টেবিল চেয়ার ফাঁক ফাঁক করে পাতা।
সেই আটটা বসার জায়গায় মধ্যে যেটা খালি ছিল সেটাতে আমার ঠাঁই হলো। আস্তে আস্তে বুঝলাম, এখানে ডিগ্রীধারী ইঞ্জিনিয়ার দু’জন – আমি আর ঘোষদা। আমি মেকানিকাল, ঘোষদা ইলেক্ট্রিকাল। আমরা দু’জনে হলাম গিয়ে এক্সিকিউটিভ, জাতে কুলিন। সার্ভিসিং-এর লোকেরা ডিপ্লোমাধারী, তিনজন টাইপিস্ট, একজন হিসাররক্ষক, একজন কর্মাশিয়াল, একজন সর্বঘটে, মিঃ বিশ্বাস আর তাছাড়া মিঃ দত্ত তো আছেনই। মিঃ দত্ত-র পড়াশুনোটা কতদূর সেটা জানা যায় না। কেউ বলেছিল নাকি জুট টেকনোলজি, শুনে ঘোষদা বলেছিলেন, ‘জ নয় ঝ।’ খুব যে ভুল বলেননি, সেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলাম। ঘোষদার বয়েস পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, মাথায় চুল কম তাই বারবার চুল আঁচড়ানোর অভ্যেস আছে। অতিরিক্ত সাবধানী, বছর দুয়েক হলো এন.টি তে ঢুকেছেন। ঘোষদা নিউমেটিক ডিভিশন দেখতেন আর প্লাস্টিক ডিভিশন এলো আমার কাছে। তাতে ঘোষদা খুশি ছিলেন না। আমার কাছ থেকে প্লাস্টিকে কী কী কাজ হচ্ছে খবর জানতে চাইতেন। ইঞ্জেকশন মোল্ডিং, ব্লো মোল্ডিং এসব আমার কাছে একদম নতুন বিষয়। শুনলাম যে সব নামী দামী মোল্ডেড লাগেজের বাজারে চল আছে তার অনেকগুলো নাকি এন টির ইঞ্জেকশন মোল্ডিং মেশিনে তৈরি হয়।
অফিসের ব্যাপার স্যাপার আমার কল্পনার সাথে একদম মিলল না। এমন তো নয় যে এক মাঝারি মাপের গুজরাতি কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট, পাঠ্যবইয়ের পাতা থেকে ঝরে পড়বে, তবে একটা কায়দা তো থাকবে। তার উপর, আমাদের অফিসে কতগুলো অলিখিত নিয়ম ছিল যা হজম করতে কষ্ট হত। প্রথমত, খদ্দের না চাইলে আগ বাড়িয়ে মার্কেটিং করবে না, অর্থাৎ এনকোয়ারি তোমার দরজায় না আসা অবধি হাতে হাত রেখে বসে থাকো। নিজের থেকে উদ্যোগ নেবে না। দ্বিতীয়ত, মেশিনপত্রের প্রাইস লিস্ট থাকবে মিসেস দাসের কাছে অর্থাৎ টেকনিকাল অফারটা তুমি বানাবে, শুধু দামটি লিখবেন শ্রীমতি দাস, এবং তাতে নাম ও সই থাকবে সুবীর দত্তর। তৃতীয়ত, কেউ ডিসকাউন্ট চাইলে কেস মিঃ দত্তের কাছে পাঠাতে হবে, কেননা ডিসকাউন্টেরও রকমফের আছে, অফিসিয়াল এবং পার্সোনাল। এই ব্যক্তিগত ছাড়ের মধ্যে পার্টি দেওয়া, জনি ওয়াকারের বোতল হাতে তুলে দেওয়া বা সোজা সাপটা নোট, মানে নারী সরবরাহটা বাদে সব সামিল থাকতো। শুধু ব্যক্তি বুঝে দিতে হতো। এই শুভ কাজগুলি মিঃ দত্ত নিজেই করতেন। সবচেয়ে জরুরী, অফিসের অফার বা কোনও চিঠি, যাই হোক সুবীর দত্তের অনুপস্থিতিতেও ফর দিয়ে সই করতে হবে, নিজের নাম লেখা যাবে না। নামে কী বা যায় আসে। ঘোষদা বলতেন, ‘কী যায় জানি না, তবে আসে তো বটেই। এ হল দত্ত সাহেবের অফিস কন্ট্রোল করার মন্ত্র। উনি নিজে ইঞ্জিনিয়ার নন, একটু কমপ্লেক্স তো আছেই। উনি চান বাইরের লোকে জানুক এন.টি কলকাতা মানে মিঃ দত্ত আর কেউ না।’ ঘোষদারও আবার কমপ্লেক্স নেই তো! কমপ্লেক্স বিষয়টা ভীষণ কমপ্লেক্স। কর্মাশিয়ালের মিত্র, মেটাল বক্সের শ্যামলদার আত্মীয় মতো হবেন, সেই সূত্রে আমার অযাচিত ও অঘোষিত অভিভাবক। সেই একটু একটু করে জানালো, আমার আগে আমার জায়গায় পারিখ বলে একজন সেলস এক্সিকিউটিভ ছিল। বম্বে থেকে এসেছিল, বিরাট চালু জিনিস নাকি। দত্ত সাহেবকে লেঙ্গি মারতে গিয়ে চাকরিটা খুইয়েছে। সেই থেকে দত্ত সাহেব একটু বেশি সাবধান থাকেন। পারিখেরও বলিহারি, হেড অফিসে নাকি লিখিত অভিযোগ করেছিল যে মিঃ দত্ত আর মিসেস দাসের মধ্যে অবৈধ সম্বন্ধ আছে। বস আর পি.এ-র মধ্যে অবৈধ সম্বন্ধের থেকে তো সহজলভ্য কুৎসা বোধ হয় আর হয় না। মিসেস দাসকে দেখলে খারাপ চিন্তা মনে আনা সহজ নয়। আর একদিন মিসেস দত্ত অফিসে এসেছিলেন, মার ভোকাবুলারি ধার করে বলতে হয়, লক্ষ্মী প্রতিমার মতো চেহারা। পরে বুঝেছিলাম পরকীয়া বিষয়টি বেশ জটিল। লক্ষ্মী আর প্যাঁচার মধ্যে পরেরটা পছন্দ করার মতো লোকেরও অভাব নেই। যাই হোক সে মুহূর্তে পারিখের কল্পনা শক্তির প্রশংসা করতে পারিনি। মিত্রদা আরও জানালেন, ‘ঘোষদার থেকে দূরে থাকাই ভালো, দত্ত সাহেবের গুড বুকে নেই।’ ঘোষদাও জানতেন সেটা। অফিস শেষে সচেতন ভাবে একলা বের হতেন, আমি তখন বের হয়ে একলা কিছুদূর গিয়ে তারপর ওনার সাথে দেখা করতাম, তারপর একসাথে হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদা। চলতে চলতেই নানা কথা শোনা হত। তারপর আমাদের পথ আলাদা। উনি উত্তরের ট্রেন ধরতেন, আমি দক্ষিণের। তবে একজন পুরুষ মানুষের সাথে লুকোচুরি করে দেখা করার ব্যাপারটাই বিদঘুটে। মেয়ে বন্ধু হলে তাও না হয়ে চলে, বিদেশ হলে তো লোকে উল্টো পাল্টা কথা ভাবত, আমারও কপাল।
এতদিন কলেজের সহপাঠীদের দেখেছি। সেখানেও সখ্যতার পাশে প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা দেখিনি তা তো নয়। তবে এ এক আলাদা জগৎ, আলাদা সমীকরণ। এ খেলার নিয়মটাই আলাদা, আমার ছাত্র রাজনীতি করা দক্ষতা বারবার অপটু চাল বলে পরিগণিত হতে লাগল, পদে পদে।
আমি একটা কায়দা করতে লাগলাম, চিঠি বা অফার বানানো হলে, নাম সই এর বদলে গোটা গোটা করে নিজের নাম লিখতে থাকলাম, যেন ওটাই এখন আমার সই। তাতে ফলও পেলাম, খদ্দেররা আমার নাম জানতে পারছিলো, আমার নাম করে আমাকে চাইতে লাগল। অফিসের পুরোনো অফারের ফাইল দেখে দেখে বিভিন্ন মডেলের দামগুলোও যোগাড় হলো। প্লাস্টিক সম্বন্ধে তো বিশেষ জানা ছিল না, তাই কলেজ স্ট্রীটের পুরোনো বই কিনে পলিমার সম্বন্ধে কিছু পড়াশুনোও করা গেলো। অন্যরা যখন কিছুই জানে না, তখন তাই খায় কে? শিয়ালরাজাও তো এক রকমের রাজা নাকি!
এটা হলো প্লাস্টিকের উত্থানের যুগ, প্যাকেটে প্লাস্টিক, মোড়কে প্লাস্টিক, সুটকেসে প্লাস্টিক, জুতো, বাসনেও প্লাস্টিক। কাঁচের শিশির বদলে এসে গেলো প্লাস্টিক বটল, উপভোক্তাদের চাহিদাও সেই দিকে। বুড়ো খোকাদের ভারত ভেঙে ভাগ করাটা আটকানো না গেলেও, তেলের শিশি ভাঙার জন্য বেচারি খুকুর উপর রাগ করাটা বন্ধ হলো। দুতিন পা এগিয়ে এন টির মেশিনপত্র নিয়ে বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেন করে বাজার গরম করলে ভালো অর্ডার হতে পারত, কিন্তু মিঃ দত্তকে কে বোঝায়! দুপুরবেলা অফিসের কাছে পিঠেই খাওয়া সেরে নিতাম, দুটাকায় ফিশ ফ্রায়েড রাইস, বেশ ভালো খেতে। মিত্রদা বলতেন, ‘মাছটা মোটেও ভেটকি নয় ম্যাকরয়েল।’ হবেও বা, তবে খেতে তো খারাপ লাগে না, আর অনেকটাও দেয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাওয়া তো কী হয়েছে? ও সব বায়না করলে এই মোকাম কলিকাতায় নশো পঞ্চাশ টাকা মাইনেতে আর চাকরি করে খেতে হবে না।
অফিসের পর ঘরে ফেরার তাগিদ কিছু ছিল না। খাওয়ারও ঠিক থাকতো না। তাই মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক চলে যেতাম। জলপাইগুড়িতে যেসব ভাবা যেত না, সে সব অনায়াসে ঘটতে থাকলো। অ্যাকাডেমিতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘লাল লন্ঠন’ দেখতে গিয়ে দেখি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে, নাটক দেখা মাথায়। থিয়েটার রোডের ক্রশিং-এ ট্রাফিক সিগনালে স্কুটারে আমাদের গুপীগাইন, ‘নয়ন মেলে’ দেখবো না তো কী করবো! দাঁড়াও পথিকবরে উৎপল দত্তের মাইকেল, শের আফগানে অজিতেশ ব্যানার্জী, পান্তু লাহা, শোয়াইক, গাব্বু খেলা, চাঁদ বণিক, আরও কত। সন্ধেবেলা নতুন চেহারায় সামনে দাঁড়াত শহর, এক কবিতার শহর, যাকে কিছুতেই ‘ফুসলিয়ে হলদিয়া বন্দরে’ নিয়ে যেতে বা ‘নারকেল নাড়ুর সাথে সেঁকো বিষ’ খাওয়াতে ইচ্ছে করে না।
মেটাল বক্সের শ্যামলদা মাঝে মাঝে অফিসে আসত, দত্ত সাহেবের (সব সাহেবরা তো আর দেশ ছেড়ে যায়নি) সাথে বেশ দহরম মহরম ছিল। শ্যামলদার যোগাযোগে চাকরিটা হয়েছে, তার ওপরে কলেজের সিনিয়র। শ্যামলদা আমাকে ওনার অঘোষিত শিষ্য মনে করতেন। শ্যামলদা জলপাইগুড়ির পরও পড়াশুনোটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। খড়গপুরের এম.টেক বলে কথা, আমার ওনার ওপর একটা বেশ শ্রদ্ধার ভাব ছিল। একটা ঘটনায় সেই শ্রদ্ধার ভাবটা একটু আঘাত খেলো। সেদিন সকালের দিকে বম্বে থেকে প্লাস্টিক ডিভিসনের মিঃ দেশাই আর শ্যামলদা মিঃ দত্তর কেবিনে আড্ডা গেড়েছেন। হঠাৎ শ্যামলদা আমার কাছে এসে বললেন, ‘চ্যাটার্জি, তোর কাছে লগ টেবিল আছে?
‘লগ টেবিল তো নেই, ক্যালকুলেটর চলবে, ভালো সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর এফ.এক্স–থার্টি ওয়ান?’
‘আরে না না, ক্যালকুলেটর ফ্যালকুলেটর চলবে না, আমার লগ টেবিলই চাই, থাকলে বের কর।’
‘দরকারটা বলবে? যদি অন্য কিছু দিয়ে…’
‘তিন লিটার জলের ওয়েট কত হবে বলতে পারিস?’
‘কত ডিগ্রিতে, মানে টেম্পারেচারের সাথে ডেনসিটিও তো পাল্টায় তাই…’
শ্যামলদা বিরক্ত হলো, ‘ওসব ভ্যানতারামোর কোনও দরকার নেই, বাংলায় জানিস তো বল, তিন লিটার পাতি জলের ওয়েট কত?’
ততক্ষণে আমার বিশ্বাস হতে শুরু করেছে যে শ্যামলদা কোনও কঠিন প্রশ্ন করছে না বা আমার সাথে মজা তো করছেই না।
‘তা হলে তিন কেজি।’
শ্যামলদা অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো, ‘তিন কেজি! ঠিক জানিস তো?’
‘মানে, ইয়ে এতে জানাজানির কী আছে। জলের ডেনসিটি যখন এক…’ কথা শেষ করার আগেই শ্যামলদা আমাকে প্রায় হ্যাঁচকা টান মেরে দত্ত সাহেবের কেবিনে ঢুকিয়ে দিল। ‘দত্তদা, চ্যাটার্জি বলছে তিন কেজি।’ কেবিনের ভিতরে দেখি মিঃ দত্ত টেলিফোনের রিসিভারের কথামুখটা হাত দিয়ে চেপে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে, মিঃ দেশাই (কানপুরের এম. টেক বলে প্রকাশ) এতটাই গভীর চিন্তামগ্ন, যে নিদ্রামগ্ন বলে ভ্রম হয়।
‘ঠিক জানো তো?’ মিঃ দত্তর সন্দেহ যায় না।
আমি বোঝাতে প্রয়াসী হলাম, ‘স্যার, জলের আপেক্ষিক গুরুত্ব তো এক, তাই এক লিটারের ওজন এক কেজি আর তিন লিটারের ওজন তিন কেজি।’ মিঃ দেশাইয়ের ধ্যান ভঙ্গ হল, ‘আমার বোধ হচ্ছে, ছেলেটি ঠিকই বলছে।’ যাক কথামালার পর বোধোদয়। ভরসা পেলেও, দত্ত সাহেব সাবধানি লোক, তাই ফোনে বললেন, ‘তিন কেজির কাছাকাছি।’
মিঃ দত্ত যে কোনও বিষয়ে কম নন, বরং আমাদের মত ছোকরা ইঞ্জিনিয়ারের থেকে বেশিই, সেটা কখনও সখনও আম জনতার সামনে প্রকাশ করতেন। যেমন একদিন কেবিনের বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চ্যাটার্জী, টিউলিপের অফারটা কি হলো?’ দিন চারেক আগে টিউলিপ সিমেন্ট কোম্পানির থেকে একটা টেন্ডার এসেছে। ওনাকে আমি তখনি জানিয়েছিলাম টিউলিপের অফারটা পাঠানো যাবে না, ওদের যা দরকার তা আমাদের প্রোডাক্ট রেঞ্জের বাইরে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘অফারটা পাঠানো যাবে না স্যার, মানে…’
গৌতম বুদ্ধর মতো ক্ষমা সুন্দর হাসি হেসে উনি বললেন, ‘তুমি পারবে না জানতাম, জাস্ট রাইট হ্যান্ড রুল লাগিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।’
ততদিনে আমি কিছু কিছু বুঝতে শুরু করলেও জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। ‘রাইট হ্যান্ড রুল স্যার, ফ্লেমিং-এর?’
‘না তো কী? এতে এমন বিরাট ইঞ্জিনিয়ারিং আর কী আছে, ই ইজিকল্টু এম সী স্কোয়ার ব্যাস।’ সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে, মিঃ দত্ত বিজয় গর্বে কেবিনের দিকে যাত্রা করলেন আর আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। ঘোষদা পরে বললেন, ‘এসব চলে চ্যাটার্জি, সব চলে।’
Our Visitor
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (একাদশ কিস্তি)বৃষ্টির শুরুতেই সামান্য ঠান্ডা পড়তে শুরু করলো। ক্লাবে লোক আসা একটু কমলো। বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (দশম কিস্তি)(৮) শিফট ডিউটি আরম্ভ হতেই জীবনটা জীবিকার প্রয়োজন মাত্র হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত সময়ে ঘুম থেকে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (নবম কিস্তি)আমাদের পুরো ব্যাচটাকে কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করা হলো। আমাদের দলে আমি, কর, সিং…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (অষ্টম কিস্তি)আমার মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে বিপদভঞ্জন দুঃখ দুঃখ মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেড়ে দিলো?’ ‘কান…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (সপ্তম কিস্তি)নিকলের নিয়োগপত্র বার পাঁচেক খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে, আমার টুইডের কোটটা গায়ে দিয়ে অফিসে গেলাম।…