পবিতরায় এক রাত – সৌম্যেন কুন্ডা
travel
-ঐ যে দূরে ঘাসের মধ্যে।
– ওটা তো পাথর!
– ভালো করে দেখুন।
– তাইতো!
ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে কথা হচ্ছিল বন্দুকধারী বনরক্ষী আর জীপের সারথি মিলন ফুকনের সাথে। পবিতরায় এসে প্রথমবার দেখা একশৃঙ্গ গন্ডারের সাথে। ওনারা বলে না দিলে ছাইরঙা পাথর ভেবে চোখ ফিরিয়ে নিতাম। একশৃঙ্গ গন্ডার দেখতেই পবিতরায় আসা।
বলতে পার “কাজিরাঙ্গা না গিয়ে পবিতরা কেন?” কেউ হয়তো বলবে “পবিতরা! কোথায়?” কাজিরাঙ্গা বড়ভাই, তবে গন্ডার বসতির ঘনত্বের হিসেবে কম খ্যাত ছোটভাই, পবিতরা, কিছুটা হলেও এগিয়ে।
গৌহাটি শহরের কাছাকাছিই পবিতরা অভয়ারণ্য, ৩৮.৮৫বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে, যেখানে ঘাসের সাথে বেড়ে ওঠে একশৃঙ্গ গন্ডারের সংখ্যা।গন্ডারের ঘনবসতি, ১০০ জনের ওপরে। পবিতরার পরিবার বেড়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে তাদের স্থানান্তরিত করা হয় মানস অরণ্যে। লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ বিমানবন্দর থেকে দূরত্ব কমবেশি ৬৬কিমি।
অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল পবিতরা যাওয়ার কিন্তু হয়ে উঠছিল না। রোজ এক অফিসে যাওয়া একই রাস্তা ধরে এবং ফিরে আসা সেই ফ্ল্যাটের ঘরে, বাড়িতে। ফ্ল্যাট বাড়িতেও প্রতীক্ষা থাকে। দরজায় হাসিমুখ, কখনও উষ্মার ছোঁয়া। দিনের শেষে সারাদিনের গল্প মাখা দুকাপ চা নিয়ে বসা। তারপর একঘেয়েমির কোনও এক সন্ধ্যায় মনে হয় ডাকছে যেন অন্য আকাশ,অন্য বাতাস। তাহলে? মন চলো যাই ভ্রমণে! দোলযাত্রার এপাশ ওপাশ আর কয়েকটি দিন জুড়ে নিলেই দিন ছয়েকের ছুটি।
সময়টা ছিল ২০২০এর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ। দুটো চারটে মাস্ক পরা মুখ, খাওয়ার আগে হাত স্যানিটাইজ করছেন কেউ এমনটা বিক্ষিপ্ত ভাবে নজরে আসছিল। যিনি পবিতরার খোঁজ দিয়েছিলেন তিনিই ফোন নম্বর দিলেন পবিতরায় থাকার জায়গার। এক রাতের আস্তানা। পবিতরায় একরাত কাটিয়ে যাব শিলং। তিনরাত সেখানে। ফিরতি পথে একরাত গৌহাটি। এমনটাই ঠিক হল।
অতঃপর কাজে লাগা। যাওয়া আসার টিকিট, বিভিন্ন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা, পরিবহন ইত্যাদি। দেখতে দেখতে যাত্রার দিনও এসে গেল সাথে দুঃসংবাদ, আংশিক কারফিউ জারি হয়েছে মেঘের দেশে। সংবিধানের সংশোধনে আগুন লেগেছে মেঘালয়ে। আগুন জ্বলে, শহর এবং মানুষ জ্বলে,তারই মাঝে জীবন চলে। ফোন করে জানলাম শহরে তেমন অসুবিধা নেই। অতএব দুগগা দুগগা। সকাল এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গৌহাটি,কিন্তু মালপত্র নিয়ে বের হতে হতে প্রায় পৌনে বারোটা। যুবক সারথি(নাম ওয়ার্ডি, খাসি সম্প্রদায়ের) অপেক্ষা করছিল হাসিমুখে। এখন থেকে গৌহাটি ফিরে আসা অবধি আমাদের সাথে থাকবে ওয়ার্ডি। জালুকবাড়ি, বশিষ্ঠ চারালি,খানাপাড়া পেরোনোর পরপরই কিছুটা রাস্তায় দুপাশে দু রাজ্য। বাঁয়ে আসাম, ডাইনে মেঘালয়। এই ব্যাপারটা শেষ হলো একটা মোড়ের কাছে, নাম বোধহয় জোরাবাট। ওয়ার্ডিকে আগেই বলে রেখেছিলাম তাই ছিমছাম চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে গেল বাহন। লিকার চা, হালকা আদা দিয়ে। বেশ লাগলো। জোরাবাট থেকে চামথা অবধি কিছুটা রাস্তা ভালো নয়। গতকাল ভারি বৃষ্টি হয়েছিল। চামথায় স্টার সিমেন্ট কারখানা তে যাওয়া আসা করে ভারবাহী ট্রাক।কাদা লেপে যায় রাস্তায়,ছোট গাড়ির চলার জন্য খুব একটা অনুকূল নয়।
ছোট ছোট জনবসতি হাহারা,কালোংপাট পিছে ফেলে সবুজ মাখা রাস্তা ধরে বেলা প্রায় দুটো নাগাদ পৌঁছে গেলাম থাকবার জায়গায়। মুখে চোখে জল দিয়েই খাওয়ার ঘরে। খুব সুন্দর খাওয়ার জায়গা।একপাশ খোলা, সেদিকে পুকুর, গাছ। পুকুরের একধারে জলে ডোবা নৌকা। বসার সময় ছিল না তাই খেয়েই দৌড় অরন্য অভিমুখে। আমাদের হোটেল থেকে অরন্যের প্রবেশ মুখ তিনশ মিটার মতো, হেঁটেই যাওয়া যায়। গেটের বাইরে ছোটখাটো উপহার কেনার দোকান, বেশ কিছু খাওয়ার দোকান। জীপ সাফারি বন্ধ হয়ে যায় বিকেল ৩-৩০ এ। জীপ ভাড়া করার জন্য গেটের বাইরে বাঁশের তৈরি গুমটি ঘরের জানালায় মুখ দেখালাম। বাঁধা রেট, একঘন্টা সফরের জন্য ১০০০টাকা। এখানে টাকা দিয়ে তার রসিদ নিয়ে ফের যাও গেটের ভেতর অরন্য দপ্তরে। এবার তারা নেবেন গাড়ি প্রতি ৩০০টাকা, আর জনপ্রতি ৫০টাকা আরও। অর্থাৎ দুজন লোক মিলে একটা গাড়ি ভাড়া করলে একঘন্টার জন্য ১৪০০টাকা। অনেকে দু দলে মিলে একটা গাড়ি ভাড়া করে। খরচ কমে খানিকটা। এই গাড়িচড়া সফরে, বা সাফারীতে গন্ডার দেখতে পাবে কিছু তবে দূর থেকে। Water Buffalo প্রচুর ঘুরে বেড়াচ্ছে গরুদের সাথে মিলে মিশে। অরন্যে ঢোকার মুখে এক বন্দুকধারী বনরক্ষী আমাদের গাড়িতে উঠলেন। তিনি ও জীপের সারথি মিলন ফুকন খুব যত্ন নিয়ে দেখা করালেন অরন্যের অধিবাসীদের সঙ্গে। বনরক্ষী বন্দুকধারী ভাই বসেছিলেন ড্রাইভারের পাশের আসনে। মুখভর্তি পান/গুটকা। থেকে থেকেই থুতু ফেলছেন বাইরে। একবার হাওয়ার সাথে দু এক ফোঁটা আমাদের দিকেও চলে আসাতে একটু কঠিন স্বরেই বারণ করতে হলো। শুনলেন এবং নিষ্ঠীবনের বিক্ষেপণ বন্ধ হলো অতঃপর।
এক ঘন্টার ঘুরানে কিছু গন্ডার দেখা গেল কিন্তু মন ভরল না। পরের দিন সকালে হাতির পিঠে চড়ে ঘোরার জন্য নাম লিখিয়ে, ফিরে এলাম হোটেলের ঘরে। সকাল সাতটার মধ্যে হাজিরা দিতে হবে। বিকেল বেলায় হাতে প্রচুর সময় তাই লাগোয়া গ্রাম রাজা মায়ঙের অধিবাসীদের সাথে গল্প জুড়লাম রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে। গ্রাম অবধি যাইনি। এ জায়গা কিন্তু খুব বিখ্যাত, ভারতবর্ষের কালা যাদু ও মন্ত্র তন্ত্রের রাজধানী বলা যায়! এখনও কিছু ব্যক্তি, যদিও সংখ্যায় খুব কম, আছেন এখানে যারা এই বিদ্যা ব্যবহার করেন। মানো না মানো তোমার ব্যাপার! তবে অনেকে শুধু এজন্যই ঘুরতে আসেন। হোটেলে ফিরে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুম।
পরদিন সকাল সকাল উঠে পৌনে সাতটায় হাজিরা দিতে গেলাম। গ্রামের রাস্তায় জটলা, গাছের ওপর মস্ত বড়ো মৌচাকে খোঁচা দিয়েছে কি এক পাখি, ধানক্ষেতে কোন জায়গায় কালরাতে গন্ডার, মহিষ ঢুকেছিল ইত্যাদি নিয়ে। খুব স্বাভাবিক নিত্য নৈমিত্তিক আলোচনা! গন্ডার যদি ধানগাছ খায় তবে তাতে চাষীর মঙ্গল হবে, কিন্তু মহিষের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। বিশ্বাস! তাতে আঘাত করার অধিকার কেউ দেয় নি তোমায়। আবার বলি, মানো না মানো তোমার ব্যাপার! কাউন্টার খুলবে সাড়ে সাতটার কিছু আগে। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন, প্রায় গনেশ ঠাকুরের সমান ভুঁড়ির মালিক, বনকর্মী গনেশ ডেকা। এমন শ্বশুর অন্ত প্রাণ মানুষ পাওয়া দুষ্কর। হয়তো কথায় কথায় বললেন “দাঁত থাকতে সব সুখাদ্য খেয়ে নেওয়া উচিত”, বলেই প্রশ্ন “বলুন তো কে বলেছেন? ” উত্তর ও উনিই দিচ্ছেন “আমার শ্বশুর”। কিংবা ” হাঁটুর জোর থাকতে সব তীর্থ ঘুরে নেওয়া উচিত ” এবং তারপরেই সেই পরিচিত প্রশ্ন ও তার উত্তর!! কোন রকমে গনেশব্যূহ থেকে বের হয়ে ছোট্ট নদীর ওপরে ঝুলন্ত পুলে দাঁড়িয়ে হাতির স্নান করা দেখতে দেখতে ডাক পড়ল টিকিট কাটার। ৫০০টাকা মাথাপিছু আর ৫০টাকা ক্যামেরার জন্য দিয়ে একঘন্টা অরণ্যময় সময় কেনা হলো। বন্দুকধারী বনরক্ষীর সাথে রওনা হয়ে একটু হেঁটে হাতির পিঠে চড়ার কংক্রীটের উঁচু কাঠামোতে পৌঁছলাম। রাস্তায় একটু দূরে দূরে বেশ কিছু কুলের গাছ। আমাদের বাহনের নাম রুদ্র আর তার মাহুত বিজু। প্রায় সমবয়স্ক ওরা। রুদ্র আঠাশ, বিজু একটু ছোট। চমৎকার বোঝাপড়া ওদের দুজনের। বিজু জানাল ওরা একে অন্যের ভাষাও বোঝে। জীবনে প্রথমবার জঙ্গলে হাতির পিঠে। যেখানে সেখানে গন্ডার, মহিষ। জানলাম ছোট খর্গ/শৃঙ্গ যাদের তারা স্ত্রী জাতীয় গন্ডার। পুরুষদের খর্গ/শৃঙ্গ তুলনায় বড়। শাবকরা রয়েছে মায়েদের সাথে। এক হায়েনা দেখলাম বন্য বরাহের পেছনে পেছনে চলছে। বিজু জানাল বরাহ গর্ভবতী, হায়েনার লোভ যে শিশু জন্ম নেবে তার মাংসের প্রতি। হাতি খুব কাছাকাছি চলে এলে গণ্ডারদের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটছে। উঠে একটু তাকিয়ে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। বিজুর কাছে জানলাম ওরা রাতে খাওয়া দাওয়া করে আর দিনে বিশ্রাম করে। জীপ সাফারীতে বিকেলের দিকে যাওয়াটাই শ্রেয় কারণ ঐ সময়ে গন্ডারের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হাতি যেখানে নিয়ে যায় সেখান অবধি গাড়ি যায় না। একঘন্টা সময় বেশ তাড়াতাড়ি কেটে গেল। ফেরার পথে রুদ্র জলখাবার খেল ডালপাতা ভেঙে। আর বিজু রুদ্রের পিঠে বসে গাছ থেকে টোপা কুল পেড়ে দিল আমাদের। অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। কোমর একটু ধরেছিল, পায়ে একটু টান, মনটা ফুরফুরে। হোটেল ফিরে স্নান করে খুব ভালো প্রাতরাশ (গরম গরম রুটি,আলুর টুকরো দেওয়া ডাল,ওমলেট আর চা) সেরে রওনা হলাম শিলঙের উদ্দেশ্যে। ঘুরব মেঘের দেশে, মেঘালয়ে।
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (একাদশ কিস্তি)বৃষ্টির শুরুতেই সামান্য ঠান্ডা পড়তে শুরু করলো। ক্লাবে লোক আসা একটু কমলো। বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (দশম কিস্তি)(৮) শিফট ডিউটি আরম্ভ হতেই জীবনটা জীবিকার প্রয়োজন মাত্র হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত সময়ে ঘুম থেকে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (নবম কিস্তি)আমাদের পুরো ব্যাচটাকে কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করা হলো। আমাদের দলে আমি, কর, সিং…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (অষ্টম কিস্তি)আমার মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে বিপদভঞ্জন দুঃখ দুঃখ মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেড়ে দিলো?’ ‘কান…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (সপ্তম কিস্তি)নিকলের নিয়োগপত্র বার পাঁচেক খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে, আমার টুইডের কোটটা গায়ে দিয়ে অফিসে গেলাম।…