দেখা হয় নাই দুই পা ফেলিয়া – ঘরের কাছে আসলি নগর – ক্ষমা ভট্টাচার্য্য

 (১)

এলিফ্যান্টস করিডোর এহেড – শুকনা ফরেস্টের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে গাড়ি দাঁড়াতেই গাইড পোস্টে  চোখ  আটকে গেল। এই অঞ্চলে  বসবাসকারীদের, দলে – অ দলে  হাতি দেখার  অভিজ্ঞতা প্রায়  সবারই আছে।তবু হাতি বের  হবার খবর পেলেই ঢল নামে –  মাঝ পথে থেমে যায় গাড়ি আর সার সার মানুষ। দুপাশে শাল সেগুন এর জঙ্গল – চা বাগান।কোথাও বা ভুট্টা ক্ষেত।এঁকে বেঁকে সিঁথি কাটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। মধুবন পার করে গাড়ি চলতে থাকে। সামনে ডানে বাঁয়ে পাহাড়ি  সীমানা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে – মিলিটারি ব্রিজ – ডানদিকে রাস্তা চলে গেছে  তিরতিরে  নদীর পাশ ঘেঁষে – কে এল পি মিলিটারি এরিয়া – আরেক হাতির আড্ডা যদিও মন ভোলানি গাছগাছাড়ি ঘেরা অনুমতি সাপেক্ষে (এখন আর দেওয়া হয় না) বনভোজনের এক আদর্শ জায়গা। বছর শেষের বৃষ্টি মেখে গাড়ি চলতে থাকে  রাস্তা বেয়ে – খোলা জানলা দিয়ে বুনো ভেজা গন্ধে মনও ভিজতে থাকে  শ’বার দেখা -পরিচিত হয়েও নিত্যনতুন পরিচয়ের আনন্দ নিতে নিতে আরো একবার।    বেশ কয়েকটা গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ দিক ঘেঁষে।আমাদের গাড়ীও দাঁড়িয়ে পড়ল। নেমে দাঁড়াতেই – একটু দূরেই শুঁড় উঁচিয়ে বন সম্রাট! ঝকঝকে সাদা দাঁতের ফাঁক দিয়ে হুংকার ছাড়ছে যাত্রাপথে মানুষীঅধিকারের বিরুদ্ধে।দলছুট দাঁতালকে না ঘাটিয়ে এঁড়িয়ে যাওয়াই ভালো।


বৃষ্টিতে ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে ধরেছে – গাড়িধুরাতে  নেমে  কোনো মতে মাথা বাঁচিয়ে এক দৌড়ে নির্মলের চায়ের দোকানে – নির্মল প্রসাদ কানু,কষ্টসহিষ্ণু বিহারী – দোকানের মালিক। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো। অমায়িক ব্যবহার। সবাই চা খেয়ে খানিকটা গরম হয়ে আবার যাত্রা শুরু। শিলিগুড়ি থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিমির মত পথ। সৌরেনী চা বাগান।আমাদের আজকের গন্তব্য। ফুগুরি গয়াবাড়ি সিমবোলি এসব হোল প্রতিবেশি বাগান৷ আর ছবির মত মিরিক গোপালধারা যদিও সৌরেনী থেকে কিলোমিটার পাঁচছয় মাত্র ৷
দু হাত দূরের শহরের সময়কে তোয়াক্কা না করে ঝপ করেই পাহাড়ে সন্ধ্যা  নেমে আসে। স্ট্রীট লাইট এখানে দূর অস্ত। গাড়ির হেড লাইটে সৌরেনী চা বাগান ফ্যাক্টরির নাম চোখে পড়তেই গাড়ি ডান দিকে টার্ণ নিল। ঢোকার রাস্তা বেশ উঁচু নিচু-এবরো খেবড়ো পাথুরে। খানিকটা চলার পর ফ্যাক্টরিকে পেছনে রেখে বাংলোর সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। সৌরেনী বুটিক রিসর্ট।  অল্প বয়সী দুটো স্থানীয় ছেলে আমাদের মালপত্র নামিয়ে ভেতরে নিয়ে এল। ঢুকতে ঢুকতে দুপাশের যত্ন করে সাজিয়ে রাখা ফুল আর নানান বাহারি পাতাবাহার জার্নির ধকল ভুলিয়ে দিল। সব ধরনের শহুরে ব্যবস্থায় সাজানো ঘরের ভেতরে পা রাখতে সব ক্লান্তিও যেন দূর হয়ে গেল এক নিমেষে!
ইলেকট্রিক কেটল, ইলেকট্রিক কম্বল,রুম হিটার, ব্লোয়ার – কী নেই গরম রাখতে!ডিনারে চাইনিজ – কন্টিনেন্টাল  গরম গরম যা চাইবেন যেভাবে চাইবেন। শুধু আমিষভোজী দের জন্য দুঃখের – খাবার এখানে সম্পূর্ন ভেজ। ভোরে ঘুম ভাঙলেও  বের হবার উপায় নেই।একে শীত তার ওপর মেঘলা – চারপাশ  ফর্সা হতে হতে সাড়ে ছটার বেশিই বেজে গেল।বাংলোর বারান্দায় বের হয়ে  চা বাগানের কোলে ঝোলানো বারান্দায় গোছানো চেয়ারে বসলেই যে অপার সৌন্দর্য ক্যানভাসে ফুটে উঠবে তা  রুমরেন্টের দশ হাজারী দুঃখ নিমেষে ভুলিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে।আড়মোড়া ভাঙ্গা আধা ঘুমন্ত পাহাড়ী চড়াই উৎরাই পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পথ আসার পরও তেমন  লোকজন চোখে পড়ল না। যত শব্দই লিখি না কেন বলা  কেন কোনো এই  পাহাড়ী সৌন্দর্যের বর্ণনায় তা কম পরে যাবে। বাঁক ঘুরতেই ঝুড়ি কাঁধে নিচ থেকে উঠে একদল নানান বয়সী মহিলা  আসা চোখে পড়ল। হেসে তাকাতেই, একজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ওদিকে কোথায় যাচ্ছ ম্যাডাম! ওটা তো আমাদের গাঁয়ে যাবার রাস্তা! আমিও দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোথায় চলেছ।
এক ঝাঁক বুনো প্রজাপতির মত হাসতে হাসতে ওরা চলে গেল  দুটি পাতা একটি কুঁড়িতে দশ কেজি ওজনে ঝুড়ি ভরাতে। দিন গেলে দুশ দুই টাকা। সময়  – নিয়ম মেনে সেই অত ঘণ্টা।চলতে দেখা হয়ে গেল শর্মা জির সাথে। সৌরেনী চা কারখানার সুপারভাইসার। মুখ ভর্তি হাসি। যা যা জানতে চাইলাম ধৈর্যের সাথে উনি বলে গেলেন।সব মিলিয়ে  তিনশ’র মত কর্মচারী এই  বাগানে কাজ করেন। ত্রিশজন ফ্যাক্টরিতে।এছাড়া ‘বিগা ওয়ার্কার’ অর্থাৎ  ক্যাজুয়াল ওয়ার্কারও  আছে। টিটাগড় পেপার মিলের মালিক জে পি চৌধুরী ছিলেন এই বাগানেরও পূর্বতন মালিক। বর্তমানে হাত বদল হয়ে শিলিগুড়ির ব্যবসায়ী দিলীপ আগরওয়াল এর হাতে।বাগানের কর্মচারীদের দেনা পাওনা স্থির হয় ত্রিপাক্ষিক সমঝোতায়-মালিক শ্রমিক আর সরকারি প্রতিনিধিত্বে।এতে কার ভাগে শিকে ছেঁড়ে তা বলাই বাহুল্য। ফুল পাতায় সযত্নে সাজানো ঘর বাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই সাধারণ মানুষদের প্রাত্যহিক দিন গুজরানোর ঘামঝরেপড়া গল্প।সরকারি স্কুল হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত।কলেজ মিরিকে। স্কুলে পড়াশুনোর অবস্থা নিয়ে সেই একই ক্ষোভ – ক্ষোভ  শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও। এখানেও যাদের মোটামুটি সামর্থ্য আছে কষ্ট হলেও তারা প্রাইভেট ইংরেজি মাধ্যমের দ্বারস্থ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মনোমুগ্ধকর তার সাথে জড়িয়ে মিশে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে ও না ভালোবেসে উপায় নেই – এখনো এতটাই সহজ সরলতায় অনায়াস এরা। পিঠে জ্যারিকেন বেঁধে জল আনতে দেখে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানলাম এখনো এভাবেই সারাদিনের ব্যবহারের জল টেনে টেনে আনতে হয় আজো।বর্ষার আশেপাশের দিন গুলোতে একটু কাছের কোনো না জানা উৎস থেকে আসা ঝর্নার  জমানো জল মেলে। জানুয়ারির শেষ থেকে তাও শুকিয়ে গেলে পাহাড়ি উৎরাই চড়াই বেয়ে প্রায় সাত আট কিলোমিটার পথ হেঁটে বেঁচে থাকার জল সংগ্রহ করতে হয়।আশপাশের সুন্দর দৃশ্যের ও কেমন যেন পানসে হয়ে যায়।নামেই গ্রাম – আসলে বাগানের সীমানার জমি – তাই বাস করলেও যেকোনো সরকারি সুবিধে পেতে গেলে বাগান কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি ছাড়া  তা সম্ভব নয়।এই বিপুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে না জানি আরো কত না জানা কাহিনী! একদিকে যাবতীয় আধুনিক সুযোগ সুবিধেমোড়া রিসর্ট – আর তার চারপাশ ঘিরে বাস করা মানুষ গুলো যারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা – জল থেকে আজো বঞ্চিত।এক কাপ সোনালি তরল কত না প্রভাত – সকালকে সঞ্জীবিত করে তোলে! আর তৈরির কারিগরেরা কমবেশি সব জায়গায় একই জীবন যাপন করে।

error: Content is protected !!