চারধাম যাত্রা : পর্ব ৪ – সৌম্যেন কুন্ডা
নরম ঘাসের মাঝে সিঁথিপথ ধরে
তুমি হেঁটে যাও নগ্ন পদে, পরিব্রাজক,
পাশাপাশি নদী, তারই জমাট দুঃখের
রক্ষাকবচ মাটির বাঁধে, কিছু অন্তর্লীন
ভালোবাসা নিয়ে বাবুইয়ের বাসা
বাজপড়া তালগাছে, নামেই তীর
রূপালী বালুর ধার দিয়ে আগাছা,
জল অনেক দূরে, শুধু লেগে থাকা
নুড়ি পাথরের গায়ে শ্যাওলার বিশ্বাস
সাগরের দিকে চলে গেছে শুশুকেরা সব॥
কেদারনাথের হোটেল ছেড়ে যখন বের হলাম তখন অন্ধকার। ধীরে ধীরে আলো হতে লাগল। আমাদের মেশিন পাখি যখন আসব আসব করছে তখন দেখি আস্তে আস্তে সোনালী হচ্ছে বরফ শৃঙ্গ। দাঁড়ানোর সময় ছিল না। অনেক জায়গায় ঘুরেছি, ফেরার সময় হয়তো মনে হয়েছে আবার আসব, কিন্তু কেদারনাথের আকর্ষণ অন্যরকম, আবার যাওয়ার ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে রাখে।
ফাটায় নেমে ফিরলাম গুপ্তকাশি। হোটেলের এক কামরায় মালপত্র রেখে গিয়েছিলাম। কামরা একটি, অতএব টয়লেট একটি। এক এক করে তৈরী হতে হবে। হোটেলের নীচের দোকানে চা/কফি পান করে এসে বাকিরা তৈরী হওয়া, গুছিয়ে নেওয়া ইত্যাদিতে ব্যস্ত হল। আমি কামরার সামনে প্রশস্ত বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে পরলাম, সবার শেষে তৈরি হব এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে। কেদারনাথের চিন্তাতেই মগ্ন ছিলাম, ঘোর ভাঙলো বাজনার আওয়াজে। বরযাত্রী ফিরে যাচ্ছে সঙ্গে নুতন কনে। কিন্তু কন্যা তো বাপের বাড়ি এমনিই ছেড়ে যাবে না! যত আদরে যত্নে বড়ো করেছ ততটাই আদরে বিদায় দিতে হবে তার নিজের সংসারে যাওয়ার মুখে। তা করে গাড়োয়ালের ভাইরা। “বিদাই” করতে এই পাহাড়ি রাস্তায় ডোলিতে বসিয়ে নিয়ে আসে তাদের আদরের বোনকে, বাহক অবশ্যই ভাইরা,এমনটাই নাকি প্রথা। তা এ মেয়ের রথ রাখা ছিল আমার বারান্দার নীচে। ডোলি এসে দাঁড়াল, নামল মেয়ে। এতক্ষণ শুধু চরণযুগল দেখতে পাচ্ছিলাম। এবার পূর্ণাঙ্গ দেখে কষ্ট হচ্ছিল ভাইদের জন্য কিন্তু আর সে যাবে না। কি কান্না, কি কান্না। আছাড়ি পিছাড়ি কান্না। কখনও মা-কাকিমা, কখনও বাবা-মামা এক এক করে সবাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল মেয়ে। নব্য বিবাহিত সুদর্শন যুবকটি বেশ একটা ছাগল ছাগল মুখে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে।ঘাসপাতা পেলেই চিবোতে লাগবে এমন একটি ভাব, যেমন হয় আর কি! মিনিট দশেক কান্নাকাটি চলার পর কনেকে প্রায় ধরে বেঁধে গাড়িতে তুলে দিল ভাইরা। মূহুর্তে থেমে গেল কান্না, একলাফে পাশের দরজা খুলে উঠে বসল ছাগল। এবার সত্যি “বিদাই”, চলে যাওয়া মারুতি গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখ মুছতে লাগল মায়েরা। পেছনের দরজার ভেতর থেকে “এই, শুনছো” শুনে বারান্দাকে বিদায় দিয়ে ছাগুলে লাফে ঘরে ঢুকলাম তৈরি হতে। দশটা নাগাদ হোটেলের হিসাবপত্র চুকিয়ে ফের রওনা ফাটামুখী। আপাতত গন্তব্য ত্রিযুগিনারায়ন মন্দির (উচ্চতা ১৯৮৯মিটার)। অনেক লোকগাথা রয়েছে গুপ্তকাশি থেকে ৩৭ কিমি দূর ত্রিযুগিনারায়নকে ঘিরে। ফাটা, রামপুর, সীতাপুর ছাড়িয়ে সোনপ্রয়াগ থেকে বাঁদিকে রাস্তা উঠে গেছে ত্রিযুগিনারায়নের দিকে। বারোটা নাগাদ পৌঁছালাম। খুব একটা ভীড় নেই, সামনের দোকানগুলোতেও দোকানীর অভাব। বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল বাইরের দিকে। বিয়ে করতে অনেকেই আসে এখানে। কারণ আছে অবশ্যই। যে কেউ তোমাকে বলে দেবে তিন যুগের গল্প। নারায়ণ স্বয়ং দাঁড়িয়ে থেকে শিব-পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন করেছিলেন এই জায়গায়। আরও আছে, সেই সময় থেকে জ্বলে আসছে হোমের আগুন, যা কখনো নেভে না (বড় বড় কাঠের টুকরো ফেলে নিভতে দেওয়া হয় না)। অখণ্ড-জ্যোতি নাম এর। বিয়ে যখন হয়েছে তখন নিমন্ত্রিত অবশ্যই ছিল। ব্রহ্মা অন্যতম। আরও অনেক মুনিঋষি এসেছিলেন। দুটো ছোটো চৌবাচ্চা আছে যাতে সবসময় জল আসছে এবং ওভারফ্লোর গর্ত দিয়ে বের হয়েও যাচ্ছে জলের গভীরতা এক জায়গায় রেখে। ছোটটির নাম ঋষিকূন্ড আর বড়টির ব্রহ্মকূন্ড। বিয়ের আগে যাঁরা যেখানে স্নান করেছিলেন সেই অনুযায়ী নামকরণ। ব্রহ্মকূন্ডের চারধারের প্রতিটি থেকেই কয়েক ধাপের ছোট্ট সিঁড়ি নেমে গেছে কূন্ডের নীচ অবধি। এ কি ব্রহ্মার চার মুখের প্রতীক? প্রশ্ন করেছিলাম, উত্তর পাই নি। ঋষিকূন্ডের পাশেই বিবাহস্থল। কিন্তু সাতপাক বা ফেরা নেওয়া হয়েছিল ব্রহ্মকূন্ডের সামনে। গোল ফুলের মতো স্থাপত্য আছে মেঝেতে। বিয়ে বাড়ির এদিক ওদিক ঘুরে দেখলাম রান্না হচ্ছে এক ঘরে। মুখ ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে রাঁধুনি জানালেন ভোগ তৈরি হচ্ছে ভগবানের। অনুরোধে ছবি তোলার অনুমতি দিলেন হাসিমুখে। বের হতে হবে,লম্বা একটা দিন রয়েছে সামনে, উখিমঠ হয়ে চোপতা পৌঁছতে হবে।
ইচ্ছে তখন হেডলাইটের আলোয়
ভাঙ্গছিল বাঁধ নিটোল কুয়াশার
হঠাৎ করেই মেঘের আড়াল সরে
সামনে এল ঝকঝকে এক চাঁদ
চেনা মুখের আদল দেখতে পেয়ে
থমকে গেল উদাসীন চরাচর;
দেবতা, পাহাড়, ঝর্না, নদী সব
এক হয়ে দিল পরম পাওয়ার স্বাদ॥
ত্রিযুগিনারায়নকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম ফের ফাটা হয়ে গুপ্তকাশির দিকে। রামপুরের কাছে মধ্যাহ্নভোজনে জীবনের সব চাইতে খারাপ ধোসা খেলাম। আলাপ হলো দুদল তরুণ দম্পতির সাথে। চারজনের একজন পেট নিয়ে বিপর্যস্ত। কি ভাবে কেদারনাথ যাবে ঠিক করতে পারছে না। শুধু জল আর গ্লূকোজ বিস্কিট খাবে, নাকি কিছুই নয়! আর যাই খাক না খাক ঐ ধোসা যেন না খায়, এমন উপদেশ দিয়েছিলাম। কী করেছিল জানা নেই।
পরবর্তী গন্তব্য উখিমঠ (উচ্চতা ১৩১১মিটার)। শীতকালে কেদারনাথ থেকে শোভাযাত্রা করে ঠাকুর আসেন উখিমঠে। মদমহেশ্বরও আসেন।অধিষ্ঠিত হন। সম্ভবত প্রচন্ড ঠান্ডার হাত থেকে ভক্তদের নিস্তার দিতেই এমন সিদ্ধান্ত! এখানেও এক বিবাহ কাহিনী বিবৃত হয়ে আসছে, সম্ভবত মান্ধাতার আমলের কিছু পর থেকে কারণ রাজা মান্ধাতার মূর্তিও আছে এখানে। বিবাহ হয়েছিল বনাসুরের কন্যা ঊষার সাথে কৃষ্ণের নাতি অনিরূদ্ধের। কৃষ্ণের ছেলে প্রদ্যূম্ন, তার ছেলে অনিরূদ্ধ। ঊষার নামে এ জায়গার নাম হয়েছিল ঊষামঠ, তার থেকে ঊখা এবং এখন ঊখিমঠ। এমনটাই জানালেন মন্দিরের পূজারী। গুপ্তকাশি থেকে উখিমঠের দূরত্ব আঠারো কিলোমিটার মতো কিন্তু পৌঁছতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগেছিল। একটু স্বপ্ন ভঙ্গের মতো ব্যাপার। কম বয়সে যে উখিমঠের কথা পড়েছি তার সাথে, স্বাভাবিক কারণেই, তফাৎ অনেক। এমনটাই হওয়ার কথা কিন্তু মন বোধহয় চাইছিল অমনটা দেখতে। মন্দির চত্বরে ঢুকতেই বাঁ পাশে বসে আছেন জনা তিনেক বাজনাবাদক। বাজনাগুলো দেখতে ঢোলের মতো। ঢোকার সময় কিছু বলছেন না, বেরোতে গেলে বেশ জোরে জোরে বাজিয়ে ভিক্ষা চাইছেন তারা। খুব বেশিক্ষণ সময় কাটান গেল না, চোপতা অপেক্ষা করে আছে। ছোট ছেলের কাছে প্রথম শুনেছিলাম চোপতার কথা। কোথা দিয়ে গেলাম মনে নেই তবে রাস্তা বড়ো সুন্দর, মাঝে মাঝে ময়না এবং নাম না জানা পাখির সাথে চোখাচোখি হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে পৌঁছে গেলাম চোপতা। শুরুতেই অনেক ক্যাম্প সাইট, ম্যাগপাই, হিমালয় কত কি নাম তাদের। ভারি সুন্দর এই চোপতা উপত্যকা, প্রচুর চারণভূমি রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এক জায়গায় দেখলাম গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তুলছেন পর্যটকেরা। আমাদের সময় নেই, এগিয়ে রাতের মাথা গোঁজবার ঠাঁই খুঁজতে হবে। গুটিকয়েক দোকান সমৃদ্ধ বাজার চোপতার। এখান থেকেই রাস্তা উঠে গেছে তুঙ্গনাথে যাওয়ার। আড়াই/তিন কিলোমিটার পথ, ঘোড়া/খচ্চর পাওয়া যায়। ছোট ছোট হোটেল আছে কিছু, বাঙালি পর্যটকে বোঝাই। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। খবর পাওয়া গেল আড়াই কিলোমিটার দূরে গ্রীন ভিউ লজে (একটু অন্য রকমও হতে পারে নামটা, সঠিক মনে নেই) জায়গা পাওয়া যাবে। চলো সেখানে। সারথী বলল তাহলে যেদিক দিয়ে এসেছি সেদিকে ফিরে গিয়ে ছবি তোলার জায়গাটি দেখে আসা ভালো হবে কারণ কাল সকালে আমরা যাব অন্যদিকে। তাই চলো। ভালো করেছিলাম গিয়ে। কি সুন্দর, কি সুন্দর! সূর্য তখন শুতে যাবে কিনা ভাবছিল। কি রঙ,কি রঙ। সব কিছু সুন্দর হয়ে গিয়েছিল। সব মাঠ,ঘাট,নারী পুরুষ..সব সুন্দর। আকাশে ছিল রঙের খেলা কিন্তু মনে তো নেই মেঘের মেলা তাই বুঝি মন গাইল কামরুজ্জামান কামুর লেখা “বায়োস্কোপ”:
“অন্তরে থাক পদ্ম-গোলাপ
গদ্যে পদ্যে আঁকছি মুখ
ঘুরতে ছিলাম রঙ্গের মেলায়
অপূর্ব সে তোমার চোখ
অমন পলক ফেলতে তো কেউ পারে না!
সেই ভাবনায় বয়স আমার বাড়ে না॥”
বাড়বে না, সেদিনের সেই সময়ের বয়সটা বাড়বে না আর।
গদ্য পদ্য ছেড়ে যেতে হলো সবুজ দেখা সরাইখানা খুঁজতে। দুটো ঘর পাওয়া গেল, তিন বিছানার প্রতিটি। নেবে নাও নইলে চার বিছানার ঘরও আছে। সারথীকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল পরবর্তী জনপদ মন্ডল, ২২ কিলোমিটার দূরে এবং রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। অগত্যা তিন বিছানার দুই কামরা নিয়ে এখানে থাকাই সাব্যস্ত হলো। খাওয়া পাবে ওপরে হোটেলের রেস্টুরেন্টে। গরম জল পাবে, এক বালতি পঞ্চাশ টাকা, ঘরে পৌঁছে দেবে। সন্ধ্যা নেমেছে, কখনও আকাশ পালিশ করা তারায় ভরা, কখনও মেঘ ঢেকে নিচ্ছে সব, এমনকি বাড়ি ঘর, এমনকি আমাকে। সামনের পাহাড়ের গায়ের রাস্তা দিয়ে গাড়ির হেডলাইট ছিঁড়ছে কিছু মেঘের জাল, কখনও শুধুই মেঘ। একটা ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাইরে ঠান্ডায়। তারপর ওপরে রাতের খাওয়া সেরে, মালিকের সাথে গল্প করে ফিরে এলাম ঘরে। শুয়েই ঘুম। সকালে উঠে দেখলাম অল্প বরফ ছড়িয়ে আছে ইতি উতি। শুনলাম রাত তিনটে নাগাদ বরফপাত হয়েছে, পরে শিলাবৃষ্টি অল্প করে। চা, কফি, গরম জল, প্রাতরাশের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। ভ্রমণের প্রায় শেষ পর্যায়ে পরের গন্তব্য, জোশিমঠ হয়ে, বদ্রীনাথ।