চারধাম যাত্রা : পর্ব ৩ – সৌম্যেন কুন্ডা

0

মহাষ্টমীর দিন শ্রীমতীদের ইচ্ছে মন্দিরে পুজো দেওয়ার। সারথী অজয় সর্বজ্ঞ (না ওর পদবী প্রজাপতি, সর্বজ্ঞ নয়) জানালো আমাদের যাত্রাপথেই রয়েছে “মাতাজি কি মন্দির” ওখানে দাঁড়িয়ে যাবে। যথাস্থানে দাঁড়িয়ে যে দিকে অজয় দেখাল সেদিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তার ওপর ছোট্ট একটু মন্দির যার ভেতর হামাগুড়ি দিয়েও ঢোকা যাবে না! আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে অজয় জানাল, “ইয়ে নেহী। নীচে যানা হ্যায়।” বাকি তিনজন রওনা হলেন মন্দিরের দিকে, আমি রয়ে গেলাম সারথীর সাথে। এমনটাই হয় সচরাচর, আমি রয়ে যাই।
আজ চলেছি গুপ্তকাশি (উচ্চতা ১৩১৯মিটার), উত্তরকাশী থেকে দূরত্ব ২২০কিমি। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারলে আরও এগিয়ে ফাটায় গিয়ে রাত্রিবাস করা হবে এমনটিই ইচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম। রাস্তায় টায়ার পাংচার, বেশ বড় বাজার চামিয়ালা ছাড়িয়ে ধনসালি থেকে ৮/৯ কি মি আগে।স্টেপনি পাল্টে ফের চলা। ধনসালির বাজার ছোট নয় তবে টায়ার সারানোর দোকান একটাই এবং সেখানে লাইন আছে আগে থেকেই। অগত্যা অপেক্ষা, পেট্রোল পাম্পের টয়লেট ব্যবহার, পাশের দোকানের চা-জলখাবার ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটল প্রায় দেড় ঘণ্টা। আমাদের টায়ারে হাত পরতে মন খুশি, মুখ উজ্জ্বল। কাজ চলাকালীন হঠাৎই একটা “প্যাঁট” করে আওয়াজ হওয়াতে চমকে তাকালাম, দেখি মেকানিক সন্ত্রস্ত! দাঁড়িয়ে সামনে বেশি ঝুঁকে কাজ করতে গিয়ে ওর প্যান্টের পেছনের সেলাই ফেটে অমন আওয়াজ হয়েছিল। আবার মিনিট পনেরো বিরতি। অস্থায়ী লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা করতে যতটুকু সময় লাগে আর কী। টায়ার ফাটা, সেলাই ফাটা নিয়ে এতটাই দেরি হলো যে ফাটা না গিয়ে গুপ্তকাশিতে রাত কাটানোই সাব্যস্ত হলো। এ অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচার চলছে জোরকদমে। ধনসালি থেকে বের হয়ে গিয়ে দুগাড্ডায় দুপুরের খাবার পরোটা, সব্জি, দই, আচার। ঋষিকেশ-যমুনোত্রী- গঙ্গোত্রী- কেদারনাথ- বদ্রীনাথ- রূদ্রপ্রয়াগ- হরিদ্বার এই পুরো রাস্তায় সকালের নাস্তায় আলুর পরোটা পাবেই পাবে, এই বিশ্বাস নিয়ে পথ চলতে পারো। তবে স্বাদে, চেহারায় পাঞ্জাব-হিমাচলের থেকে আলাদা। আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় উত্তরাখন্ডের আলুপরোটাকে খুব একটা উঁচু জায়গায় রাখব না। এরপর এল মায়ালি, রাস্তার ওপর সুন্দর ল্যাজ-প্যাখমওয়ালা পাখি, পাতি হাঁসের মতো বড়। নাম জানি না, ছবি তোলার সময় ছিল না। সারথী বলল “ওহ মোর থা!” আমার মন যদিও এই মোর কে ময়ূর হিসেবে মোটেও মানতে চাইল না। সে যেই হোক, খুব সুন্দর। সব কিছুই সুন্দর। শুধু হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্টের বাঁধ ছাড়া। বিদ্যুৎ অবশ্যই চাই, কিন্তু নদীর অনায়াস গতি বাধা পেতে দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমার কাছে এটা “কালিঝোরা সিন্ড্রোম,” বুঝবে স্বজন যে মন জানে। সে যাই হোক, তিলওয়াড়া, অগস্ত্য মুনির খারাপ রাস্তা পেরিয়ে, প্রায় এগারো ঘন্টা পথে কাটিয়ে, মন্দাকিনীর রূপ দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল গুপ্তকাশি পৌঁছাতে। শহরটির কেন্দ্রে হোটেল খুঁজে রাত কাটালাম। সক্কালবেলায় উঠে সাথীরা স্নান সেরে গেল বিশ্বনাথের মন্দিরে, সাথে আছে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি (পার্বতী আর শিব)। আমি রয়ে গেলাম, যেমন থাকি। হোটেলে একটা কামরা রেখে তাতে সব মালপত্র তালা বন্দী করে, নটা নাগাদ রওনা হলাম ফাটার উদ্দেশ্যে। ১৫ কিমি লম্বা বেশ খারাপ রাস্তা পার হতে লাগল প্রায় এক ঘন্টা। পথে প্রায় তিনটে হেলিপ্যাড পিছে রেখে এলাম আমাদের গন্তব্যে, পবন হন্সের হেলিপ্যাড।সব হেলিপ্যাড থেকেই উড়ছে পাখি, নামছে পাখি, মেশিন পাখি। GMVN এর অনলাইন সাইট থেকে অগস্ট মাসেই টিকেট কেটে রেখেছিলাম। রিপোর্টিং ১১টায় হলেও আমরা একটু আগেই পৌঁছে গেলাম। দেখলাম আগে গেলে বাঘে খায় না, আগেই পাঠিয়ে দেয়। প্রত্যেককে আলাদা করে ওজন করা হলো এবং মিলিয়ে নিল বুকিং এর সময় লিখে দেওয়া ওজনের সাথে। একটু চিন্তা ছিল সাথে কতটা ওজন নিতে দেবে, নিয়মে বোধহয় মাথাপিছু ২.৫/৩ কেজি নিতে দেয়। সেগুলো আর ওজন করল না। এরপর অপেক্ষা দুশ্চিন্তার সাথে। যদি আবহাওয়া খারাপ হয়, তাহলে তো উড়ান বন্ধ করবে! অতএব বারবার অফিসে হানা, অনুরোধ। বারোটা নাগাদ ডাক পরল। নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা সম্বন্ধীয় নির্দেশ শুনতে শুনতে এসে গেল আমাদের মেশিন পাখি। মেশিন বন্ধ হয় না, দু মিনিটের মধ্যে যাত্রী নামানো, ওঠানো শেষ। একজন পাইলটের সাথে, আর পাঁচজন পেছনে। মালপত্র ওঠানো নামানোর দায়িত্ব কোম্পানির। বসতে না বসতেই মেশিন পাখির সাত মিনিটের উড়ান শুরু। দূরে অন্যান্য মেশিন পাখিগুলোকে দেখে ছোটবেলার সেই বড়ো বড়ো লাল নীল ফড়িং এর মতো লাগছিল। মিনিট খানেকের অস্বস্তি (বিমান তো এত খোলামেলা নয় আর এত নীচু দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উড়তেও দেখিনি ভেতর থেকে!) কাটিয়ে বাকি ছয় মিনিট উপভোগ করলাম উত্তেজনার সাথে। ঠিক সাত মিনিটের মাথায় মাটি ছুঁল মেশিন পাখি। এবার সত্যি এলাম কেদারনাথে।

বহু বহুদিনের সাধ ছিল এই স্থানে আসার, এইখানে বসার। কেদারনাথ (উচ্চতা ৩৫৮১ মিটার)। এই মাটিতে পা রাখার আলাদা অনুভূতি নেই, কারণ মেশিন পাখির পেট থেকে বের হয়েই মাথা নীচু করে ছুটতে হচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে। প্রচুর মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফেরার অপেক্ষায়। এখানে বিভিন্ন কোম্পানির মেশিন পাখির আস্তানা। উঠছে পাখি নামছে পাখি, অবিরাম। হেলিপ্যাডের গা লাগোয়া GMVN এর কটেজ গুলি আর ডরমিটরি। আমরা থাকার জায়গা কোথাও আগে থেকে ঠিক করে যাইনি। এখানেও তাই, যদিও একরাত থাকব সেটা আগের থেকেই ঠিক করা ছিল। ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম মন্দিরের দিকে। অনেকেই সাবধান করে দিয়েছিলেন যেন জোর করে কিছু না করি, উচ্চতা বেশি থাকার জন্য অক্সিজেনের স্বল্পতা শ্বাসকষ্টের কারণ ঘটাতে পারে। অক্সিজেন ক্যান, কর্পূর ইত্যাদি নিয়ে যেতেও বলেছিলেন। কর্পূর ছিল সাথে কিন্তু প্রয়োজন হয়নি। ৫০০/৬০০ মিটার মত লম্বা হাঁটা পথ বেশ চওড়া, বাঁধানো। ওপরে উঠছে তবে ধীরে। পথে পিছু নিচ্ছে পিঠ্ঠুরা। তোমাকে পিঠের ঝুড়িতে তুলে পৌঁছে দেবে মন্দিরে। শেষের সিঁড়ি বেয়ে উঠে মুখোমুখি সেই পাহাড়ের পটভূমিতে কেদারনথের মন্দির, সামনে বিস্তীর্ণ বাঁধানো চাতালে বিশ্বাসের ভীড়। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম মাথা গোঁজবার জায়গা খোঁজার তাগিদে। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। হোল টা কি? বছরের এ সময়ে তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা নয়! জানা গেল পতঞ্জলি (রামদেব) থেকে প্রচুর সংখ্যক সাধুসন্ত এসেছেন আজ, তাই এ দুরবস্থা। অনেক ঘুরে চার বিছানার এক ঘর পাওয়া গেল মন্দিরের কাছেই, সাথে টয়লেট যাতে ঢুকতে কষ্ট করতে হয়। বিছানার নীচে নোংরা মালপত্র ঠাসা, এক কোণে ছোট জেনারেটর নোংরা কাপড়ে ঢাকা। স্যাৎস্যাতে, গন্ধ সুখকর নয়। মূল্য ২৬০০ টাকা এক রাত, নেবে তো ফেল কড়ি নইলে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নাও। গীজার আছে কিন্তু চালানো হবে মালিকের সময়মতো;এটা আগে বলা হয়না, উত্তরকাশী, গুপ্তকাশি তেও এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।এরমধ্যে পান্ডা এলেন ঘরে, ভাঙ্গা বাঙলায় প্রশ্ন এল “কোলকাতার কোথায় বাড়ি? ” বললাম “সন্তোষপুর, যাদবপুর” “আমার বাড়িও যাদবপুরে” “কোথায়?” “এইট বির কাছে’ ” ঠিক কোথায় বলুন তো?” “গরফা, কসবা” “এগুলো তো অন্যদিকে!!” সাথে সাথে পেশাদার সাক্ষীর মুরগির সাইজ বলার মত উত্তর এল “এসব জায়গায় আমার শিষ্যরা থাকে!” কথা না বারিয়ে ওনার কার্ড নিয়ে বললাম প্রয়োজন হলে জানাব।কড়ি ফেলে, তেল না মেখে, ব্যাগ গুলো রেখে পরিস্কার হয়ে চললাম কয়েক কদম দূরের মন্দিরে। ভাগ্যিস নিয়েছিলাম ঐ ঘর, নইলে বিপদ ছিল। প্রচুর মানুষকে পাগলের মত ঘুরতে দেখেছি সন্ধ্যাবেলায়। যার মধ্যে এ আই এম এস থেকে আসা ১৪ জনের হবু ডাক্তার মেয়েদের দলও শামিল। দুটো ঘরেই ১৪ জন থাকতে রাজি। সামনে দর্শনার্থীদের অল্প লম্বা লাইন। দাঁড়িয়ে গেলাম। বিকেল তিনটেয় মন্দির বন্ধ হবে। আবার সন্ধ্যা ছটায় আরতি। সুশৃঙ্খল ভাবে এগোতে থাকা লাইন ধরে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম মূল দ্বারে। ভিতরে ঢুকেই ছোটো হলের মাঝখানে দড়ি দিয়ে ঘেরা নন্দীর ধাতব মূর্তি, তার কানে কানে অনেকেই (বিশেষত মহিলারা) ফিসফিস করে মনের ইচ্ছে জানাচ্ছেন। যেন কোনো মন্ত্রীর ব্যাক্তিগত সচিব। পাশের দেওয়ালে মা কুন্তী(স্থানীয় বক্তব্য। উইকিপিডিয়া বলে দ্রৌপদীর) সহ পান্ডবদের পাথুরে মূর্তি। এরপর ছোট্ট করিডোর, গর্ভগৃহে যাওয়া এবং আসার পথ। গর্ভগৃহের ভেতর বেশ ভীড়, তবে মোটামুটি শৃঙ্খলা বজায় আছে। তিনকোণা কালো পাথরের ওপর ঘি মাখাচ্ছেন যারা বিশ্বাসী। শিব ঠাকুর নাকি পান্ডবদের চোখ এড়াতে ষাঁড়ের রূপ নিয়েছিলেন। পান্ডবরা চিনে ফেলায় তিনি মাটির ভেতর ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এক পান্ডব ল্যাজ টেনে ধরে রাখায় কুঁজ রয়ে যায় মাটির ওপর। আর এক গল্প বলে ভীম তার গদা দিয়ে ষাঁড়ের গায়ে আঘাত করেছিলেন, পরে সত্য জেনে অনুতপ্ত ভীম তাঁর গায়ে ঘি মালিশ করে দেন। সেই থেকে পরম্পরা ঘি মাখানোর। মানো না মানো তোমার ব্যাপার। মন্দির থেকে বের হয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের ব্যবস্থা করতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রায় মারামারি করে খাওয়ার জোগাড় হলো। আরও বেশি মারামারি করতে হল পয়সা দিতে। মালিকের সময় নেই, মনে নেই কে খেয়েছে বা কি খেয়েছে। তুমি যা বলবে তাই জুড়ে দেবে। এরপর ঘোরাঘুরি চারপাশে। মন্দিরের পেছনে সেই পাথর যা কিনা ২০১৩ র প্লাবন থেকে, অবিশ্বাস্য হলেও, রক্ষা করেছিল মূল মন্দিরকে। নামকরণ হয়েছে, ভীমশীলা। পাথর থেকে ধীরে ধীরে উন্নিত হবে দেবতার মর্যাদায়। বিশ্বাসের সিঁদুর, সিক্কা লেগে আছে ভীমশিলায়। বিশ্ব-জোড়া-জাল ঘেঁটে কেদারনাথ মন্দিরের একটা ছবি পেয়েছিলাম, ১৮৮০ সালের। দিলাম সাথে জুড়ে।

এদিক সেদিক ঘুরে, দোকানপাট দেখে কাটল সময় আরও কিছু। এক দোকানে চারজনে চা/কফি খেলাম, তারপর বাকিরা গেল ঘরে কিছু কাজ সারতে। আমি রইলাম দোকানীর সাথে গল্পে মেতে এবং কিছুক্ষণ বাদে পয়সা না দিয়েই চলে এলাম। যখন খেয়াল হলো তখন ফিরে গিয়ে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে পয়সা দিতে গিয়ে শুনলাম “কৌই বাত নেহি মহারাজ, হো যাতা হ্যায়।” পয়সা দিয়ে ফিরে এসে বসে রইলাম মন্দির সামনে বেঞ্চে। ঠান্ডা ক্রমশ বাড়ছিল। কালো কফির তেষ্টা আবার টেনে নিয়ে গেল সেই দোকানে। ঢুকতেই দোকানী বললেন “মহারাজ, আপ পহেলেকা পয়সা নেহি দিয়া!” আমি হতবাক, বলে কি? আমতা আমতা করে বললাম আধঘণ্টা আগেই তো দিয়ে গেলাম! তিনি মানবেন না। অবস্থা আয়ত্বের বাইরে যাওয়ার আগেই আগমন ঘটল দোকানীর যমজ ভাই এর! অবস্থা বুঝে ক্ষমা চেয়ে নিলেন ভুল বোঝাবুঝির জন্য। আমিও অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম দুই ভাইয়ের প্রায় একরকম মুখের দিকে। ধীরে ধীরে একটা লাইন তৈরি হচ্ছিল মন্দিরের প্রধান দরজার সামনে থেকে। জানা গেল সন্ধ্যারতি দেখার জন্য এ লাইন। সঙ্গীরা তৎক্ষণাৎ লাইনে। আমি সামনের চত্বরের কতিপয় ধাতব বেঞ্চের একটিতে নিজেকে নিয়ে বসলাম। ঠান্ডা বেড়েই চলেছে। মেঘ খেলছে পূণ্যার্থীদের সাথে। কখনও উঠে আসছে নীচের সিঁড়ি বেয়ে, চলে যাচ্ছে মন্দিরের পেছনে পাহাড়ের বুকে। আবার নামছে, ঢাকছে প্রাঙ্গন,খেয়ালী বসত করছে অস্থায়ী।
কে যেন লিখেছিলেন “মরে যেতে ইচ্ছে করে এমন এক জ্যোৎস্নার” কথা? হুমায়ুন আহমেদ কি? মনে নেই। এক পরাবাস্তব সময়ে বসে ইচ্ছে করছিল বেঁচে থাকার, অনেক দিন, অনেক অনেক দিন,শুধু এই সময়টাকে নিয়ে। ঘন মেঘের মাঝে বিশ্বাসী অবয়ব। অতিপ্রাকৃত মনে হয় নি একবারের জন্যও। হঠাৎ করে মেঘের পর্দার আড়াল সরিয়ে সামনে আবির্ভূত হলেন এক ভদ্রলোক। “কাঁহা সে মহারাজ?” “কোলকাতা।” শুরু হলো কথা, বেশিরভাগটাই একতরফা, শ্রোতা আমি: বাইশ বছর ধরে এই মন্দিরের সাথে যুক্ত আছেন। কেদারনাথ না ডাকলে কেউ আসতে পারে না এখানে। বিশ্বাস হয় না? তাহলে সেবার বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠ হেলিকপ্টার কেন তিনবারের চেষ্টাতেও দেশের রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে আসতে পারল না মহারাজ? তা হবে, তা হবে, হয়তো ওনার কথাই ঠিক। বিশ্বাসী মন নিজের মতো ঠিক করেছে দিক। মন্দিরের বাঁদিকে যে শীর্ণ ধারা দেখছেন মহারাজ সেটা মন্দাকিনীর, আর ডানদিকে সরস্বতীর। একটু সামনে গিয়ে সরস্বতী মিশেছে মন্দাকিনীর স্রোতে। আগে সরস্বতীর অস্তিত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে, কিন্তু ২০১৩ এর প্লাবনের পর থেকে নিজের রূপ দেখাচ্ছে সরস্বতী, এমনটাই জানালেন তিনি যিনি ২০১৩ তে আশ্রয় নিয়েছিলেন মন্দিরে, না কেদারনাথ আশ্রয় দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। “আচ্ছা মহারাজ, নমস্কার”, যেমন এসেছিলেন তেমনই হঠাৎ করেই বিদায় নিলেন তিনি। আর দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে মন্দিরের লাইন বাড়তে বাড়তে কখন যেন আমার সামনে চলে এসেছে। তার থেকে আচমকা প্রশ্ন এল আমার দিকে “বলছি, মানে, আভি পূজা করনে দেতা হ্যায়?” আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেল “আমার চাইতেও বাজে হিন্দি বলিস”। রাগ করেনি বৈদ্যবাটির মিষ্টি বউটি। একমুখ হাসি নিয়ে বলেছিল ” বাব্বা, বাঁচলাম। আর হিন্দি বলতে পারছি না! ” অথচ আমি কিন্তু প্রায় সবখানেই প্রচুর বাঙালি পেয়েছি! সে যাই হোক, ঘটনা হলো, এ সময়ে “পূজা করনে তো দেতা হ্যায়, তবে অনেক টাকা লাগতা হ্যায়।” হ্যাঁ, পাঁচ হাজারী, দশ হাজারী পূজো দেওয়া যায় গর্ভগৃহে বসে। লাইনের লোকেরা গর্ভগৃহের বাইরে থেকে দর্শন করতে পারবে। সকাল ছটা থেকে বিকেল তিনটে অবধি যে কেউ যেতে পারে গর্ভগৃহের ভেতর অবাধে,পূজো করতে পারে,বিগ্রহ ছুঁতে পারে। সন্ধ্যার আশীর্বাদ কিন্তু টাকা দিয়ে কিনতে হবে। এমত জ্ঞানদান করে উঠে গেলাম অন্য পাশের অন্য দোকানে। চা, কফি, পকোড়া, সিগারেট পাওয়া যায়। আলাপ হলো বাগুইহাটি থেকে আসা বছর তিরিশের অমিতের সাথে। অমিত মিত্র। বাংলায় এম.এ করেছে, বাংলা পড়ায়। আর ফাঁক খুঁজে বেরিয়ে যায় পাহাড়ে। দুদিন হলো এসেছে। গতকাল গিয়েছিল কেদারনাথ থেকে ছয় কিলোমিটার ওপরে এক জায়গায়, হেঁটে। কি কারণে যেন কবিতার কথা উঠল। কিছুক্ষণ বাদে কফির কাপ ফেলে বের হওয়ার সময় মুখে চলে এল বুকের ভেতর ঘরে রাখা, বহুবার আওড়ানো, একটি লাইন “আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি”। শুনতে পেলাম পেছন থেকে গলা মিলিয়েছে অমিত।
বন্ধ দোকানের বাইরে আসতেই শরীরের ভেতর অবধি কেঁপে উঠল। দোকানপাট বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গেছে।আরও কিছুক্ষণ মন্দির চত্বরে থেকে ঘরে ঢুকতে বাধ্য হলাম, অসহনীয় ঠান্ডা। রাত আটটা নাগাদ এ্যাকুওয়েদার জানাল তাপমান শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াস! নটার মধ্যে গরম ভাত, ডাল, আলুর তরকারি গলাধঃকরণ করে লেপের ভেতর। শরীর, বিছানা কিছুই গরম হতে চায় না ঘুম আসবে কোত্থেকে? ১১টা অবধি জেগে থেকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো রাত আড়াইটে নাগাদ। পাশের ঘরের যাত্রীদের গরম জল, চা ইত্যাদি চাওয়া এবং পাওয়ার আওয়াজে। সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে প্রাতঃকৃত্য সেড়ে এক কাপ গরম চা-চিনি-দুধের ঝোল খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্যে। বার বার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম কেদারনাথ কে, তাঁর পাহাড়, তাঁর মন্দির, তাঁর ভক্তবৃন্দ সবাই কে। অসহ্য সুন্দর।ভোর পাঁচটাতেই দোকান খোলা, মন্দিরের সামনে ছোট্ট লাইন। তাড়াতাড়ি যাওয়ায় প্রথম ফ্লাইটেই জায়গা পেলাম তিনজন। অন্যজন পরের ফ্লাইটে। সাধ মিটল বটে তবে আশ মিটল না। কত সময় পেলে আশ মিটবে জানা নেই। ব্রহ্মার এক অহোরাত, এক কল্প, ৪৩২ কোটি বছর?

“তোমার সাথে গল্প করার সময় ছিল অল্প
হাতের মুঠোয় জোনাক আলোর পরিসরও স্বল্প।
চেয়েছিলাম এক অহোরাত, ব্রহ্মা দিলেন কল্প
তোমার সাথে গল্প করার সময় তবুও অল্প।”

Leave a Reply

error: Content is protected !!