বিয়েবাড়িতে সেদিন কী হয়েছিল? – অতনু দত্ত

0

বিয়েবাড়ি… শুনলেই মনের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে না? সানাই, রজনীগন্ধা, আলো ঝলমলে উৎসব প্রাঙ্গণ, বেনারসী আর গয়নার চমক, পারফিউমের মাদকতা, সুখাদ্যের ছড়াছড়ি, তার সাথে একটা রোমান্টিক পরিবেশ। বর কনের তো বটেই সাথে হয়ত আরো কিছু হৃদয়ের অনায়াস হাত বদল। কি মিষ্টি। ভাবতেও ভালো লাগে।

তবে সব বিয়েবাড়ি কিন্তু এরকম হয় না বা হত না আগে। কিছু থাকে একটু হটকে। আজ তেমনই এক বিয়েবাড়ির গল্প শোনাই তাহলে।

1987 র কথা। এক বন্ধুর বৌভাত। বন্ধুর বাড়ি আমাদের শহর থেকে বেশ দূরে, দু ঘন্টা বাসে। একদম অজ পাড়া গাঁ। চারিদিকে ধান ক্ষেত। একখানা সটান চলে যাওয়া বাস রাস্তা, তার দুপাশে গজিয়ে ওঠা গ্রাম। যেমনটা হয় আর কি।

বৌভাতে আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু গেলেও বিয়েতে আমরা দুজন মাত্র ছিলাম। বেশ ভালোই কেটেছিল বিয়েটা। মেয়ের বাড়িতে ছেলের প্রবাসী রোজগেরে বন্ধুরা একটু বেশি পাত্তা পাবে সেটাই স্বভাবিক। পেয়েওছিলাম। অনেক হৈ হুল্লোড় হয়েছিল। ওখানে বাজি ধরে কে কাকে কোলে তুলে নিয়েছিল, কে কার মুখে বোঁদে মাখিয়েছিলো, সে সব কথা আজ নয় থাক।

বৌভাতের দিন সকালের বাসে আমরা সবাই সেই গ্রামে পৌঁছলাম। ছেলের বাড়িতে খুব হৈ চৈ। শুরুতে আমাদের কানে একটু যেন বেশিই লাগছিলো। তবে খানিক বাদে বুঝলাম ওদের বাড়ির বিশেষত্ব। ওখানে সবাই একটু উচ্চগ্রামে কথা বলতে ভালোবাসে। হয়ত, ভালোবেসে ডাকছে, “বাপু ভাত খেয়ে যাও” শুনে মনে হবে এই বুঝি তেড়ে মারতে আসছে। নির্দোষ পারিবারিক আলোচনা চলছে হয়ত, শুনলে মনে হবে এই লাঠালাঠি হল বুঝি। ব্যাপারটা মাথায় ঢোকার পর বুঝেছিলাম লোকগুলো কিন্তু নিতান্তই সহজ সরল মনের। এই সব আমাদের বন্ধুই (একটু তোতলা, আটকে গেলে নিজের পায়ে থাপ্পড় মারতো, আর কথা বেরিয়ে আসতো সুরুৎ করে ) সিগারেট টানতে টানতে ইনস্টলমেন্টে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল।

কেলো হল বিকেলে। ছেলের দাদা এসে বলল, “ভাই সকল, তোমাদের বন্ধুর বিয়ে, লোক খাওয়ানোর দায়িত্ব টা তোমরাই বুঝে নাও।”

আমরা বিপদের গন্ধ পেলাম। অনেক বোঝালাম আমরা খাওয়াবো কি করে, কাউকে তো চিনি না। কাকে কেমন খাওয়াব, কাকে কি দেব… আপনারাই বরং ওটা সামলান। আমরা আছি তো…

কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। বলে “ভাই তোমরাই সামলাও। আমরা আছি তো। চিন্তা কি… “

অগত্যা, কি আর করা যায়। কোমরে গামছা বেঁধে লাগতে হল। সবাই মিলে রান্নার জায়গায় গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। বিশাল পরিমান ভাত ডাল তরকারি আর প্রচুর লাল নীল বোঁদে। জিগ্যেস করলাম, কত জন?

বলল, জন আবার কি? পুরো গ্রাম…
আচ্ছা, ভালো কথা, মিষ্টি কিন্তু ওই বোঁদেই। আর কিছু নেই। বোঁদে তে আবার যত রকমের রং তত ভালো।

সে যাই হোক। আমাদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট, ঘোষদা, জিজ্ঞেস করল, “সে তো বুঝলাম। মাংস হচ্ছে শুনলাম ওটা কোথায়?”

বলল, “ওই পিছন দিকে”। আমরা বললাম “ঘোষদা তুমি যাও গিয়ে দেখে এসো। আমরা একটু দম নিয়ে নিই। সামনে অনেক খাটুনি।”

ঘোষদা গেল। আমরাও একটু ফুঁকে টুকে এসে দেখি ঘোষদা হন্তদন্ত হয়ে আসছে। মুখ চোখের অবস্থা ভালো না। জিজ্ঞেস করায় বলল, সব্বনাস হয়েছে। আজ বোধ হয় আমাদের কপালে পাবলিক ধোলাই আছে।

ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম “কেন কী হয়েছে?”

ঘোষদা বলল, যা শুনছি প্রায় হাজার খানেক লোক খাবে। কিন্তু মাংস মনে হল এক দেড়শো লোকেরই আছে। জানিস তো, এসব দিকে খাওয়া ঠিক মনের মত না হলে কিন্তু মুখে কিছু বলে না, যা বলার হাতে বলে।

বন্ধুরা শুনে টুনে আমাকে বলল , “হ্যাঁ রে এখন কোন বাস নেই? পালাবো…”

শুকনো মুখে বললাম লাস্ট বাস দেড় ঘন্টা আগে চলে গেছে।

যাই হোক। মোটামুটি বুঝে গেলাম ফেঁসে গেছি। উদ্ধার পেতে হবে। ওখানকার লোকেদের কথা তো আগেই বলেছি, কিছু বলতেই ভয় লাগে। মাংস কম কেন জিজ্ঞেস করা আরো মুশকিল। প্রেস্টিজে লাগতে পারে।

শেষে বন্ধুকেই গিয়ে ধরলাম। সবার দু প্রস্থ খিস্তি খেয়ে ও পুরো ব্যাপারটা বুঝল। তারপর হেসে বলল “ধুর… এরকম হবে না। এক্সপার্ট লোক সব ঠিক করেছে। ছোটকাকা।”

ঘোষদা রেগে আগুন। বললে, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, দেড়শ থেকে খুব জোর হলে দুশ। বাকি?
ডাকা হল কাকাকে। কাকা আবার তখন অলরেডি চড়িয়ে নিয়েছেন। কথা জড়ানো। আমাদের কথা শুনে হেসেই বাঁচেন না। বললেন, “চল ওখানে চল সব বুঝিয়ে বলছি।”

গেলাম। আর উনি বুঝিয়ে দিলেন সব জলের মত করে।

বললেন, দেখ এদিকের লোকেরা খাটে বেশি খায়ও বেশি। তোমাদের শহরের লোকের মত পাখির আহার নয়। আর না বলতেও জানে না। পেটে জায়গা থাকলে, তুমি যতবার দেবে ওরা ততবার নেবে। কাজেই ডাল ভাত তরকারি ঘুরিয়ে যাও ঘুরিয়ে যাও ঘুরিয়ে যাও, যতক্ষণ না মানা করতে শুরু করে। যখন করবে তখন একজন মাংস নিয়ে যাবে। আর মোটামুটি একরাউন্ড দিয়েই হাওয়া হয়ে যাবে। ঝোলের কোন অভাব নেই ঝোলটা ঘোরাবে। যদি কেউ মাংস মাংস করে, মিছি মিছি হাঁক ডাক করবে মাংস আন মাংস আন করে। আর তারপর টুক করে বোঁদে চালিয়ে দেবে। তাহলেই সবাই ভুলে যাবে মাংসের কথা।

শুনে আমাদের তো স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। ঘোষদা তাও মানে না। বলে “তবু হবে কি? মাংস এত কম…”

কাকা একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখটান মেরে বললেন, তারও উপায় করা আছে। মাংস দেবে হাতে করে, আর মাংস নেবে ওই যে রাখা আছে সরু গলা মাটির কলসি টাইপের হাঁড়ি ওটায়। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মাংস মুঠো করে ধরে বার করার সময় দেখবে যত টুকু বেরোনোর ততটুকু বেরোবে, দু পিস। বেশি হলে হাতই বেরোবে না।

সত্যি বলছি ওই করে উতরে গিয়েছিল সেদিন। খারাপ লাগছিল খুব। কিন্তু উপায় কী।

Leave a Reply

error: Content is protected !!