স্বপ্নসম্ভব – অতনু দত্ত
“মেরে স্বপ্নো কি রানী কব আয়ে গীতু”
( জানি লাইনটা ভুল। তবে এভাবেই গাইতাম ছোটবেলায় আর অপরাধ বোধে ভুগতাম। কারণ নামটা আবার পাড়ার এক দশাসই দিদির।)
আজ কেন জানি না হঠাৎ গানটার কথা মনে পড়ে গেল স্বপ্ন নিয়ে কিছু লিখব ভাবতেই। তারপর কোত্থেকে শুরু করব তাই নিয়ে ধন্ধ। স্বপ্নের গল্প তো একটা নয়, অনেক। তার মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য, মৃত্যুর পরে বাবার সাথে স্বপ্নে গল্প করা এবং এমন কিছু শোনা যা আমার পক্ষে আদৌ জানা সভব ছিল না সে সময়। খানিকটা একই ধরণের ঘটেছিল মেজ পিসীমাকে নিয়ে। এছাড়াও বেশ কিছু এলোমেলো অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, যা মনে রয়ে গেছে।
স্বপ্ন তো চিরকাল দেখি। আমি কেন সবাই দেখে। প্রতিদিন দেখে, ঘুমোলেই দেখে। অল্প কিছু মনে থাকে, বাকিগুলো থাকে না। এদিকে কালাম সাহেব নাকি বলে গেছেন স্বপ্ন জেগে দেখতে হয়। আমার বয়সীদের জন্য একটু দেরি করেই বলেছেন। তবে সময়ে কেউ বললেও কোন কাজ হত কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ‘আমি’ মালটাকে আমি তো চিনি। মহা ফাঁকিবাজ এবং ল্যাদখোর স্বভাবের। কাজেই বেঁচে থাক আমার মধ্যবিত্ত রাতের টক ঝাল মিষ্টি স্বপ্ন। সকালে উঠে ঘুমঘুম চোখে জাবর কাটতে যা লাগে না। সে জন্যই তো কবি বলেছেন, “স্বপন যদি মধুর এমন…” ইত্যাদি প্রভৃতি।
সে যাকগে, স্বপ্নের কথা বলি। একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি, আমার স্বপ্ন গুলোয় বেশ ধারাবাহিকতা থাকে। তার মানে এই নয় আমি প্রতিরাতে ইনস্টলমেন্টে বাংলা সিরিয়ালের মত স্বপ্ন দেখি। ধারাবাহিকতা মানে, এক ঘন্টার স্বপ্নে এক জায়গা থেকে শুরু করে একটা লাইন ধরে স্বপ্ন এগোয়। মাঝে কোন সূত্র থাকে। উল্টোপাল্টা বিটকেল কিছু হয় না তা বলছি না, তবে হলেও মেইন থিম থেকে সরে যায় না।যেমন হয়ত স্বপ্ন দেখলাম ছুটি থেকে ফিরছি কর্মস্থলে। তার জন্য কেনা কাটা চলছে, কিনতে গিয়ে সেখানে নানান কান্ড হচ্ছে, মাঝে মাঝে অল্প অফ ট্র্যাক হলেও চটপট ফিরে আসছে থিমে। হয়ত টিফিন বাক্স কিনতে গিয়ে হোল্ড-অল কিনে ফেললাম। মা বকা দিল, দাম বেশি নিয়েছে বলে, রাস্তায় বন্ধুর সাথে দু চারটে এলোমেলো সিনের পরেই হয়ত সুটকেস গুছিয়ে মনে পড়ল চাবি হারিয়ে ফেলেছি অথবা ট্রেনের টিকিট হারিয়ে ফেলেছি অথবা টিকিট কাটাই হয় নি, হলেও রিজার্ভেশন করতে ভুলে গেছি। তারপর খেয়াল হয় আমার ছুটি তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। কাজে জয়েন করার ডেট পেরিয়ে বসে আছি। স্বপ্ন যাই হোক থিম কিন্তু একই সাথে একটা যে কোন ধরণের দুশ্চিন্তার চাপ।
মজার ব্যাপার হল, আমার স্বপ্নেও আমি কিন্তু পুরোনো সময়েই থাকি। সমসাময়িক স্বপ্ন প্রায় দেখি না বললেই চলে। কিংবা দেখলেও মনে থাকে না হয়তো। স্বপ্নে আশেপাশের চরিত্রগুলো এবং তাদের চেহারাও তখনকার। অন্য টাইম জোনের দুয়েকজন কখনো সখনো গেটক্র্যাশ করে ঢোকে না তা নয়, তবে খুবই কম।
আমার স্বপ্নে মা খুব বেশি থাকে। কোন না কোন ভাবে ঠিক ঢুকে পড়ে। বাবা দিদা দাদুও… তবে মায়ের মত রেগুলার না। বর্তমানের চরিত্ররাও থাকে। আমার বয়স কিন্তু মোটামুটি একই থাকে সব স্বপ্নে। সেই কবে থেকে দেখছি বাড়েই না।
স্বপ্নে ট্রেন দেখি খুব। নানান রকম ট্রেন, কী সব বিটকেল স্টেশন থেকে ছাড়ে। খালি মাঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভুলভাল লোক ওঠে। কালো কোট টিটি থাকে। ভালো টিটি, খারাপ টিটি। মাঝে মাঝে কামরা গুলো ঘরের মত হয়ে যায়। চেয়ার টেবিল। পড়ার বই।
আর নানা কারণে ট্রেনের স্বপ্নে মাঝে মাঝেই আমি চেইন টানতে যাই। কিন্তু চেইন ধরে ঝুলে পড়লেও ট্রেন দাঁড়ায় না। সে কি অসহায় অবস্থা। হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে টিকিট কাউন্টারগুলোর মধ্যিখান দিয়ে হাত দিয়ে ঠেলে লোকের ভিড় সরিয়ে ট্রেন যায় মাঝে মাঝে। কেউ জানে? আমি নিজের চোখে দেখেছি, স্বপ্নে।
ভয়ের স্বপ্নও খুব দেখি আমি। ভয়ের স্বপ্নের কয়েকটা সিরিজ আছে আমার। সেগুলোই ঘুরে ফিরে আসে। তার মধ্যে ফেভারিট হল চোরের স্বপ্ন। অন্ধকার ঘরে কি করে যেন চোর ঢুকে আসে। চোর আমাকে দেখতে পায় না। আমি কিন্তু সব পরিস্কার দেখি। শুধু চোরটার মুখ দেখতে পাই না। আমি বেশ তক্কে তক্কে থাকি, কাছে আসলেই ধরে ফেলবো। চোর ধীরে ধীরে আমার দিকে এগোয়। যখন খুব কাছে আসে, তখন আমি ধরতে গিয়েও ধরতে পারি না। চোর আমাকে দেখে ফেলে, আমি ভয় পেয়ে চেঁচাতে যাই। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না আর ঘুম ভেঙে যায়।
আসল কাহিনী এটাই থাকে। স্থান কাল পরিবেশ বদলায় মাঝে মাঝে।
একবার এই চোরের স্বপ্ন দেখেই… বলব? ধুর, বলেই ফেলি।
তখন ব্যাঙ্গালোরে সবে এসেছি। মা বাবা কিছুদিন পরে বেড়াতে এসেছেন। ভাড়াবাড়ি, রাতে আমি একা হলে(সেটা নামেই হল ছিল, আসলে এক চিলতে জায়গা, বসে আড্ডা মারার মত) একা বিছানায় ঘুমিয়েছি। রাতে স্বপ্ন চালু।
আমি জানি আমি ওখানে শুয়ে আছি। ঘর অন্ধকার। কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি এক হতচ্ছাড়া চোর পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার খুব রাগ হচ্ছে স্বপ্নে। আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না অভদ্রটা, এত বড় সাহস!! চোর ইতিমধ্যে এগোতে এগোতে আমার পায়ের নাগালে এসে গেছে। ব্যাস, আমিও শরীরে যত জোর আছে লাগিয়ে লাথি মেরেছি চোরকে।
ব্যাস, প্রচন্ড যন্ত্রনায় লাফিয়ে উঠলাম। লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দু টুকরো। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। আর দেয়ালে বেশ ভালোমত নখের দাগ। সে যে কি জ্বালা। যন্ত্রনায় ঘুমোতে পারছি না। কাউকে ডেকে বলতেও পারছি না। কি বলব? স্বপ্নে চোরকে লাথি মেরে নখ ভেঙেছি? (অবশ্য খানিক বাদে যন্ত্রনায় বলতে বাধ্য হয়েছিলাম।)
তবে ভয়ের স্বপ্নে আমার ফেভারিট হল হঠাৎ ভূতের স্বপ্ন। ওগুলোয় বেশ স্মুদলি স্বপ্ন চলতে থাকে। আসে পাশে চেনা জানা মানুষের মুখ। বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ করে কি ভাবে যেন, সামনের কোন একজনের দৃষ্টিটা বদলে যায়। আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে। কাছে আসতেই আমি লক্ষ্য করি মুখটায় পরিবর্তন আসছে। হনুগুলো জেগে ওঠে। চোখের মনির রং বদলায়। মুখের আকৃতি চেন্জ হতে হতে দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে। তখনই খেয়াল হয়, শরীরটাও আর মানুষের শরীর নেই। ততক্ষণে আবার সে আমার খুব কাছে। আমি চেঁচাই। আওয়াজ বেরোয় না। খালি হাওয়া বেরোয়। প্রানপনে চেষ্টা করতে একটা গোঙানির মত শব্দ বেরোয়। ভূত ততক্ষণে আমার মুখের কাছে চলে আসে। নখ বার করা শিরে ওঠা দুটো হাত আমার গলার দিকে এগিয়ে আসে। তারপরেই খুব জোরে ঝাঁকুনি লাগে।
বউ ধাক্কা দিতে দিতে ধমকায়। “এই বুকের থেকে হাত নামিয়ে শোও বলছি। কতবার বলেছি এভাবে শোবে না। এত্ত জ্বালায় না। রাতে শান্তিতে একটু ঘুমোতেও দেবে না। নাও, পাশ ফিরে শোও…”