চারধাম যাত্রা : পর্ব ৭ – সৌম্যেন কুন্ডা

0

প্রতীক্ষা কি দরজাতে
ভেতর ঘরে রয় না?
সজনে ডালে হলদে পাখি
বউ কথা কউ কয় না।
প্রতীক্ষা কি পথের বাঁকে
ঘরের আলো সয় না?
পানকৌড়ি ডুব সাঁতারে
মুখ তুলে সে চায় না।
প্রতীক্ষা কি ডাগর আঁখি
উথলে পড়া কান্না?
অশেষ দুপুর ঘুঘুর ডাকে
বাতাস কেন বয় না!!

এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যার আগেই রূদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে যেতাম, কিন্তু সব চাওয়া তো পাওয়া যায় না।ফিরতি পথে কথা ছিল পাঁচ প্রয়াগ দেখার। বদ্রীনাথে একবার, জোশিমঠে একবার টায়ার পাংচার, নুতন টায়ার কেনা, লাগানো এসবে প্রায় দুঘন্টা গেল। তারপর রাস্তায় ধ্বস নামায় গেল আরও ঘন্টা খানেক। জোশিমঠের আগে বিষ্ণুপ্রয়াগ, এখানে ধৌলী গঙ্গা মিশছে অলকানন্দার সাথে। দেখা হলো। রাত হয়ে যাওয়ার ফলে নন্দপ্রয়াগ (নন্দাকিনী আর অলকানন্দার মিলন স্থল) আর কর্ণপ্রয়াগ (পিন্ডারি মিলছে অলকানন্দার সাথে) দাঁড়িয়ে দেখা হলো না। রূদ্রপ্রয়াগে পৌঁছালাম রাত নটায়। শহর প্রায় ঘুমে। যে দু একটি হোটেলের রিশেপশনে লোক আছে সেখানে ঠাঁই নেই অথবা অস্বাভাবিক ভাড়া এক রাতের হিসেবে। সারথীর পরামর্শ মেনে এগিয়ে চললাম এই শর্তে যে কাল সকালে সঙ্গম স্থল দেখিয়ে দেবে। রাস্তার পাশের প্রথম হোটেলের ম্যানেজারের সময় নেই কথা বলার, তিনি রেস্টুরেন্ট সামলাতে ব্যস্ত। অন্য একজনকে দায়িত্ব দিলেন কামরা দেখানোর। তিনিও আসছি বলে উধাও! কি করব ভাবছি,এমন সময় খেতে বসা এক ড্রাইভার ভাই এগিয়ে এসে বললেন “এদের ভরসায় থাকলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এক কিলোমিটার এগিয়ে যান। বাঁহাতে সাংগ্রিলা রেসর্ট পাবেন। আমি দেখে এসেছি একটি চার বিছানার কামরা খালি আছে। তাড়াতাড়ি যান।” ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চললাম। রিসেপশনিস্ট প্রাণচঞ্চল যুবক কামরা দেখালেন। দরদাম হলো। শেষে উভয়পক্ষই খুশি। সুন্দর ঘর। বেশ বড়ো। পরিস্কার ঘর, বিছানা, টয়লেট, গরম জল। সামনে বিরাট বারান্দায় চেয়ার পাতা। পাশের ঘরে দুই বিদেশী দম্পতি। হ্যালো, হাই, হাসিতেই শেষ হলো ক্লান্ত পর্যটকদের আলাপ। ইংরেজি ভাষা ভাষী নন। গরম খাওয়ার খেয়ে এক ঘুমে রাত কাবার। ভোরবেলায় দরজা খুলতেই হেসে ওঠল পাহাড় জুড়ে এক সুন্দর দিন। হোটেলের উল্টোদিকে রাস্তার পাশে ছোট্টো দোকানে কফি খেয়ে দিন শুরু। তৈরী হয়ে বিল মেটাতে গিয়ে দেখি আগের রাতের জল, কফি হিসেবে ধরেইনি! সেই নিয়ে হাসি ঠাট্টায় বিদায় নিয়ে উল্টোদিকে চললাম প্রয়াগ দেখতে। খুব সুন্দর। এখানে মন্দাকিনী নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিচ্ছে অলোকানন্দায়। জলখাবার খাওয়া হলো শ্রীনগরে। অবশ্যই আলু পরোটা। দেখলাম জলখাবারে ফুচকাও খাচ্ছে লোকে এখানে। একটু মোটা চামড়ার ফুচকা। কি যেন নাম বলেছিল এখন আর মনে পড়ছে না। ফিরে যাওয়া মনকেমনের রাস্তা ধরে একসময়ে পৌঁছে গেলাম দেবপ্রয়াগ (উচ্চতা ৪৭২মিটার)। ভাগিরথী আর অলকানন্দা মিলে গিয়ে স্রোতের নাম এখান থেকে গঙ্গা, গঙ্গাজী। একটু দেরী হলো, লছমন ঝুলায় প্রায় অপরাহ্নিক ভোজন। ঋষিকেশ পেড়িয়ে এলাম হরিদ্বারে (উচ্চতা ৩১৪ মিটার)। রাত্রিবাস এখানেই। হোটেল ঠিক করে তৈরী হয়ে বের হতে একটু দেরী হলো। হর কি পৌরীর আরতি দেখা হলো না। হর কি পৌরী যাওয়ার রাস্তার দুপাশে জমজমাট দোকানপাট। মনে হলো গরিয়াহাটের চৈত্র সেল চলছে। আর হর কি পৌরী? হাওড়া হাট। কত দাদা-বউদির হোটেল! একটি বোধহয় মাসীমাও ছিল। ত্রিশ বছর পুরনো স্মৃতি রোমন্থন, উঠে এল ঠান্ডা কুঁয়া, পদ্মাসনে বসা মিঠাইওয়ালা, কুলফিওয়ালা। এক এক করে খুঁজে বের করলাম। মথুরাওয়ালে মিঠাই এর দোকান, এখনও একইভাবে বসেন বিক্রেতা। দোকান বড় হয়েছে, পশার বেড়েছে। কুলফির দোকানে এখন ফালুদা, লস্যিও বিক্রি হচ্ছে। কোনো এক দাদা বউদির দোকানে রাতের খাওয়ার সেরে হোটেলে ফিরে ঘুম। সকালে উঠতে হবে, গোছগাছ সেরে দিল্লি (উচ্চতা ২২৭মিটার) চলো। রাতের বিমান ধরে ফিরতে হবে যে শহরে বসত আমার (উচ্চতা ৯.১৪ মিটার)। মাঝরাতে পৌঁছাব ঘরে। তালা বন্ধ ঘর। প্রতীক্ষায় কিছু আসবাব।

কেদারনাথ যাব, এ ইচ্ছে বহুদিন ধরে পুষছিলাম। যেতে যেতে ২০১৯ এর অক্টোবর হয়ে গিয়েছিল। এর বোধহয় মাস ছয়েক আগে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ছিল সকাল বেলায়। স্বপ্ন ছিল কিছুটা এমন : আমি কেদারনাথ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে বসে আছি, একদম সোজাসুজি না একটু পাশের দিকে বসে। খুব ঠান্ডা। আমার দৃষ্টি মন্দিরের দিকে আর আমার দুচোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জলের ধারা বয়ে চলেছে, কিন্তু স্বপ্ন বলছে আমি কাঁদছি না। ঘুম থেকে উঠেই জানালাম ছায়াসঙ্গিনীকে। এরপর সময় গেছে। আরও অনেকের সাথে এই স্বপ্নটাকেও ঠেলে দিয়েছিলাম মনের পেছন ঘরে। একদিন শুরু হলো চারধাম যাত্রা। যমুনোত্রী,গঙ্গোত্রী দর্শন করে গুপ্তকাশী, ফাটা হয়ে পৌঁছে গেলাম কেদারনাথ। পৌঁছে একবার মন্দিরের ভেতর ঘোরা হয়ে গিয়েছিল তাই বিকেলে আমি আর বাকিদের সাথে দর্শনের লাইনে না দাঁড়িয়ে কিছু জরুরি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, যেমন এদিক ওদিক ঘোরা, কফি, সিগারেট, মানুষের সাথে কথা বলা ইত্যাদি। কিছুক্ষণ বাদে এসে দেখি লাইন বেশ লম্বা হয়ে গেছে। সাথীদের বলে এলাম যে আমি একটি ফাঁকা বেঞ্চ খুঁজে বসতে যাচ্ছি। পেয়েও গেলাম একটি। বলে আসার কারণ আমার ছায়াসঙ্গিনী। ওর একটা নিজস্ব ভয় আছে, হারিয়ে ফেলার। অল্প ভীড়েও ওর উদভ্রান্ত চেহারা দেখতে পাওয়া যায়, খুঁজছে ছেলেরা কোথায় গেল বা আমি। লাইন আমার সামনে দিয়েই ঘুরে যাওয়ার ফলে অনেকের সাথেই টুকটাক কথা হচ্ছিল। এরই মাঝে লাইনের ফাঁক দিয়ে দেখলাম সেই চিরপরিচিত উদভ্রান্ত ছোটখাটো চেহারা। এখানে তো ছেলেরা আসেনি তাই বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আমিই হারিয়ে গেছি। অতএব উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে ডেকে আবার বসে পড়ে তার অপেক্ষা। আমি তাকিয়েই আছি, ও এগিয়ে আসছে। লাইনের মাঝ দিয়ে গলে এদিকে আসতেই হঠাৎ আমার ভেতর থেকে কান্না উঠে এল,অকারণ। কিছু তো হারাই নি! তবুও অসম্ভব ফাঁকা লাগছিল বুকের ভেতর। কোনও ক্ষমতা ছিল না সে স্রোত আটকানোর।লাইনের সব লোক হাঁ করে দেখছে সাদা চুল দাড়ি ভর্তি একটা মাথা বুকে জড়িয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করছেন এক মহিলা। দেখুক সবাই, মানুষ,পাহাড়,মন্দির, অলোকনন্দা, মন্দাকিনী, মেঘ, ঝর্ণা সবাই। আমাকে ফাঁকা করে, ক্লান্ত করে একসময় থামে জলস্রোত। মন্দিরের দরজা খোলে। পূণ্যার্থীদের লাইন এগোতে থাকে। ফাঁকা হতে থাকে চত্বর। মেঘের চাদর সরে যায়। কেদারনাথের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উপলব্ধি হয়, আমি ঠিক আমার স্বপ্নে দেখা কোণ থেকে তাকিয়ে আছি মন্দিরের দিকে। অবাক হয়ে বসে থাকি। কোন ঐশ্বরিক চিন্তা আসে না। মনের ভেতর শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন “যখন তুমি দাঁড়াও এসে, আন্ধারে রোদ্দুরে ভেসে, হাসির ছ্বটায় ভুলিয়ে দিল ভিতরে কেউ কাঁদছিল। বহুদিনের সাধ ছিল তাই কইতে কথা বাধছিল, দুয়ার খুলে দেখিনি ঐ একটি পরমাদ ছিল।” (কেদারনাথের সেই স্বপ্নের কোণ থেকে তোলা ছবি দিলাম সঙ্গে)

ফেরার পর এক ভাইঝির সাথে কথা হচ্ছিল। ও কয়েক বছর আগে গিয়েছিল। বলছিল “কাকা, যখন ওখানে ছিলাম তখন কেমন যেন সব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করত! “
আমি বললাম :
সব সত্যি কমলিকা,
আধার টা তো বিশ্বাস।
মনগভীরে রাখলে নদী
পাহাড়ও দেয় আশ্বাস
বেঁচে থাকার, ভালোবাসার
বরফ শৃঙ্গে প্রতিভাস।
তোর কোলে তোর ইচ্ছে যেমন
সত্যি করে আবদার
তেমনি ভাবেই সত্যি যদি
মানুষে রয় বিশ্বাস।
সত্যি বোধহয়, কমলিকা,
এক সময়ের নিশ্বাস,
যেমন ছিল কঙ্কাবতীর
মেঘের মতো কেশভার।
সব সত্যি কমলিকা
থাকুন অমর বেদব্যাস,
গনেশ ঠাকুর, ভূর্জপত্রে
ভারতগাথার নির্যাস॥

Leave a Reply

error: Content is protected !!