চারধাম যাত্রা : পর্ব ৬ – সৌম্যেন কুন্ডা

0

বেশ হলো তোর ঘোরা ও বেড়ানো
যদিও একদা ছিলি ঘরকুনো,
এখন বাতাসে নোনা স্বাদ ভাসে
কিউরিও শপে আদিম মুখোশে
ধুলোর প্রলেপ, বিদূষক হাসে,
সম্পর্কের দাম লেখা থাকে
নিরাপত্তার কাগজে,
টুকরো স্বপ্ন পশরা সাজায়
টানাপোড়েনের বাজারে।।

বদ্রীনাথ থেকে চার কিলোমিটার দূরে ভারতের শেষ গ্রাম মানা। যদি না জানা থাকে কোনো অসুবিধা নেই, বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে ঢোকার মুখেই। সরু রাস্তা ওপরে উঠছে পাশে দোকান। উলের জিনিস মূখ্য পণ্য। ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনছেন বঙ্গললনারা। আমার ছায়া সঙ্গিনীও এক বিশেষ পণ্যের দাম জিজ্ঞাসা করতে করতেই চলেছেন। ৮০০ থেকে ১০০০ দাম শোনা গেল বিভিন্ন দোকানে। বেশ খাড়াই, ধীরে ধীরে উঠে এসে পৌঁছলাম গনেশ গুহার কাছে। এখানে বসে গনেশ ঠাকুর লিখেছিলেন ব্যাসদেবের মুখনিঃসৃত মহাকাব্য । বলো তো গনেশ ঠাকুরের একটা দাঁত ভাঙ্গা কেন?আমার কাছে উত্তর ছিল না। শোন তবে, কলম ভেঙে গিয়েছিল তাই দাঁতের অগ্র ভেঙে তাই দিয়ে লিখেছিলেন। কলম একটাই কেন ছিল তার উত্তর পাওয়ার আশা রাখি না বলেই প্রশ্ন করিনি। তার ওপর, বিশ্বাস বড় সুন্দর, যেমন সুন্দর এই নদী পাহাড় লোকগাথা। গনেশ গুহা পৌঁছানোর একটু আগেই ছিল এক তিন মাথার মোড়। সোজা গনেশ এবং ব্যাস গুহা। বাঁদিকে ভীমপুল। বাঁদিকে প্রায় ইউ টার্ণ গ্রামের দিকে। মহিলারা গেলেন জুতো খুলে গুহা দেখতে আর একটু ওপরে। আমরা জুতোর সাথে রইলাম। এখান থেকে চড়াই অনেক বেশি। কিছুদূর গিয়ে দুই সঙ্গী বসে পড়লেন বিশ্রাম নিতে। আমরা দুজন ” চলতি হাওয়ার পন্থী ” হয়ে এগিয়ে চললাম, মাঝে মধ্যে থামতে থামতে। দম একদম শেষ হওয়ার মুখে পৌঁছলাম ব্যাসদেবের গুহার মুখে। যেখানে মহাভারতের কথা বলেছিলেন ব্যাসদেব। বিশ্রাম নিয়ে ঢুকলাম গুহায়। সুন্দর শান্ত একটি আশ্রয়, ব্যাসদেবের মূর্তিও আছে দেবতার আসনে। তরুণ পূজারী সরস ভাবে বর্ণনা করলেন ব্যাসদেবের কথা। ডাক দিয়ে কপালে ফোঁটা দিতে গিয়ে অনুরোধ করলেন মাথার টুপি ৩০ মিলিমিটার ওপরে তুলে নিতে। বললেন মন্দিরের পেছনে গেলে দেখা যাবে পাথরের গায়ে পরিস্কার ভাবে লেখা আছে শ্লোক। আমার অবিশ্বাসী চোখ পাথরের গায়ে ক্ষয় ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। পূজারীর চোখ নেই যে আমার! ওপর থেকে অসাধারণ লাগছিল দৃশ্যপট। এবার নামা। একটু নীচেই আবার দোকান, বিরতি, দুই বাঙালী মহিলার হাতে সেই বিশেষ পণ্য দেখে। ওনারা দেখে নিচ্ছিলেন ছেঁড়া ফাটা আছে কিনা। জানালেন “দুটোই ছিল, আমি আর আমার মেয়ে নিয়ে নিয়েছি, ১৭০০টাকায়।” আর একটু নামতেই নীচের সিঁড়ি থেকে হাত উঠে এল আমার সঙ্গিনীর দিকে “please help”, দক্ষিণ ভারতীয় দিদি হাঁপিয়ে গেছেন উঠতে গিয়ে।আমি কিছু বোঝার আগেই আমার তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ ভার তোলার জন্য,কোন চিন্তা না করেই। প্রায় উল্টে পড়ার উপক্রম দেখে আমি এগিয়ে গিয়ে তার জ্যাকেটের কলার ধরলাম, অবস্থা দেখে পাশ থেকে এগিয়ে এল সাহায্যের তরুণ বলিষ্ঠ হাত। তিনজন মিলে টেনে তোলা হলো দিদিকে। আমাদের দুই সঙ্গীর দেখা নেই। অতএব ভীমপুলে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তা ছেড়ে আবার নামলাম তেমাথার মোড়ে, এখানেও নেই তারা। সঙ্গিনীর ইচ্ছে গাড়ি অবধি গিয়ে খোঁজ করে আসার, আমার ইচ্ছে ভীমপুল হয়ে গাড়িতে ফেরার। তা কখনও সখনও আমার ইচ্ছেও জেতে! সুন্দর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে চললাম ভীমপুলের দিকে। কাহিনী: পান্ডবরা এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন মহাপ্রস্থানের পথে, মাঝে নদী/প্রপাত ধারা পেরোতে ভয় পাচ্ছিলেন দ্রৌপদী। পাঞ্চালির জন্য ভীম এক বিরাট পাথর তুলে বসিয়ে দেন দুই শিলার মাঝে। তার নাম ভীমপুল। যে জলপ্রপাত নেমে আসছে তিনি সরস্বতী নদী, তাঁর আওয়াজে ব্যাসদেবের কাজে বিঘ্ন ঘটায় ঋষির শাপে সরস্বতীর আর কোন অস্তিত্ব থাকে না, মিলিয়ে যায় অলকানন্দার বুকে। সামনের পাহাড়ের গায়ে দুটো ছাপ রয়েছে মানুষের (অতিমানব বললেও কম হবে) পায়ের ছাপের আদলে। ভীমের পায়ের ছাপ! একটি বাচ্ছা মেয়ে তার মাকে জিজ্ঞাসা (খুবই স্বাভাবিক) করছিল “মা, এত বড়ো পা হয় কারও?” মা হাসছেন কিন্তু উত্তর দিচ্ছেন না। ওকে আর বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথায় না জড়িয়ে পাশ থেকে বললাম “সুপারম্যান ছিলেন ভীম “। শিশু মুখের হাসি দেখে মনে হলো উত্তর পছন্দ হয়েছে। গাড়ির দিকে ফেরার পথে দরদাম করে কেনা হলো সেই বিশেষ পণ্য, উলের তৈরি চাদর। দুটো ১৫০০টাকায় রফা হলো, হঠাৎই এক হাত এসে পড়ল চাদরের ওপর, হাতের মালিক তার টুপি-দাড়ি-গোঁফের ভেতর থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন “Have you taken these?” কেন রে বাবা, ভুল করেছি? এবার একটু হাসির মত ফুটল “Good purchase, pure wool.” ফেরার পথে গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সময় ছিল না, আমাদের লক্ষ্য আজকের মধ্যে, সন্ধ্যের মুখে, রূদ্রপ্রয়াগে পৌঁছান। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল রওনা হব হরিদ্বার, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারলে কিছু সময় কাটানো যাবে হরিদ্বারে। গাড়িতে ফিরে দেখলাম, যেমন ভেবেছিলাম, সঙ্গী দুজন বসে আছে। একজনের শরীর অসুস্থ লাগছিল তাই আর না এগিয়ে পিছিয়ে এসেছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় খবর দিতে পারে নি। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যার আগেই রূদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে যেতাম, কিন্তু সব চাওয়া তো পাওয়া যায় না।বদ্রীনাথে একবার, জোশিমঠে একবার টায়ার পাংচার, নুতন টায়ার কেনা, লাগানো এসবে প্রায় দুঘন্টা গেল। তারপর রাস্তায় ধ্বস নামায় গেল আরও ঘন্টা খানেক।

Leave a Reply

error: Content is protected !!