চারধাম যাত্রা : পর্ব ৫ – সৌম্যেন কুন্ডা

0

দূরের থেকে আসছে ভেসে
মনভোলান বাঁশি,
হাত বাড়ালেই যায়না ছোঁয়া
হৃদয় পরবাসী।‌

চোপতার সকাল। বড় মনোরম। নরম ঝকঝকে আলো, মেঘলেপা পাহাড়চূড়া শান্ত সমাহিত। এসবের থেকে চোখ আর মন সরাতে সময় লাগে। আমাদেরও লাগলো। তারপর চা, কফি,পঞ্চাশ টাকা বালতির গরম জল, গরম আলু পরোটা, হিসেব চোকানো, গাড়িতে ওঠার আগে ছবি তোলা ইত্যাদি সেরে রওনা হলাম বদ্রীনাথ, বদ্রী বিশাল। খাওয়ার টেবিলে আলাপ হলো হাওড়া থেকে আসা বাবা-মা আর দুই স্কুল পড়ুয়া মেয়ের সাথে।মেয়েদের ডাক নাম হানি আর এ্যানি। জানতে চাইলাম এদের নাম কি মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা? উত্তরে মা চুপ, বাবা এগিয়ে এলেন “না না, ওর ডাকনাম পুঁটি।” মায়ের মুখ দেখে মনে হলো ভদ্রলোকের কপালে দুঃখ নাচছে। বাবা মায়ের যাওয়ার ইচ্ছে তুঙ্গনাথ, কিন্তু হানি-অ্যানি যাবে না। কারণ? হরিদ্বারে ওদের বাবাকে অকারণে থাপ্পড় মেরেছিল এক হনুমান। লেগেছিল বাবার,ভয় পেয়েছে ওরা। তাই গাড়ির সুরক্ষার বাইরে বের হবে না তারা। রাস্তায় দেখা হলে যে পুঁটিকে ডাকনাম ধরেই ডাকব একথা জানিয়ে ভদ্রলোকের বিপদ বাড়িয়ে বিদায় নিলাম। উপরি পাওনা হিসেবে পেলাম সবুজ দেখা সরাইখানার মালিকের বিদায় কালীন উষ্ণ আলিঙ্গন। চোপতার উচ্চতা ২৬৮০ মিটার, বদ্রীনাথ ৩৩০০মিটারে অবস্থিত। মন্ডল অবধি কুড়ি কিলোমিটার মতো রাস্তা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। সারথী জানাল এখানে চিতা, ভালুক ইত্যাদি প্রায়শই দেখা যায়। আমাদের সাথে অবশ্য তারা দেখা করতে আসেননি। সারথীর কাছে আরও জানা গেল যে এই জঙ্গলে কস্তুরী পাওয়া যায় যা কোনো এক বিশেষ গাছের গায়ে থাকে। কস্তুরীর গন্ধ অনেক দূর অবধি যায় এবং অনেক দিন অবধি থাকে। কোথায় পাওয়া যাবে তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় নি। মন্ডল, গোপেশ্বর (বেশ বড়ো শহর), চামোলি, পিপলকোটি হয়ে হেলং। এখান থেকে বেশ খানিকটা চড়াই। আরও ১৩ কিলোমিটার গিয়ে জোশিমঠ। উখিমঠের মতোই স্বপ্নভঙ্গ জোশিমঠে। তা হোক, তবুও তো আমি জোশিমঠে! যেখানে বদ্রীনাথ অধিষ্ঠান করেন শীতকালে। আদি শঙ্করাচার্যের পীঠস্থান। বিশাল মন্দির রয়েছে নৃসিংহ অবতারের। কথিত আছে এখানে প্রহ্লাদ নৃসিংহ রূপী নারায়ণের তপস্যা করে তুষ্ট করেন যাতে তিনি তাঁর সৌম্যরূপে ফিরে আসেন। মন্দির রক্ষক তরুণ জানালেন এমনটাই। বিষ্ণুপ্রয়াগ পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম পান্ডুকেশ্বরে খাওয়ার জন্য। ঘুরে দেখার সময় ছিল না কোথায় পান্ডু থাকতেন কুন্তী ও মাদ্রীর সাথে, কোথায় বনবাস চলাকালীন পান্ডবরা তাঁদের পিতৃদেবের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন। লোকগাথায় ভরে আছে এই দেবভূমি। তবে পান্ডুকেশ্বরে ভাত যেন জীবন্ত, মনে হয় মুখের ভেতর লাফাচ্ছে রাবারের পুঁতির মতো! আধপেটা খেয়েই উঠতে হয়েছিল। রাস্তার রূপ অসাধারণ। রূপসী অলকানন্দা চলছে পাশে পাশে। হঠাৎ এলো বড় বড় বৃষ্টি ফোঁটা দমকা হাওয়ার সাথে। সারথী ঘোষণা করল উপরের আবহাওয়া খারাপ গরম কাপড় ছাড়া গাড়ি থেকে নামা উচিত হবে না। নয়দিন ধরে চলছি আমরা একসাথে অজয়ের সুদক্ষ ড্রাইভিং কখনও অস্বস্তির কারণ ঘটায়নি। বেশ চলছিলাম। সামনে একটি আর্মি লেখা সুইফট অনেক ক্ষণ ধরে আস্তে আস্তে চলছিল রাস্তা না ছেড়ে। হয়তো বিরক্ত হচ্ছিল অজয়, হঠাৎ এক বাঁকের মুখে গতি বাড়িয়ে ওভারটেক করল এবং বাঁক ঘুরতেই দেখি সামনে থেকে বেশ জোরে ধেয়ে আসছে আর একটি গাড়ি। চালকের পাশের আসনে বসে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অসাধারণ দক্ষতায় পাশ কাটাল দুই ড্রাইভার। ধাক্কা লাগলে খাদের পাশেই নীচে বইছে অলকানন্দা, ভাসিয়ে নিত কোনো এক প্রয়াগে। লোকগাথার শেষ নেই। এ রাস্তাতেও আছে এক হনুমান চট্টি। মনে আছে তো সেই গল্প, যেখানে পবন পুত্র বৃদ্ধ হনুমান অনুজ ভীমকে টিজ করছিলেন ল্যাজ সরিয়ে যেতে বলে? এইখানেই ঘটেছিল! আবার বলি, তোমার বিশ্বাস তোমার কাছে, অন্যেরটায় আঘাত কোর না। বদ্রীনাথে যখন পৌঁছলাম পাঁচটা নাগাদ, বৃষ্টি পড়ছে সাথে বেশ ঠান্ডা হাওয়া। GMVN এ জায়গা নেই। সিদ্ধান্ত হলো এর কাছাকাছিই থাকব, কারণ আমার এক প্রিয়জন বলে দিয়েছিলেন যে এখান থেকেই নীলকন্ঠ শৃঙ্গ সবচাইতে ভালো দেখা যায়। সারথী বলল পাশেই ভোলাগিড়ি আশ্রমে চেষ্টা করতে। জায়গা পাওয়া গেল। পরিস্কার দু বিছানার বড় ঘর দোতলায়, গীজার সহ টয়লেট, পরিস্কার বিছানা। তোয়ালে, সাবান তোমার নিজের। খাওয়ার দোকান সামনে,পাশে অনেক। দুই কামরায় মালপত্র রেখে, বৃষ্টি কমলে, সাথীরা চলল দেব দর্শনে। আমি রইলাম ঘরে, যেমন থাকি। বারান্দা থেকে নীলকণ্ঠের একটু ঝলক দেখা যাচ্ছে। সঙ্গীরা মন্দিরে গিয়ে সন্ধ্যারতি দেখে এল মাথাপিছু ৩৭৬ টাকা টিকিট কিনে। সন্ধ্যা বেলায় কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ দুই ধামেই দাম দিয়ে দর্শন পেতে হয় দেখলাম! রাতে বেশ ভালো ঠান্ডা। লাইট ছিল না, জেনারেটর চলল। পাশের রেস্টুরেন্টে ভালো গরম খাওয়ার খেয়ে এসে ঘুম। বেশ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই উঁকি নীলকণ্ঠের দিকে। সুন্দর, খুব সুন্দর। চা খেয়ে অন্যরা তৈরি হওয়ার সময়টুকু আমি আরও কফি, আরও গল্পে কাটালাম দোকানিদের সাথে। তৈরি হয়ে মন্দিরের পথে হাঁটা। প্রচুর দোকান দুপাশে। উষ্ণ কুন্ডের ধোঁয়া নদীর এপার থেকে দেখা যাচ্ছে। লাইন দিয়ে দর্শন। কেউ গান গাইছেন, অনেকে গলা মেলাচ্ছেন, মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে “জয় বদ্রী বিশাল।” তবে এখানে বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত। পাশ দিয়ে লোক ঢুকে যাচ্ছে, বের হওয়ার রাস্তা দিয়েও ঢোকার চেষ্টা করছিল কেউ কেউ। আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকর লেগেছে। যাই হোক পূজো দিয়ে এসে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলাম মানা ভিলেজের উদ্দেশ্যে। বদ্রীনাথ থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতের শেষ গ্রাম মানা। রয়েছে গনেশ গুহা, ব্যাস গুহা, ভীমপুল।

Leave a Reply

error: Content is protected !!