নাচসূত্র
– সোমাদ্রি সাহা
একবিংশ শতকের বাঙালি জন জীবনে নাচের ভিন্নরূপ আমরা এখন দেখতে পাই। অবশ্য অনেক বসন্ত যাবৎ বাঙালির নিজস্ব নৃত্যচর্চার অভ্যাস রয়েছে। বাঙালির লোকনৃত্যের পর্যায় পেরিয়ে রবীন্দ্রনৃত্যের কথা বিশেষভাবে মনে আসে। রবি ঠাকুরই বাঙালির নৃত্যচর্চাকে শিল্পকলা রূপে বিশ্বের ক্যানভাসে আলাদা স্থান করে দিয়েছিলেন। যদিও রবি চেতনার এই দিকটি এতটা সহজতর ছিল না। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা আর বাধাবিঘ্ন পার করেই নাচের এই আঙ্গিককে গৌরবজনক প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন কবি।
বাঙালির নাচের ইতিহাস দেখতে গেলে রবি ঠাকুরের জন্ম সময়ের কথা বিশেষ ভাবে দেখতে হয়। ১৮৬১ সালের ৭ মে তিনি জন্মেছিলেন। সেই সময় থিয়েটার বা যাত্রার নাচ ও বাইজির নাচ সমাজে প্রচলিত ছিল। এই যাত্রার নাচ সম্পর্কে কবি তার ‘ছেলেবেলা’-র পাতায় লিখেছিলেন – “আমাদের বাড়িতে যাত্রাগান হয়েছে মাঝে মাঝে। আমি দেখতে পেয়েছি তার গোড়াকার যোগাড়-যন্তর। বারান্দা জুড়ে বসে গেছে দলবল, চারিদিকে উঠছে তামাকের ধোঁওয়া।… বাইরে চলেছে হাঁকডাক, বাইরে জ্বলছে ঝাড়-লন্ঠন। আমার ঘরে সাড়াশব্দ নেই, পিলসুজের উপর টিমটিম করছে পিতলের প্রদীপ। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে নাচের তাল…”
আসলে যাত্রার নাচ শ্রবণ-বাহিত এক অভিজ্ঞতা। তবে বাইজি নাচ সম্পর্কে কবি তার ‘জাভাযাত্রীর পত্র’-এ লিখেছিলেন “আমাদের নর্তকী বাইজিদের আঁট-পায়জামার উপর অত্যন্ত জবরজঙ্গ কাপড়ের অসৌষ্ঠবতা চিরদিন আমাকে ভারী কুশ্রী লেগেছে। তাদের প্রচুর গয়না ঘাগড়া ওড়না ও অত্যন্ত ভারী দেহ মিলিয়ে প্রথমেই মনে হয় – সাজানো একটা মস্ত বোঝা। তারপরে মাঝে মাঝে বাটা থেকে পান খাওয়া, অনুবর্তীদের সঙ্গে কথা কওয়া, ভুরু ও চোখের নানাপ্রকার ভঙ্গিমা ধিক্কারজনক বলে বোধ হয় – নীতি দিক থেকে নয়, রীতির দিক থেকে।”
আসলে সেই সময়ের বাইজি নাচ যে শিল্পসৌন্দর্য থেকে বহুদূরের ছিল তা রবি ঠাকুর তার বক্তব্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, তাই বোধহয় বাংলাদেশের নাচকে এই প্রেক্ষিতেই তার নিজস্ব কলা সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে উনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের নাচ অনেকটাই বঞ্চিত। ১৩৪০ বঙ্গাব্দে তাই ‘প্রবাসী’-র ভাদ্র সংখ্যায় লিখলেন “একদিন আমাদের দেশের চিত্তে নৃত্যের প্রবাহ ছিল উদ্বেল। সেই উৎসের পথ কালক্রমে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। অবসাদগ্রস্ত দেশে সেই আনন্দের ভাষা আজ স্তব্ধ।… নৃত্যহারা দেশ অনেক সময় একথা ভুলে যায় যে, নৃত্যকলা ভোগের উপকরণমাত্র নয়। মানবসমাজে নৃত্য সেইখানে বেগবান, গতিশীল, সেখানে বিশুদ্ধ, যেখানে মানুষের বীর্য আছে। যে দেশে প্রাণের ঐশ্বর্য অপর্যাপ্ত, নৃত্যে সেখানে শৌর্যের বাণী পাওয়া যায়। শ্রাবণ মেঘে নৃত্যের রূপ তড়িৎ লতায়, তার নিত্যসহচর বজ্রাগ্নি। পৌরুষের দুর্গতি যেখানে ঘটে, সেখানে নৃত্য অন্তর্ধান করে।”
কবির কথাতেই বুঝতে পারি এক সময়ের নৃত্যকলা সমৃদ্ধ দেশ আজ নৃত্যহারা। জাতির প্রাণশক্তি দ্যোতকরূপে নৃত্য এখানে যেন প্রতিভাত হয়েছিল। ১৯২৭ খ্রি. ‘জাভা যাত্রী’-র ১৭ সংখ্যক পত্রেও নাচ সম্পর্কে কবির মনোভাব “একদা ভারতবর্ষ থেকে নটরাজ ওদেশে এসে নৃত্যবর দিয়েছিলেন আর ভারতবাসীর জন্যে কি শুধু তাঁর শ্মশানভস্মই রইল।” তাই আমরা লক্ষ্য করি কবি তার সুদীর্ঘকাল ধরেই নানা চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির নিজস্ব নাচের শিল্পরূপ তৈরি করেন। উৎকর্ষতার নতুন অভিমুখে নৃত্য চেতনাকে প্রকাশ করেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার বিলেত যান ১৮৭৮ সালে ফেরেন ১৮৮০-র মাঝামাঝি সময়। সে সময়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথ ওখানকার নৃত্যসভায় (ball dance) যোগ দিয়েছেন ও নাচও করেছিলেন। এই বল ডান্সের আসরের বর্ণনা আমরা পাই ‘য়ুরোপ প্রবাসী পত্র’-এ। এই গ্রন্থের নৃত্য সংক্রান্ত পত্রগুলি পড়ার পরে বুঝতে পারি তিনি বিচিত্র ধরনের বল নাচের রীতিমত কুশলতা অর্জন করেছিলেন। যদিও সেই নাচে ব্রিটিশদের উচ্চবিত্ত সামাজিকতার অঙ্গ হিসেবেই দেখেন, তাতে শিল্প বা ভাবগত আলাদা কোনও সৌন্দর্য দেখতে পাননি। তবে এই আঙ্গিক তাঁকে ভাবিয়েছিল। আমরা বুঝতেই পারি বাঙালি নৃত্যচর্চার পালাবদলের শুরু সেখান থেকেই।
শান্তিদেব ঘোষ-এর স্মৃতিচারণায় জানতে পারি ১৮৮০ খ্রি. ইংল্যান্ডের থেকে ফিরে এসে “মানময়ী” নাটকের অভিনয়ের সময় কবি ‘আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিবি ঘিরি ঘিরি’ গানটি নিজে লিখে বিলিতি নাচের আঙ্গিকে নাচিয়েছিলেন। প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্য-নির্দেশনা। এই বীজপথেই বাঙালির নিজস্ব রবীন্দ্রনৃত্য জন্মলাভ করে।
পরবর্তীতে দশ বছর পরে ১৮৯০ সালে দ্বিতীয়বার বিলেতে গিয়ে ‘Savoy Theatre’ এ ‘Gondoliess’ নামক অপেরা দেখেন। সেই অপেরার নাচটি তার ভালো লেগেছিল। কবির কথায়, “সে চমৎকার কান্ড। স্বপ্নের মতো বোধ হল, এমন সুন্দর। এমন সুন্দর নাচ! মনে হল যেন আমার চারিদিকে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি হয়ে গেল।”
তারও অনেক পরে ১৯১৬ সালে কবি জাপান ভ্রমণ করেন। এ সময় দেখেছিলেন জাপানি নাচের সৌন্দর্য। তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। “একদিন জাপানি নাচ দেখে এলুম। মনে হল এ যেন দেহভঙ্গির সঙ্গীত। এই সঙ্গীত আমাদের দেশের বীণার আলাপ। অর্থাৎ পদে পদে মীড়। ভঙ্গির বৈচিত্র্যের পরস্পরের মাঝখানে কোনো ফাঁক নেই কিম্বা কোথাও জোড়ের চিহ্ন দেখা যায় না সমস্ত দেহ পুষ্পিত লতার মতো এক সঙ্গে দুলতে দুলতে সৌন্দর্যের পুষ্পবৃষ্টি করছে।” রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন জাপানি নাচ পরিপূর্ণ নাচ। তার প্রধান কারণ তিনি লক্ষ্য করেছিলেন নৃত্যে দেহের লালসার ইশারামাত্র ছিল না। দেহকে ছাপিয়ে সেখানে বড় হয়ে উঠেছিল নৃত্যকলার কলাগত সৌন্দর্য।
আরও একটি দেশের নাচ কবিকে ভাবিয়েছিল, জাভার নাচ। ১৯২৭ খ্রি. কবি জাভা-বালি ভ্রমণ করেন ও সেখানে প্রত্যক্ষ করেন প্রাচ্যদেশীয় নৃত্যকলার চরম আদর্শটি। শুধু নৃত্যই নয়, নৃত্যের উপযোগী শোভন সুন্দর রুচিসম্মত বেশবাস। কবি লক্ষ্য করেছিলেন “নাচের তালে দুটি অল্প বয়সের মেয়ে এসে মেজের উপর পাশাপাশি বসল। বড় সুন্দর ছবি। সাজে সজ্জায় চমৎকার সুছন্দ। সোনায়-খচিত মুকুট মাথায়, গলায় সোনার হারে অর্ধচন্দ্রাকার হাঁসুলি, মণিবন্ধে সোনার সর্পকুন্ডলী বালা, বাহুতে একরকম সোনার বাজুবন্ধ – তাকে এরা বলে কীলকবাহু। কাঁধ ও দুই বাহু অনাবৃত, বুক থেকে কোমর পর্যন্ত সোনায় – সবুজে – মেলানো আট কাঁচুলি, কোমরবন্ধ থেকে দুই ধারার বস্ত্রাঞ্চল কোঁচার মতো সামনে দুলছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত শাড়ির মতোই বস্ত্রবেষ্টনী সুন্দর বর্তিকা শিল্পে বিচিত্র দেখা মাত্রই মনে হয়- অজন্তার ছবিটি। এমনতরো সুপরিচ্ছন্নতার সামঞ্জস্য আমি কখনও দেখিনি।” আমরা জানি বাটিকে উত্তরীয় ও বাহুল্যবর্জিত ছিমছাম দৃষ্টিনন্দন সজ্জা রবীন্দ্রনৃত্যের শিল্পীদের অন্যতম পরিচায়ক। স্বয়ং রবি ঠাকুরের এই নির্দেশের পিছনে জাভার অভিজ্ঞতা কাজ করেছিল।
সেই দিনের সেই দুটি বালির নাচে কবি প্রত্যক্ষ করেন অঙ্গকে অবলম্বন করেই স্থূল অঙ্গ-সীমার অতীত, আঙ্গিকের অতীত নৃত্যের প্রকৃত কলাসৌন্দর্যকে। “আমরা দেখলুম, এই দুটি বালিকার তনুদেহকে সম্পূর্ণ অধিকার করে অশরীরী নাচেরই আবির্ভাব। বাক্যকে অধিকার করেছে কাব্য, বচনকে পেয়ে বসেছে বচনাতীত।” নৃত্যের এই আদর্শটিই কবির কাছে চরম যে নৃত্যে দেহ বা আঙ্গিক কখনো মুখ্য হয়ে উঠবে না, দেহাতীত শিল্প সৌন্দর্যই সেখানে প্রধান ভূমিকা নেবে। আর এই কারণেই সম্ভবত পরবর্তীকালে বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নৃত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “উদয়শঙ্করের নাচের প্রধান গুণ হচ্ছে এই নাচে তার আত্মশক্তি এবং শিক্ষা দুইই মিলেছে। আঙ্গিকের দিক থেকে উৎকর্ষ প্রাপ্তি জিনিসটা ভাবিক দিকে ক্ষুণ্ণ। ওর য়ুরোপীয় নৃত্য-সঙ্গিনী সিম্্কি বাঈজীদের ভাত্ত-বাংলানোর নকল করেছে – সেই ভাও-বাংলানোতে ভাবের গভীরতা নেই – তাতে নারী – অঙ্গের কামনার লহরীলীলা প্রকাশ পায়, কামনা উদ্রেকের মন ভোলানো আর্টের ইতর পন্থা। জাভাতে জাপানে এর লেশমাত্র আভাস পাইনি – ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগলোলুপ চিত্তারিকার থেকে সম্ভূত। যে কল্পনাবৃত্তির উৎকর্ষ থেকে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। উদয়শঙ্করের নাচে এখনও তার অপেক্ষা আছে।”
আমরা বুঝতে পারছি রবি ঠাকুর উদয়শঙ্করের নৃত্যের ভূয়সী প্রশংসা করতে পারছেন না। কারণ তাঁর এখানে নৃত্যের কলা সৌন্দর্যের আঙ্গিক দেহকে অতিক্রম করে অক্ষম। রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করতে পারেননি এই নাচকে। তাই তো রবীন্দ্রনৃত্যে আঙ্গিক বা দেহ নয়, নাচে ভাবকে মুখ্য ভূমিকা দিতে হবে বলে তিনি আঙ্গিকের কাঠামোতে ভাবের ফুল প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছিলেন।
নৃত্য নির্দেশনা
আমরা অনেকেই জানি না রবীন্দ্রনাথ নিজে খুব ভালো নাচতেন। বিলিতি বল নাচের রীতিমত কুশলতা অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনন্যসাধারণ শিল্পবোধ ছিল। সমস্ত কিছু নিয়েই রবি ঠাকুরের নৃত্য নির্দেশনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানেই কবির নৃত্য-পরিবেশনা ও নৃত্য নির্দেশনার পর্ব শুরু হয়। শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছেন যে সে আমলে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি নৃত্যগীত চর্চার কথা কেউ ভাবতেও পারতেন না। কিন্তু রবি ঠাকুর তাঁর বিদ্যালয়ে সংগীত, অভিনয় ও চিত্রকলার চর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিলেন আর – ‘নৃত্যকলাচর্চার সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রথম থেকেই করতে পারেনি বটে, কিন্তু বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে নাটকের অভিনয়কালে গানের সঙ্গে নিজে উৎসাহের সঙ্গে নেচেছেন এবং ছাত্রদের নাটকের গানের সঙ্গে নাচতে উৎসাহিত করেছেন।’ অমিতা সেনের স্মৃতিচারণায় জানা যায় নাটকের গানের সঙ্গে সেই সমস্ত নাচ রবীন্দ্রনাথ নিজে শেখাতেন। কারণ তখন আশ্রমে তিনি ছিলেন একমাত্র নৃত্যগুরু। আমরা বুঝতেই পারছি রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে যে রবীন্দ্রনৃত্য গড়ে উঠেছিল তা নয়, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সেই মূল ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
১৯০৮ সালে পুজোর ছুটির আগে একদল ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মীদের নিয়ে ‘শারোদৎসব’ নাটকটির অভিনয় করান রবীন্দ্রনাথ। সেই অভিনয়েই সম্ভবত প্রথম কবির শিক্ষা ও নির্দেশনায় নাটকের বালকদল ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’ ও ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি’ গান দুটির ছন্দে পা মিলিয়ে মঞ্চ প্রদক্ষিণ করে। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবে ‘রাজা’ নাটকটির অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সীতা দেবী। তিনি বলেছিলেন, “ছেলেদের গানগুলি অতি সুন্দর হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যবর্তী ঠাকুরদারূপী কবিবরের নৃত্য দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলাম। তিনি অতি সুন্দর নৃত্য করিতে পারিতেন।” ১৯১৩-১৪ সালে অভিনীত ‘অচলায়তন’-এ রবীন্দ্রনাথেরই শিক্ষা ও উৎসাহ শোনপাংসুরূপী পিয়ারসন সাহেব (উইলি পিয়ারসন) উদ্দাম নেচে সকলকে মুগ্ধ করে দেন। ১৯১৬ সালে ‘ফাল্গুনী’-তে কবিশেখর ও অন্ধ বাউল এই দুটি ভূমিকাতেই রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব সুন্দর নৃত্য করেন। শান্তিদেব ঘোষের কাছ থেকে জানা যায় এই সময় বিদেশী নাচের আঙ্গিকেই নিজের মতো নতুন নাচ তৈরি করে নাচতেন রবীন্দ্রনাথ। তবে বোঝা যায় নাচে কিছুটা বাউল আঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন। রবি ঠাকুরের একক প্রচেষ্টায় অবজ্ঞার নাচ হয়ে উঠেছে মন মুগ্ধকর এক শিল্পসৃজন। ১৯১৯ সালে সিলেটের মছিমপুরে শিরে মণিপুরি নৃত্য দেখে মুগ্ধ কবি ত্রিপুরাধিরতি বীরেন্দ্রকিশোর দেবমাণিক্যকে আশ্রমের নৃত্যশিক্ষার জন্য একজন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষক পাঠাতে অনুরোধ করে পত্র লিখেছিলেন। এরই ফলে কুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহ শান্তিনিকেতনের প্রথম নৃত্যগুরু রূপে আগরতলা থেকে আশ্রমে আসেন। তরুণ ও বালকেরা ধ্রুপদী নৃত্যকলা মণিপুরির তালিম নিতে শুরু করে। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণের চোখে তা হেয় বস্তু ছিল বলেই ‘শান্তিনিকেতন’ ফাল্গুন সংখ্যায় লেখা হয়েছিল ‘ত্রিপুরাধিপতি মহারাজ বাহাদুরের দরবার হইতে দু’জন কলাবিদ আশ্রমে আসিয়াছেন। আশ্রম বালকেরা তাঁহাদের নিকট হইতে মৃদঙ্গ সহযোগে সাঙ্গীতিক ব্যায়াম শিক্ষা করিতেছে।’ আমরা বুঝতেই পারছি শান্তিনিকেতনেও পুরুষের নাচের অনুশীলনের কথাটি বলা গেল না, যদিও রবি ঠাকুর কয়েক বছরের মধ্যেই মেয়েদের নৃত্যচর্চা শুরু করেছিলেন।
১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘নটির পূজা’ এমন এক ধরনের নাটক যেখানে প্রধান বিষয়বস্তুই হল নৃত্য। সে সময় নন্দলাল বসুর নৃত্যপটিয়সী কন্যা গৌরী দেবী ‘শ্রীমতি’-র ভূমিকায় নৃত্যাভিনয় করলেন ও নতুন পরম্পরাগত বৈপ্লবিক যুগের সূত্রপাত ঘটল। সারা বাংলায় তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল সে সময়। কঠোরভাবে কবি সমালোচিত হন। কবি থামেননি, তাই তো এই পূজানৃত্যের শ্রীমতি প্রবাদে পরিণত হলো ও মেয়েদের নৃত্যচর্চার ও নৃত্যশিল্পের পথ খুলে গেল।
দেখা যায় যে বাংলাদেশে নৃত্যকলাকে সম্মানজনক বিদ্যারূপে প্রতিষ্ঠা করার পিছনে রবীন্দ্রনাথকে দ্বিবিধ কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছিল। একদিকে সমাজের মানসিকতার বদল ঘটানো, রুচিবোধ ফিরিয়ে আনা অন্যদিকে বাঙালির নিজস্ব নৃত্যকলা রবীন্দ্রনৃত্যের আর্দশে তৈরি করা। সমান্তরাল দুটি কাজে কবি এগিয়ে চলেছেন সফলতার সাথেই। নাচ সম্পর্কে সামাজিক দিকটির বড় উদাহরণ নটীর পূজা। অপর পক্ষে রবীন্দ্রনৃত্যের আদর্শ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল যে বিচিত্র নৃত্যাঙ্গিক শেখাটা জরুরী। কারণ তাতে কাঠামোটা তৈরি হয়। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে যখন নাচ হবে তখন সেই কাঠামোর উপরে ভাব অনুযায়ী প্রতিমা গড়ে তুলতে হবে। কবির এই নির্দেশকে শিরোধার্য করেই সেকালের শান্তিনিকেতনে মণিপুরি, কথাকলি, ক্যান্ডি, বার্মার রামপোয়ে, জাভা-বালির নৃত্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেই রবীন্দ্রনৃত্য নির্মাণ চলতে থাকে। শুদু নির্দেশ নয়, আপামর বাঙালির নিজস্ব নাচের প্রয়োগ কেমন হওয়া উচিত তা হাতে ধরে দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রাণের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নবীন-এর মহড়া চলাকালীন একজন শিল্পী রমা মুখার্জী তার অভিজ্ঞতায় জানান “আমার একটা নাচ ছিল মরি হায় চলে যায় বসন্তের দিন গানের সঙ্গে। আমাদের রিহার্স্যাল পুরো দমে চলছে। গুরুদেব নিজে উঠে এসে আমার হাত ধরে দেখিয়ে দিলেন কোন লাইনের সঙ্গে কী ভাবে নাচতে হবে। আমি সসঙ্কোচে নাচছি। বেশি দূরে যাচ্ছি না দেখে তিনি বউঠানকে বললেন ‘বৌমা একটা চক্ (chalk) নিয়ে এসো তো’ বউঠান পুপের ডেস্ক থেকে একটা চক্ নিয়ে এলেন, গুরুদেব বললেন, ‘এইবার এইখানে একটা সেমি সার্কেল করে দাও, রমা ঐখান পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। তারপর নিজে উঠে এসে এক হাত ধরে দেখিয়ে দিলেন কী করে এগিয়ে গিয়ে আমি চলে যায় বসন্তের দিন করব আর মরি হায়’-এর সঙ্গে কীভাবে পিছিয়ে এসে কী করব। ‘পুলকিত আম্রবীথি’ বিশেষ করে মনে পড়ে – পুলকিত কথাটা দ্রুত স্টেপ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে যেন বোঝানো হল, শুধু হাতের মুদ্রায় নয়। ‘পরানে বাজায় বীণা কে গো উদাসীন’ সে যে কী ব্যঞ্জনাময় তাঁর নৃত্যভঙ্গি, বলে বোঝানো যায় না। জানি না আমি কতটা সফল হয়েছিলাম।
গুরুদেবের অনেকখানি সময় নষ্ট হল—আমি খুবই কুন্ঠিত বোধ করছিলাম। কিন্তু গুরুদেবের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বারে বারে নাচটা করিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে তবেই ছাড়লেন।”
উপরের বিবরণ থেকে আমরা বুঝতেই পারছি ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম যুগ থেকে নাটকের জন্য যে নৃত্য-নির্দেশনা রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন তাতে আর কখনো ছেদ পড়েনি। জীবনের শেষ পর্বে হয়তো এভাবে আর হাতে ধরে শেখাতে পারেনি তবু শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনৃত্যের ক্ষেত্রে তখনও তাঁর নির্দেশই ছিল শেষ কথা।
রবীন্দ্রনৃত্যের সফলতম চূড়ান্ত রূপ কবির শেষ বয়সের রচনা নৃত্যনাট্যগুলি – ১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদা, ১৯৩৮ সালে চন্ডালিকা ও ১৯৩৯ সালে শ্যামা। কবি এমন ধরনের অনন্য নৃত্যনাট্য পরিবেশন করলেন যেখানে নাচ হয়ে উঠলো সংলাপের ভাষা। এই নৃত্যনাট্যগুলিতে ভাবকেই মুখ্য প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনমতো বিচিত্র নৃত্যাঙ্গিকের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছিল। সর্বোপরি ছিল রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ। নৃত্যনাট্যগুলি, বিশেষত চিত্রাঙ্গদা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হয় এবং বিপুল সমাদর লাভ করে। এই সময়পর্বে রবীন্দ্রনৃত্য এতোটাই সমৃদ্ধি লাভ করে যে জাপান ও য়ুরোপে রবীন্দ্রনৃত্য প্রদর্শনের প্রস্তাবও ওঠে।
রবীন্দ্রনৃত্য যাতে আরও সমৃদ্ধ হয় তার জন্য শান্তিদেব ঘোষকে কোচিন, শ্রীলঙ্কা, রেঙ্গুন, জাভা-বালি-সুমাত্রা প্রভৃতি জায়গায় পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই বিচিত্র নৃত্যাঙ্গিক শিখে এসে রবীন্দ্রনৃত্যকে সার্থক করে তোলা। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথেরই উদ্যোগে কুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহ, নবকুমার সিংহ, কল্যাণী আম্মা, কেলু নায়ার প্রভৃতি নৃত্যগুরুরা একে একে শান্তিনিকেতনে এসে নৃত্যশিক্ষা দিয়েছিলেন। এছাড়াও উদয়শঙ্কর, গোপীনাথ, রাগিনী দেবী, ডাল্লাখোল প্রভৃতি বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীপা ও বিদেশি কলাবিদরা শান্তিনিকেতনে তাঁদের নৃত্য দেখিয়েছিলেন।
যদিও আজ রবীন্দ্রনৃত্য তার মূল আদর্শ থেকে হয়তো বা কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে তবু কবির নির্দেশিত নৃত্যের আদর্শটি এখন পুনরায় গুরুত্ব সহকারে স্মরণ করার মনে হয় খুবই প্রয়োজন। রবীন্দ্রনৃত্য আসলে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব নৃত্যকলা। বাঙালি শুধু এইটুকুর জন্যই অন্য সমস্ত দিকের মতো রবি ঠাকুরের কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবেন বলে আশা করি।
গ্রন্থঋণ
১। রবীন্দ্র রচনাবলী।
২। শান্তিদেব ঘোষ, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য।
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, খন্ড – ৪ ও ৫।
৪। তদেব।
৫। শান্তিদেব ঘোষ, প্রাগুক্ত।
৬। প্রবাসী, প্রথম খন্ড।
৭। অমিতা সেন, আনন্দ সর্বকাজে।
৮। সীতা দেবী, পুণ্যস্মৃতি।
৯। প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, খন্ড ২, খন্ড ৭
১০। সুকৃতি চক্রবর্তী, নটরাজের নাট্যশালে।
১১। রমা চক্রবর্তী, ভরা থাক স্মৃতিসুধায়।
১২। ইন্টারনেট।