নিকষিত হেম
– দেবদাস মুখোপাধ্যায়
‘…প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন, নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। ৬৩ বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, জেনো কোনো দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালি শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে ওঠা ঢেউ তোলা সাদা চুলের রাশি। …মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনই সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব।’
বিশ্ব কবি সম্পর্কে এই বর্ণনা আর কারো নয়, রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ এক বিদেশিনীর যার জন্ম ১৮৯০ সালে সুদূর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেশ-এ। তিনি আর্জেন্টিনীয় মহিলা কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবিঠাকুর ও ওকাম্পোর মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিলো নয় নয় করে ২৯-৩০ বছরের। শুধুই কি বয়সের ব্যবধান? বয়ঃজেষ্ঠ্য রবিঠাকুর ও তাঁর বান্ধবীর জন্মস্থানের মধ্যেও ব্যবধান হাজার হাজার মাইলের। কোথায় কোলকাতা আর কোথায় বুয়েনস আইরেশ! কোথায় এশিয়া আর কোথায় দক্ষিণ আমেরিকা!তবুও স্থানিক এবং বয়সের দূরত্ব তাঁদের নিষ্কাম প্রেম সুলভ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন বাধা হতে পারেনি।
ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের সমগ্র আলো আঁধারিময় ও দুঃখবিলাসী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এহেন দুই মহাদেশের দুই সাহিত্য সেবীর মধ্যে যে প্লেটনিক ভালোবাসা ও অনুভূতির চোরা টান পরিকল্পিত হয় তার যোগসূত্র ছিল সাহিত্যচর্চা। বরাবরই সাহিত্য মহলে ওকাম্পো-রবিঠাকুর সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর লেখালেখি আলোচনা এবং সাম্প্রতিক কালে চলচ্চিত্র ও (পাবলো সিজার পরিচালিত, ভিক্টর ব্যানার্জি অভিনীত ‘Thinking of Him’) নির্মিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে সশরীরে দেখার পূর্বেই ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের লেখনীর প্রেমে পড়েছিলেন। সালটা ছিল ১৯১৪। নোবেল বিজয়ীর ‘গীতাঞ্জলি’ ফরাসি অনুবাদে পড়ে ওকাম্পো মুগ্ধ হন এবং প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ তাঁর মনের মণিকোঠায় চিরতরে ভাস্বর হয়ে ওঠেন। এরপর ১০ বছরের ব্যবধান। পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণকালে বিশ্বকবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ বাধ্য হন বুয়েন্স আইরেশের প্লাসা হোটেলে যাত্রা বিরতি করে অবস্থান করতে। সালটি ছিল ১৯২৪। এ যেন ওকাম্পোর কাছে শাপে বর!একদিকে কবি অসুস্থ কিন্তু এ সুযোগ একজন রবীন্দ্র অনুরাগীনী হয়ে কি হেলায় হারানো যায়?
অসুস্থ ৬৩-র রবীন্দ্রনাথকে ৩৪শে পা রাখা এক নারী নিজের বাড়ি ‘ভিলা ওকাম্পো’ তে নিয়ে আসেন। এ যেন সেই নারীর কাছে হাতে চাঁদ পাওয়া! আতিথেয়তার দিনগুলিতে রবীন্দ্রনাথও ওকাম্পোর ভক্ত হয়ে পড়েন। কালক্রমে দেখা যায় কবিগুরুর জীবনে এই বিদেশীনির বিশেষ প্রভাব। এই ওকাম্পোর উৎসাহ এবং উদ্দীপনাতেই সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’। নারীদের সম্পর্কে বিশ্ব কবির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে ওকাম্পোকে দেখার পরই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-’এদিকে প্রায় পৃথিবীর সকল দেশেই মেয়েরা আপন ব্যাক্তিগত সংসারে গন্ডি পেরিয়ে আসছে। আধুনিক এশিয়াতেও তার লক্ষণ দেখতে পাই। তার প্রধান কারণ সবত্রই সীমানা ভাঙ্গা যুগ এসে পড়েছে। যে সকল দেশ আপন আপন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক প্রাচীরের মধ্যে একাত্ম বদ্ধ ছিলো তাদের সেই বেড়া আজ আর তাদের তেমন করে ঘিরে রাখতে পারে না, তারা পরস্পর পরস্পরের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।’
অনেক রবীন্দ্র গবেষক মনে করেন’শেষের কবিতা’র লাবণ্য চরিত্রটি আসলে ওকাম্পোর ছায়া। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পো র নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’। তার বিজয়ার আতিথ্যে প্রায় দু’মাস যাবত অবস্থান কালে কবিগুরু ৩০টির মতন কবিতা রচনা করেন। এর প্রমাণও মেলে ১৯২৫ সালে প্রকাশিত ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি ওকাম্পকেই উৎসর্গ করা হয়। বিজয়া ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক চিঠি চালাচালি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে আপ্যায়িত করতে বিজয়াকে নাকি তার দামি হীরার টায়রাটি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় ও শেষবারের মতন উভয়ের দেখা হয় ১৯৩০ সালে প্যারিসে। ওকাম্পোর ব্যবস্থাপনাতেই প্যারিসের বিখ্যাত ‘পিগাল গ্যালারি’তে কবি গুরুর আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনী সম্ভব হয়েছিল। এরপর আর কখনই তাদের দেখা হয়নি তবে পত্রালাপ কখনও বন্ধ হয় নি। একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে লিখেছিলেন—
‘প্রিয় বিজয়া,
সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে চাই তুমি তোমার ভ্রমণ সূচিতে ভারতবর্ষ রাখ একবার, আমার নিজের জায়গা শান্তিনিকেতনে এসে আমাকে দেখে যাও।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিজয়া তখন তার সম্পাদিত ‘সুর’ (Sur) পত্রিকাটি নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। ফলে ফেমিনিস্ট ওকাম্পোকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আর দেখা হয়ে ওঠেনি। হয়তো এই বিদেশীনির না আসা রবীন্দ্রনাথের মনোবীনায় আমৃত্যু বিরহের মতন বেজেছিল।
রবিঠাকুরের জীবনে ওকাম্পো যেমন প্রথম নারী ছিলেন না তেমনই ওকাম্পোর জীবনেও রবীন্দ্রনাথ প্রথম পুরুষ নন। ওকাম্পো গুনী ও সুদর্শন পুরুষের প্রতি বরাবরই আসক্ত ছিলেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে তার প্রণয় ছিল কিন্তু এ সকল বিষয়সমূহ রবীন্দ্রনাথ ও তার বিজয়ার প্লেটনিক প্রনয়াসক্তির ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই রবীন্দ্রনাথের জন্ম সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাদের সম্পর্ক নিয়ে কতো সাহিত্য সভা, বিতর্কসভা সরগরম হয়, কত শত তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ‘ওগো বিদেশিনী’ গানটির মর্মকথাও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কথাই যেন বারংবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।