রবি-বিবেকের সেতুবন্ধন
সোমাদ্রি সাহা
রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দ—দুই কালজয়ী আত্মার জন্ম-সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে এসেছি কিছু কাল পূর্বে। রবি ঠাকুরের মতন জনপ্রিয়তা সেই অর্থে চোখে পড়ছে না! বিবেকানন্দ যে আমাদের সমাজের সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবেন এমনটা আশা করা অবশ্য বাতুলতা; কেননা সন্ন্যাসীর গৈরিক বোধহয় বাঙালির খুব প্রিয় হতে পারেনি কোনোদিনই। রসলীলায় তার আগ্রহ, তাই বাঙালির প্রিয় মন-উতল-করা বাসন্তী বা গাছ-লতার সবুজ কিংবা পলাশ-কৃষ্ণচূড়ার ফাগুয়ার রঙ।
তাই রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আলোচিত বা পরিচিত, বিবিদিষানন্দকে আমরা সেভাবে চিনিই না। জিজ্ঞাসা করলে হয়ত অনেকেই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন–কে বিবিদিষানন্দ? ভানুসিংহকে আমরা চিনি, কিন্তু তেমনভাবে খবর রাখিনি যে, সন্ন্যাস গ্রহণের পর নরেন্দ্রনাথ পূর্বাশ্রমের নাম ত্যাগ করে হয়েছিলেন বিবিদিষানন্দ। পরে সেই নাম রূপান্তরিত হয়ে হয় বিবেকানন্দ।
অবশ্য বিবেকানন্দ তো সত্যিই জীবনের সব স্বপ্ন-আহ্লাদ ছেড়েছুড়ে কৌপীনসর্বস্ব সন্ন্যাস পালন করতে বলেননি আমাদের! কিংবা দুরূহ বেদান্তের চর্চায় কোলকুঁজো হয়ে একনিষ্ঠ বসে থাকতে বলেননি! তিনিও তো রবীন্দ্রনাথের মতোই ডাক দিয়েছিলেন যৌবনকেই। আজ দেড়শো বছর পরের যৌবন রবীন্দ্রনাথে তবু যতটা সাড়া দেয়, বিবেকানন্দে ততটা দেয় না কেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দি অনায়াসে পেরিয়েছেন, কিন্তু বিবেকানন্দ বন্দী হয়ে গেছেন মঠ-মিশনের নিয়ন্ত্রিত শ্রদ্ধার ঘেরাটোপে। একই কালবৃত্তের ও একই স্থানবৃত্তের দুটি মানুষ—যাঁরা ধর্মবোধ ও জীবন সম্পর্কে প্রায় একই কথা উচ্চারণ করলেন আমৃত্যু, কুসংস্কারমুক্তি–বিজ্ঞান ও যুক্তিনিষ্ঠতা—লোকহিত—লোকশিক্ষা–আচারবিহীন ধর্মচেতনা—জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়—মানবমুক্তি—স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে দুজনেই মানুষকে পৌঁছে দিতে চাইলেন একই মানবতার তীর্থে, তাঁরা কেন আজও হয়ে রইলেন দুটি দূরবর্তী মানুষ?
অথচ উভয়ে জীবনের চলার শুরুটা তো প্রায় এক রেখাতেই আঁকা হচ্ছিল! একজনের জীবনের সূর্যোদয় জোড়াসাঁকোয় ১৮৬১ তে, অন্যজনের ১৮৬৩ তে কলকাতার সিমুলিয়ায়। রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সন্তান দ্বিপেন্দ্রনাথের (১৮৬২-১৯২২) সহপাঠী হিসেবে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আনাগোনা ছিল নরেন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও এই সূত্রেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। এই ঘনিষ্ঠতার সূচনা সম্ভবত ১৮৮০ তে রবীন্দ্রনাথের প্রথমবারের বিদেশবাস থেকে ফেরার পরেই। ১৮৮১-র জুলাইতে রাজনারায়ণ বসুর কন্যার বিবাহ সভায় গাইবার জন্যে গান বাঁধলেন রবীন্দ্রনাথ, আর সে গান রবীন্দ্রনাথ ও অন্য সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইলেন নরেন্দ্রনাথ। কালোয়াতি গানের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পী হিসেবে বেশ নামডাকই ছিল নরেন্দ্রর। নিজের সম্পাদিত ‘সংগীত-পদকল্পতরু’ বইটিতে রবীন্দ্রনাথের দশখানা গানও সংকলিত করেছিলেন বিবেকানন্দ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুর কেটে গেল। বিবেকানন্দ ততদিনে ব্রাহ্মসমাজের অভ্যন্তরীণ ঝগড়া ও মতভেদের আবিলতা থেকে সরে গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের উদার সহজ অনাবিল আশ্রয়ে। বিশ্বজয় করে ফেরার পর ১৮৯৭-তে শোভাবাজারে বিবেকানন্দের সংবর্ধনা সভায় সৌজন্যবশত অবশ্য উপস্থিত থাকলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তিনি সেই বিশ্বজয়ের সংবাদে উচ্ছ্বসিত কিনা বোঝা গেল না, কেননা তাঁর কোনো নথি আমাদের হাতে নেই। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯০২-তে ভবানীপুরের শোকসভায় সভাপতিত্ব করলেন রবীন্দ্রনাথ (হয়ত নিবেদিতার একান্ত অনুরোধেই), কিন্তু সেই সভাপতির ভাষণ কোথাও মুদ্রিত হল না। নিবেদিতা ছিলেন এই দুই জ্যোতিষ্কপুরুষের মধ্যে সেতুরচনার এক সচেষ্ট কারিগর। কিন্তু ১৯১১-য় নিবেদিতার প্রয়াণে সেই প্রচেষ্টাও অনারব্ধই থেকে গেল।
রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভায় সত্যিই ছিল সূর্যের দীপ্তি। কিন্তু চলনে-বলনে-আচরণে সত্যিকার পৌরুষের দীপ্তি ছিল বিবেকানন্দের সহজাত। রবীন্দ্রনাথের কবিস্বভাবের নম্রতা বিবেকানন্দের সমর্থন পায়নি। পরোক্ষে তাঁর সেই অসমর্থন শোনা যায় ‘পরিব্রাজক’ বইটিতে – “ঐ যে এক দল দেশে উঠেছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা, নরম নরম বুলি কাটেন, এঁকে বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবধি পিরিতের কবিতা লেখেন, আর বিরহের জ্বালায় ‘হাসান-হোসেন’ করেন।” আর বিবেকানন্দের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অসমর্থনের আভাস পাওয়া যায় রঁলার লেখা রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ সম্পর্কিত গ্রন্থ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের পাঠ-প্রতিক্রিয়ায়। সেই আলোচনা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ চলে আসেন হিন্দু বহুদেববাদের সমালোচনায় এবং তারপরেই কালী-উপাসনার বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণে। রবীন্দ্রনাথের এই কালী বিরোধিতার পিছনে অবশ্য একটা ঘটনা আছে। শৈশবে ঠনঠনের পথে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন বলির বীভৎসতা। এই ধরণের হিংস্র হত্যার উপাসনাকে কোনো তত্ত্ব বা প্রতীকের অজুহাতেই স্বীকার করে নিতে রাজি ছিলেন না তিনি। আলোচনার শেষে রম্যাঁ রঁলা তাঁর দিনপঞ্জিতে লিখেছিলেন – “এটা স্পষ্টই বোঝা গেল, তাঁর চোখের সামনে এই মুহূর্তে আছেন বিবেকানন্দ।”(ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি: ১৯১৫-১৯৪৩, রম্যাঁ রঁলা ; অবন্তীকুমার সান্যাল অনুদিত)।
অথচ পরস্পরের প্রতি তাঁদের নীরব শ্রদ্ধাবোধেরও অভাব ছিল না। না হলে ভারতবর্ষকে জানার আগ্রহে নিবেদিতা ওকাকুরাকে স্বামীজির কাছে নিয়ে গেলে তিনি কেন বলবেন – ‘এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ, রবীন্দ্রনাথের কাছে যাও, তিনি জীবনের মধ্যে আছেন।’ আর সেই পরামর্শে ওকাকুরা নিবেদিতাসহ রবীন্দ্রনাথের কাছে গেলে রবীন্দ্রনাথ জানালেন – ‘ভারতবর্ষকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে দেখুন।’
আমৃত্যু বিবেকানন্দের এত বক্তৃতা, রচনা ও বাণীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সাহিত্য অথবা তাঁর সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় চিন্তার স্বপক্ষে-বিপক্ষে কোনো মন্তব্যই করলেন না বিবেকানন্দ। অন্যদিকে বুদ্ধ, খ্রিস্ট, চৈতন্য থেকে শুরু করে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, এমনকি বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতা সম্পর্কে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করলেন না রবীন্দ্রনাথ ; অরবিন্দ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর মূল্যায়ন বা শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত হলেন না, শুধু ব্যতিক্রম ঘটে গেল বিবেকানন্দের ক্ষেত্রে!
এড়িয়ে গেলেন? এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল? একবার ভেবে দেখুন তো যদি দুজনে ভিন্ন পথের পথিকই হবেন, তাহলে এই কথাগুলি কে শোনালেন আমাদের –”শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মান ভার/ মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।” (গীতাঞ্জলি) ‘মানুষের নারায়ণ’! ১৯১০-এ লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। বিবেকানন্দও তো জীবকেই ঈশ্বর বা নারায়ণ বলে ঘোষণা করেছিলেন! আবার গীতাঞ্জলিতেই যখন শুনি – “তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ/……/কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।” এখানেও তো অনায়াসেই মনে করা যায় বিবেকানন্দের কথা; মানুষের প্রাত্যহিক জীবনপ্রবাহের কর্মযজ্ঞের মধ্যেই তো বিবেকানন্দও ঈশ্বরকে খুঁজেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ধরে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়, যা বিবেকানন্দের উচ্চারণের সঙ্গে প্রায় পাশাপাশি রেখে পড়া যায়। যে প্রবল ঝঞ্ঝার মত মানুষটিকে ‘গোরা’ উপন্যাসে দেখে আমরা বিস্মিত হই তাঁর শক্তি ও যুক্তির সামর্থ্যে, তিনি কে? ব্রহ্মবান্ধব ছাড়া গোরার চরিত্র নির্মাণে যিনি প্রবলভাবে উপস্থিত, তিনি বিবেকানন্দই। গোরা আগ্রাসী, প্রখর ও নির্মম, তার্কিক। সে আগে ছিল ব্রাহ্মসমাজভুক্ত আধুনিক যুক্তিবাদী, কিন্তু পরে সে হিন্দুধর্মের ও হিন্দুসমাজের প্রশ্নহীন উপাসক। ভারতবাসীকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান ও কর্মশক্তিতে আত্মনির্ভর করে তোলার যে সংকল্প গোরার, তা যেমন রবীন্দ্রনাথের, তেমনি বিবেকানন্দেরও মূলমন্ত্র। গোরার রচনাকালে (১৯১০) রবীন্দ্রনাথও তো প্রাচীন ভারত, উপনিষদিক সংস্কৃতির মাহাত্ম্যপ্রচারে অকুণ্ঠ। সেখানেও তো হিন্দুত্বেরই প্রকাশ। কিন্তু তাকে ব্রাহ্মধর্মের বিশ্বাত্মকতা দ্বারা সংকীর্ণতামুক্ত করা হয়েছে শুধু। সেই সংকীর্ণতামুক্ত উদার বিশ্বব্যাপী ব্রহ্মবোধ দিয়েই তাই কি রবীন্দ্রনাথ আঘাত করতে বাধ্য হন গোরাকে তথা বিবেকানন্দকে? রবীন্দ্রনাথের এই ব্রহ্মবোধ যদি সাম্প্রদায়িক না হয়, তাহলে বিবেকানন্দের হিন্দুত্বও তো আসলে তা-ই। বিলেতে গোমাংস গ্রহণের জন্য ভক্তদের কারো কারো সমালোচনার জবাবে তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন – “তোমরা কি বলিতে চাও যে, কেবল শিক্ষিত হিন্দুসমাজে যেসব জাতিভেদবিশ্বাসী কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর, ভণ্ড, নাস্তিক কাপুরুষকে দেখা যায়, আমি তাহাদেরই একজন হইয়া বাঁচিতে ও মরিতে জন্মিয়াছি? … আমি যেমন ভারতের তেমনি সমস্ত পৃথিবীর। কোন্ দেশ আমার ওপর বিশেষভাবে অধিকার দাবি করিতে পারে? কোন্ জাতির গোলাম আমি?” এমনকি যে কালীভক্তিকে হিংস্রতার উপাসনা বলে বাতিল করে দিতে চান রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ কিংবা নিবেদিতার কাছে সেই কালীও তো আসলে কোনো রক্তপিপাসু আগ্রাসী হিংস্রতার প্রতিমা নন, তিনি আসলে ‘মৃত্যুরূপা মাতা’। অন্ধকারের মধ্য থেকে আলোকাধিক আলোককে আবিষ্কারই তো কালীর উপাসনা। রবীন্দ্রনাথও তো ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’-কেই খুঁজলেন আজীবন। তাঁরও তো মন্ত্র – ‘মাভৈঃ’।
তাই বাইরের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দকে যতই দূরবর্তী বলে মনে হোক না কেন, আসলে তাঁদের মনন ও কর্মসাধনা যেন একই রেখায় আঁকা।
বিবেকানন্দের চরিত্রের একটি দিক বিশেষভাবে বিস্মিত করে আমাদের। যিনি শৈশব থেকে যুক্তিবাদী তার্কিক, তিনি কেমন করে অকস্মাৎ প্রশ্নহীন ভক্তির সমুদ্রে অবগাহন করেন? রবীন্দ্রনাথও বিবেকানন্দকে নিয়ে এই কূট প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সেই জন্যই সমর্থন বা বিরোধিতা – উভয়তই তিনি প্রায় নীরব, আপাতভাবে যাকে বিরোধিতা বা ঈর্ষা বলে মনে হতে পারে। গোরা চরিত্রে তাই বিবেকানন্দের চরিত্রকে নিজের বিশ্লেষণ দ্বারা পুনর্নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথ।
এই ব্যাখ্যাহীনতাই আর-একভাবে উপস্থাপিত হয় ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের শচীশ চরিত্রে। জ্যাঠামশাই জগমোহনের প্রখর যুক্তিবাদের বৃত্ত থেকে কখন এবং কিভাবে স্খলিত হয়ে শচীশ ভক্তিবাদে পুণ্যস্নান করতে বসে রবীন্দ্রনাথ তা জানানই না আমাদের। শচীশ হয়ে উঠতে চায় লীলাসঙ্গিনীহীন কঠোর ব্রতধারী। তাই গুহাদৃশ্যের অন্ধকারে ঘটে যায় এক নিগূঢ় নাটক। দামিনীর নারীচিত্তের দান চরম প্রত্যাখ্যান পায় সেই অন্ধকার গুহার নির্জনে, যার ক্ষতচিহ্ন আঁকা থাকে দামিনীর বুকের গভীরে। আশ্চর্য কারুকৌশলে শচীশ-দামিনীর এই সম্পর্কবিন্যাসে রবীন্দ্রনাথ গ্রথিত করে রাখেন বিবেকানন্দ-নিবেদিতাকেই। ভাবতে অবাক লাগছে? দেখে নিতে পারেন ‘Unpublished Notes Of Some Wanderings With The Swami Vivekananda’ নামে প্রকাশিত নিবেদিতার ডায়েরি বা প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণা অনূদিত নিবেদিতার পত্রসংকলন। সেখানে ১৮৯৮-তে অমরনাথের গুহামন্দিরের যে ঘটনার আভাস আছে, পড়লে দেখবেন যেন তারই একটা কল্পিত ছায়ারূপ আঁকা হয়েছে ‘চতুরঙ্গ’-এ রবীন্দ্রনাথের হাতে। উপন্যাসের শেষের দিকে শচীশ আবার গুরুর পথ ছেড়ে একান্ত আত্মগত অন্তর্যামীর নির্দেশকেই অনুসরণ করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শচীশের পথটাও অস্পষ্টই থেকে যায়। শচীশ চরিত্রের মধ্যে বিবেকানন্দের ছায়া এসে পড়লেও রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে গড়া বলে শচীশকে অদ্বৈতসাধনার থেকে দ্বৈতসাধনার দিকেই নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। এই দ্বৈতের সাধনাই রবীন্দ্রনাথের আমৃত্যু সাধনা।
কিন্তু বিবেকানন্দের মধ্যেও কি সত্যিই কোনো স্পষ্ট পথরেখা ছিল? যে বিবেকানন্দ সন্ন্যাসজীবনেও নিজের গর্ভধারিণী মাকে ভুলে যান না, কিন্তু মার্গারেট নোব্ল-এর নারীসত্তাকে প্রত্যাখ্যান করেন, এমনকি নিবেদিতার গুরু বা আচার্য হতেও অস্বীকার করেন তিনি; অথচ সেই বিবেকানন্দই তো শ্বেতশুভ্র মহাকালের মহাশক্তিরূপিনীকেই ভজনা করেন। যিনি কর্মের মধ্যেই ঈশ্বরের আরাধনার মন্ত্র আবিষ্কার করেন, দরিদ্র সাধারণের মধ্যে খুঁজে পান নারায়ণকে, তিনিই কেন আবার নির্জনবাস থেকে ফিরে এসে হিতসাধন, কর্মসাধন প্রচেষ্টাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন –”স্বদেশপ্রেম বা আর সবকিছুই ভ্রান্তিমাত্র। সবই কেবল মা…। আমি আর শিক্ষা দিতে যাব না। অপরকে শিক্ষা দেবার আমি কে?”(১৩ অক্টোবর ১৮৯৮ তারিখে লেখা নিবেদিতার পত্রে উদ্ধৃত) তাহলে কি রবীন্দ্রনাথের শচীশের মতই বিবেকানন্দও তীব্র দোলাচলে ক্ষয় করেছেন নিজেকে? পথ খুঁজতে খুঁজতে তাই মাত্র ঊনচল্লিশেই ফুরিয়ে গেল তাঁর পথ! আর রবীন্দ্রনাথ? আরো ঊনচল্লিশ বছর পথ হেঁটেও কি তিনি পেয়েছিলেন সত্যের ঠিকানা? তাঁর জীবনের ‘শেষ সূর্য’ কি কোনো স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিল তাঁকেও?
কাঁটায় কাঁটায় হয়ত মিলবে না, তবু দুজনেই তো স্বর্গ আর মাটির পৃথিবীর মধ্যে সেতুবন্ধনের একই কাজ করে গেলেন সারা জীবন ধরে। অথচ তাঁদের দুজনের জীবনসাধনার দুটি তীর কেন অসেতুসম্ভবই থেকে গেল আজও? আমরাই বা কেন এই দুটি জীবনসাধনাকে মিলিয়ে জীবনের পাঠ নিলাম না? নাকি এমনটাই আমাদের স্বভাব আর ভবিতব্য! প্রত্যেকেই আমরা মানবকল্যাণের—মানবমুক্তির—জনগণেশের সুস্থ জীবনেরই মন্ত্রজপ করব শুধু, নিজ-নিজ গোষ্ঠীর কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এসে একে-অপরের হাতে হাত রেখে টুকরো-টুকরো তটরেখাগুলোর মধ্যে সাঁকো বাঁধবো না কখনও! এই সার্ধশতবর্ষের অবসরেও যদি এই দুই জীবন-সাধকের সাধনার দুটি তটের মধ্যেকার ভাঙা সেতুটাকে গড়ে নিতে না পারি আমরা, তাহলে কি হবে এইসব আয়োজনে? জীবন চলাচলের সেই ভাঙা সেতুটাকে নতুন করে গড়ে তোলাই তো আজকের প্রধান কাজ।