রবি চিন্তায় বাস্তু-প্রকৃতি
সোমাদ্রি সাহা
ভূমিকা
প্রবন্ধের নামশীর্ষকে প্রবেশের পূর্বে রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার রাশিমালা স্বীকার ও সম্মান করা অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভার বৈচিত্র, ব্যাপকতা ও গভীরতা আমাদের বিস্মিত করে। চারুকলার সর্বস্তরে তাঁর অবাধ ও স্বচ্ছন্দ গতিবিধি। তিনি মূলত কবি হিসাবেই সর্বাধিক পরিচিত। নির্দ্বিধায় বলা চলে তিনি বাঙালীর শ্রেষ্ঠ কবি। আবার তিনি অনন্যসাধারণ সংগীত স্রষ্টা। আবার কখনো তিনি এক অতি উচ্চস্তরের ঔপন্যাসিক। সঙ্কেত মূলক নাটক রচনায় তিনি অদ্বিতীয়। আবার তাঁর গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য নাট্যশিল্পে এক অভিনব সংযোজন। তাঁর ছোট গল্প শ্রেষ্টত্বের দাবী রাখে। আবার তাঁর চিত্রকলা ও ভাষ্কর্য সারা বিশ্বে গুণীজনের চিত্তকে আকৃষ্ট করেছে। তাঁর চিঠিপত্র ও ভ্রমণ কাহিনীও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
রবীন্দ্র প্রতিভা শুধুমাত্র চারুকলার জগতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর অতিমানবিক প্রতিভা বিস্তার লাভ করেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশ সম্পর্কিত চিন্তাধারার জগতেও। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা আলোচনার ক্ষেত্র কবিগুরুর পরিবেশ, নৈতিকতা ও রক্ষণ-সম্ভব উন্নয়ন সম্পর্কিত চিন্তাধারা।
কবিগুরুর সমগ্র সৃষ্টির দিকে দিকপাত করলে একটা বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। তা হল তাঁর সমগ্র চিন্তাধারার ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীভূত মূল সুর রয়েছে, রয়েছে এক অখন্ড জীবনবোধ। তাঁর পরিবেশ ও নৈতিকতা সম্পর্কিত চিন্তার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আবার এটাও লক্ষ্য করা যায় যে তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকেই স্পর্শ করে গেছে নৈতিক ও পরিবেশ সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি। অবশ্য বর্তমান প্রবন্ধের পরিসরের সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে আমরা মূলত তাঁর প্রবন্ধের ক্ষেত্রে (যেখানে বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ ও রক্ষণ-সম্ভব উন্নয়ন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ভাবে আলোচনা করা হয়েছে) আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। তবে একথা বলে নেওয়া অত্যন্ত আবশ্যক যে তাঁর কবিতা, সংগীত, উপন্যাস, ছোট গল্প, নাটক, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য সর্বত্র এই একই জীবন বোধের ইঙ্গিত রয়েছে যদিও এই প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে এই সব ক্ষেত্র সম্বন্ধে আলোচনা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করি তাহলে একটা বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেটা হচ্ছে তাঁর সমগ্র চেতনার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে প্রাচীন ভারতীয় জীবনদর্শন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ গঠনে উপনিষদ এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা নিম্নে কবিগুরুর দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন দিকের আলোচনা প্রসঙ্গে এ বিষয়ের বিশদ ভাবে আলোচনা করব। আমরা প্রথমে কবিগুরুর পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কিত আলোচনার মাধ্যমে তাঁর চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির এই বিশেষ দিকটিকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করব।
রবীন্দ্রনাথের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ সম্পর্কিত চিন্তাধারা
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ সম্পর্কিত যে চিন্তা ধারার প্রকাশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে উপনিষতদিয়া দৃষ্টিভঙ্গি, “বসুধৈব কুটুম্বকম” অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব একই পরিবার ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথের মতে প্রকৃতি ও মানব জীবন একই অখণ্ড সত্তার অঙ্গীভূত। সুতরাং তাঁর পরিবেশ চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানব জীবন ও প্রকৃতি জগতের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থান। তাঁর বিভিন্ন রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টাকে স্পষ্ট করে তোলা যেতে পারে।
তাঁর ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে কবি এই মত প্রকাশ করেছেন যে আধুনিক মানুষ বিলাসবহুল ও প্রদর্শন-মুলক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যতদিন সে অরণ্যের অভ্যন্তর বা উপকণ্ঠে বসবাস করেছে ততদিন তার মধ্যে অরণ্য সম্পর্কে গভীর শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ ছিল। সে ততদিন অরণ্য ও অরণ্যবাসী জীবকুলের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সহবাস করেছে। যে মুহূর্ত থেকে সে নগরবাসী হয়েছে তখন থেকেই সে হারিয়েছে তার জীবন সংরক্ষক অরণ্যের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তার শহুরে বাসস্থান তৈরির উপাদান সংগ্রহের জন্য সে অরণ্য সম্পদকে যথেচ্ছ ভাবে ধ্বংস করে নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। ডেকে এনেছে নির্মম মরুর অভিশাপ। তার অপকর্মের ফলে বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা শুধুমাত্র চাষেরই ক্ষতি করেনি, ভারতের বিভিন্ন অংশে মরুভূমি বিস্তার লাভ করে জনবসতিকে গ্রাস করতেও সহায়তা করেছে। কবিগুরুর মতে তাই এই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় আমাদের অরণ্যের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাকে ফিরিয়ে আনা। কবিগুরুর ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে।
“মানুষ অমিতাচারী। যতদিন সে অরণ্যচর ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে পরিপূর্ণ ছিল তার আদানপ্রদান। ক্রমে সে যখন নগরবাসী হল তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধ সে হারাল; যে তার প্রথম সুহৃদ, দেবতার আতিথ্য যে তাকে প্রথম বহন করে এনে দিয়েছিল, সেই তরুলতাকে নির্মমভাবে নির্বিচারে আক্রমণ করলে ইট কাঠের বাসস্থান তৈরি করবার জন্য। আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিলেন যে শ্যামলা বনলক্ষ্মী তাঁকে অবজ্ঞা করে মানুষ অভিসম্পাত বিস্তার করলে। আজকে ভারতবর্ষের উত্তর-অংশ তরুবিরল হওয়াতে সে অঞ্চলে গ্রীষ্মের উৎপাত অসহ হয়েছে—সে নির্মম ভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আরব মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে। — সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে – আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে, দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া।”১
কবিগুরু তাঁর আলোচনাকে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যে একই সমস্যা মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনছে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। নিম্নের উদ্ধৃতি থেকে সেটা স্পষ্ট হবে।
“এ সমস্যা আজ শুধু এখানে নয়, মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকাতে বড়ো বড়ো বন ধ্বংস করা হয়েছে; তার ফলে এখন বালু উড়িয়ে আসছে ঝড়, কৃষি ক্ষেত্রকে নষ্ট করছে, চাপা দিচ্ছে—
লুব্ধ মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছে; বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে।”১
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতার সূত্রপাত হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বিশেষ করে ১৯৭২ সালের “United Nations Conference on Human Environment”, Stockholm (Sweden) এবং পরবর্তীকালে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেইরোতে ‘Earth Summit’ এর ফলশ্রুতি হিসাবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অরণ্য সম্পদকে বিশেষ গুরুত্ব দান করা হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে যে বহু পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ অরণ্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে সম্যক ভাবে অবহিত ছিলেন এবং তাঁর বিভিন্ন রচনায় অরণ্যের গুরুত্ব ও তা বিনাশের বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছেন। আমরা এ রচনায় শুধুমাত্র তাঁর প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি। কিন্তু তাঁর কাব্য, সংগীত, কথা সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য, নাটক সর্বত্রই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অরণ্যের গুরুত্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি।
প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অরণ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কবিগুরুর দৃষ্টিকোণ আধুনিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ? এর উত্তরে স্পষ্টভাবে বলা চলে যে আপাত দৃষ্টিতে সেটা মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে দুটি দৃষ্টিভঙ্গির উৎস ও মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উৎস পাশ্চাত্য জীবন দর্শন। অপর পক্ষে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রাচীন ভারতীয় ঔপনিষদিক জীবন দর্শন। এই দুই দৃষ্টিকোণের মূল পার্থক্য রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক।
১। “যে বিরাট প্রকৃতির দ্বারা মানুষ পরিবেষ্টিত, যার আলোক এসে তার চক্ষুকে সার্থক করেছে, যার উত্তাপ তার সর্বাঙ্গে প্রাণকে স্পন্দিত করে তুলছে, যার জলে তার অভিষেক, যার অন্নে তার জীবন, যার অভ্রভেদী রহস্য নিকেতনের নানা দ্বার দিয়ে নানা দূত বেরিয়ে এসে শব্দে গন্ধে বর্ণে ভাবে মানুষের চৈতন্যকে নিত্য নিয়ত জাগ্রত করে রেখে দিয়েছে, ভারতবর্ষ সেই প্রকৃতির মধ্যে আপনার ভক্তিবৃত্তিকে সর্বত্র ওতপ্রোত করে প্রসারিত করে রেখে দিয়েছে, জগৎকে ভারতবর্ষ পূজার দ্বারা গ্রহণ করেছে, তাকে কেবলমাত্র উপভোগের দ্বারা খর্ব করেনি, তাকে ঔদাসীন্যের দ্বারা নিজের কর্মক্ষেত্রের বাইরে দূরে সরিয়ে রেখে দেয়নি; এই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে পবিত্র যোগেই ভারতবর্ষ আপনাকে বৃহৎ করে জেনেছে, ভারতবর্ষের তীর্থস্থানগুলি এই কথাই ঘোষণা করছে।”২
২। “শেকস্পীয়রের As You Like It নাটক একটা বনবাস কাহিনী – টেম্পেস্টও তাই, Mid Summer Night’s Dream ও অরণ্যের কাব্য। কিন্তু সে-সকল কাব্যে মানুষের প্রভুত্ব ও প্রবৃত্তির লীলাই একেবারে একান্ত – অরণ্যের সঙ্গে সৌহার্দ্য দেখতে পাইনে। অরণ্য বাসের সঙ্গে মানুষের চিত্তের সামঞ্জস্য সাধন ঘটেনি। হয় তাকে জয় করবার, নয় তাকে ত্যাগ করবার চেষ্টা সর্বদাই রয়েছে; হয় বিরোধ, নয় বিরাগ, নয় ঔদাসীন্য।”২
উপরের প্রথম উদ্ধৃতিটিতে কবি প্রকৃতি সম্পর্কে ভারতীয় দৃষ্টিকোণকে ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় জীবন দর্শন অনুসারে প্রকৃতি মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে সম্পর্কটা ভোগ, প্রভুত্ব কিংবা অবহেলার নয়। সম্পর্কটা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও একাত্বতার।
অপরপক্ষে পাশ্চাত্য জীবন দর্শন অনুসারে মানুষ প্রকৃতির প্রভু এবং প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে মানুষের সম্পর্ক শুধুমাত্র ভোগের। বিভিন্ন বিখ্যাত পাশ্চাত্য সাহিত্যিকের রচনার উল্লেখ করে কবি এই পাশ্চাত্য জীবনদর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। উপরের উদ্ধৃতিতে শেক্সপীয়রের কয়েকটি নাটকের উল্লেখ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে অন্যান্য পাশ্চাত্য সাহিত্যিকের লেখারও উল্লেখ করেছেন। যেমন :
“মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট কাব্যে আদি মানবদম্পতির স্বর্গারণ্যে বাস বিষয়টিই এমন যে সহজেই সেই কাব্যে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলনটি সরল প্রেমের সম্বন্ধে বিরাট ও মধুর হয়ে প্রকাশ পাওয়ার কথা। কবি প্রকৃতি সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন, জীবজন্তুরা সেখানে হিংসা পরিত্যাগ করে একত্রে বাস করছে তাও বলেছেন, কিন্তু মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সাত্ত্বিক সম্বন্ধ নেই। তারা মানুষের ভোগের জন্যেই বিশেষ করে সৃষ্ট, মানুষ তাদের প্রভু। এমন আভাসটি কোথাও পাইনে যে এই আদি দম্পতি প্রেমের আনন্দ-প্রাচুর্যে তরুলতা পশুপক্ষীর সেবা করছেন, ভাবনাকে কল্পনাকে নদী গিরি অরণ্যের সঙ্গে নানা লীলায় সম্মিলিত করে তুলছেন।”
সাম্প্রতিক কালের পরিবেশ সচেতনতার সূত্রপাত মূলত বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। এই পরিবেশ ধারণা যে মূলত পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত তা একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। প্রকৃতপক্ষে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই নির্বিচারে শিল্পায়ন এর ফলে পরিবেশ দূষণের কু-প্রভাব সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। এই বিশ্বব্যাপী সচেতনতার ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে অনুষ্ঠিত হয় মানব-পরিবেশ সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলন। এর পর পরিবেশ রক্ষার জন্য গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যেমনঃ
- Convention on International Trade in Endangered Species (CITES)
- Environmental Protection Agency (EPA)
- United Nations Environment Program (UNEP)
- South Asia Co-operative Environment Program (SACEP)
এর পর ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেইরো শহরে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
বিভিন্ন দেশও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও আইনের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করতে থাকে ও গড়ে তুলতে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ভারতে প্রণীত এ-জাতীয় কয়েকটি আইন হলঃ
- Water (Prevention and control of pollution) Act, 1974
- Air (Prevention and control of pollution) Act, 1981
- Environment (Protection) Act, 1986
- Motor Vehicles Act, 1998
ভারতে এই সব আইনকে বাস্তবায়িত করার জন্য ১৯৮৫ সালে স্থাপন করা হয় “The Department of Environment, Forest and Wild Life” এবং ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, কেন্দ্রস্তরে “The Central Pollution Control Board” ও রাজ্যস্তরে “State Pollution Control Boards।” ভারতে পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য সরকারি ও অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
- Botanical Survey of India
- Zoological Survey of India
- National Wasteland Development Board
- Central Ganga Authority
- Bombay Natural History Society
- Central Forestry Commission
- Department of Non-conventional Energy Sources
- Tata Energy Research Institute
বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও আইনের মূল বিষয় বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সাম্প্রতিক কালের পরিবেশ সচেতনতার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল নিম্নরূপ।
পরিবেশ দূষণ ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হলে মানব জীবন বিপন্ন হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ অপচয় ঘটলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। অরণ্য, জীব বৈচিত্র প্রভৃতি রক্ষা করা আবশ্যক কেননা মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা ও বৈষয়িক অগ্রগতির জন্য এসবের প্রয়োজন। অর্থাৎ সমস্ত বিষয়টাই মানুষের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। এখানে প্রকৃতির সাথে মানুষের সাযুজ্যবোধের কোনো স্থান নেই। সাম্প্রতিক কালের পরিবেশ সচেতনতার মূলে রয়েছে পাশ্চাত্য বিচ্ছিন্ন জীবনদর্শন। রবীন্দ্রনাথের তথা ভারতীয় জীবনদর্শনের এখানে কোন স্থান নেই। এর ফলে পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত ব্যবস্থাগুলি তাৎক্ষনিকভাবে আঞ্চলিক কিছু সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ হলেও সমস্যার সামগ্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। আর এখানেই রয়েছে পরিবেশ চেতনার ক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিক তথা ভারতীয় জীবনদর্শন গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা।
এ প্রসঙ্গে আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করা বিশেষ আবশ্যক। সেটা হল এই যে পাশ্চাত্য জীবনদর্শন ভিত্তিক সাম্প্রতিক কালের পরিবেশ সচেতনতা পরিবেশ দূষণের বাহ্যিক রূপ সম্পর্কেই দিকপাত করেছে। মানব মনের গভীরে যে এই বাহ্যিক দূষণের বীজ নিহিত সে বিষয়টা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ দূষণের এই অভ্যন্তরীন দিকটির প্রতিই সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কবিগুরুর সমগ্র রচনা পাঠ করলে এ বিষয়টা অবহিত হওয়া যায় যে তিনি বাহ্যিক পরিবেশ দূষণের মূল কারণ অনুসন্ধান করেছেন মানুষের মনের গভীরের নিগূঢ় অন্ধকারে যেখানে লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষের অবাধ বিচরণ। এই প্রসঙ্গে কবিগুরু ভোগ-সর্বস্বতা সম্পর্কে ‘সমাজ’ গ্রন্থের ‘বিলাসের ফাঁস’ প্রবন্ধে যে বক্তব্য রেখেছেন তা প্রাণিধানযোগ্যঃ
“এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে, এই জন্য বাহবার স্রোত সেই মুখেই ফিরিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মাহাত্ম ঘোষনা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লইয়া প্রতিযোগিতা। ইহাতে যে কেবল তাহাদেরই চাল বাড়িয়া যাইতেছে তাহা নহে, যাহারা অশক্ত তাহাদেরও বাড়িতেছে। আমাদের দেশে ইহাতে যে কতদূর পর্যন্ত দুঃখ সৃষ্টি করিতেছে, তাহা আলোচনা করিলেই বুঝা যাইবে।”৩
ভোগসর্বস্বতা লোভ এবং ‘কাম’ বা ‘কামনা’ রিপুর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের নির্দেশক। বাহ্য জড়বস্তুকে জীবনের সর্বস্ব মনে করা এবং তার জন্য অন্ধভাবে মানবিক মূল্যবোধকে বিসর্জ্জন দিয়ে ছুটে চলাই বর্তমান যুগের মূল ব্যাধি আর এই মানসিক বিকৃতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাহ্যিক পরিবেশ দূষণের বীজ। মানুষের জীবন যাপন জড়বস্তু ছাড়া সম্ভব নয় একথা মেনে নিয়েও বলতে হয় যে জড়বস্তু সম্পর্কে আকাঙ্খা যখন বাস্তব প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন জড়বস্তু মানুষের প্রভু হয়ে ওঠে এবং এখানেই নিহিত রয়েছে সকল প্রকার বিপর্যয়ের মূল। এই প্রসঙ্গে কবিগুরুর নিম্নের বক্তব্যগুলি বিশেষভাবে পরিধানযোগ্যঃ
১। “সমাজে একবার যদি এই বাহ্য সম্পদকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়া হয় তবে সে এমনই প্রভু হয়ে বসে যে, তার হাত আর সহজে এড়াবার জো থাকে না।”৪
২। “বেগবতী মহানদী নিজে বালুকা সংগ্রহ করে এনে অবশেষে নিজের পথরোধ করে বসে। য়ুরোপীয় সভ্যতাকে সেইরকম প্রবল নদী বলে এক-একবার মনে হয়। তার বেগের বলে, মানুষের পক্ষে যা সামান্য আবশ্যক এমন-সকল বস্তুও চতুর্দিক থেকে আনীত হয়ে রাশীকৃত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সভ্যতার প্রতি বর্ষের আবর্জনা পর্বতাকার হয়ে উঠছে।” ৪
৩। “আর, যদি আমার আশঙ্কা সত্য হয়, তবে য়ুরোপীয় সভ্যতা হয়তো-বা তলে তলে জড়ত্বের এক প্রকাণ্ড মরুভূমি সৃজন করছে; গৃহ, যা মানুষের স্নেহপ্রেমের নিভৃত নিকেতন, কল্যাণের চিরউৎসভূমি, পৃথিবীর আর-সমস্তই লুপ্ত হয়ে গেলেও যেখানে একটুখানি স্থান থাকা মানুষের পক্ষে চরম আবশ্যক, স্তূপাকার বাহ্যবস্তুর দ্বারা সেইখানটা উত্তরোত্তর ভরাট করে ফেলছে, হৃদয়ের জন্মভূমি জড় আবরণে কঠিন হয়ে উঠছে।” ৪
৪। “বোধের তপস্যার বাধা হচ্ছে রিপুর বাধা; প্রবৃত্তি অসংযত হয়ে উঠলে চিত্তের সাম্য থাকেনা, সুতরাং বোধ বিকৃত হয়ে যায়। কামনার জিনিসকে আমরা শ্রেয় দেখি, সে জিনিসটা সত্যই শ্রেয় বলে নয়, আমাদের কামনা আছে বলেই; লোভের জিনিসকে আমরা বড়ো দেখি, সে জিনিসটা সত্যই বড়ো বলে নয়, আমাদের লোভ আছে বলেই।”৫
৫। “যেখানে প্রতিযোগিতার তাড়নায়, পাশের লোককে ছাড়াইয়া উঠিবার অত্যাকাঙ্ক্ষায়, প্রত্যেককে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করিতে হইতেছে, সেখানে কর্তব্যের আদর্শকে বিশুদ্ধ রাখা কঠিন। এবং সেখানে কোনো একটা সীমায় আসিয়া আশাকে সংযত করাও লোকের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়।”৬
এবার আমরা রবীন্দ্রনাথের রক্ষণ-সম্ভব উন্নয়ন সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে বিশদ ভাবে আলোচনা করব।
রবীন্দ্রনাথের রক্ষণ-সম্ভব উন্নয়ন (sustainable development) সম্পর্কিত চিন্তাধারা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের রক্ষণ-সম্ভব উন্নয়ন সম্পর্কিত চিন্তাধারা কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন। এই পুনরুজ্জীবন-এর দুটি প্রধান স্তম্ভ হলঃ
ক) সমবায় এবং
খ) গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা।
এই দুটি ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ জনসাধারনের আত্মশক্তির জাগরণ ও পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্তির মাধ্যমে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং তাদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে যথাযথ শিক্ষার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে যাতে তারা নিজেরাই একজোট হয়ে বাহ্যিক কারো সহায়তা ছাড়াই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ প্রসঙ্গে কবির ‘আত্মশক্তি’ গ্রন্থের ‘স্বাদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ থেকে এবং ‘সমবায় নীতি’ গ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাকঃ
১। “নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করা, চালনা করাই আত্মরক্ষার প্রকৃত উপায়।”৭
২। “আসল কথা, আমাদের দেশে ভরসার অভাব। তাই, যখন আমরা পেটের জ্বালায় মরি তখন কপালের দোষ দিই; বিধাতা কিংবা মানুষ যদি বাহির হইতে দয়া করেন তবেই আমরা রক্ষা পাইব, এই বলিয়া ধূলার উপর আধ-মরা হইয়া পড়িয়া থাকি। আমাদের নিজের হাতে যে কোনো উপায় আছে, এ কথা ভাবিতেও পারি না।”৮
৩। “এইজন্যই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া। — মানুষ খাটো হয় কোথায়। যেখানে সে দশ জনের সঙ্গে ভালো করিয়া মিলিতে পারে না। পরস্পরের মিলিয়া যে মানুষ সেই মানুষই পুরা, একলা মানুষ টুকরা মাত্র।”৮
রবীন্দ্রনাথ গভীর অন্তঃদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন যে সমবায় সমিতি কিংবা গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা (পঞ্চায়েত) যদি সরকার বা বাইরের কোনো অ-সরকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় কিংবা বাইরের কোনো সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাহলে তা উদ্দেশ্য সাধনে বিফল হবে। ভারতে স্বাধীনতা লাভের পূর্বেই কৃষি উৎপাদন ও কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার প্রচলন করা হয় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী কালে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিশেষ প্রসার লাভ করে। কিন্তু এই ব্যবস্থা গুলি গ্রামীণ জনসাধারণের উন্নতি সাধনে বিশেষ ফলপ্রসু হতে পারেনি এবং তার মূল কারণ হল এই ব্যবস্থাগুলি বাইরে থেকে সরকারী প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহুক্ষেত্রেই এই সব ব্যবস্থা কায়েমী স্বার্থ সম্পন্ন ধনী ব্যক্তি এবং অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ সিদ্ধির উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ সমাবায়ের গুরুত্ব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ভারতীয় কৃষির মূল সমস্যাগুলিকে স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ শক্তি দেখে অবাক হতে হয়। ভারতের কৃষির অনগ্রসারতার কারণ হিসাবে কবিগুরু যেসব বিষয়ের উল্লেখ করেছেন সেগুলি হলঃ চাষযোগ্য জমির বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা, বাজার জনিত সমস্যা, শস্য সংরক্ষণের সমস্যা, কৃষি যন্ত্রায়নের সমস্যা, কৃষি ঋণের সমস্যা, মহাজনের শোষণ ইত্যাদি। কবির মতে এ সকল সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় সমবায় ব্যবস্থার প্রবর্তন। এ প্রসঙ্গে কবিগুরুর ‘সমবায় নীতি’ গ্রন্থ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে:
১। “জমির ভাগগুলি সমান নয়, সীমানা আঁকাবাঁকা। এই জমি যখন চাষ চলিতে থাকে তখন প্রথমেই এই কথা মনে হয়, হালের গোরু কোথাও-বা জমির পক্ষে যথেষ্ট, কোথাও-বা যথেষ্টর চেয়ে বেশি, কোথাও-বা তার চেয়ে কম। — যদি প্রত্যেক চাষা কেবল নিজের ছোটো জমিটুকুকে অন্য জমি হইতে সম্পূর্ণ আলাদা করিয়া না দেখিত, যদি সকলের জমি এক করিয়া সকলে একযোগে মিলিয়া চাষ করিত, তবে অনেক হাল কম লাগিত, অনেক বাজে মেহন্নত বাঁচিয়া যাইত।”৯
২। “কলের লাঙল, কলের ফসল-কাটা যন্ত্র থাকিলে সুযোগমাত্রকে অবিলম্বে ও পুরাপুরি আদায় করিয়া লওয়া যায়। দেখিতে দেখিতে চাষ সারা ও ফসল কাটা হইতে থাকে। ইহাতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা অনেক পরিমানে বাঁচে। কিন্তু কল চালাইতে হইলে জমি বেশি এবং অর্থ বেশি চাই।”১০
৩। “আমার কাছে মনে হয়, এই কোঅপারেটিভ-প্রণালীই আমাদের দেশকে দারিদ্র্য হইতে বাঁচাইবার একমাত্র উপায়।”১১
রবীন্দ্রনাথের মতে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির পূণরুজ্জীবনের জন্য সম্পূর্ণ স্বনির্ভর গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা একান্ত আবশ্যক:
“দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজন সাধনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য কতকগুলি পল্লী নিয়ে এক একটি মণ্ডলী স্থাপন করা দরকার, সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের ও অভাবমোচনের ব্যবস্থা করে মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করে তুলতে পারে তবেই স্বায়ত্বশাসন চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হয়ে উঠবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যবস্থাপনার জন্য পল্লীবাসীদের শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হবে। এমনি করে দেশের পল্লীগুলি আত্মনির্ভরশীল ও ব্যূহবদ্ধ হয়ে উঠলেই আমরা রক্ষা পাব। কিভাবে বিশিষ্ট পল্লীসমাজ গড়ে তুলতে হবে, এই হচ্ছে আমাদের প্রধান সমস্যা।”১২
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মূলত এই নীতিকে অনুসরণ করেই ভারতে ‘পঞ্চায়েত’ নামক গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে এবং তা দ্রুত বিস্তার লাভ করে চলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ নির্দেশিত গ্রামীণ জনসাধারণের আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরশীলতা সম্পর্কিত মূল নীতিকেই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সরকারী প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাইরে থেকে গ্রামের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পঞ্চায়েত পরিচালনার জন্য গ্রামীণ জনসাধারণ সম্পূর্ণরূপে সরকারের ও সরকারী সংস্থা সমূহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং পঞ্চায়েতগুলি অসৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের স্বার্থসিদ্ধির উর্বর ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। যার ফলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই বিফল হয়েছে।
রক্ষণ-সম্ভব দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রবীন্দ্রনাথ গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করলেও তিনি আধুনিক শিল্পের উন্নয়ন ও বিদেশ থেকে আধুনিক প্রযুক্তি আমদানির গুরুত্বকে অস্বীকার করেননি। এই প্রসঙ্গে নিম্নের উদ্ধৃতিটি উল্লেখযোগ্য:
“এই কল-জিনিষটা আমাদের ছিল না, সুতরাং ইহা বিদেশ হইতে আনাইতে হইবে এবং কারখানা-ঘরের সমস্ত সাজসরঞ্জাম-আইনকানুন গ্রহণ না করিলে কল চলিবে না।
কথাটা আসংগত নহে। কল পাতিতেই হইবে। এবং কলের নিয়ম যে দেশী হউক না কেন, তাহা মানিয়া না লইলে সমস্তই ব্যর্থ হইবে। একথা সম্পূর্ণ স্বীকার করিয়াও বলিতে হইবে, শুধু কলে ভারতবর্ষ চলিবেনা।”১৩
আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং রক্ষণ-সম্ভব উন্নয়ন সম্পর্কিত চিন্তাধারার তত্ত্বগত গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই ধারণাগুলি কি বর্তমান যুগে বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ সমাজের অগ্রগতি ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য জনসাধারণের আত্মনির্ভরশীলতা ও সমাজ ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের তুলনায় সমাজের বিধান-এর উপরই মানুষ অনেক বেশি নির্ভর করে এসেছে এবং বর্তমান কালেও এই সমাজের উপরই আমাদের সমধিক গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। এই প্রসঙ্গে ‘আত্মশক্তি’ গ্রন্থের ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধের নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিগুলি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকঃ
১। “আমাদের দেশে যুদ্ধবিগ্রহ রাজ্যরক্ষা এবং বিচারকার্য রাজা করিয়াছেন, কিন্তু বিদ্যাদান হইতে জলদান পর্যন্ত সমস্তই সমাজ এমন সহজভাবে সম্পন্ন করিয়াছে যে, এত নব নব শতাব্দীতে এত নব নব রাজার রাজত্ব আমাদের দেশের উপর দিয়া বন্যার মতো বহিয়া গেল, তবু আমাদের ধর্ম নষ্ট করিয়া আমাদিগকে পশুর মতো করিতে পারে নাই, সমাজ নষ্ট করিয়া আমাদিগকে একেবারে লক্ষ্মীছাড়া করিয়া দেয় নাই। রাজায় রাজায় লড়াইয়ের অন্ত নাই – কিন্তু আমাদের মর্মরায়মাণ বেণুকুঞ্জে, আমাদের আমকাঁঠালের বনচ্ছায়ায় দেবায়তন উঠিতেছে, অতিথিশালা স্থাপিত হইতেছে, পুষ্করিণী-খনন চলিতেছে, গুরুমশায় শুভংকরী কষাইতেছেন, টোলে শাস্ত্র-অধ্যাপনা বন্ধ হয় নাই, চণ্ডীমণ্ডপে রামায়ণপাঠ হইতেছে এবং কীর্তনের আরাবে পল্লীর প্রাঙ্গণ মুখরিত। সমাজ বাহিরের সাহায্যের অপেক্ষা রাখে নাই এবং বাহিরের উপদ্রবে শ্রীভ্রষ্ট হয় নাই।”১৪
২। “ইরেজিতে যাহাকে স্টেট বলে, আমাদের দেশে আধুনিক ভাষায় তাহাকে বলে সরকার। এই সরকার প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজশক্তি আকারে ছিল। কিন্তু বিলাতের স্টেটের সঙ্গে আমাদের রাজশক্তির প্রভেদ আছে। বিলাত, দেশের সমস্ত কল্যাণকর্মের ভার স্টেটের হাতে সমর্পণ করিয়াছে – ভারতবর্ষ তাহা আংশিকভাবে মাত্র করিয়াছে।”১৫
৩। “ইহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যাইবে, ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার প্রাণশক্তি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত। সাধারণের কল্যাণভার যেখানেই পুঞ্জিত হয়, সেইখানেই দেশের মর্মস্থান। সেইখানে আঘাত করিলেই সমস্ত দেশ সাংঘাতিকরূপে আহত হয়। বিলাতে রাজশক্তি যদি বিপর্যস্ত হয়, তবে সমস্ত দেশের বিনাশ উপস্থিত হয়। এইজন্যই যুরোপে পলিটিক্স এত অধিক গুরুতর ব্যাপার। আমাদের দেশে সমাজ যদি পঙ্গু হয়, তবেই যথার্থভাবে দেশের সংকটাবস্থা উপস্থিত হয়। এইজন্য আমরা এতকাল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ করি নাই কিন্তু সামাজিক স্বাধীনতা সর্বতোভাবে বাঁচাইয়া আসিয়াছি।” ১৫
এবার দেখা যাক রবীন্দ্রনাথ যে চিরাচরিত স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছেন তার প্রকৃত রূপ কি ছিল। কবিগুরু ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার বাহ্যিক রূপই কেবল লক্ষ্য করেছেন। তিনি নিজেই তাঁর ঐকতান কবিতায় বলেছেন,
“মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।”১৫
সত্যিই কবি প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার ভিতরের রূপ দেখতে পাননি। প্রকৃতপক্ষে এই সমাজব্যবস্থা মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণ ও ধনি ব্যক্তির দ্বারা অসংখ্য নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষের শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সমাজ ব্যবস্থার সমস্ত নিয়ম-কানুন মূলত উচ্চ শ্রেণীর মানুষের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে রচিত হয়ে ছিল। এ সমাজে সাধারণ মানুষের জীবন ক্রীতদাস সদৃশ ছিল। বৃটিশ আমলে জমিদার ও অন্যান্য মধ্যস্বত্ব ভোগীদের নীতিহীন উশৃঙ্খল জীবন যাপনের প্রভাবে সমাজ আরো বেশি কলুষিত হয়ে পড়ে এবং তার মধ্যে যেটুকু ভাল গুণ ছিল তা অন্তর্হিত হয়ে সমাজ এক কুৎসিত রূপ পরিগ্রহ করে। এরূপ সমাজ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে স্বনির্ভর উন্নয়ন প্রক্রিয়া আদৌ সম্ভব নয়।
এবার পরিবেশ সম্পর্কিত ঔপনিষদিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকটা দেখা যাক। আসলে এটা একটা তত্ত্বগত আদর্শ ধারণামাত্র। প্রাচীন কাল থেকে ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একমাত্র সম্রাট অশোকের রাজত্ব কাল ছাড়া প্রামাণ্য ইতিহাসে এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব প্রয়োগের আর কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। অশোকের রাজত্ব কালেও পরিবেশ সম্পর্কিত নিয়মকানুনের প্রচলন সম্রাট রাষ্ট্রীয় আইনের বলে বাস্তবায়িত করেছিলেন। আপামর জনসাধারণের মধ্যে চেতনা বিস্তারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আমরা দেখতে পাই পরিবেশ দূষণ ঘটানর জন্য বিবিধ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে।১৭
সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা থাকলে এসব কঠোর আইন-কানুনের আদৌ কোনো প্রয়োজন হত না। তা ছাড়া আর একটা বিষয় আমাদের ভুললে চলবে না। তৎকালীন সময়ে জনসংখ্যা খুবই কম ছিল এবং পরিবেশ দূষণের মুল উৎস আধুনিক যন্ত্র শিল্পের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তৎকালীন সময়ে মানুষের জীবন অনেকটা সহজ সরল ছিল। শিল্প ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মানুষের কামনা ও লোভ রিপুকে সীমাহীন ভাবে চরিতার্থ করার যে সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন তা আদৌ ছিল না। তাই মানুষের লোভ ও ক্ষমতালিপ্সা সেদিন অনেক পরিমিত ছিল।
পাশ্চাত্য দেশে আধুনিক অর্থনৈতিক চিন্তার জনক এডাম স্মিথ উল্লেখ করেছেন যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিল্পোৎপাদন ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে বৈষয়িক উন্নতির যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয় তার ফলে মানুষের সমস্ত নীতি ও মূল্যবোধ খড়কূটোর মত ভেসে যায়।১৮
এই কারণেই বর্তমান যুগে মানুষ পুরাতন মূল্যবোধ ও নীতিকে হারিয়ে ফেলেছে এবং এই বাস্তব পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারাকে বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ, কিন্তু সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। আমাদের যদি আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে তাহলে কবিগুরুর চিন্তাকে বাস্তবায়িত করে আমরা একটা সুন্দর কলূষমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। তার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন জনসাধারণের মনে মূল্যবোধের সঞ্চারণ আর সেটার সূত্রপাত ঘটানর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসংগীত একটা বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে। কবিগুরুর সংগীতে কথা, সুর, তাল ও লয়ের সাযুজ্যের মাধ্যমে এমন একটা ক্ষেত্র তৈরি হয় যা মানুষের মনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং তাকে কলূষ মুক্ত করে তুলতে পারে বলে আমার গভীর বিশ্বাস।
গ্রন্থঋণ
[এখানে র-র = রবীন্দ্র রচনাবলী, ১২৫তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ, বিশ্বভারতী, ১৯০৮]
১। অরণ্য দেবতা, র-র-১৪, পৃঃ ৩৭৩
২। শান্তি নিকেতন, র-র-৭, পৃঃ ৬৯৮
৩। বিলাসের ফাঁস, র-র-৬, পৃঃ ৫২৭
৪। বিলাসের ফাঁস, র-র-৬, পৃঃ ৫৪৩
৫। বিলাসের ফাঁস, র-র-৬, পৃঃ ৭০১-০২
৬। ‘ব্রাহ্মণ’, ভারতবর্ষ, র-র-২, পৃঃ ৭১১
৭। স্বদেশী সমাজ, র-র-২, পৃঃ ৬৪০
৮। সমবায় নীতি, র-র-১৪, পৃঃ ৩১৩
৯। সমবায় নীতি, র-র-১৪, পৃঃ ৩১৪
১০। সমবায় নীতি, র-র-১৪, পৃঃ ৩১৫
১১। সমবায় নীতি, র-র-১৪, পৃঃ ৩১৬
১২। সমবায় নীতি, র-র-১৪, পৃঃ ৩১৯
১৩। ‘স্বদেশী সমাজ’, আত্মশক্তি, র-র-২, পৃঃ ৬৩৪
১৪। ‘স্বদেশী সমাজ’, আত্মশক্তি, র-র-২, পৃঃ ৬২৬
১৫। ‘স্বদেশী সমাজ’, আত্মশক্তি, র-র-২, পৃঃ ৬২৭
১৬। র-র-১৩, পৃঃ ৬৬
১৭। Kangle, R. P. (1986): Kautīlyan Arthaśāstra, Part-II (English translation), Motilal Banarasidass, Delhi, Book-II, Ch.-36
১৮। Smith, Adam (1759): The Theory of Moral Sentiments, A. Millar, Sixth edition, London, 1790, IV.I.10 & I.III.23
এছাড়াও ইন্টারনেট সহায়তা করেছে তথ্য অনুসন্ধানে
অনেক কিছু জানলাম। শুভেচ্ছা