ফ্যাশন-স্টাইল-কবিগুরু
– দীনেশ সাউ
“ফ্যাশনটা হল মুখোশ, স্টাইলটা মুখশ্রী”
ফ্যাশনের সাথে স্টাইলের পার্থক্যটা ক্ষণিকের সাথে চিরন্তনের, বিরোধটা গতানুগতিকতার সাথে নিয়ম ভাঙার, ভাবনাটা মানিয়ে নেওয়ার সাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আর সংগ্রামটা বহুর সাথে একার। যা কিছু গতানুগতিক, চলনসই এবং সার্বিক তার সাথে গা ভাসিয়ে চলাটাই ফ্যাশন। আর যেখানে নিজস্বতা বহুর মধ্যে মিশে না গিয়ে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে প্রতীয়মান থাকে তাই স্টাইল। ফ্যাশন অনুকরণযোগ্য কিন্তু স্টাইল অনুসরণ করার জন্যই দীপ্রমান। আকাশের সকল নক্ষত্রের মধ্যে ধ্রুবতারার মতোই। কিন্তু আমরা স্টাইলের চাইতে ফ্যাশনটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কাউকে কিছু করতে দেখলেই সারাটা সমাজ জুড়ে গেল গেল রব উঠতে শুরু করে, তা সমাজের যতই ভালোর জন্য হোক। রাজা রামমোহন রায় যখন সতীদাহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন বা ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের পক্ষে ও বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তখনও যেমন সারাটা সমাজ এককাট্টা হয়ে বিরোধিতা করেছিল আজও সেই ধারার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। সত্যিই আমরা গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভয় পাই। যে কোনো পরিবর্তনকেই আমরা সাদরে গ্রহণ করতে কুন্ঠিত হই। সবাই যা করছে তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াটাই আমাদের ধাত হয়ে গেছে। সেই মানসিকতা থেকেই কোনো চাকরিরতা মহিলাকে সেজে-গুজে কর্মক্ষত্রে যেতে দেখলেই আমরা বাঁকা চোখে তাকাই।
কবিগুরু নিজেই যে সকল ফ্যাশনের ঊর্দ্ধে উঠে নিজস্ব স্টাইলে ধ্রুবতারার মতোই উজ্জ্বল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ‘শেষের কবিতা’য় অমিতের মুখ দিয়ে তাঁরই কথা ব্যক্ত হয়েছে “হাটের লোকের পায়ে চলা রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরতে ভরসা পায় না বলেই আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর।’’ তিনি তো সেই কত বছর আগেই তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে ‘বিমলা’কে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে আধুনিক নারী হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন। ‘ল্যাবরেটরি’ ছোটগল্পে লন্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার নন্দকিশোরকে তার অশিক্ষিত স্ত্রীকে নিজেই লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের সমকক্ষ বানানোর সময় পড়শিদের প্রশ্নের উত্তরে বলতে দেখা গেছে “ওকে নন্দ কিশোরী করতে হবে।’’ আবার ‘ঘরে বাইরে’র সন্দীপকে তিনি ফ্যাশন দুরস্ত গতানুগতিক পুরুষ সমাজের প্রতীক হিসাবেই দেখিয়েছেন। চিরাররিত স্বভাবগত ভাবেই যে পুরুষ পরস্ত্রীর স্পর্শ অনুভবের ব্যাকুলতায় উদ্গ্রীব। নির্লজ্জের মতো বলতে পারে-
“এসো পাপ, এসো সুন্দরী!
তব চুম্বন-অগ্নি-মদিরা
রক্তে ফিরুক সঞ্চরি।
অকল্যাণের বাজুক শঙ্খ,
ললাটে লেপিয়া দাও কলঙ্ক,
নির্লাজ কালো কলুষপঙ্ক
বুকে দাও প্রলয়ঙ্করী!’’
এই দুইয়ের পার্থক্য বোঝনোর জন্যই বোধহয় নিখিলেশ চরিত্রকে তৎকালীন গতানুগতিক জমিদারি ফ্যাশনের বাইরে এনে দাঁড় করিয়েছেন।
আসলে কবিগুরু প্রতিটা ক্ষেত্রেই ফ্যাশনের বাইরে এসে নিজস্ব স্টাইলকে এক সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবন তথা গল্প, উপন্যাস, নাটকের চরিত্রগুলোতেও সেই স্টাইল স্বাভাবিক নিয়মেই এসে গেছে। নিজের জীবনযাত্রা ও সাজপোশাকেও সেই স্টাইলের ছাপ। জমিদারের সন্তান হয়েও নিজেকে কেবলমাত্র জমিদারি পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেননি।
সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তো এই ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো। প্রচলিত পদাবলী ও মঙ্গলকাব্যের ধরা বাঁধা ছন্দ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ছন্দ ও অন্তমিলযুক্ত পদ্য রচনার মাধ্যমে যেমন কাব্য রচনার নতুন দিক উন্মোচন করেছেন তেমনি বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যুগের সাধু ভাষায় রচিত গদ্য ও উপন্যাস থেকে বেরিয়ে এসে, মানুষের মুখের কথা- চলিত ভাষায় জীবন ও চেতনাকে লিপিবদ্ধ করে এক নতুন যুগের সূচনা করেছেন। প্রতিটি উপন্যাসের এক একটি চরিত্রকে তিনি গড্ডালিকার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। তাই তো একমাত্র তিনি বলতে পেরেছেন “কমল হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকে বলে কালচার।’’ আলো না থাকলে তো আর আলো ঠিকরে বের হবে না কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আলোক রশ্মির প্রতিফলনের ব্যবস্থাটা তিনি পাকা করে দিয়েছেন। এই কারণেই তিনি আসল হীরে প্রকৃত স্টাইলিশ।
সংগীতের ক্ষেত্রেও তিনি সমান ভাবে নিজস্বতার ছাপ রেখে গেছেন। নিভৃত সন্ধ্যায় বা চরম একাকীত্বে যে গানগুলো প্রতিবারই মানব মনের অন্তঃস্থল ছুঁয়ে যায়। “জানার মাঝে অজানার সন্ধান’’ করতে করতে আমরা তাঁর মধ্যেই হারিয়ে গেছি।
“ওই তব এল আহ্বান॥
চেয়ে দেখো মঙ্গলরাতি
জ্বালি দিল উৎসব বাতি
স্তব্ধ এ সংসার প্রান্তে
ধরো ধরো তব বন্দনগান।’’
তাঁর এই আহ্বান গতানুগতিকতা ভাঙার আহ্বান- নতুন দিনের আহ্বান- নতুন যুগের আহ্বান। নিজে একাই গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ডাক দিয়েছেন “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’’
কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের ন্যাড়া-ফ্যাকাশে ভূমিকেই তিনি যে উর্বর করে গেছেন তা নয়, শিক্ষাচিন্তার ক্ষেত্রেও তাঁর অত্যাধুনিক মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার ফসল বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতন। এখানেই তিনি প্রকৃত স্টাইলিশ, ফ্যাশন থেকে যাঁর অবস্থান কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে। এই ব্যতিক্রমী মানুষটির জন্য তাঁর লেখা লাইনগুলো উদাত্ত কন্ঠেই উচ্চারণ করা যায়-
“জানি জানি এসেছ এ পথে
মনের ভুলে,
তবে তাই হোক, তবে তাই হোক
দ্বার দিলেম খুলে।’’