কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (পর্ব দুই)
নিজের কোম্পানির ডুপ্লিকেট মাল বেচার অপরাধে বাপ্পাদার চাকরি যাওয়ার খবরটা আমি পেলাম সন্তুদার কাছে। সন্তুদা আমাদের পাড়ায় থাকে, বাপ্পাদার ছোটবেলার বন্ধু। বাপ্পাদার কাছ থেকে খবরটা পাবো তেমন আশা করাটা বোধহয় অন্যায়। তবে এরপর আমার সাথে বাপ্পাদার আর কখনও দেখা হয়নি। কমিশনের টাকা না পেলেও কিছুদিন এদিক ওদিক থেকে অভিযোগ এলে সামলাতে হয়েছে। ঘরের তো এমনিও খাচ্ছিলাম, তার সাথে এ ক’দিন বনের মোষ তাড়িয়ে একটাই লাভ হয়েছে, মোষের শিং আর লেজ থেকে নিজেকে বাঁচাতে শিখেছি। অন্তত তখন তো তাই মনে হয়েছিল। রেজাল্ট তখনও বের হয়নি, তাই অফিসিয়ালি বেকারের তকমাটা গায়ে লাগেনি। কলেজে পড়া চলার সাথে সাথে টিউশনি করার মধ্যে তাই অগৌরবের কিছু ছিল না। পড়াশুনোর ব্যাপারে আমাদের কলেজের ছেলেদের শহরে একটা সুনাম ছিল, তাই মাঝে মাঝে টিউশানির ডাক আসতো। টিউশনির আরেকটি অস্বস্তিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো, ছাত্রীর বা ছাত্রের দিদির সাথে হৃদয়গত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়া। তবে মতামতটি সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত। কারণ প্রতিক্রিয়া পাবার আশায় ক্রিয়াতে সময় দেবার লোকেরও অভাব ছিল না। তখন পাঠক্রমে এমন কোনো বিষয় ছিলই না যা থেকে প্রেমের স্ফুরণ হতে পারে। ইংরেজিতে একটি একদম নিরামিষ প্রেম কাহিনি পাঠ্য ছিল, ও হেনরির ‘গিফট অব দি ম্যাজাই’ বা লকিনভারের মতো কবিতা। সেই আটের দশকে প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারগুলো তোষকের তলায় রাখাটাই প্রথা ছিল। মনে আছে, লকিনভার নামক ব্যালাডটি পড়াতেই আমাদের স্যার রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়তেন। একটা লাইন ছিল, ‘দা ব্রাইড কিসড দি গবলেট, গ্যালান্ট টুক ইট অ্যাওয়ে।’ সুবোধবাবু স্যার করুণ মুখ করে বললেন, ‘এঁঠো খাওয়াচ্ছে।’ স্কটের রোমান্টিক লাইনের বারোটা বাইশ। অমিত আমাদের সাথে থাকলেও কবিতার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতো। ওর অভিজ্ঞতায়, ‘একটা কথা খুব সাফ বুঝে নে গুরু, হবার হলে না, লগ টেবিল থেকেও প্রেম হয়। কবিতা ফোবিতার থেকে আজকাল আর প্রেম হয় না।’ অমিতের অভিজ্ঞতার দাম আছে কারণ, অমিতের টিউশনির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অমিত বাইরে অনেক পড়ালেও ওর বোনটা ওর কাছে পড়তো না। ওকে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অঙ্ক-বিজ্ঞান দেখানোর দায়টা আমার ওপর এলো। মাসখানেক পড়ানোর পর, ভেবেছিলাম অমিতকে বলি, তোর বোনের পড়াশুনোয় মন নেই, আমাকে নিষ্কৃতি দে। অসুবিধে হলো, বন্ধুর বাড়ি বলে পয়সা নিতে পারি না, তাই ছেড়ে দিলে তার অন্য অর্থ হবে। অমিতের বোন সোনালী দেখতে কেমন ছিল, কী রঙের স্কার্ট ব্লাউস পড়তো তেমন করে কখনও দেখার কথা মনে হয়নি। একচক্ষু হরিনের যেটা হয়েছিল, সেটা আমার সাথেও হলো।
‘শান্তদা, তুমি কবিতা লেখো?’
‘কবিতা। তোর আবার কবে কবিতায় ইন্টারেস্ট হলো। পড়েছিস আমার কবিতা।’
‘আমার জন্য লেখো, তখন পড়বো। লিখবে, বলো না, লিখবে?’
একথাটা আর অমিতকে বলে উঠতে পারিনি।
অমিতের বাড়ির সাথে ওর জামাইবাবুর বা তার পরিবারের কী একটা প্রাথমিক ঝামেলার দরুন ওর দিদি বাড়ির অমতে ওর হবু জামাইবাবুর সাথে চলে গিয়েছিলো। তারপরে যেমন হয় সব মিটে গিয়ে দু’বাড়ির সম্পর্ক ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিলো। একদিন শুনি অমিত ওর জামাইবাবুর বোনকে অংক করাচ্ছে। জামাইবাবুর বোন মানে, ‘ম্যান ইটার অব সোনালী গার্লস’ চৈতালি। এসব বিশেষণ সহযোগে খবরটির পরিবেশক আমাদের তুহিন। অমিত বিকেলের আড্ডায় একটুও অস্বীকার করলো না। বললো, ‘খুব ভালো রেস্পন্স পাচ্ছি।’ তবে আমাদের জানা আছে চৈতালি রেস্পন্সিবল না হলেও রেস্পন্স দিতে খুবই স্বচ্ছন্দ। অমিত নাকি বদলা চায়। মানেটা কারোর কাছেই স্পষ্ট হলো না। অমিত ওর জামাইবাবুর বোনকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে ফিল্মি ভাষায় জামাইবাবুর হিসেব বরাবর করতে চায়। বোঝো। জীবনটা কী আর অক্ষম হাতে লেখা বানান ভুলে ভরা গল্প? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “প্রকৃতিঠাকুরানী উপন্যাস লেখিকা নহেন, তাঁহার হাতে বিস্তর কাজ আছে।” আমার কেমন যেন মনে হয় উনি মাঝে সাঝে দু একটা কৌতুক করার সময় পান। অমিতের তথাকথিত প্রেমের কাহিনি চাপা থাকলো না। ভাগ্যের ফেরে ওর জামাইবাবুর বাড়ির দিক থেকে কোনো আপত্তিই এলো না, কিন্তু অমিতের মা বাবা প্রচন্ড রেগে গেলেন। অমিতের বদলার প্ল্যানটা ঘেঁটে তো গেলোই, তারপর সোনালীর খপ্পর থেকে বেরোনোর প্রেসার।
তবে কলেজের পড়া হয়ে যাবার পর চাকরি না করে, মতান্তরে না পেয়ে, বাংলা উপন্যাসের সংগ্রামী চরিত্রের মতো দু-হাতে টিউশনি করাটা একজন ইঞ্জিনিয়ারের সম্মানের পক্ষে বিশেষ হানিকর। তাছাড়া চেনা পরিচিতরা আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে মাঝে মধ্যেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে শুরু করলেন। তাদের ভাসুরের ছেলেরা সবাই আই আই টির ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সবাই দেশে বিদেশে বড় বড় চাকরি করছে। একমাসের মাইনের অঙ্ক শুনলে পুরো বছরের বলে ভ্রম হয়। এইসব কথা তারা বাড়ি বয়ে এসে মাকে বলে যেতেন। এদিকে নানা কারণে আমার কেরিয়ার চিন্তাজনক রাস্তায় দাঁড়িয়ে লিফট পাবার আশায় বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। একে তো জলপাইগুড়ির অনুন্নয়ন এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত অসুবিধে আমাদের দক্ষিণবঙ্গের ছেলেদের থেকে পিছিয়ে রেখেছে। তার ওপর বাংলা স্কুল এবং পশ্চিমবঙ্গের কলেজে পড়ার দরুন, প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক ইংরেজিতে না দিতে পারার দুর্বলতার জন্য, আমাদের অনেককেই ইন্টারভিউ-এর দৌড় থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে। তাই আর কোনো উপায় না দেখে আমাদের ইংরেজি শোধরানোর চেষ্টা করা গেল। যেটা সহজেই করা গেলো সেটা হলো, নিয়ম করে বুধবার ছাড়া অন্য দিনও স্টেটসম্যান পাঠ এবং কেউ না থাকলে নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে বার্তালাপ। শুরুর সংকোচ, ভুল কাটিয়ে ওঠার পর এই নতুন উদ্যমের সুফল কম বেশি আমরা সকলেই পেতে লাগলাম।
এর মধ্যে ‘দুদন্ড শান্তি দিয়েছিল’ সিনেমা হলগুলো। জলপাইগুড়িতে তখন তিনটে সিনেমা হল। রূপশ্রী, রূপমায়া আর দীপ্তি টকিজ। তিনটি হলের সমানতা হচ্ছে সিটে ছারপোকা, পর্দায় দাগ বা সেলাই, টয়লেটের একশো ফুট দূর থেকে নাক জ্বালানো গন্ধ ও ব্ল্যাকারদের দৌরাত্ম। সাইকেল রিকশায় মাইক লাগিয়ে, সারা শহরে জানানো হতো, কোন হলে তিনটে ছটা রাত্রি নটায়, নতুন কী বই লাগলো। দীপ্তি টকিজ সবার উপর দিয়ে যেত। শুরুতেই সাফাই গেয়ে রাখতো, কারেন্ট চলিয়া গেলে বই চলিবে, পাঙ্খা চলিবে না। তখনকার দিনের নায়কেরা ঢিসুম ঢিসুম করে তবলায় বোল তুলে মারপিট করতো বটে, কিন্তু তারা সিক্সপ্যাকের অধিকারী ছিলেন না বলে জামা খুলে গা দেখাতেন না। (সে দায়িত্বটা নেবার জন্য নারী বাহিনী ছিল) । কিন্তু দীপ্তি টকিজে দুটাকা দশ পয়সার সিটে বসলে আমরা জামা খোলার জন্য প্রস্তুত হয়েই আসতাম।
রেজাল্ট বের হলো ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে, বুধবার। সময়ের প্রায় সাতমাস পরে। ততদিনে বড় মেজো সব পাবলিক সেক্টরের সে বছরের পরীক্ষা ইন্টারভিউ সব শেষ। আমাদের মধ্যে যারা এখানে ওখানে ইন্টারভিউ অবধি পৌঁছেছিলাম, তাদের প্রায় সবাই সুযোগ হারিয়েছি । সাতমাস দেরি তো কোনো সুস্থ লোকে বিশ্বাসও করতে চায় না। এন.টি.পি.সি-র লেখা পরীক্ষায় উতরে গেলেও, ইন্টারভিউতে আটকে গেলাম। ইন্টারভিউ দিতে দিল্লি গিয়েছিলাম, সেখানে আমাকে তো মুখের ওপরই বলে দিয়েছিল, ‘পুরো এক সেমিস্টার দেরি! নিশ্চয় ব্যাক-ট্যাক পেয়েছো।’ বলতে গেলে কর্মজীবনের একবছর কমে গেলো।
তবে নম্বর যেমন আশা করেছিলাম যেটা এলো সেটা তার চেয়ে সামান্যই ইতর বিশেষ । একটা ভদ্রসদ্র নম্বর। নম্বর টম্বর বীভৎস ভালো হলে নাকি সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি, ইন্টারভিউ বোর্ডে সক্কলে মিলে হেজিয়ে বোর করে ছেড়ে দেয়, বধ হয়েও অভিমন্যুর গৌরবটা পাওয়া যায় না। তেমন বীভৎস ভালো নম্বর পেয়ে নিজেকে অসুবিধেয় ফেলবো সে আশঙ্কা আমার বিশেষ ছিল না, থাকার কোনও বাস্তব ভিত্তিও ছিল না। বন্ধুদেরও সেই কথা, ‘যা পেয়েছি তাই খায় কে গুরু?’
সেদিন মার্চ মাসের তৃতীয় শনিবার। গরম পড়তেই প্রতিবছর আমাদের বিকেলের আড্ডা মারার জায়গাটা বাবুপাড়ার গানের স্কুলের কালভার্ট থেকে করলা নদীর ব্রীজে চলে আসে, গত পাঁচ বছর ধরে তাই আসছে। আমাদের এই বিকেলের আড্ডায় সবাই যে আমাদের কলেজের সহপাঠী ছিল তা নয়। তাই আলোচনাগুলো কলেজ বা ভবিষ্যৎ চাকরির সীমানা পার করে যেত। আমি, দেবাশিস, উত্তম, গৌতম রোজ তাড়াতাড়ি হাজিরা দিতাম। ছাত্র চরিয়ে একটু পরে আসতো তুহিন, অমিত। কাজলের এসব ঠেকবাজি বা কবিতা নিয়ে আঁতলামো পছন্দ ছিলো না, তাই খুব কম হাজিরা দিতো। আমাদের কবিতা পত্রিকা বার্ণিকের পঞ্চম সংখ্যা অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গেলে বাংলা সাহিত্যের কী বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে তাই নিয়ে আমরা তখন আলোচনায় নিমগ্ন। বার্ণিকের আগের চারটে সংখ্যা ছিল এক একটা বিষয়ের ওপর – মৃত্যু, ভূত, শৈশব আর প্রেম। পঞ্চম সংখ্যাটা হতো বিপ্লব। আমরা কিভাবে যে গত চারটে সংখ্যা বের করেছি ভাবলে, নিজেদেরই অবাক লাগে। পড়াশুনো নষ্টতো আছেই। তাছাড়া লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বিজ্ঞাপন পাওয়া যে পুজোর চাঁদা তোলার চেয়ে ঢের ঢের কঠিন তা কেই বা কবে জানতো। পত্রিকার দাম রাখা হয়েছিল একটাকা। বিক্রি করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। পয়সা খরচ করে কে আর তোমার আঁতলামো পড়বে?
বার্ণিকের ভবিষ্যৎ পাকা করার ফাঁকে হাকিমপাড়ার টিউশনটা সেরে সাইকেল ঝনঝন করতে করতে অপূর্ব এসে উপস্থিত। বিনা ভূমিকায় শুরু হয়ে গেলো, ‘চট্টো, একটা চাকরি আছে, সেলসে, করবি? কলকাতায় কিন্তু।’ চট্টো আমার শান্তনু চট্টোপাধ্যায় নামের সবচেয়ে ভদ্র সংক্ষিপ্ত রূপ।
‘চট্টো বাপ্পাদার নাটে আলরেডি টাইট হয়ে আছে গুরু, আবার সেলস।’ উত্তমের মন্তব্য ‘তোর মুনিয়া আবার আজকাল চাকরিও দিচ্ছে নাকি বস। তা চট্ট কেন, তুই নিজেই তো লেগে পড়লে পারতিস।’
‘মুনিয়া তুলে কোনো কথা হবে না, বলে দিচ্ছি।’ অপূর্ব রেগে গেলো।
‘মুনিয়াকে তোলার চান্স আর কোথায় পেলাম গুরু, তুমি তো আগেই তুলে বসে আছো।’ এসব কথা কাটাকাটিতে, আমার চাকরির ঘুড়ি আকাশে ওড়ার আগেই ভোকাট্টা হবার জোগাড়। জানা গেলো আজ বিকেলে অপূর্ব যখন হাকিমপাড়ার টিউশনি ছাত্রীকে পড়াতে গিয়েছিল, তখন ছাত্রীর দাদা শ্যামলদার সাথে দেখা। ছাত্রী সদর (করলা) গার্লসে ক্লাস টেনে পড়ে এবং অপূর্ব তাকে মাত্র ষাট টাকায় বিজ্ঞানের সব বিষয় সপ্তাহে তিনদিন পড়ায়। একদিনও ফাঁকি না মেরে পড়াতে যাবার কারণ ছাত্রীর দিদি, মণিদীপা ওরফে মুনিয়া, পি.ডি. কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। (বিজ্ঞানের সব বিষয়ের মধ্যে অবশ্যি বায়োলজি বাদ। গৌতম বলে ‘ওটা উল্টে মুনিয়াই অপূর্বকে পড়ায় – সপ্তাহে তিনদিন। অপূর্বটা বোধ হয় পাস করে যাবে।’) শ্যামলদা আমাদের কলেজ থেকে চার বছর আগে পাস করে বেরিয়ে খড়গপুর আই.আই.টি থেকে এম.টেক করেছে, বর্তমানে কলকাতায় মেটাল বক্সে কর্মরত। কর্মসূত্রে নিয়মিত কলকাতার কোনও এক এন.টি.ইন্ডাস্ট্রীস লিমিটেডে যেতে হয়, তখন নাকি ওখানকার সেলস ম্যানেজার কথায় কথায় শ্যামলদাকে বলেছেন, ‘একটা ফ্রেশ ছেলে দিতে পারেন, মেকানিকাল?’ অপূর্ব ইলেক্ট্রিকাল, তার ওপর স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে একটা ইন্টারভিউও এসেছে। তাছাড়া নাট বেচার অভিজ্ঞতার সূত্রে সেলসে আমার একটা ইয়ে তো আছেই।
আবেদন পাঠানোর সাতদিনের মধ্যে ডাক এলো। ইন্টারভিউ কলকাতায়, যাতায়াতের ভাড়া টাড়া দেবে এমন কথা চিঠিতে খুঁজে না পেলেও দেরি না করে দার্জিলিং মেলে চড়ে বসলাম। সেলস ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিটা আমার মা’র অপছন্দ ছিল। কারণটা মা’র কোনো এক নিকট আত্মীয় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সেলসে চাকরি নেবার পরেই সিগারেট ও সূরাসক্ত হয়ে পড়ে। অজুহাতে বলা হয়, সেলসে কাজ করতে গেলে ওসব না খেলে নাকি চলবেই না। বোঝো কারবার। আমি অতিকষ্টে মার সামনে সিগারেট সূরা থেকে দূরে থাকার প্রতিজ্ঞা করে তবে ট্রেনে চড়তে পারলাম। এন.টি.ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড এক গুজরাতি কোম্পানি। হেডঅফিস বোম্বেতে আর কারখানা আহমেদাবাদে। জাপানের তোশিবার প্রযৌক্তিক সহায়তায় এন.টি.ইন্ডাস্ট্রীস লিমিটেড প্লাস্টিক মোল্ডিং মেশিন বানায়, টি মানে হচ্ছে তোশিবা। এছাড়া এক সুইস কোম্পানির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ব্লোয়ার ভ্যাকুয়াম পাম্পের ব্যবসাও আছে। রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে, যাকে সবাই ওয়েলিংটন বলে থাকে, তার একটা চারতলা বাড়ির তিনতলায়, পুরো তলাটা নিয়ে কলকাতার অফিস। তুহিনের মামা কোনো এক আধা বিদেশি কোম্পানির মার্কেটিং ডিভিসনে কাজ করেন, সেই সুবাদে ও আমাকে একটা আভাস দিয়েছিল। ‘অফিসটা পুরো এসি থাকবে। বড় বড় পেতলের টব, গাছ ফাছ দিয়ে হেভি করে সাজানো। একপিস ঝিনচাক রিসেপসনিস্ট থাকবে। পেন দিয়ে ফোন ঘোরাবে, নেলপলিস, লিপস্টিক পুরো ইস্টম্যান কালার। তবে সাবধান, আদেখলার মতো ঝারি করলে চাকরি ভোগে।’
কে যেন বলে দিয়েছিল, হিন্দ সিনেমার সামনে নামবি। একটা পুরানো ধরনের চারতলা বাড়ি, আদ্যিকালের লিফট, কোনো নাম বোর্ডের বালাই নেই, সার দিয়ে রাখা লেটার বক্সের একটার গায়ে এন টি র নাম দেখে অফিসের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হওয়া গেলো। এন.টি.ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেডের, কলকাতা শাখা, সাজ শয্যায় মোটেই তুহিন বর্ণিত সেলস অফিসের মত নয়। রিসেপসনিস্ট বলে যে ঝিনচাক মহিলার দর্শন পাবো বলে ভেবে মনে মনে উৎসাহিত অথচ সতর্ক হয়ে এসেছিলাম, তার দেখা পেলাম না। কুদৃষ্টিপাত তো দূরে থাক, যাযাবর এলেও দৃষ্টিপাতও করতে পারতেন না। রিসেপশনের বালাই নেই। সামনে টুলে একজন বসে ছিল, পরে জেনেছি তার নাম আহমেদ, পিওন থেকে শুরু করে সে কী যে না তা বলা মুশকিল। সেই ভিতরে যেতে বললো। দু’দিকে দুটো কেবিন। মধ্যে গোটা আষ্টেক চেয়ার টেবিল পরপর সাজানো, তিনখানার ওপর টাইপরাইটার রাখা আছে। টাইপিস্টদের মধ্যে দু’জন মহিলা, একজনের পাশে দুটো ফোন রাখা আছে। দুই মহিলার একজন ঝড়ের বেগে টাইপ করে যাচ্ছিলেন, সিরিয়াস চেহারা, বয়েস তিরিশের কম বলে মনে হয়, নাম পরে জেনেছিলাম, মিসেস মাথাই। অন্য মহিলা কিছু করছিলেন বলে মনে হচ্ছিলো না, মিসেস দাস, যিনি ফোনের পাশে ছিলেন চোখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাই?’ কী চাই নয়, কাকে চাই। চিঠিটা বের করে হাতে দিলাম। মিসেস দাসের বিশেষত্বহীন বাঙালি চেহারা, বয়েস পঁয়ত্রিশের বেশি, আপাতদৃষ্টিতে অহঙ্কারি মনে হয়, যদিও অহঙ্কারের উৎস দৃষ্টিগোচর বা কারণ বোধগম্য হয় না। উনি পরম অবহেলায় চিঠিটা হাতে নিয়ে, ফোনে কাউকে আমার আগমনবার্তা জানালেন। তারপর আমাকে ভুলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ডাক পড়লো সেলস ম্যানেজার মিঃ দত্তর কেবিনে। কেবিন আকারে মাঝারি, বন্ধ জানালার নিচে একটা এ.সি. একটু আওয়াজ করছিল। মিঃ দত্তর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, গায়ের রং কালোই বলা যায়, বেশ শক্ত পোক্ত, থ্যাবড়া নাক, বক্সার বক্সার চেহারা। ঘুরপাক খাওয়া চেয়ারের কাঁধে সিকি ময়লা তোয়ালে চাপানো, টেবিলে আধখাওয়া জলের গেলাস ঢাকা দিয়ে রাখা।
টেকনিকাল বিশেষ কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। আগে কোথাও কাজের অভিজ্ঞতা আছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে না বললাম, বাপ্পাদাজনিত লাফালাফিটাকে কাজের নাম দেওয়া যায় না। রাজনীতিতে উৎসাহ আছে কিনা প্রশ্নেও না বললাম। যদি চাকরি পেতে চাও তো নাই বলতে হয়। সময় নষ্ট না করে সোজা বললেন, ‘পনেরো তারিখে জয়েন করে যান।’ বেতন মাসে নশো পঞ্চাশ টাকা, তিনমাস পরে থেকে পি.এফ কাটা যাবে, ছ-মাস পর আমার কাজকর্ম ওনাদের ভালো লাগলে চাকরি পাকা হবে।
আমার মুখের ক্যাবলা ক্যাবলা হাসি দেখে অফিসের লোকেদের বুঝতে অসুবিধে হল না, যে কাজটা আমার হয়েছে। একজন ডেকে সামনে বসতে বললেন। ‘কলকাতায় থাকার জায়গা আছে?’ না শুনে একটু বমকে গেলেন। চা এলো সামান্য পরিচয় বিনিময় হল। বললেন, ‘আহমেদকে বলুন, একটা হিল্লে হয়ে যাবে।’
এপ্রিলের ষোলো তারিখ, সোমবার, সন উনিশশো তিরাশি, শান্তনু চট্টোপাধ্যায়, এন.টি.ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেডের কলকাতা শাখায়, সেলস ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজে যোগ দিল।