কচ্ছপের বেঁচে থাকা (নতুন পর্ব)- দেবব্রত সান্যাল
আগের পর্বের পর
উন্নয়নের দাবিতে নানা আন্দোলনের জেরে আমাদের কলেজের সেশন প্রায় সাতমাস পিছিয়ে, আন্দোলনে লাভ কিছুই হয়নি। না কলেজ শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে, না ভালো হয়েছে পরিকাঠামো। শুনেছি ষাটের দশকে এক চা শিল্পপতির ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে এই কলেজের প্রতিষ্ঠা। এই আটের দশকেও কলেজে মাত্র তিনটি বিভাগ, মেকানিকাল, ইলেক্ট্রিক্যাল আর সিভিল। শহরের বাইরে অনেকটা জায়গা নিয়ে কলেজ আর হস্টেল। কলেজের গা ঘেঁষে ডেঙ্গুয়াঝার চা বাগান। জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনও কাছে। কলেজে স্পষ্টতই দুই ধরণের ছাত্ররা পড়তে আসতো। খুবই অল্প সংখ্যক স্থানীয় ছাত্র ছিল, যারা আমার মতো বাড়িতে থেকে যাওয়া আসা করতো। অধিকাংশই এসেছিল দক্ষিণবঙ্গ থেকে। বাড়ি ঘর ছেড়ে এতদূর শহরে হস্টেলে থাকতে ভালো লাগার কথা নয়। সারা রাজ্যে মোট চারটি কলেজে সব মিলিয়ে আটশো মতো সিট। কোটা, রিজার্ভেশন পর বাকি থাকতো আরও কম। স্পষ্টতই আর কোনো উপায় ছিল না তাই এই কলেজে, এ শহরে পড়তে এসেছে। যেন স্বর্গের শাপগ্রস্ত কোনো গন্ধর্ব, চার বছরের শাপমোচনের অপেক্ষায়। যারা হস্টেলে থাকতো, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা আত্মীয়তার পর্যায়ে চলে যেত, যেটা ডে স্কলার আমাদের বোধগম্য হতো না। তাই কলেজে সহপাঠী থাকলেও বন্ধু ছিল না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেক একপেশে ধারণাও তৈরি হতো। কেমন যেন মনে হতো, হস্টেলের ছেলেদের এ শহরটার প্রতি শুধু অবজ্ঞাই ছিল, ভালোবাসা ছিল না। তাই কখনো কখনো শহরে গিয়ে মারপিট করে পুলিসি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তো। শহরের মেয়েদের শুধু টাইমপাস ভেবে মেলামেশা করত, কখনো কখনো সে সূত্রেও অসুবিধের সৃষ্টি হত। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে শহরের মেয়েদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করতো। ইঞ্জিয়ারিং কলেজের ছাত্র মানে পড়াশুনোয় ভালোই হবে, সুতরাং মেয়েকে সায়েন্স সাবজেক্ট পড়ানোর জন্য আদর্শ। মেয়ের মাস্টারমশাইকে বিশেষ পছন্দ হয়ে যেত। মেয়ের বাড়ির লোকেরা কিছু আঁচ পেলেও নিখর্চায় ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পাবে ভেবে চোখ বুজে থাকতো। কিছু প্রেম হতো শর্ত সাপেক্ষ ও প্রতিশ্রুতিহীন। কিন্তু পরিণতি হরে দরে একই হতো। চা বানানোর পর যেমন চা পাতা আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নয়, চা গাছের আড়ালে করা প্রেমও তাই। আমার মনে হয় শারীরিক সম্পর্ক ভাষাটায় কিছুটা গলদ আছে। দুটো শরীর কাছে এলেই কী সম্পর্ক তৈরি হয়! আমাদের কলেজ হস্টেলের ছেলেরা পাশের পলিটেকনিকের ছাত্রদের মনুষ্যপদবাচ্য জ্ঞান না করায় তাদের সাথেও সম্পর্ক ভালো ছিল না। খারাপ সম্পর্কটা অনেক সময়েই মারামারির পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতো। ঝুমঝুম আমার শিশুনিকেতনের প্রাণের বন্ধুদের একজন। ঝুমঝুম একবার বলেছিলো, ‘তোদের কলেজের হস্টেলের ছেলেরা কেমন রে? একবার একটা কাজে কোনও একটা হস্টেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, এতো বাজে ভাষায় চিৎকার করে আওয়াজ দিচ্ছিলো, যে রাগের থেকে বেশি অবাক লেগেছিলো। আওয়াজ দেবার স্ট্যান্ডার্ড এতো খারাপ?’ জবাব দিতে পারিনি। কিন্তু কোনও এক দু জনের জন্য কলেজের বদনাম শুনতে ভালো লাগে নি। শিক্ষকরাও কেউ কলকাতা ছেড়ে আসতে চাইতেন না, আসতে বাধ্য হলে তার হতাশার জের ছাত্রদের ওপর পড়তো। সহজ সত্যিটা হলো আমাদের মতো বেড়ালের কপালে শিকে ছিঁড়লেও লাভ কিছু হয় না, হাঁড়িটা সোজা আমাদের মাথার ওপরে পড়ে।
শিকে ছেঁড়ার নবতম সংযোজন, আমাদের কলেজে নতুন একজন ট্রেনিং অ্যান্ড প্লেসমেন্ট অফিসার এলেন, ডঃ রায়চৌধুরি। ডক্টর বলতে ভুল হলে বিশেষ অসন্তুষ্ট হন। আমাদের মতো অন্ধকারের জীবদের উদ্ধার করতেই মহাপ্রভুর ধরাতলে আগমন, সেটা ওনার সাথে কথা বলতে গেলে বোঝা যেত। তবে সোজা ভাষায় সেটা কখনো প্রকাশ করে বলেননি। সেটা করলে ওনার স্বাস্থ্যহানি হবার আশঙ্কা ছিল।
ভোকেশনাল ট্রেনিং-এর নামে একবার ভুটানে এক সিমেন্ট কারখানা দর্শন করা হলো। বিদেশ ভ্রমণ ভেবে উৎসাহিত হবার কারণ নেই, জায়গাটা বিশেষ দূরে নয়, সকালে গিয়ে সন্ধ্যেবেলা ফিরে আসা হয়েছিল। সে ফ্যাক্টরিও সবে শুরু হয়েছে। ধুলোয় ভরা ডলোমাইটের পাহাড়। কলেজের পয়সায় একদিনের ট্রিপ হলো বটে, কিন্তু অনেকেই বললো, সিকিমে হলে ভালো হতো। মালটা ওখানে সস্তা। এই জলপাইগুড়ি কলেজে পড়াশুনো করে, এই বাজারে ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখাটা যে কতটা অনুচিত সেটা মোটের উপর ডঃ রায়চৌধুরি হাবভাবে জানতে পেরেছিলাম। তবু উনি অসাধ্য সাধন করলেন। হঠাৎই একদিন কলেজে হিন্দুস্থান কম্প্যুটার এসে হাজির, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হবে। ক্যাম্পাস! কলেজের ইতিহাসে প্রথমবার। হাওয়ায় হার্ডওয়ার, সফটওয়ার সব নতুন নতুন শব্দ। রায়চৌধুরি স্যারের তো সিগারেট খাওয়াই বেড়ে গেলো। আমরা মেকানিকালের অবোধ বালকেরা কম্পিউটার ব্যবহার করাতো অনেক দূরে, তেমন ভাবে কম্পিউটার চোখেই দেখিনি। কলেজের কোথাও এক বিশেষ স্থানে একখানা কম্পিউটার রাখা ছিল। সেখানে অনধিকারীদের প্রবেশ নিষেধ। যারা সেই কম্পিউটার ক্লাস করতো, তারা নিজেদের মধ্যে সেই রূপনগরের কথা বলতো, আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে শুনতাম। প্রচলিত ছিল, সেটি নাকি আমাদের লেকচারার সানুদা একবার চালাতে গিয়েছিলেন, কম্পিউটারের ভিতর থেকে হঠাৎ একটা হাত এসে ঠাঁই করে ওনাকে এক চড় কষিয়ে দিয়েছিল। কম্পিউটার তো আর ওনার প্রাক্টিক্যালের মার্কসের মুখাপেক্ষী অসহায় ছাত্র নয়, যে রাজ্যের ভাট সহ্য করবে। অমিতাভ শুনে বললো, ‘তোরা শুধু সানুদার কথাটাই ভাবছিস, বেচারা কম্পিউটারের কথা কেউ ভাবে না।’ সেবার ক্যাম্পাস থেকে যে কারোরই চাকরি হয়নি সেটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ শহরটা, সেই ছোটোবেলা থেকে তো দেখে আসছি, বিশেষ বদলায়নি। এই না বদলানোটা নাকি একটা বিশেষ গর্বের বিষয়। ট্র্যাডিশনের নামে এক গতিহীনতার উপাসনা। আটষট্টির বন্যায় ঝলসে যাওয়া চেহারায় সময়ের সস্তার মলম। ঘা শুকিয়েছে কিন্তু দাগ মেলায়নি। সেই দাগ দেখিয়ে যতটা পারা যায় সহানুভূতি আদায় করা, শিবরাত্রির সময় জল্পেশ মন্দিরের মেলার মাঠের ভিখারিদের মতো। করলা নদী শহরের মাঝখান দিয়ে গেছে আর তিস্তা শহরের বাইরে দিয়ে। এখনও বর্ষায় তিস্তা তার পাড়ের মানুষদের নিয়ে খেলা করে আর করলা নদীর জল রাস্তায় উঠে আসে। ছোটোবেলায় দেখেছি শহর থেকে কিছু দূরে পাঙ্গা থেকে কলকাতার জন্য প্লেন ছিল। জামএয়ার কোম্পানির প্লেনে সামনের দিকটায় যাত্রী বসতো, পিছের দিকে বাক্স টাক্স থাকতো। শহরের থেকে একটা বাস যাত্রীদের নিয়ে এরোড্রোমে পৌঁছে দিতো। ডাকোটা প্লেন, কানে তুলো ঠেসে বসতে হতো। চা বাগানের হেড অফিস জলপাইগুড়ি থেকে উবে যাওয়ার সাথে সাথে পাঙ্গা এয়ারপোর্টও বন্ধ হয়ে গেলো। নিকটতম এয়ারপোর্ট হলো বাগডোগরা। জলপাইগুড়ি একপা পিছিয়ে গেলো। এ জেলায় চা বাগান ছাড়া তেমন কোনো শিল্প তৈরি হয়নি। কেন হয়নি, তার জন্য পরিকাঠামোর দৈন্য আর যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবের সাথে সাথে আমাদের মানসিকতাকেও অবশ্যি দায়ী করা চলে। তবে দায়ী করলেই দায়িত্ব থেকে নিস্তার পাওয়া যায় না। সমস্ত জলপাইগুড়ি জেলায় চা বাগান কম নেই, তবে ভীষণভাবে শ্রমিক নির্ভর। প্রযুক্তি অত্যন্ত পুরোনো, সেখানে তো আর ইঞ্জিনিয়ারের দরকার হয় না, তাই স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের জীবিকার প্রয়োজনে বাইরের দিকে না দেখে উপায় নেই। একসময় রূপশ্রী সিনেমা হলের উল্টো দিকে মুর্শিদাবাদ হাউসের দেয়ালে কবিতা পোস্ট করার ধুম পড়েছিল। একটা বেশ মনে আছে, ‘পর্বতও একদিন মোহাম্মদের কাছে এসেছিল, কিন্তু মোক্ষদা তুমি একবারও শিউচরণের বিছানায় এলে না।’
এ শহরের উন্নতি থমকে যাবার সব দায় সবাই সেই আটষট্টির বন্যার ঘাড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। সেই বন্যাতে ব্যবসায়ীরা নাকি এমন ভয় পেলেন যে দলে দলে শহর ছেড়ে চলে গেলেন। পাইকারি দোকানগুলি বন্ধ হয়ে গেল। থাকল শুধু কয়েকটি মুদি দোকান। সেই ক্ষতি নাকি আজও পূরণ হয়নি।
এতগুলো নাকির কারণ হলো, আমি কিন্তু এমন একজনকেও জানি না যে বন্যার ভয়ে বাড়ি ঘর বিক্রি করে শহর ছেড়ে চলে গেছে। স্বাধীনতার আগে থেকেই জলপাইগুড়ি শহরের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ছিল চা এবং কাঁচামালের ব্যবসার ওপর। বন্যার ধাক্কায় নাকি কাঁচামালের ব্যবসার কেন্দ্রই সরে যায় জলপাইগুড়ি থেকে। আর তার আঘাতে গুটিয়ে যায় চা বাণিজ্যও। উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলির সদর দফতর ছিল জলপাইগুড়িতে। চায়ের গুদাম ছিল। চা পাতা রাখার কাঠের বাক্সও তৈরি হতো শহরে। বেশ কিছু চা সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয়, এই সুযোগে অফিস কলকাতায় সরিয়ে নিয়ে যাবেন। চায়ের থেকে টাকা আসতো অনেক, সে টাকা তো আর জলপাইগুড়িতে বসে খরচ করা যায় না। তাই চলো কলকাতা। পরের প্রজন্মকে কলকাতার স্কুলে পড়াতে হবে। কলকাতার বড় দোকান থেকে বাজার করতে হবে। আর দোষ ঘাড়ে নেবার জন্য বন্যা তো আছেই। বাবুরা বলে বেড়ান, ‘বন্যায় সরাসরি পুঁজির ওপর আঘাত আসে। একের পর এক বিনিয়োগ সরে যায় জলপাইগুড়ি থেকে।’
যুদ্ধে বিদ্ধস্ত হয়ে যদি জাপান, ভিয়েতনাম উঠে দাঁড়াতে পারে। যদি ভূমিকম্প, সামুদ্রিক তুফানের সাথে লড়াই করেও থেকে যেতে পারে, তাহলে জলপাইগুড়ি পারলো না কেন? এ জেলায় যে চা বাগান ছাড়া আর কোনো শিল্প কেন তৈরি হয়নি, সেটা আমাদের বিকেলের আড্ডা গুরুতর বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। সরকার ও তার নেতিবাচক শিল্পনীতির যথাসাধ্য সমালোচনা করেও একটা কথা মনে হচ্ছিলো। আমরা কি কিছু করতে পারি না! এটা তো পরিষ্কার, আমরা নিজেরাই কিছু না করলে এই শহর থেকে আমরা যারা মেকানিকাল পড়েছি তাদের নিশ্চিত নির্বাসন এবং তা হয়তো চিরতরে। আমাদের সারা বছরে কলেজের টিউশন ফি ছিল একশো ষাট টাকা এবং সেটাও আটটা কিস্তিতে দেওয়া যেত। এটা তো সহজ বুদ্ধিতে বোঝা যায়, যে আমরা যে টাকাটা দিয়েছি তাতে কিছুই হয়না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আজ আমরা ইঞ্জিনিয়ার। তাহলে তো সবাই মিলে জলপাইগুড়িতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া আমাদের কর্তব্যও বটে। বন্ধুরা বললো, ‘তুই একবার গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আয়, তারপর প্ল্যান করা যাবে।’
যেই ভাবা সেই কাজ, পরদিন সকালে, তাড়াহুড়ো করে, স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে, ভদ্রলোকের মতো তেলপাটি করে চুল আঁচড়ে, ঠিকঠাক জামা প্যান্ট পরে, আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্প দফতরে গিয়ে হাজির হলাম। শিশুনিকেতনের গলিতেই জ্ঞানদা পন্ডিতের চতুস্পাঠীর পাশেই দপ্তরটি। সাইকেলে উঠলে আর কতটুকু দূর! সরকারি দপ্তর ঠিক যেমন হয়, তেমনই আগোছালো ও কাগজ সর্বস্য। আমার তাড়াহুড়ো করার তেমন বিশেষ প্রয়োজন ছিল না, কারণ অফিসার তখনও আসেননি। উনি যে ঠিক কখন আসবেন তার সম্যক ধারণা কারোরই নেই। না আসলেও যে বিশেষ ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না সেটা তাঁর পিওনের হাবেভাবে স্পষ্ট। সময়কে যে রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো লাঞ্ছিত করা যায় তা নিজের চোখেই দেখে নিলাম। তার ওপর আবার পিওনের বিস্মৃতি শক্তি অপরিসীম। আধ ঘন্টা পর পর আমাকে জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, ‘কাকে চাই? ও, বসতে হবে। সাহেবের তো দেরি হবে।’ কে বলে সাহেবরা দেশ ছেড়ে গিয়েছে!
লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমি ছাড়া আর কোনো দর্শর্নাথী নেই। হয় তারা অভিজ্ঞতাবলে দেরি করে আসে, নয় বুঝে গিয়েছে এখানে এসে কোনো লাভ নেই। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ দেখলাম সাহেব এলেন। অনেক দিনের পরে যেন…
আধ ঘন্টা পর ডাক পড়লো, তখন আমার উৎসাহের ব্যারোমিটারে নিম্নচাপ। দাঁড় কাকের পালকের মতো কালো চুলের জন্য ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের শেষ দিকে না পঞ্চাশের প্রথম দিকে তা অনুমান করা একটু শক্ত। ক্যাটকেটে রঙের জামায় ঢাকা মেদবহুল আত্মপ্রত্যয়ী চেহারা। বোধহয় রোজ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বার স্যার স্যার শুনতে অভ্যস্ত। আমার সামনেই সুরুৎ সুরুৎ শব্দে চা খেয়ে চললেন, আমাকে বলার প্রয়োজন দেখলেন না। অবশ্য আমাকে বললেও আমি খেতাম না, কাপের যা অবস্থা। সাহেব অবহেলাভরে আমার জীবনখাতার পাতাগুলোকে থুতু লাগিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন। জলপাইগুড়ির শিল্পোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উনি ওয়াকিবহাল এবং প্রবল উৎসাহী সেটা একাধিকবার বললেন। ‘তবে হ্যাঁ, বেশি পাওয়ার চাই তেমন পরিকল্পনা নেবেন না, পাস হবে না।’ বেশি পাওয়ার মানে জলঢাকার ঢাকনা খুলতে হয় তেমন কিছু না, চারশো চল্লিশ ভোল্ট দরকার হয় এমন কোনো প্রজেক্ট। বুঝতে পারলাম বড় কিছু করার উদ্যোগটাকে এখানে শুরুতেই শেষ করে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতের টাটার টুপি তো তখনই খসে গিয়েছে। জলপাইগুড়ি শিল্পে অনুন্নত, তাই ব্যবস্থাটা হলো, প্রজেক্টের দশ শতাংশ সরকার দেবে (দেবে মানে অবশ্যই ধার, তবে ব্যাংকের চেয়ে কম সুদে) আর বাকিটা ব্যাংক থেকে ম্যানেজ করতে হবে। সে ম্যানেজমেন্ট তো আর আই.আই.এম-এ শেখায় না বস, জীবনের পাঠশালায় টিউশনি পড়ানো হয়। আমার কল্পনার পাখিটাকে উনি ডানা মুচড়ে দক্ষ হাতে বাজারের থলিতে ভরে, দু’খানা আইডিয়া দিলেন, টায়ার রীট্রীডিং আর ইলেক্ট্রোপ্লেটিং। সস্তায় পুষ্টিকর। হায়রে জলপাইগুড়ি, হায় আমার শিল্পায়নের সাধ। শেষে টায়ারের ঘাট লাগানো আর গিল্টি করা। এইসব আইডিয়া দেওয়ার জন্য সরকারি পয়সায় এইসব সাহেবদের পোষা হয়! আমার উৎসাহের প্রদীপটা একেবারে নিভে না গেলেও দপদপ করছিল। তবুও পরের দিন আমি, কাজল, অমিত তিনজনে মিলে শিলিগুড়ি গেলাম টায়ার রীট্রীডিং আর ইলেক্ট্রোপ্লেটিং কারখানা দেখতে। শিলিগুড়ি কারণ, এই সামান্য কাজগুলোও জলপাইগুড়িতে হয় না। এমনিতে তিন বন্ধুতে মিলে বাসে করে শিলিগুড়িতে যাওয়াটা একটা মজার ব্যাপার হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে মজার জায়গাটায় টেনশনের ছায়া পড়েছে। যখন ছোট ছিলাম তখন মনে হতো বড়ো হলে কত স্বাধীনতা মানে মজাই মজা। স্বাধীনতা এমন সব ভেজাল নিয়ে আসে যে মজাটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ইলেক্ট্রোপ্লেটিং কারখানা, গলির একটা কোণে বারো বাই বারো জায়গা নিয়ে কাজ চলছে আর টায়ার রীট্রীডিং একটু বেশি জায়গা নিয়ে। ব্যাপারগুলোকে কান্ড বলা যেতে পারে, কিন্তু কারখানা নৈব নৈব চ। দক্ষতার দরকার কিছু থাকলেও প্রযুক্তিগত যোগ্যতা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। সাদা ভাষায় আমরা হায়ার সেকেন্ডারী পাস করেই বা না করেও এই কাজটা শুরু করতে পারতাম, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা একেবারে ফালতু! হিলকার্ট রোডের ওপর রঞ্জিত রেস্তোরাঁয় জীবনে প্রথমবার ঠান্ডা দই-এ আলুর পরোটা ডুবিয়ে খেয়ে, ঝংকারে একটা জবরদস্ত নাচ-গান-মারপিটের মুভি দেখে আটটা নাগাদ ঘরের ছেলে ঘরে। পরদিন থেকে আবার স্টেটসম্যান আর দ্বিজেনদার টাইপ মেশিন।
রেজাল্ট যে কবে বের হবে তার কোনও ঠিক ঠিকানা নেই, নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির কোলে একমাত্র একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। কার গোয়াল কে দেয় ধুনো। সেই সময় নরেনভিলায় আমাদের এক আত্মীয় বাড়ির বিয়েতে দেখা হলো আমার লতায় পাতায় সম্পর্কের এক মামাতো দাদার সাথে। দাদা, তবে বয়েসে অনেকটাই বড়ো। বাপ্পাদা অনেক দিন থেকে জলপাইগুড়ি ও পরে বাংলার বাইরে। কত বড়ো হয়ে গেছিস, কী করছিস, পার হয়ে… ‘ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বিশেষ প্রযৌক্তিক জ্ঞান হয় না’ তে পৌঁছালেন। শুনতে হলো, বেকারদের শুনতে হয়।
‘আমাকে দেখ, এতো বছর বাংলার বাইরে আছি, কিন্তু বাংলাটা একদম ভুলিনি’ (তুমি শালা বাংলাটা ঠিক করে শিখলে কবে, যে ভুলবে?)
‘দিল্লিতে বুঝলি তো, খালি ইংরেজি আর হিন্দি।’
(তাহলে তো গুরু তোমার মুখে পুরো সেলোটেপ, কী কষ্ট!)
‘আমি বুঝলি তো ইঞ্জিনিয়ারিং ফিঞ্জিনিয়ারিং পড়িনি, দরকারই হয়নি। তবু আজকের তারিখে আমি দিল্লি ব্রাঞ্চের সেলস ইঞ্জিনিয়ার। নো বডি ক্যান কোয়েশচেন মাই টেকনিকাল ইসে, এক্সপেরিয়েন্স বুঝলি তো এক্সপেরিয়েন্স…’
(ইঞ্জিনিয়ারিং কেন, তুমি শালা দশ ক্লাসের বেশি কিছুই পড়োনি। বাড়ির কাজের মাসির মেয়ের সাথে বাড়াবাড়ি রকমের ঘনিষ্ঠতা করার জন্য তোমাকে জলপাইগুড়ি ছাড়তে হয়, না ছাড়লে তো শালা মাসিকে মা বলতে হতো। শুনেছি শিবপুরের দিকে একটা কারখানায় এমন নেতাগিরি করেছিলে যে কোম্পানি লাটে ওঠার জোগাড়। মালিক পক্ষের সাথে রফা যা হল, তাতে শ্রমিক ভাইদের কী হলো জানা নেই কিন্তু বাপ্পাদা অফিসার হয়ে গেলো)
না, সেদিন এ সব কিছুই বলা তো দূর, মনেও আসেনি। ঐ সময়ে অত শত আমার জানাও ছিল না। তাই খাবার পর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাপ্পাদা যখন আমাকে বললেন, ‘ব্যবসা করবি?’ তখন নাকে গন্ধ লাগছে বলে বিরক্ত হওয়া গেলো না, বরং আমার উৎসাহের প্রদীপটা আবার জ্বলে উঠল।
না টাটা বিড়লা নয়, আমিও অবোধ নই যে বিনাশ্রমে রাতারাতি টাটা বিড়লা হবার কথা ভাববো। (ভাবনাটা একটু গম্ভীর গম্ভীর হলেও) নিষ্ঠা, সততা আর পরিশ্রম দিয়ে কোনও কোনও সিঁড়িকে এসকেলেটার বানানো যায়, এটা আমার অনেক বিশ্বাসের মধ্যে একটা। ব্যাপারটা সংক্ষেপে এরকম, দিল্লিতে ওখলা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এরিয়ার একটি কোম্পানি, নাম নিউ দিল্লি ফাসনার্স, পুরোনো রাশিয়ান যন্ত্র জোগাড় টোগার করে নাকি অবিকল পি.ডব্লু.এফ-এর মতো নাট বোল্ট বানিয়েছে। কোম্পানির মালিক পবন ট্যান্ডন, বাপ্পাদাকে গুরুর মতো ভক্তি করে, আর করবে নাই বা কেন, ইত্যাদি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো বাপ্পাদা পি ডব্লু এফের দিল্লির মার্কেটিংয়ে কাজ করেন, তাই কাস্টমারদের জানেন। বাপ্পাদা দিল্লিতে বসে সারা ভারতে সেই অভূতপূর্ব প্রোডাক্ট পাঠাবেন, এই উত্তরবঙ্গের বাজারে সেগুলো আমি মার্কেটিং করব। এই জলপাইগুড়িতে তো যন্ত্রপাতির বিশেষ ব্যবসাপত্র হয় না, তাই উত্তরবঙ্গ বলতে প্রধানত শিলিগুড়ি। একটা ছোটো ব্যাপার, আপাতত কাজটা রিমা বৌদি অর্থাৎ বাপ্পাদার স্ত্রীর নামে চলবে, অফিসের ইয়ে আর কী, এতে আর আপত্তির কী থাকতে পারে। আমার কমিশন শতকরা তিন ভাগ। জাগো বাঙালি, তোমার উন্নতির কলিং বেলের আওয়াজ শোনো, আলসেমি করোনা, দরজা খোলো। ভাবলাম এই কমিশনের ব্যবসাটা করে যদি কিছু অভিজ্ঞতা আর পয়সা হয় তবে ধীরে ধীরে আমরা সবাই মিলে নাট – বোল্ট বানানোর কারখানার কথা ভাবা যেতেই পারে। তবে প্রথমে ছোট করে শুরু করতে হবে, তারপর…
এইসব আবেগের হাওয়া পালে ভরে নিয়ে আমি কদমতলা থেকে সকাল সাড়ে আটটার মিনিবাসে চললাম শিলিগুড়ি। জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ি মিনি বাসে একঘন্টা সোয়া ঘন্টা মতো লাগে। বাপ্পাদা যাবার আগে আমাকে কয়েকটা কাগজপত্র দিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো বারবার করে পড়তে পড়তে চললাম। কখন যে ফাটাপুকুর, তিন বাত্তির মোড় পেরিয়ে গেল খেয়ালও করলাম না।
একটা লিস্ট বাপ্পাদাই দিয়ে গিয়েছিলো। তাতে শিলিগুড়ির কিছু হলেও হতে পারে কাস্টমারদের নাম ঠিকানা দেয়া ছিল। বাপ্পাদা তার পি ডব্লু এফের কাস্টমার লিস্ট আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। এখন তার নকলটাকে বাজারে ছাড়ার কাজটা আমার। লিস্ট মতো, শিলিগুড়িতে আমার প্রথম গন্তব্য মহাদেব এন্টারপ্রাইজ, মহানন্দা রোড। দোকানই বলবো, একটু বড়ো, একপাশে একটু অফিস মতো, মানে টেবিল চেয়ার পাতা। দোকানের জিনিসপত্র বেশ সাজানো গোছানো, পিছে এক চেন কোম্পানির ক্যালেন্ডারে কান মাথা গরম করা একখানা দুর্ধর্ষ ছবি। তাকাতে অস্বস্তি হয়, আবার না তাকিয়েই বা উপায় কী! মালিক ভদ্রলোক অবাঙালি, বয়স চারের ঘরে, ধুসর রংএর সাফারি পড়া, ফোনে কথা বলে যাচ্ছিলেন, তো বলেই যাচ্ছিলেন। আমাকে ঠিক দেখেও দেখছিলেন না। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার আকাশচুম্বী আত্মপ্রত্যয় তখন নড়বড় করতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছি না। ঠিকঠাক জামাজুতো পরে এসেছি, ঢোকার আগে অবাধ্য চুলকেও শাসন করেছি। তাহলে এমন অবজ্ঞা কেন? বেচারামদের বোধহয় মুখ দেখেই বোঝা যায়, নয়তো অবাঙালি দোকানে ভদ্রসদ্র জামাকাপড় পরে গেলে, সাধারণত ‘আসুন-বসুন কী চাই’ টা করে। নাকি নাট বল্টুর ব্যবসা করতে করতে এই ইয়েটার ভদ্রতা সভ্যতা…
ফোন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উনি আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিপাত করলেন। যোগাযোগের ভাষা নির্ধারণ করতে আমার একটু সময় লাগলো। উনি বাঙলায় যখন ব্যবসা করছেন, তখন বাঙলা অবশ্যই জানেন। হতেই পারে একাধিক পুরুষানুক্রমে এখানেই আছেন। তবে যেহেতু এক্ষেত্রে ব্যবসাটা আমাকে করতে হবে তাই ওনার পছন্দ অর্থাৎ হিন্দি বলাটাই বিধেয়। সাধারণ বাঙালির তুলনায় আমার হিন্দিটা ভালোই বলা যায়। তাই হিন্দিতে জানালাম, আমি নিউ দিল্লি ফাসনার্স নামক একটি কোম্পানির অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ফসল শিলিগুড়ির গুণবত্তা সচেতন উপভোক্তাদের সামনে প্রস্তুত করতে চাই। পুরো ভাষণটা যে দিতে পারিনি সেটা বলাই বাহুল্য। নিখুঁত নিমপাতা খাওয়া মুখ করে আমার বাক্যস্রোতে বাঁধ দিয়ে জানালেন, নিউ দিল্লি ফাসনার্স এমত কোনো সংস্থা সম্বন্ধে উনি কখনও কিছু শোনেন নি (সে আর নতুন কথা কী, দিন তিনেক আগে আমিই কী ছাই শুনেছিলাম!) আর আপাতত শোনার কোনও ইচ্ছেও নেই, তাই আমি এখন আসতে পারি। অভদ্রতাকে যে পেশাদারী আচরণের বেনামে চালানো হয় সেটা জানা ছিল না বলে একটু আহত হলাম। বাপ্পাদা বলে গিয়েছিল, ‘এ দুনিয়ার সব কেনা যায় সব বিক্রি হয়। বেচতে শিখতে হবে আর সেই শেখাটা অনেক ধাক্কা খেয়েই শিখতে হবে।’ বলা সহজ, কিন্তু করাটা যে ততটা নয় সেটা বুঝতে বুঝতে দুপুর দুটো। ব্যবসার নামে লবডঙ্কা, পেটে ছুঁচোর ব্যায়ামলীলা। আর যাদের দোকানে ঢুঁ মারলাম, তাদের আচরণও বিশেষ নয়, ইতরই বলা যায়। মনে তীব্র অভিমান, আয় করিনি, খাবার জন্য খর্চা করি কোন মুখে! ইতিমধ্যেই বাস ভাড়ার জন্য খরচ হয়ে গিয়েছে, ফেরার সময় আবার হবে। সেদিনের মতো শেষ গন্তব্য মহাবীর হার্ডওয়ার, হিলকার্ট রোডের মুখে। যেমন আশঙ্কা করা গিয়েছিল তার থেকে বিশেষ আলাদা নয়। দোকান পরিষ্কার হলেও এলোমেলো করে সাজানো। ঢালা গদি পাতা, তাতে সাদা পরিষ্কার বেডকভার, পিছে গন্ধমাদন পর্বত হাতে হনুমানের ছবিতে মেটে সিঁদুর লেপা এবং দোকানের মালিক এক বৃদ্ধ মারোয়ারি। কপালে লাল চন্দনের সরু তিলক আবছা হয়ে এসেছে, আধঘুম চোখে তাকিয়া ভর দিয়ে আধশোয়া। ভাবলাম ফিরে যাই। বয়স্ক মানুষের নিদ্রাচেষ্টায় ব্যাঘাত করে, বিরাগ ভাজন হয়ে কি লাভ! সকাল থেকে যা চলেছে তাতে বেশি কী আর হবে!
ভদ্রলোক নিজে সোজা হলেন, আমাকেও বসতে বললেন। আমি হিন্দিতে শুরু করে দিলাম, ‘আমি নিউ দিল্লি ফাসনার্স নামক একটি কোম্পানি…’
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘বাংলায় বোলতে পারেন, আমার অসুবিধা নাই।’
আমাকে আর পায় কে। অভয় পেয়ে আমি কোল্ড ফোর্ডজ নাট সম্বন্ধে হই হই করে বলতে থাকলাম।
উনি সবটা শুনলেন, আরেকটু হেসে বললেন, ‘তো কী হলো!’ আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ‘শুনেন, আপনি যা বলছেন তাতে আপনার কাস্টোমার ইন্টারেস্টেড নাই। আপনার কাস্টোমার কি জানে আপনি নাট হট ফোরজিং করলেন কি কোল্ড? আপনার কাস্টোমার কী দেখে জানেন? নাট থ্রেড তার সাথে দাম, ডেলিভারি ব্যস। আইটেম বেচতে হলে আপনাকে প্রোথোমে জানতে হবে আপনার কাস্টোমার কী চায়, বুঝলেন কী। ভালো কোথা, আপনি পড়াটা কী করলে মিস্টার চ্যাটার্জি? মানে হোলো আপনি কী ইঞ্জিনিয়ার আছেন? ডোন্ট মাইন্ড, এটা আপনার বিজনেস না।’
একজন অল্প পরিচিত লোককে যতটা বলা যায় বললাম। জানলাম ওনার ছেলে যাদবপুর থেকে ইলেকট্রনিক্স-এ বি.টেক পাস করে আমেরিকায় চাকরি করছে। উনি স্যাম্পেল দেখলেন, ‘এ প্রোডাক্টটা পি.ডব্লু.এফ-এর ডুপ্লিকেট, এসব ডুপ্লিকেটেরও মার্কেট আছে। কিছু পার্টি সস্তার মাল কিনে। আপনাকে আমি অর্ডারটা দিবো। বুঝে নিয়ে অর্ডারটা বুক করে নিন, তবে আবার বলছি, এ কাজটাতে বেশি দিন থাকবেন না।’
কী মনে করে আমার কারখানা বানানোর স্বপ্নের কথাটাও বলে ফেললাম। উনি মাথা নাড়লেন।
‘জলপাইগুড়িতে নাট বানাবেন? জলপাইগুড়িতে ইস্টিল কোথায় যে আপনি কারখানা বানাবেন? ওহী বানাবেন, যেটার র’মেটিরিয়াল লোকালি এভেলেবুল।’
যাহোক, সব মিলে আটত্রিশ হাজার টাকার মতো অর্ডার। কলেজে ক্যালকুলেটার ব্যবহার করে করে অভ্যাসটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে, তাই আমার কমিশনটা কত হলো তা হিসেব করতে একটু সময় লেগে গেলো। খরচ বাদ দিয়েও হাজার টাকার বেশি। মহাবীর হার্ডওয়ারের কাজ মিটিয়ে রাস্তার এক দোকানে পাঁঠার ঘুগনি দিয়ে পাউরুটি খেতে খেতে ঠিক করলাম, আমার আত্মকথায় (লেখাতো একদিন হচ্ছেই), এই দিনটা নিয়ে বেশ ক’পাতা লিখতে হবে। ঘুঘনিটা বেশ ঝাল। ফাটা ঠোঁটে ধরছিল, ওসব তুচ্ছ ব্যাপারে তখন পাত্তা দেবার সময় কোথায়! আর যে যে শালা নাট বোল্ট নিয়ে ফালতু খিল্লি করেছে, তাদের দেখে নেওয়া আছে।
আমি যে বেশ রোজগেরে হয়ে উঠেছি, বন্ধু বান্ধবরা সেটা জেনে বলল, ‘গুরু সোসাইটিতে একদিন মাটন কবিরাজি নামিয়ে দাও।’ মা ও বললেন, ‘যোগামায়া কালীবাড়িতে একটা…’
বাপ্পাদা খুব একটা পাত্তা দিতে চাইলেন না। ‘এ তো কিছুই না রে, লড়ে যা, লাখখানেক টাকার বিজনেস আন, তবে না…’
এরপরও কিছু অর্ডার পেলাম, পাঁচ হাজার, আট হাজার এরকম। বাপ্পাদার আশা মতো ব্যবসা হচ্ছে না। বাপ্পাদা আমাকে আবার অলস উদ্যোগহীন ভাবছে না তো! কমিশনের টাকা যদিও কিছু হাতে আসেনি, তবে কমিশনের টাকাতো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। একদিন সুষমা এন্টারপ্রাইজ, মাদারীহাট থেকে ডাক এলো, মালে ডিফেক্ট। বাপ্পাদা বললেন, ‘এসব টেকনিক্যাল ঝামেলা যদি নাই সামলাতে পারিস, তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে লাভটা কী!’ যেতে হলো, কথা শুনতে হলো। আমি যে দুনম্বরি কোম্পানির দুনম্বরি মাল বেচি, সেটা কানে মধুবর্ষণ করলো না।
সেদিন সকালে চামচের উল্টো দিকটা দিয়ে একটু পুড়ে যাওয়া পাউরুটিগুলো ঘষে জলখাবারের যোগ্য করে তুলছিলাম। বাবা চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বাবা আমাকে বললেন, ‘জানিস কী, সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে, “অনাহূত: প্রবিশতি, অপৃষ্ঠ বহুভাষতে, অবিশ্বস্তে বিস্বাসিতি মূঢ়চেতা নরাধম। সাদা ভাষায় যার অর্থ হলো, যারা না ডাকতেই যখন তখন আসে, বিনা প্রশ্নেই অনর্গল বকে আর বিশ্বাসের অযোগ্যকে বিশ্বাস করে, তারা বোকা হাঁদা ছাড়া কিছুই না। তুই এর মধ্যে পড়ছিস না তো!’
ক্রমশ
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (একাদশ কিস্তি)
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (দশম কিস্তি)
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (নবম কিস্তি)
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (অষ্টম কিস্তি)
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (সপ্তম কিস্তি)