কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (একাদশ কিস্তি)

বৃষ্টির শুরুতেই সামান্য ঠান্ডা পড়তে শুরু করলো। ক্লাবে লোক আসা একটু কমলো। বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে দেখি শোভা বসে আছে। শোভা খেলে টেলে না, আড্ডা মারতে আসে।

‘গায়ে সোয়েটার দাওনি কেন, ঠান্ডা লেগে অসুখ করলে বুঝবে।’ বিশেষ কিছু না ভেবেই বলেছিলাম। 

‘তুমি বলার কে? আমার অভিভাবক?’ শোভা খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো।

‘অভিভাবক! অভিভাবক কেন হতে যাবো?’ আমি তো অবাক! কী হলো রে বাবা! ‘সেভাবে ভাবলে তো ঠিক মতো বন্ধুও নই। তাও মানলাম, কিন্তু সহকর্মী তো বটে নাকি তাও নয়?’

‘নিজেকে কী ভাবো, হিরো? মেয়েরা তোমাকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যাবে, মোহনলাল না কমল হাসান?’

স্কুলে থাকতে কাগজ কলমে যুদ্ধ জাহাজ বলে একটা খেলা খেলতাম। পরে টিনটিনের কমিক্সে দেখেছি ঠিক মনে থাকলে ফ্লাইট ৭০১। দুজনে খেলে, একজন একবারে তিনটে করে টর্পেডো ছোঁড়ে। শোভার একটা টর্পেডোও বাইরে পড়ছিলো না। আর আমি আনাড়ির মতো বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হলোটা কী? লোকজন অল্প থাকলেও একদম ফাঁকা নয়। বিশ্রী লাগছিলো।

‘এমন হাস্যকর ধারণা আমার হতে যাবে কেন? নিশ্চয়ই আজ বসের ঝাড় খেয়েছো, তাই আমার উপর লাফাচ্ছো?’

‘আমার সম্বন্ধে বন্ধুদের কাছে বড়াই করার আগে আমিও যে সেসব কথা জেনে যেতে পারি তা বোধহয় ভাবোনি, না কি তারও পরোয়া করো না?’

‘কে কী বলেছে আর তুমি যে কী শুনেছো তা তো তুমিই জানো। তবে তোমাকে আমি বুদ্ধিমতী মনে করে আলাপ করেছিলাম। এখন তো দেখছি আমার সে ধারণা সঠিক নয়। যে না জেনে শুনে অন্য লোকের কথা শুনে নাচে, সে আমার কলীগ হলেও বন্ধু হতে পারে না।’

***

আমি রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকলাম করকে চেপে ধরার জন্য। ‘তুই কী বলেছিস শোভাকে? কিছু তো বলেছিস।’

‘বলব কী করে? শোভার সাথে কথা বলার সুযোগটা পেলাম কখন? শোভা আমাকে কেমন যেন …’

‘তাহলে ইলেক্ট্রিকালের কাউকে তো কিছু বলেছিস, সত্যি বল।’

‘বন্ধুদের নামে আড়ালে নিন্দা করার ছেলে বিপদভঞ্জন নয় বুঝলি। আমি তো রামালুর কাছে তোর প্রশংসা করে বললাম, চ্যাটার্জিকে ফালতু ভেবো না, ও হেব্বি জিনিস। তোমাদের ওই শোভা ফোভাকে তুলতে ওর পাঁচ মিনিটই কাফি।’

***

প্রতি মাসেই আমাদের একবার করে স্থানীয় বড় বসের ঘরে হাজিরা দিতে হয়, আমরা ঠিকমতো শিখছি কিনা সেটা দেখাই এর মহান উদ্দেশ্য। মাইনসের বস ডঃ গিরি, উড়িষ্যার লোক, জিওলজি নিয়ে পড়াশুনো।

‘মাইনসের শভেল দেখেছো?’ আমি বসার আগেই শুরু করে দিলেন। 

শভেল মাইনসের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু। মাইনসে যেখানে যেখানে ব্লাস্টিং করা হয়ে গেছে তেমন চার জায়গায় চারটে বসানো আছে। ওটাতে করে লোহার আকর একশো বিশ টনের যে বিশাল বিশাল ডাম্পারগুলো আছে তাতে ভর্তি করা হয়, তারপর সেই আকর যায় ক্রাশারে। গত পনেরো দিন ধরে তো এসবই দেখেছি। মাথা নাড়লাম।

‘শভেলের বাকেটটা কত বড় জানো?’

জানা ছিল, একুশ দশমিক সাত মিটার কিউব। বলতেই খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে বললেন, ‘মানে বোঝো? একটা পুরো জীপ গাড়ি ওর ভিতর ঢুকে যাবে।’

শোনা ছিল মাইনসে গত বছর একটি হিন্দি ছবির শুটিং হয়েছিল, যাতে ওরকম একটা রোমাঞ্চকর দৃশ্য ছিল। আরও শুনেছি সেই সিনটায় নাকি ডঃ গিরিকে একটু দেখাও গিয়েছে।

‘ব্যাবকোর টায়ারে দাম জানো।’ একশো বিশ টন ডাম্পারগুলো এখানে ওই নামেই পরিচিত। তার টায়ার কিনতে তো আপাতত যাচ্ছি না, জানার কথা নয়, কথা প্রসঙ্গে শুনেছিলাম এক লাখ। উত্তর পেয়ে আরও বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘টায়ারের প্রেশার কত রাখা উচিত?’

‘সত্তর থেকে আশি পি. এস. আই।’

‘সত্তর থেকে আশি বললেই চলবে? দশ পি.এস. আই এর তফাৎ, কী বিরাট ব্যাপার বোঝো কিছু?’

মোটেই তা নয়, কিন্তু ততক্ষণে বুঝে গেছি উনি সকাল থেকে আমাদের ওপর জিভের সুখ করবেন বলে তৈরি হয়ে এসেছেন, তাতে বাধা হওয়াটা কোনও কাজের নয়।

তারপর মিনিট কুড়ি যা বললেন তার সারাংশ হচ্ছে, উনি কুদ্রেমুখে এসেছেন প্রায় সম্পৎ আয়াঙ্গারের পরে পরেই। ওনার আত্মত্যাগ ও বলিদানের ফলে আমরা সব করে খাচ্ছি, সেটা যেন কখনোই না ভুলি।

ক্রাশার, সাইলো, মাইনস সার্ভিস ইত্যাদি বিভাগে ট্রেনিং শেষ করে আমরা এলাম আসল প্ল্যান্টে।

বেনিফিসিয়েশন প্ল্যান্টের নাম রাখা হয়েছে কনসেন্ট্রেটর। লোহার আকরের কৌলিন্য বাড়াতে এখানে বিশ্বসেরা যন্ত্রপাতি লাগানো হয়েছে, ঘন্টায় তিন হাজার টন আকর গুঁড়ো করে, ছেঁকে, নানা পদ্ধতিতে পরিশ্রুত করে দেড় হাজার টন মত জল মেশানো জাত আকর পাওয়া যায়, আর বাকিটা লাকিয়া নদীর ওপর তৈরি বিশাল মাটির বাঁধে গিয়ে জমা হয়।

এখানে আমার কাজ দু’জনের নীচে (শুনতে খারাপ লাগলেও কঠোর বাস্তব)। একজন ডেপুটি ম্যানেজার ডি. রমেশ আর অন্যজন ম্যানেজার কে. সী. রাও। রাও তখনকার দিনের রেডিও জকি ছিলেন। টেনে টেনে অনর্গল বকে বাজার এবং ওয়াকিটকি গরম রাখতেন এবং সবার কথার মধ্যে নাক গলাতেন।

একদিন রমেশ আমাকে ব্যস্ত হয়ে ডেকে পাঠালো। রমেশের এক অভ্যেস। সব কথাই হাসতে হাসতে বলে।

‘খুব ব্যস্ত?’

‘ওই বল মিলের লাইনার পাল্টানো হচ্ছে তাই দেখছিলাম।’

‘তা দেখো, ভালো কথা। কিন্তু এতটা ব্যস্ত হওয়াও তো কাজের কথা নয় যে বাড়িতে একটা কুশল সংবাদও দিতে পারো না। দেখো তোমার বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে, ‘চিঠি নেই। চিন্তিত। মা।’ যাও এক্ষুনি গিয়ে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে এসো।’

লজ্জা পেলাম। আমার মাকে চিঠি দেবার কথাটা তৃতীয় ব্যক্তির কাছ থেকে শোনাটা মোটেই গৌরবের নয়। শিফট টিফটের ঝামেলায় নিয়মিত চিঠি লেখা হয় না। চিঠি লিখলে উত্তর পেতে কম করে দশ দিন, তাই চিঠির উত্তরের অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যায়। এখানে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বলতে এক খবরের কাগজ, দুই রেডিও। টি.ভি আসে না, ফোনে চেঁচিয়ে মেচিয়ে ম্যাঙ্গালোর ব্যাঙ্গালোর কথা বলা যেতে পারে কিন্তু কলকাতা নয়। আর জলপাইগুড়ি তো একেবারেই না। মুখার্জীদার উদ্যোগে দেশ পত্রিকা কদিন দেরি হলেও আসে। ক্লাবে গিয়েও শান্তি নেই। প্ল্যান্ট আর কোম্পানি ছেড়ে অন্য বিষয়ে কথা খুব কম লোকেই বলে। সদা সর্বদা প্ল্যান্টের উন্নতির চিন্তা না করলে যে সাম্বার হজম হবে না, সেটা সবার হাবে ভাবে পরিষ্কার। তাছাড়া বয়স্কদের মধ্যে কেউ কেউ ফ্ল্যাসব্যাকে বিরিঞ্চি বাবারও ওপর দিয়ে যায়।

প্ল্যান্টে সর্বত্র আকর মিশ্রিত কাদা। অবিরাম ব্যবহারের ফলে আমার গাম শু-র তলায় ফুটো হয়ে বিশ্রী অবস্থা। এখানে সময়ের আগে জুতো খারাপ হয়ে গেলে নতুন জুতো পেতে ম্যানেজারের অনুমোদন চাই। বিনীত ভাবে আমার করুণ অবস্থা বর্ণনা করে ম্যানেজারকে একটা আবেদন পত্র দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আবেদন নাকচ হয়ে ফিরে এলো। পরের দিন ভালো করে দুই জুতোতে কাদা ভরে ম্যানেজারের চেম্বারে দরজা থেকে কাদা ছেটাতে ছেটাতে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কাদার পরিমাণ দেখে রাও আঁতকে উঠতেই, আমি সরি স্যার বলে বিশ্রীভাবে জুতো জোড়া খুলে আরও কিছুটা কাদা ছেটালাম। তারপর খালি পায়ে লক্ষ্ণীর পা আঁকতে আঁকতে ওনার দিকে এগোলাম। আলুসেদ্ধর মতো মুখ করে জানালাম, ‘আমি খুব দুঃখিত স্যার, জুতোটা আগে ফুটো হয়ে যাওয়াতে এই বিপত্তি।’

‘জানো গাম শু গুলো সব ডাকব্যাকের, তার মানে কলকাতায় তৈরি। তুমি কলকাতার লোক হয়ে কলকাতায় তৈরি জিনিসের বদনাম করছো।’

রাও আমাকে জানালেন আমার মতো স্বজাতি বিদ্বেষী বাঙালি তিনি আগে কখনো দেখেননি। আরেকজন বাঙালি যে আছে, কী যেন নাম হ্যাঁ কর, কই করের জুতো তো খারাপ হয়নি। তার সোজা অর্থ অসুবিধে জুতোতে নয় আমার পায়ে আর তার জন্য আমি কিনা কলকাতায় তৈরি জিনিসকে খারাপ বলছি। উনি বাংলা বুঝতে পারেন, তবে বলতে পারেন না। ওনার আগের কোম্পানির বস বাঙালি ছিলেন, মাছের ঝোল মাছের ঝাল সব জানা আছে ইত্যাদি। এরপরও আমি কিন্তু নতুন গাম শু পেলাম না। শেষে প্ল্যান্টে দামি লিনোটেক্স রবার দিয়ে দুজন লোক লাগিয়ে আমার জুতো সুন্দর মেরামত হয়ে গেল, তবে খরচটা হয়তো নতুন জুতোর চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি হলো এই যা।

ডি. রমেশ একদিন ডেকে বললেন, ‘চ্যাটার্জি, তুমি নাকি রাও সাহেবের ঘরে কাদা ছিটিয়ে বিপ্লব করে এসেছো?’

‘কাদা ছেটাতে যাবো কেন? ফুটো জুতো, প্ল্যান্টে কাজ করলে পায়ে কাদা তো লাগবেই। তা স্যার আপনি জানলেন কী করে?’

‘কারোর জানতে বাকি নেই, এসব কথা চাপা থাকে না। জি.ই.টি. পিরিয়ডে বেশি খবরে না আসাই ভাল।’

‘ঠিক আছে স্যার আপনিই বলে দিন খবরে না আসার জন্য আমার ঠিক কী কী করা উচিত? একটা বছর না হয় বোবা কালা হয়ে থাকবো, আর কিছু…’

‘চ্যাটার্জি তুমি কাজের ছেলে কিন্তু একটু বেশি ছটফটে। খরগোশ আর কচ্ছপের দৌঁড়ে সব সময় কচ্ছপ জেতে কেন জানো? কচ্ছপ শান্ত ধীর আর খরগোশ খুব ছটপটে। লাফালাফি করে কত বছর বাঁচে খরগোশ, মাত্র দশ বছর। আর শান্তিতে থেকে কচ্ছপ একশো দেড়শো বছর বেঁচে থাকে। এই পাবলিক সেক্টরে বেঁচে থাকতে জানতে হয় আর সেই জানাটা খুব জরুরী।’

error: Content is protected !!