কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (অষ্টম কিস্তি)

আমার মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে বিপদভঞ্জন দুঃখ দুঃখ মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেড়ে দিলো?’

‘কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে বলল।’

‘বেঞ্চ কোথায়?’

অন্য সবাই নিজেদের মধ্যে পরিচয় করতে ব্যস্ত থাকলেও মেয়েটি একা বসে কাগজে কিছু লিখছিল। ওকে দেখিয়ে বিপদভঞ্জন নিচু গলায়, গণেশ পাইকে জ্ঞান দিচ্ছিল, ‘তামিল, দেখেই বুঝতে পারি। ভীষণ রক্ষণশীল হয়। পরিচয় করবেই না। আমি জানি, ছ’বছর আমি ওখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েছি।’

‘ছ’বছর! কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং তো চার বছরের কোর্স!’

গায়ের রং শ্যামলা, কোঁকড়া চুল, রোগা চেহারা, কালো গভীর চোখ। শান্ত ভাবলেশহীন মুখ। যেন এ মুহূর্তে এখানে থেকেও নেই।

আমি মেয়েটির সামনে গিয়ে ‘হাই’ বলতেই ও মুখ তুলে তাকালো।

‘আমার নাম চ্যাটার্জি, শান্তনু চ্যাটার্জি।’ (তখন রজার মুর চলছে)

‘আমি মেনন শোভা।’ গলার স্বর ধীর কিন্তু দৃঢ়।

‘বাড়ি জলপাইগুড়ি, উত্তরবঙ্গ।’

‘আমি কালিকট থেকে কেরালা, ঈশ্বরের নিজের দেশ, ম্যাঙ্গালোর থেকে প্রায় ঘন্টা চারেকের রাস্তা।’

‘কালিকট বন্দর শুনেছি ভাস্কো ডা গামা এসেছিলেন।’

‘তাহলে আমি একটু দুঃখিত, কারণ আমি জলপাইগুড়ির নাম কখনো শুনিনি।’

বসন্তরাজ ভাট, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। আটমাস আগে মাইনসে এক দুর্ঘটনার পর ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টে এসেছেন। ওই দুর্ঘটনায় কী করে বেঁচে ফিরলেন, তা নিয়ে এখনো গবেষণা হয়। উনি এসে এক এক করে সবার পরিচয় জানলেন। ওনার প্রশ্ন করার ধরনে ভালো হোমওয়ার্কের ছাপ স্পষ্ট। নাম, ধাম, কলেজ ছাড়াও সবাইকে কোনও এক বিষয় দিয়ে তার ওপর বলতে বললেন। আমি জলপাইগুড়ির থেকে বলে ভেবেছিলাম প্রশ্নটা টী, টোব্যাকো আর টিম্বারেই সীমাবদ্ধ থাকবে। একটু বাইরে গেলে দার্জিলিং। আমাকে অবাক করে জিজ্ঞেস করলেন নকশালবাড়ির কথা। নকশালবাড়ি ফাঁসি দেওয়া, জায়গাগুলো ধুলাবাড়িতে বিদেশি জিনিস কিনতে গিয়ে দেখেছি, অন্য রকম কিছু তো লাগেনি। নাকি আসলে জানতে চাইছেন নকশাল আন্দোলনের কথা। নকশাল আন্দোলন বলতে কী বলবো? ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষার দিন অমিতাভদাদের স্কুল লাইব্রেরীতে আগুন লাগানোর কথা, না সুভাশিসদাদের স্কুল এসেমব্লীতে জনগনমনকে বুর্জুয়া সংগীত বলে থামিয়ে, ‘আমরা নতুন প্রাণ, গাই লাল পিকিং-এর গান,’ গাওয়ার কথা। রাহুত বাড়ির গলিতে চোখের সামনে ফণীন্দ্রদেবের হেডমাস্টার মশাই-এর খুন হতে দেখার কথা, নাকি পুলিসের মারে স্কুলে সবচেয়ে ভালো ছাত্র নীলমনিদার দলা পাকিয়ে যাওয়া শরীরটার কথা।

পড়া কথা মনে ছিল, ‘ইট ওয়াজ দা ক্লাস স্ট্রাগল অব দা পীসান্টাস’ ইত্যাদি, কে কতটা নিল জানি না, আমি মুখ লাল করে বসে পড়লাম।

বিপদভঞ্জনের ভাগ্যে এলো দুর্গাপুজো, ‘দুর্গাপুজো স্যার মানে বিশাল পুজো স্যার, বিশাল সব ব্যাপার, মা দুর্গার স্যার দশ হাত, সঙ্গে ফ্যামিল, অসুর, পুরো স্যার মারামারি। প্যান্ডেল, লাইট, খাওয়া দাওয়া হই চই কান্ড। ভীষণ ভিড় স্যার, আমাদের পাড়ায় সাত আটটা পুজো হয়… ইত্যাদি।’

দুপুরের পরে আমাদের থাকার জায়গা ঠিক হলো, সেক্টর ফোরের একটা সী ফ্যামিলিতে আমরা তিন জন, আমি, কর এবং সিং। আপাতত এতজনের জন্য ব্যাচেলর্স কোয়ার্টার খালি নেই, তাই কিছুদিন এরকম করে ভাগাভাগি করে থাকতে হবে। সিং-এর পুরো নাম সূরযভান সিং, জাতে রাজপুত এবং প্রথম পরিচয়েই সেটা জানাতে পছন্দ করে। রাজপুত বলতে যদি তলোয়ার হাতে দশাসই চেহারা বোঝায়, সূরযভান মোটেই সে রকম নয়। পাঁচ আট লম্বা, শক্ত পোক্ত চেহারা, ফর্সা। কর আমাকে চুপিচুপি বলে গেলো, ‘আমরা দু’জন বাঙালি, ও একা, খাওয়া দাওয়া সব আমাদের মতই করবো।’ ঢুকেই একটা বড়সড় বসার ঘর। তবে শোয়ার ঘর দুটো, একটা বিপদ ভঞ্জন কর দখল করল, অন্যটা আমি আর সূরয। করের নাকি চিরদিনই একা একা শোয়ার অভ্যেস, কারোর সাথে এক ঘরে থাকার কথা ভাবতেই পারে না। সূরয বোকা বোকা মুখ করে বলল, ‘তোর বিয়ের পর মুশকিল হবে না?’

কর অবাক, ‘বিয়ে তো আমি ম্যানেজার হবার পরেই করবো, ততদিনে তো কোয়ার্টার বড় হবে, মাইনে অনেক বেড়ে যাবে।’

()

আমাদের কোয়ার্টারগুলোকে ইংরেজিতে বলা হয় সেমি ফার্নিসড, পাতি বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, শুধু আলো এবং পাখা লাগানো আছে। সব ঘরগুলো পুরোই ফাঁকা, কথা বললে প্রতিধ্বনি হয়। কর ধরদাকে ম্যানেজ করে নিজের ঘরে একটা খাট পাতলেও, আমরা দুজন জমিদার হয়েই রইলাম। সিং তো আমার ওপর এক কাঠি। বিছানায় বসে ভাত খাওয়ার পার্টি। তাই আমাদের ঘরটা উদ্বাস্তু কলোনি হয়ে রইলো। স্বীকার করতে হবে কর নিজের ঘর আমাদের তুলনায় যথেষ্ট সাফ সুতরো রাখতো, ‘মিশনের শিক্ষা বস, আলাদা তো হবেই।’ এমনকি প্রতি শনিবার রাতে মদ্যপান করে ঘর ভাসানোর পরদিন নিজের হাতে ঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিতো। বেশ একটা পবিত্র পবিত্র ব্যাপার। মিশনের শিক্ষা।

কুদ্রেমুখে শহরটা পাহাড়ের কোলে। পাহাড়টা সমুদ্রতল থেকে হাজার তিনেক ফীট উঁচুতে। সে জন্য স্বাভাবিক নিয়মে ঠান্ডা। পুরো শহরটা মোটামুটি চারটে অঞ্চলে ভাগ করা, যাকে সেক্টর বলা হয়। প্রত্যেক সেক্টরের একটা করে ছোট বাজার আছে যেখানে রোজকার দরকারি জিনিস পাওয়া যায়। তাছাড়া কুদ্রেমুখে দুটো বড় বাজারও আছে, বড় কথাটা আপেক্ষিক। তাই ফ্রিজ, টিভি, স্কুটার জাতীয় বড় কিছু যদি কিনতে হয় তবে ম্যাঙ্গালোর যেতে হবে। তিন পাহাড়ের তিন মাথায় মন্দির, মসজিদ আর গীর্জা। পাহাড়ি পথের নিরিখে সুন্দর চওড়া রাস্তা। কোম্পানির তরফ থেকে নিয়মিত দেখাশুনো করা হয়। রাস্তায় কোথাও খানা খন্দ নেই। পার্কের সামনে অনেকটা জায়গা নিয়ে তিনতলা সেই সহ্যাদ্রি ভবন, সেখানেই গেস্ট হাউস, রেস্তোরাঁ, ক্লাব। কুদ্রেমুখের পার্কটা বেশ বড় এবং সুন্দর। প্রচুর গাছপালা, পাখি, খরগোশ, হরিণ, রঙিন মাছ কত কী…পার্কের ভিতর দিয়ে ভদ্রা নদী বয়ে গেছে বলে সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে। এই ভদ্রা নদীর জন্ম কুদ্রমুখের কাছেই গঙ্গামুলাতে। কুদ্রমুখ, ভদ্রাবতী হয়ে সিমোগার কাছে গিয়ে তুঙ্গার সাথে মিলে তুঙ্গভদ্রা হয়ে যায়। শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের সৌজন্যে, তুঙ্গভদ্রা নদীটি আমার মতো বাঙালির কাছে যত না ঐতিহাসিক তার চেয়ে অনেক বেশি রোমান্টিক।

প্রথম দুই সপ্তাহ আমাদের ক্লাস রুম ট্রেনিং চলল, আমাদের উনিশ জনের সাথে সাথে আরও জনা সাতেক যোগ দিল। এই সাত জন কর্ণাটকের বিভিন্ন কলেজ থেকে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। পাঁচজন ছেলে, দুটি মেয়ে। রোজ সকাল থেকে বিকেল, নানান বিভাগীয় প্রধানরা এসে নিজেদের কাজের কথা বলতেন। একেক জন একেক ধরনের, তবে ধীরে ধীরে কুদ্রেমুখের কাজ কারবার সম্বন্ধে ধারণা হতে শুরু করল। কুদ্রেমুখ কিন্তু আবিষ্কার হয়েছিল সেই ১৯১৩ সালে। সম্পত আয়াঙ্গার নামে এক চৌত্রিশ বর্ষীয় সহকারী ভূতত্ত্ববিদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্য পশুর আক্রমণের ভয়কে জয় করে পায়ে হেঁটে তদানীন্তন মহীশূর রাজ্যের পুরো ভূসম্পদ খুঁজে বের করেছিলেন। ভয়ের কথাটি অমূলক নয়, কারণ ওনার বস মিঃ স্মিথকে জঙ্গলে পাইথনের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। লোহা আকর অনেক রকম হলেও হেমাটাইট আর ম্যাগনেটাইট প্রধান। কুদ্রেমুখের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ম্যাগনেটাইট আর হেমাটাইটের এক বিচিত্র মিশ্রণ। তবে সেটাকে কাজে লাগানোর পথে প্রধান অন্তরায় হল আকরের গুণগত মান। বাজারে যেখানে পঁয়ষট্টি শতাংশ লোহা না থাকলে আকরকে ব্রাত্য করে রাখা হয়, কুদ্রেমুখের আকরে লোহা সেখানে মাত্র চল্লিশ শতাংশের কম। সুতরাং পনেরো কোটি টন লোহার আকর পশ্চিমঘাটের কোলে ঘুমিয়ে রইল আরও চল্লিশ বছর।

সত্তরের দশকে এক বিদেশী রাষ্ট্রের উৎসাহে ও অর্থানুকূল্যে, গড়ে উঠল আকরকে কুলীন করে তোলার এক বিশাল কারখানা। পাহাড়ের বুকে গড়ে উঠল নানান বিভাগ, মাইনস, স্টোর্স, ক্রাশার কনসেনট্রেটর। গড়ে উঠল হাজার চারেক লোকের বসবাসের যোগ্য একটা ছোট শহর, রাস্তা, লাকিয়া নদীর বুকে বাঁধ আরও কত কী। তাছাড়া প্রায় সত্তর কিলোমিটার লম্বা পাইপ লাইন, কুদ্রেমুখ থেকে ম্যাঙ্গালোর বন্দর পর্যন্ত। তার সাথে ম্যাঙ্গালোর আছে পাইপে করে পাঠানো আকরকে জল মুক্ত করার জন্য ফিল্টার প্ল্যান্ট, আকর জাহাজে বোঝাই করে বিদেশে পাঠানোর জন্য রিক্লেমার আর অটোমেটিক শিপ লোডার। তাছাড়া পাঁচশো জনের থাকার জন্য একটা ছোটো টাউনশীপ। কুদ্রেমুখে লোহার আকর পাওয়া যায় পাহাড়ের ওপরেই, কয়লা খনির মত পেটের মধ্যে নয়, তাই খনিতে নামার ব্যাপারটাই এখানে নেই।

দু’সপ্তাহ কেটে যাবার পর ট্রেনিং হলে আমরা সবাই জমায়েত হলাম। বসন্তরাজ ভাট আমাদের ছাব্বিশ জনকে তেরোটা জোড়া বানিয়ে তিন চার মিনিটের একটা কিছু করে দেখাতে বললেন। সেই কিছুর সাথে গত দু’সপ্তাহের ট্রেনিং-এর কোনো সম্বন্ধ থাকবে না। করের জুড়িদারের নাম এল বালু। কর আমার কাছে এসে বলল, ‘ইসস, আমরা দু’জন একসাথে হলে ভানুর কমিক করতাম, ফাটাফাটি হতো।’ ফাটাফাটি কথাটার এমন সুন্দর প্রয়োগ আর হয় না।

আমার সাথে যার জুটি হলো তার নাম সুনীতা বি। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে আসা দুটি মেয়ের একজন। বি টা নাকি ওর বাবার নাম, বসবরাজ। ওরা লিঙ্গাইত, সব সময় নাকি সঙ্গে শিবলিঙ্গ নিয়ে ঘোরে। বোঝো কারবার! সুনীতা ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, পাস করার আগেই চাকরিটা হাতে এসে গিয়েছিলো। গান খুব ভালো গায় মানে আকাশবাণীর শিল্পী। ফর্সা, সুশ্রী চেহারা, মেয়েদের তুলনায় লম্বা আর রোগা। সুনীতার বাড়ি এবং কলেজ দুই চিত্রদুর্গায়। চিত্রদুর্গা উত্তর কর্ণাটকের একটা জেলার সদর। দুর্গার সাথে দুর্গা ঠাকুরের কোনও সম্বন্ধ নেই। ওখানে একটা পুরোনো দুর্গ আছে, তাই থেকেই নাম। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘গাইতে পারো?’

‘অন্য কেউ জিজ্ঞেস করলে হয়তো, হ্যাঁ বলতাম, কিন্তু তোমার সামনে তো তা বলা যাচ্ছে না।’

‘কোনও হিন্দি গান যদি ডুয়েট গাই।’

‘প্র্যাকটিস ছাড়া! পুরো কমেডি শো হয়ে যাবে। আমার তো কিছু হারানোর ভয় নেই, তোমার একটা সুনাম আছে, সেটার কী হবে! তাছাড়া একটু আলাদা রকম কিছু করলে ভালো হতো।’

সুনীতা কিছু করা বলতে গানের বাইরে অন্য কিছু ভাবতে পারে না। জানলাম সুনীতা বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীতের কানাড়া রূপ জানে, শেষে ঠিক হলো, জগতে আনন্দ যজ্ঞের দুলাইন আমি বাংলায় গাইবো, সুনীতা তারপর সেটা কানাড়ায় দুলাইন গাইবে। রাগ কেদার, ধরে রাখলেই চলবে। ব্যাপারটা ভালই হলো, সবাই তো তাই বলল। কর পরে বলল, ‘চালিয়ে যাও গুরু, একদিকে শোভাকে লাইন করছ, অন্যদিকে সুনীতার সাথে লাভ সং গাইছো। কপাল মাইরি।’

***

error: Content is protected !!