কচ্ছপের বেঁচে থাকা (পর্ব ১) – দেবব্রত সান্যাল
Kachchoper Benche Thaka
A Bengali Novel
by Debabrata Sanyal
‘একটা সিগারেট খাওয়াও তো,’ দ্বিজেনদা টাইপ মেশিন থেকে হাত তুলে বললেন।
স্বভাব দোষে বলতে যাচ্ছিলাম, ‘আমি সিগারেট খাই না, কাউকে খাওয়াইও না।’ উত্তম তাড়াতাড়ি একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ফিল্টার উইলস চলবে তো?’ ফেরার পথে উত্তম বলেছিল, ‘তোর এই স্বভাবের জন্যই একদিন এমন ফাঁসবি, কোনও শালা বাঁচাতে পারবে না।’ স্বীকার করতেই হবে নস্ট্রাদামুসের ভাত মেরে দেবার মতো প্রতিভা ছিল।
সময়টা বিরাশির শেষের দিকে। জলপাইগুড়ি শহরটা এখন শীতের তুহিনা মেখে রূপচর্চা করছে। উত্তম আমারই সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়া প্রায় শেষ করে চাকরির চেষ্টায় জুটে গেছে। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি এম টেকটা করি। তবে বাকি সবাই বললো, এম টেক করে কী লেজ বের হবে? জুটবে তো সেই ওই একই চাকরি, মাঝ থেকে দু’বছর সময় নষ্ট। একটা বয়েসে বাবা মার চেয়ে আর সবাইয়ের কথাটা বেশি ঠিক লাগে। তাছাড়া, বাবার চাকরি শেষের দিকে, তাই এম টেকের বিলাসিতা আমার পোষায় না।
এরপর মার্কসীট ইত্যাদি অ্যাটেস্ট করানোও আরেক পর্ব। পনেরো বছর ধরে জলপাইগুড়ি পৌরসভার পৌরপিতা থাকার সুবাদে, আমার বাবার অ্যাটেস্ট করার ক্ষমতা ছিল, তবে সেটা আমার নয় আমার বন্ধুদের কাজে লাগতো। আর আমাকে কলেজে, পোস্টাপিসে, সরকারি অফিসে ঘোরাঘুরি করতে হয়। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় চিঠি যদি যায় তিন দিনে। আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ওইরকম মার্কামারা বাদামী রঙের মোটা খাম দেখলে পোস্টাপিস থেকেই ফেলে দেয়, শেষমেষ ঠিকানায় আর পৌঁছায় না।
তখনকার দিনে আমাদের মতো সদ্যজাত ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে ভালো চাকরি হলো ভারত সরকারের উদ্যোগগুলো, যাকে সবাই পাবলিক সেক্টর বলে জানে। যারা অভিজ্ঞতা জানতে চায় না। অভিজাত কলেজজাত কিনা বিশেষ পরোয়া করে না। ঢালাও পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। সেই পরীক্ষাতে উতরে গেলে চাকরিতে ডাকে। তাই ওদের দিকেই আমাদের নজর। এন.টি.পি.সি.র আবেনপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ আর চার দিন পরেই। দ্বিজেনদাকে পটিয়ে এখন ফুল্সক্যাপ (সার্থকনামা কাগজ গুরু) কাগজে দু’পাতায়, ‘কান কটকট করে কিনা? জীবিত কী মৃত ইত্যাদি’ অত্যাবশ্যকিয় বিবরণের সাথে আমার হালে অনেক কায়দা করে ভেনাস স্টুডিওতে তোলা ছবিখানা সেঁটে চটপট পাঠাতে হবে। গ্রন্থ ভারতীর পাশে ডি ভি সি রোডে ছোট ছোট ধারার বেড়া দেওয়া দোকানের একটাতে দ্বিজেনদা, মার্কসিট, অ্যাডমিট কার্ড, চাকরির দরখাস্ত তৈরি রাখতো। দিনে বারো ঘন্টা মতো সেখানে বসে আমার সাইকেলের থেকেও জোরে আর বেশি শব্দ করে ওর রেমিংটন টাইপ রাইটার চালাতো। দ্বিজেনদার পুরো নামটা কখনো জানার কথা মনে আসেনি। ওই এক কালির ফোঁটা লাগা চেক শার্ট, পুরোনো স্টাইলের নীল প্যান্ট, ভাঙা গাল ও অযত্নের দাড়ি। কথা যতটা না বললেই নয় ততটাই। দ্বিজেনদা মুডি ছিলেন। আবেদনপত্র টাইপ করতে নিয়ে গেলে অন্তত একটা শব্দ অবশ্যই বদলাবেন। এরপর মার্কসীট ইত্যাদি অ্যাটেস্ট করানোও আরেক পর্ব। পনেরো বছর ধরে জলপাইগুড়ি পৌরসভার পৌরপিতা থাকার সুবাদে, আমার বাবার অ্যাটেস্ট করার ক্ষমতা ছিল, তবে সেটা আমার নয় আমার বন্ধুদের কাজে লাগতো। আর আমাকে কলেজে, পোস্টাপিসে, সরকারি অফিসে ঘোরাঘুরি করতে হয়। জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় চিঠি যদি যায় তিন দিনে। আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ওইরকম মার্কামারা বাদামী রঙের মোটা খাম দেখলে পোস্টাপিস থেকেই ফেলে দেয়, শেষমেষ ঠিকানায় আর পৌঁছায় না। ফাইনাল সেমিস্টারও শেষ, কলেজ যাবার আর দরকার হয় না। প্রজেক্টের নামে পাতা ভরানো চলছে। আমি, উত্তম, কাজল, অমিত মিলে একটা দল। শুরুতে কিছুদিন খুব পড়া, খোঁজ খাঁজ চললো। কাজল সব কিছুতেই একটু বেশি সিরিয়াস। এমন কী রমা বলে একটা মেয়েকে নিয়ে এতো বেশি সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল যে ইতিহাসের পাতায় নাম উঠে যাবার অবস্থা। শুনেছি রমা নাকি একবার ডুবন্ত সূর্যকে সাক্ষী রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাজল, তুমি কি আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াস?’ তারপর থেকে কাজল প্রতিজ্ঞা করেছিল ইত্যাদি। তখন একদিন উত্তম বলেছিল, ‘ঠিকাছে ঠিকাছে শুনেছিস কটকার বাবা না সিরিয়াস।’ অমিত দুম করে বলে বসেছিল, ‘কাজলের থেকেও?’ কাজল কিন্তু পরে আরও সিরিয়াস হয়ে বাবার বাধ্য ছেলের মতো তৃণা বলে একজনকে বিয়ে করেছিল। সে যা হোক, কাজলের ইচ্ছেয় একটা বড় করে পরিকল্পনা করা হলো। যেটা করতে পারলে, চা বাগানের কাজেও সুবিধে হবে আর চা বানানোর খরচও কম লাগবে। কলেজের কাছেই ডেঙ্গুয়াঝার চা বাগান। ছোটবেলায় এরই নাম শুনতাম রংধামালী। কলেজ থেকে তিন কিলোমিটার মতো হবে, সাইকেলেই যাওয়া যায়। বাগানের ম্যানেজার বাবু কিন্তু আমাদের সিরিয়াসলি নিলেন ও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চা পাতা থেকে সিটিসি বানানোর খুঁটিনাটি বুঝিয়ে বললেন। ফিরে এসে আমাদের সবার তখন অবস্থা পুরো কাজলের মতো না হলেও কাছাকাছি। চটপট সবাই মিলে দশ পাতার একটা পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেলো। কাজলের হাতের লেখা দিব্য গোটা গোটা। তিনখানা ছবি লাগিয়ে রিপোর্ট খানা দেখতেও বেশ হলো। প্রজেক্টের কাগজপত্র নিয়ে দে স্যারের কাছে যেতেই দেখি উনি বালতি নিয়ে জল ঢালতে প্রস্তুত হয়েই বসে আছেন। সরকারি কলেজ, কিন্তু কলেজের পকেটে নাকি পয়সা নেই, থাকলেও আমাদের মতো অর্বাচীনদের প্রজেক্ট নামক অপ্রয়োজনীয় কর্মকান্ডের জন্য পয়সা খরচ করার ইচ্ছে নেই, তা আমাদের ভাবান্তরে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। ফেরার পথে এর ওপর অমিতের, ‘আমি তো শালা আগেই বলেছিলাম’ শুনতে হলো। অগত্যা এবারের মতো সব যুগান্তকারী পরিকল্পনা শিকেয় রেখে কাগজ কলমই ভরসা। খাতায় কলমে অন্তত একটা প্রজেক্ট না থাকলে তো ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যাচ্ছে না। আমাদের প্রজেক্টটা শুধুই খাতা কলমে হয়েছিল বলে দে স্যার আমাদের প্রজেক্টের নম্বরটাও কম দিয়েছিলেন। আমরাও তারপর যে ওনার মঙ্গল কামনা করিনি, সেটাও সত্যি। যতদিন কলেজে ছিলাম, ডাকঘরের অমলের মতো কাজ খোঁজাটাকে মন্দ লাগতো না। যখন সত্যিটা সামনে এলো, তখন বোঝা গেল সেই খোঁজা আর পাওয়াটা প্রতিযোগিতা মূলক। আমার নিজের বন্ধুরা এখন আমার প্রতিযোগী। খবরের কাগজ বলতে আমাদের বাড়ি যুগান্তর আর বাবার পার্টির দৈনিক আসতো। জেলা স্কুলে পড়ার সময় যুগান্তর থেকে রিপ কার্বি কিংবা সূর্য কাঁদলে সোনা কাঁচি দিয়ে সযত্নে কেটে জমিয়ে রাখতাম। অরণ্যদেব বা জাদুকর ম্যানড্রেক আনন্দবাজারে বের হতো, তাই পড়তে বাবুপাড়া পাঠাগারে যেতে হতো। জিষ্ণু বলতো, ওর লোথারের গার্ল ফ্রেন্ড কার্মাকে খুব পছন্দ। লোথার যদি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ না হতো তাহলে কার্মাকে বিয়ের কথা সিরিয়াসলি ভেবে দেখতো। সেদিক থেকে মহাবিশ্ব সুন্দরী হলেও ম্যানড্রেকের গার্লফ্রেন্ড নার্দার থেকে অরণ্যদেবের গার্লফ্রেন্ড ডায়না পামারের ভক্তের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি। বাবা আমার এই কমিকস প্রিয়তা খুব একটা পছন্দ করতেন না। বাবার মতো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কম পেয়েছি। গল্প পড়লেও কল্প বিজ্ঞানের। বাবা চাইতেন আমি বিজ্ঞানকে ভালোবেসে বিজ্ঞানমনস্ক হই। ইংরেজি কাগজ পড়ে ইংরেজিটা ভালো করে শিখি। আমি জানতাম রোজ স্টেটসম্যান ভাজা করে খেলেও আমি ভুলুদা বা সুবোধবাবু স্যারের মতো ইংরেজি লিখতে পারবো না। ভুলুদাকে কমলবাবু স্যার বলাটা বেশ কঠিন। খেলায়, হাতের লেখায়, পড়ানোতে, স্মার্টনেসে একেবারে স্কুলের হিরো। এমন স্যারকে দাদা বলতেই সাধ হতো। কিন্তু সেসময় স্যারকে স্যার বলাটাই আইন ছিল। বরং ইংরেজির শিক্ষক সুবোধবাবুকে স্যার ছাড়া কিছু বলার কথা মনে আসতো না। অসম্ভব মৃদুভাষী ছিলেন, কিন্তু ইংরেজির ব্যাপারে একদম পারফেকশনিস্ট। সবাইকে শুদ্ধ ইংরেজি শিখিয়ে, বলিয়ে তবে ওনার শান্তি। বলতেন, মাথায় অনুবাদ করে ইংরেজি বলবি না। ইংরেজিতেই ভাববি। বেড়ার ফেন্সিংএর কথা বলতে বলতে হ্যামলেটের তরোয়াল খেলার কথা বলতেন। আমি আর মংরা হাঁ করে শুনতাম।
এমন সব মাস্টারমশাইরা ছিলেন বলেই আমাদের জেলা স্কুলের পিছনের বেঞ্চের ছেলেরাও জীবনে কিছু একটা করে ফেলতো। আমাদের কাগজওয়ালাকে বলা থাকতো সপ্তাহে দুদিন ইংরেজি কাগজ দিয়ে যাবে। স্টেটসম্যান ছাড়া চাকরি পাওয়া যায় না। অগত্যা রেজাল্ট বের হবার আগে থেকেই বুধবারের স্টেটসম্যান হাতরে হাতরে ট্রেনি-ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির আবেদন পাঠানো চালিয়ে যেতে হলো। তারপর ডাক এলে কলকাতায় গিয়ে পরীক্ষা দাও। কেউ কেউ আবার আবেদনের সাথে দশ টাকার পোস্টাল অর্ডারও চায়, বেচারা বেকারদের ফাঁকা পকেট কাটার ব্যবস্থা। বাবার কাছে এসবের জন্য বারবার টাকা চাইতে সঙ্কোচ হয়। চাইলেই পাবো যে, তাই সঙ্কোচটা আরও বেশি। দুটো টিউশান আছে, পঞ্চাশ-পঞ্চাশ, একশো। চাকরি জোটানোর খরচটা তার মধ্যে ম্যানেজ হয়ে গেলেই ভালো। শুনেছি বাইরের সব কলেজে ক্যাম্পাসে চাকরির ইন্টারভিউ হয়, পাস করার আগে হাতে চাকরি চলে আসে। ভাবো কান্ড। গাছে না উঠেই…
(ক্রমশ)
Our Visitor
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (একাদশ কিস্তি)বৃষ্টির শুরুতেই সামান্য ঠান্ডা পড়তে শুরু করলো। ক্লাবে লোক আসা একটু কমলো। বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (দশম কিস্তি)(৮) শিফট ডিউটি আরম্ভ হতেই জীবনটা জীবিকার প্রয়োজন মাত্র হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত সময়ে ঘুম থেকে…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (নবম কিস্তি)আমাদের পুরো ব্যাচটাকে কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ করা হলো। আমাদের দলে আমি, কর, সিং…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (অষ্টম কিস্তি)আমার মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে বিপদভঞ্জন দুঃখ দুঃখ মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেড়ে দিলো?’ ‘কান…
- কচ্ছপের বেঁচে থাকা – দেবব্রত সান্যাল (সপ্তম কিস্তি)নিকলের নিয়োগপত্র বার পাঁচেক খুঁটিয়ে পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে, আমার টুইডের কোটটা গায়ে দিয়ে অফিসে গেলাম।…