রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র
সোমাদ্রি সাহা
“বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ । অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ।”
মানুষের নিজের চেতনার সাথে বন্ধুত্ব যখন প্রকৃত আত্ম-পরিচয় লাভ করে, তখন তার সকল বাঁধনই খুলে যায়, খুলে যায় তার আত্মবিকাশের সকল সিংহদ্বার। বন্ধুত্বের সেই চেতনা, সেই অনুভূতি আমরা দেখতে পাই ঐতিহাসিক যুগপুরুষদ্বয়ের জীবনীতে। বন্ধুগাছরূপী জগদীশচন্দ্র বসু এবং রবি কিরণের আজীবন ছাত্রবন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জগদীশচন্দ্র বসুই প্রথম বলেন মানুষের মতো উদ্ভিদেরও অনুভূতি আছে। আঘাত করলে ওরা ব্যথ্যা পায়। জগদীশ বসুর আবিষ্কার সারা পৃথিবীতে হৈ চৈ ফেলে দেয়। অতবড় একজন বিজ্ঞানী, অথচ মাঝে মাঝে একেবারে ছেলেমানুষের মতো কাজ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন হরিহর আত্মা। রবীন্দ্রনাথ তখন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বাস করেন। ওদিকে বিজ্ঞানী মশাই কবিকে বেশিদিন না দেখে থাকতে পারতেন না। তাই মাঝে মাঝে গবেষণা ছেড়ে তিনি কলকাতা থেকে পাড়ি দিতেন শিলাইদহে। থাকতেন অনেকদিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাবিবারিক বোটে চেপে সপরিবারে বেরিয়ে পড়তেন পদ্মার কোনো চরে দিকে। নির্জন চরে কিছুদিন বাস করতেন বেদে-বেদেনীদের মতো। সাথে থাকতেন জগদীশ বসুও। জগদীশ বসুর ভাব শুধু রবীন্দ্রনাথের সাথেই ছিল না। তাঁর ছেলেমেয়েদের বন্ধু ছিলেন তিনি। বিশেষ করে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের বড় ছেলে। জগদীশ বসুর সাথে তিনি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। কচ্ছপের ডিম খুঁজে বেড়াতেন চরের বালুতে। কখনও কখনও কচ্ছপ ধরে তার মাংসও খেতেন। এসব কাজে তার গুরু জগদীশচন্দ্র বসু। বিজ্ঞানী মশাই মাঝে মাঝে পদ্মার তীরে গর্ত কবরের মতো গর্ত খুঁড়তেন। অনেকগুলো গর্ত। সেই গর্তের একটা তিনি শুতেন। আর অন্যগুলোতে রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েরা। মাথায় একটা ভেজা গাম জড়িয়ে নিতেন। তারপর গর্তের ভেতর শুয়ে শরীরে রোদ লাগাতেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর শরীর গরম হয়ে উঠত। আর রোদ সহ্য করতে পারতেন না। তখন রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের নিয়ে দৌড়ে ঝাঁপ দিতেন পদ্মার বুকে। উত্তপ্ত শরীরের পদ্মার শীতল জলের ছোঁয়ায় ভেসে যেতেন প্রশান্তির সাগরে।
তাঁদের দুজনের অন্তরঙ্গতা সম্পর্কে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “একজন বিজ্ঞানী, অন্যজন কবি এঁদের মধ্যে যে আকর্ষণ ছিল সে কেবল বন্ধুত্ব বললে সম্পূর্ণ বলা হয় না। পরস্পরের মধ্যে একটি গভীর অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ ছিল। কথাবার্তা গল্প করার মধ্যে ভাব-বিনিময়ের চেষ্টা যেন সর্বদাই চলত। নতুন গল্পের প্লট বা যে প্রবন্ধ লিখছেন তার বিষয়বস্তু নিয়ে বাবা আলোচনা করতেন। জগদীশচন্দ্র তাঁর উদ্ভাবিত নতুন যন্ত্রের কথা বলতেন, নতুবা বলতেন জড় ও জীবের মধ্যে কী সব অদ্ভুত মিল তিনি সেই যন্ত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করেছেন। দুজনের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চললেও তাঁরা যেন যথেষ্ট খোরাক পেতেন পরস্পরের আলোচনা থেকে।”
কলকাতায় প্রথম বিনা তারে বার্তা প্রেরণ এবং তা গ্রহণ করার একটি কৌশল দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বড় লাটের হস্তক্ষেপে তাঁর এই আবিষ্কার ইংল্যান্ডে দেখানোর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সহায়তা করলে তিনি লন্ডনে গিয়ে সেটি প্রদর্শন করেন। ১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই লন্ডনে রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতিতে তিনি তাঁর আবিষ্কার সব বিজ্ঞানীর সামনে তুলে ধরেন। এমনকি তিনি তাঁর পরীক্ষার খুঁটিনাটি এত বিশদভাবে তুলে ধরেন যে তা থেকে যে কেউ পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলকাতার সেই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের ঘটনাটিই প্রথম। পরে লন্ডনেও তিনি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তাঁর উদ্ভাবনের কোনো ‘পেটেন্ট’ বা ‘স্বত্ব’ করেননি। কারণ, কর্ণ ছিল তাঁর আদর্শ। মহাভারতে যেমন দুর্যোধনকে হরিহর আত্মা মেনেছিল কর্ণ। কর্ণ সেখানে বন্ধুর জন্য পান্ডবদের বিপক্ষে লড়াই করে নিজেকে আত্মবলিদান দিতেও পিছ পা হননি। তাঁর সব কাজকর্ম হবে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। বলা যায়, জগদীশচন্দ্র বসু হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মুক্ত দর্শনের অধিকারী বিজ্ঞানী। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও এই মুক্ত দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই হরিহর আত্মা বলা যেতেই পারে।
“ভারতের কোন বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি, হে আর্য আচার্য জগদীশ।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জগদীশচন্দ্র বসুর ইতিহাস একটু বলে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এতো কাছের বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তিনি। ‘সেই সাধনার সে আরাধনার যজ্ঞশালার’ দ্বার উন্মুক্ত করবার জন্য আবির্ভূত হলেন ভারতের বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি আচার্য জগদীশ। লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর পদার্থবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এর অন্যতম কারণ হলো, তিনি তখন ‘ধাতব বস্তুর’ প্রাণ আছে কি না তা ভাবতে থাকেন। তবে তাঁর এই ভাবনাটা ক্রমেই উদ্ভিদের দিকেই চলে যায়। ফলে মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে বিনা তারে বার্তা প্রেরণের জগদীশের সাফল্য অনেকে ভুলে যান। অন্যদিকে উদ্ভিদের জীবনের বহিঃপ্রকাশের কারণে তিনি সেই দিকে বেশি কার্যকরী হন।
বর্তমানে, বিশ্বের তাবত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকেই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ঐ আমরা যে মোবাইল নিয়ে নেট করছি, বন্ধুত্ব তৈরি করছি তার শুরু জগদীশ বাবুর চিন্তা থেকেই। তবে জগদীশচন্দ্র বসু কাজ করেছেন মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে এবং রেডিও যন্ত্রের উদ্ভাবক মার্কনি কাজ করেছেন বেতারতরঙ্গ নিয়ে। অনেকেরই ধারণা, জগদীশচন্দ্র যদি মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে তাঁর কোহেরারকে আরও এগিয়ে নিতেন, তাহলে ১৯০১ সালের প্রথম নোবেল পুরস্কারটি একজন বাঙালি পেলেও পেতে পারতেন।
হৃত-গৌরব দরিদ্র জাতির পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারত-জননীর অশ্রুসিক্ত আর্শীবাদ পাঠালেন – “আজি মাতা পাঠাইছে অশ্রুসিক্ত বাণী আশীর্বাদখানি।” বেতার-যন্ত্রের আবিস্কারকের সম্মান, প্রকৃতপক্ষে জগদীশচন্দ্রেরই প্রাপ্য। জগদীশবাবু তাই এক স্থানে লিখেছেন – “যাঁহারা আমার বিরুদ্ধ পক্ষ ছিলেন, তাঁহাদেরই একজন আমার আবিষ্কার পরে নিজের বলিয়া প্রকাশ করেন।”
যে কলেজ তাঁকে নিয়োগ দিতে চায়নি, সে কলেজই তাঁকে অবসরের পরও অতিরিক্ত দুই বছর জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক হিসেবে বেতন দিয়েছে। ১৯১৫ সালে অবসরের পর তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস মর্যাদা দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ১৯০৩ সালে তাঁকে কমান্ডার অব ইন্ডিয়ান এম্পায়ার উপাধি দেয়। ১৯২৮ সালে তিনি রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির ফেলো নির্বাচিত হন।
১৯২৭ সালে তিনি কলকাতায় একটি বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এটিকে তিনি একটি ‘মন্দির’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বর্তমানে এটি বসু বিজ্ঞান মন্দির নামেই বেশি পরিচিত। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র বসুর তিন বছরের ছোট হলেও তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল আমৃত্যু। একজনের হাতে বিকশিত হয়েছে বাংলায় সাহিত্য আর একজন করেছেন বাংলায় বিজ্ঞান রেনেসাঁর সূচনা।
রবীন্দ্রনাথ বন্ধুত্ব সম্পর্কে এক সময় লিখেছিলেন – “বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাৎ আছে, কিন্তু ঝট্ করিয়া সে তফাৎ …বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না।… আমাদের ডান হাতে বাম হাতে বন্ধুত্ব। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই। …অনেকে বলিয়া থাকেন বন্ধুত্ব ক্রমশ পরিবর্তিত হইয়া ভালোবাসায় উপনীত হইতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা নামিয়া অবশেষে বন্ধুত্বে আসিয়া ঠেকিতে পারে না। … প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায় তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।”
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু একটি চমত্কার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, সে-ই প্রকৃত বিজ্ঞানী যে তার ল্যাবরেটরির সঙ্গে ঝগড়া করে না। অর্থাৎ প্রকৃতিবিজ্ঞানী সব সময় নিজের ল্যাবরেটরি তৈরি করে নেন, অন্যকে দোষারোপ করেন না। আজ থেকে প্রায় সোয়া শ বছর আগে একটি পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে জগদীশচন্দ্র বসু মানবসভ্যতাকে একটি বড় ঝাঁকুনি দিয়েছেন। সেই মাত্রায় না হলেও যদি আমরা তাঁর মতো বিজ্ঞানকে ভালোবেসে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলেই কেবল এই বিজ্ঞানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারব।
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এতটাই জগদীশচন্দ্রের মধ্যে ছিল যে তাঁর রচিত ‘অব্যক্ত’ গ্রন্থে রয়েছে তাঁর অমলিন স্বদেশপ্রেম, গভীর দর্শন-চিন্তা ও অকৃত্রিম সাহিত্যানুরাগের সুস্পষ্ট পরিচয়। হতমান ভারতবর্ষের সন্তান হিসেবে তিনি যে পরাধীনতার গ্লানি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন তাতে তিনি রবীন্দ্রনাথের সাথে সমব্যাথী হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর ‘অব্যক্ত’ হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যদিও বিজ্ঞানবাণীকেই তুমি সুয়োরানী করিয়াছ, তবু সাহিত্য-সরস্বতী সে পদের দাবি করিতে পারিত, কেবল তোমার অনবধানেই সে অনার্দত হইয়া আছে।” ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘বিজ্ঞানী ও কবি একই অরূপের সন্ধান করেন, তবে প্রভেদ এই_ কবি পথের কথা ভাবেন না, বৈজ্ঞানিক পথটা উপেক্ষা করেন না।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিরসুহৃদ জগদীশচন্দ্র বসুর উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে-দিগন্তের সমুদ্রের একূলে ওকূলে; আপন দীপ্তিতে আজি বন্ধু, তুমি দীপ্যমান; উচ্ছলি উঠেছে বাজি বিপুল কীর্তির মন্ত্র তোমার আপন কর্মমাঝে।’ ওদিকে তাঁর বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয়ক আবিষ্কার যখন বৈজ্ঞানিক জগতের স্বীকৃতি লাভ করল, অধ্যাপক র্যা মজে তখন বিজ্ঞানে ভারতের তখন পর্যন্ত অতি সামান্য অবদানকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করেছিলেন, “আপনি ব্যতিক্রম, একটি কোকিলের ধ্বনিতে বসন্তের আগমন সূচিত হয় না।” কথাটায় জাত্যাভিমানে আঘাত লেগেছিল জগদীশচন্দ্রের। তাই স্পর্ধার সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি নিশ্চয় বলছি অচিরে ভারতের বিজ্ঞানক্ষেত্রে শত শত কোকিল বসন্তের জয়গান করবে।” তাঁর সেই কথা আজ সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা জগদীশ্চন্দ্র বসুও রবীন্দ্রনাথের কেবল ব্যক্তিগত বন্ধু-ই ছিলেন না, রবি-প্রতিভায় মুগ্ধ জগদীশ রবীন্দ্রনাথের লেখা ভালোভাবে ও উঁচুমানের ইংরেজিতে অনুবাদের জন্যে যথেষ্ট কাজ করেছেন, যাতে সারা পৃথিবী এই অমূল্য রত্নের সন্ধান পান। সমপ্রতি প্রকাশিত অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া লিখিত “অবলা বসুর সন্ধানে বিক্রমপুর” গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “নিজেদের সংগ্রাম-সাফল্যে দুবন্ধু-ই একে অন্যের পরিপূরক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারীর তত্ত্বাবধানে যখন শিয়ালদহ থাকতেন, প্রেসিডেন্সী কলেজের তরুণ বিজ্ঞানী জগদীশ্চন্দ্র বসু তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তে সস্ত্রীক চলে আসতেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। জগদীশের দাবী ছিল প্রতি সপ্তাহে রবি একটি করে ছোট গল্প লিখে দেবেন যেটা অনুবাদ করিয়ে ছাপাবার ভার জগদীশের ওপর। প্রথম দিকে ইংরেজ যে নারীকে দিয়ে জগদীশ অনুবাদ করাতেন, রবীন্দ্রনাথের অতি সূক্ষ্ম অনুভূতির অনুবাদে মাঝে মাঝে তিনি হিমসিম খেয়ে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ-ও খুব খুশি ছিলেন না তাঁর অনুবাদে। অবশেষে ভগ্নী নিবেদিতা অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁর অনুবাদের মান নিঃসন্দেহে অনেক উঁচুতে মেনে নেন জগদীশ ও রবীন্দ্রনাথ। ভগিনী নিবেদিতা ১৯১২ সালের জানুয়ারি সংখ্যার মডার্ন রিভিউতে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেন।
আর এখানেই রবীন্দ্রনাথের সাথে বিজ্ঞানের নিবিড় সম্বন্ধের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে তাঁর এই বন্ধুত্ব। রবি ঠাকুরের লেখা পত্রাবলীতে একটু নজর দিলেই আমরা দেখতে পাবো তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন :
‘বিজ্ঞান ও রসসাহিত্যের প্রকোষ্ঠ সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন মহলে, কিন্তু তাদের মধ্যে যাওয়া আসার দেনা পাওনার পথ আছে। জগদীশ ছিলেন সেই পথের পথিক। সেই জন্য বিজ্ঞানী ও কবির মিলনের উপকরণ দুই মহল থেকেই জুটত। আমার অনুশীলনের মধ্যে বিজ্ঞানের অংশ বেশী ছিল না, কিন্তু ছিল তা আমার প্রবৃত্তির মধ্যে। সাহিত্য সম্বন্ধে তাঁর ছিল অনুরূপ অবস্থা। সেই জন্য আমাদের বন্ধুত্বের কক্ষে হাওয়া চলত দুই দিকের দুই খোলা জানালা দিয়ে।’
অর্থের অভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণা যখন প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগার হয়েছিল, তখন বন্ধুর গবেষণা যেন কোনভাবে বন্ধ না হয়, সে বিষয়ে মুল উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ১৯০০ সালের ২০ নভেম্বর একটি চিঠিতে জগদীশচন্দ্রকে বলেছিলেন:
‘আচ্ছা, তুমি এদেশে থেকেই যদি কাজ করতে চাও, তোমাকে কি আমরা সকলে মিলে স্বাধীন করে দিতে পারিনে? কাজ
করে তুমি সামান্য যে টাকাটা পাও, সেটা যদি আমরা পুরিয়ে দিতে না পারি, তা হলে আমাদের ধিক্। কিন্তু তুমি কি সাহস করে এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে? পায়ে বন্ধণ জরিয়ে পদে পদে লাঞ্ছনা সহ্য করে তুমি কাজ করতে পারবে কেন? আমরা তোমাকে মুক্তি দিতে ইচ্ছা করি – সেটা সাধন করা আমাদের পক্ষে যে দুরূহ হবে তা আমি মনে করিনে। তুমি কি বল?’
কবিগুরু কতটুকু সাহায্য করতে পারবেন, এ নিয়ে বোধ হয় জগদীশ চন্দ্রের মনে খানিকটা হলেও সন্দেহ ছিল। এ যে বিশাল টাকার ব্যাপার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশ্বাসবানী যে স্রেফ কথার কথা ছিল না, এটি বোঝাতে পরবর্তী চিঠিতেই (১২ ডিসেম্বর, ১৯০০) আবারো লিখলেন রবীন্দ্রনাথ:
‘তুমি তোমার কর্মের ক্ষতি করিও না, যাহাতে তোমার অর্থের ক্ষতি না হয় সে ভার আমি লইব।’
তার বন্ধুকে সাহায্য করার আবেদন রবীন্দ্রনাথ অন্যদেরও জানিয়েছিলেন। এর প্রমাণ আমরা পাই রমেশ্চন্দ্র দত্তের ১৯০১
সালের ১৬ জুলাই লন্ডন থেকে লেখা একটি চিঠিতে যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে দু’লাখ টাকার একটি তহবিল গঠনের জন্য তাঁকে চেষ্টা করতে বলেন। বলাবাহুল্য জমিদার রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও এত টাকা যোগার করা সে সময় সম্ভব ছিল না। তাই তিনি শেষ পর্যন্ত শরণাপন্ন হন ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের। শুধু জগদীশের গবেষণার জন্য টাকা জোগারের জন্যই ত্রিপুরা ভ্রমণ করেন। সেখান থেকেই অক্টোবর কিংবা নভেম্বর মাসে (চিঠিটিতে কোন তারিখ ছিল না) তিনি জগদীশচন্দ্রকে লেখেন :
‘আমি তোমার কাজেই ত্রিপুরায় আসিয়াছি। এইখানে মহারাজের অতিথি হইয়া কয়েক দিন আছি। তিনি শীঘ্র বোধ হয় দুই এক মেলের মধ্যেই তোমাকে দশ হাজার টাকা পাঠাইয়া দিবেন। সে টাকা আমার নামেই তোমাকে পাঠাইব। এই এক বৎসরের মধ্যেই তিনি আরো দশ হাজার পাঠাইতে প্রতিশ্রুত হইয়াছেন। ইহাতে বোধ করি তুমি বর্তমান সংকট হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারিবে।’
জগদীশের জন্য অর্থ সাহায্য করেই কেবল রবিঠাকুর ক্ষান্ত হননি, জগদীশের কাজ যাতে সাধারণেরা জানতে পারে, যাকে
আমরা বলি ‘পপুলার লেভেল’-এ পৌঁছানো, তারও ব্যবস্থা করলেন তিনি নিজে। ১৯০১ সালে বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত (শ্রাবণ সংখ্যা) একটি লেখায় জগদীশ চন্দ্রের কাজের উপর ভিত্তি করে রবি ঠাকুর রচনা করলেন একটি প্রবন্ধ – ‘জড় কি সজীব?’ তারও আগে আষাঢ় সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘আচার্য জগদীশের জয়বার্তা’ নামের আরেকটি প্রবন্ধ। রবীন্দ্রনাথের হয়ত সংশয় ছিল প্রবন্ধগুলোর মান ও গুণ নিয়ে, তাই জগদীশচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে বলেছিলেন –
‘আমি সাহসে ভর করিয়া ইলেক্ট্রিশ্যান প্রভৃতি হইতে সংগ্রহ করিয়া শ্রাবণের বঙ্গদর্শনের জন্য তোমার নব আবিস্কার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছি। প্রথমে জগদানন্দকে লিখিতে দিয়াছিলাম- পছন্দ না হওয়াতে নিজেই লিখিলাম। ভুলচুক থাকিবার সম্ভাবনা আছে – দেখিয়া তুমি মনে মনে হাসিবে।’
না, জগদীশচন্দ্র বসু হাসেন নি। বরং উল্টে বলেছিলেন :
‘তুমি যে গত মাসে আমার কার্যের আভাস বঙ্গদর্শনে লিখিয়াছিলে তাহা অতি সুন্দর হইয়াছে। তুমি যে এত সহজে বৈজ্ঞানিক সত্য স্থির রাখিয়া লিখিতে পার, ইহাতে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।’
১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর জগদীশ্চন্দ্রের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে দিয়ে সমস্ত দেশের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলেন। তাই তিনি জগদীশচন্দ্রকে বলেছেন,
‘এ তো তোমার একার সঙ্কল্প নয়, এ আমাদের সমস্ত দেশের সঙ্কল্প, তোমার জীবনের মধ্যে দিয়ে এর বিকাশ হতে চলল।’
বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময় কবিগুরু ছিলেন আমেরিকায়। তারপরেও শত ব্যস্ততার মাঝে উদ্বোধনী সঙ্গীত লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেই বিখ্যাত সঙ্গীতটিই হল- ‘মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন কর মহোজ্জ্বল আজ হে’।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। পুরস্কার ঘোষিত হয় ১৯১৩ সালের ১৩ ই নভেম্বর। রবীন্দ্রনাথ
খবর পান ১৬ নভেম্বর। এর ঠিক তিন দিন পরে জগদীশচন্দ্র তাঁকে অভিনন্দন জানালেন এভাবে :
‘বন্ধু, পৃথিবীতে তোমাকে এতদিন জয়মাল্যভূষিত না দেখিয়া বেদনা অনুভব করিয়াছি। আজ সেই দুঃখ দূর হইল। …’
রবীন্দ্রনাথের জীবনে এভাবে কথা বলার অধিকার যদি কেউ রেখে থাকেন, তবে নিঃসন্দেহে তা জগদীশচন্দ্র বসু। জগদীশচন্দ্র কিন্তু বলেন নি যে কবির পুরষ্কার পাবার ঘটনায় তিনি ‘আনন্দিত’। তিনি বলেছেন – তাঁর ‘দুঃখ দূর হল’। এ যেন যথার্থ বন্ধুর চাপা আনন্দের এক নির্মোহ স্বর!
তথ্যসূত্র
১। অন দ্য এজেজস অব টাইম, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২। রবিজীবনী, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২৭৯, প্রশান্তকুমার পাল
৩। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট