আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে
চম্পাকলি চট্টোপাধ্যায়
বিশ্বসত্তার মহাসমুদ্রে ব্যক্তিসত্তা হল এক একটি তরঙ্গ। বিশ্বের বিরাট স্বরূপে আছে নক্ষত্র ও আকাশ, সৎ ও সম্ভূতি। সে প্রকাশ রূপ নিয়েছে দিব্য প্রেমে যা সার্বিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বিশ্বসত্তার কেন্দ্রবিন্দু হল এই প্রেম। এখান থেকেই বিচ্ছুরিত হয় সব এবং উপজাত প্রকাশ রূপে। প্রেমের প্রবাহধারায় মানুষ জাগতিক সত্তাকে উন্নীত করে আধ্যাত্মিক সত্তা অবহিত করতে পারে। স্রষ্টার সঙ্গে সমস্ত জীবের সঙ্গে মানুষ বৈশ্বিক প্রেমে একত্ব বোধ করতে পারে। বিশ্বাস রাখতে হয় শুধু আত্মায় ও আত্মতত্ত্বে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ একাত্মা দর্শনম জ্ঞানম লক্ষ্যে পৌঁছতে নিজেকে বিস্তারের সাথে সাথে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর কাব্য ও সাহিত্যকে।
‘আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মস্থ করেছিলেন সমগ্র বিশ্বের এই স্বরূপ সত্তা। জেনেছেন অসীমকালের জোয়ারভাঁটায় বিশ্বপ্রাণ অন্তঃশীলা। পৃথিবীমন্ডলে পরিভ্রমণকালে চেতনে মনে মননে মানুষ জেনেছে পার্থিব রূপ রস গন্ধ বর্ণ। প্রেম ভালবাসা ঘৃণা। এই জানার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসু মন ব্যস্ত হয় অপার্থিব জানাকে জানতে। আকাশের সূর্য তারা, প্রকৃতির সৌন্দর্য, শৃঙ্খলা, ঐক্যতান সুরমাধুরীর সঙ্গে মানবের যোগ কোথায়? নিত্যকালব্যাপী বিচিত্র অফুরান লীলার মধ্যে স্পর্শযোগ্য মাটির মানুষ কি ভাবে যুক্ত বিশ্বের সৃজন কেন্দ্রে?
বিরাটত্বের মধ্যে অণুসম মানুষ। বিষ্ময়! মহানের সঙ্গে ক্ষুদ্রের মিলন অনুসন্ধানে তিনি বিস্মিত শিহরিত। তিনি নেচে ওঠেন ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত নাচাও যে ঝংকারে,’ জেগে ওঠেন ‘এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ।’ বিশ্বসত্তার মাঝে রক্ত মাংসের নাড়ির টান, ক্রিয়াকেন্দ্রের আলোড়ন অন্তরে মানতে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করেছে উপনিষদ। ব্যক্তিকে অতিক্রম করে ব্যক্তির সীমা পেরিয়ে তিনি পৌঁছে যান সর্বজনীনে, বিশ্বগত জিজ্ঞাসায়।
সত্তার মধ্যে যে আমি, তার স্বদেশ মাটি ঘরপরিজন নিয়ে ব্যাপৃত, তাতে আছে ব্যক্তিক সুখ দুঃখ প্রেম ঘৃণা ঝগড়া। আরো একটি বড় সত্তা আছে যা নাটকের মত এক গল্প থেকে অন্য গল্পে ক্রমাগত অন্তর্ভুক্ত হয়ে চলেছে। এক সঙ্গে সে স্রষ্টা ও দ্রষ্টা অথচ একে অন্যকে সহজেই অতিক্রম করে যায়, প্রসারে যিনি অসীম। সেই সত্তা রবীন্দ্রের কাছে ‘পরমপুরুষ’। ‘প্রভাতসংগীত’ কাব্যমালায় তিনি আভাসে ইঙ্গিতে, ব্যক্তিগত আকাশে, বিচ্ছিন্ন সুখে দুঃখে, ব্যক্তিক বিকাশে পরমপুরুষের আহ্বান ধুলায় ঢাকা আপনার ভেতর অস্পষ্ট ছায়া মায়ার মধ্যে অনুভব করতে পেরেছিলেন। অন্তর বাইরের দূরত্বে ‘নিখিলনয়ন হতে/ ঢাকা ছিল, সখা সে_ /প্রভাতের আলোকে তো / ফোটে নাই প্রকাশে।’ ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কবিতায় ‘তোমা – সাথে হবে চেনা’ র পর্ব পরিশীলিত। দু এর ব্যবধান ঘুচে সহজতর আনন্দের পূর্ণতর পরিচয়ে অন্তহীন প্রাণের উপলব্ধিতে তখন কবি। পৃথিবীময় যে আনন্দ ছড়িয়ে আছে দানের মতো, সংগ্রহের ঝুলিতে তাই নিতে মন ব্যাকুল।
‘বিরোধ কোলাহলে / গভীর তব বাণী।’
দুই সত্তার সংশয় দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কবি সুনিশ্চিত। অহং বোধের বাড়াবাড়ি তো থাকেই। এই সচেতনতা থেকে তিনি বলেন ‘সত্য মুদে আছে / দ্বিধার মাঝখানে, ’ সত্যানুসন্ধানে পদে পদে মোহ অজ্ঞতার কালো মেঘ। ঝড়ের আঘাতে নুয়ে পড়ে, ধাক্কা খেয়ে পিছু হাঁটে আবার দুঃখে বিষাদে নিমগ্ন হয়। তপস্যার দুঃখ থেকে জাগতিক সৃষ্টি। সমস্তকে আচ্ছন্ন করে তার মধ্যে আছেন তিনি। ‘তেমনি গভীর মোহের মাঝে / তোমায় আমি চাই। / শান্তিরে ঝড় যখন হানে / শান্তি তবু চায় সে প্রাণে, / তেমনি তোমায় আঘাত করি / তবু তোমায় চাই।’বিরোধের মাঝে আছে সত্যের পূর্ণ প্রকাশ। চাওয়ার মধ্যে প্রাপ্তি।
এই চাওয়া সীমার মধ্যে অসীমের মধ্যে প্রত্যক্ষের মধ্যে। তাই অহংকারের মিথ্যে খেলায় আসে আত্ম অবিশ্বাস। আসে আলস্য সংশয় নিরাশ্বাস। রাতের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকার মতো এরা। আর তাদের উপস্থিতির জন্যই অন্ধকারে ভয়। ভয় কাটিয়ে ঝড়কে সাথি করে নিভন্ত বাতির ভরসায় পথ চলতে প্রত্যয়ী কবি জানেন হঠাৎই প্রভাতের স্নিগ্ধ আলো সত্যের দ্বার খুলে দেবে। জল স্থল আকাশ পশুপাখি দিনরাত্রির মধ্যে চলতে চলতে সত্য উজলে উঠবেই। মুহূর্তে সর্ব অনুভূতিতে বিশ্বের বিচিত্র অথচ অখন্ড লীলার অংশ হয়ে যায় তখন মানুষ। সীমা অতিক্রম করে অখন্ডতার স্পর্শ। এখানেই পূর্ণতা। কালে কালে এই পূর্ণতার স্বাদ পেতে মানুষ সামিল হয়েছেন জীবনের তীর্থযাত্রায়। শুরু সে তো ‘আজকে নয় সে আজকে নয়।’
সংশয় থেকে মুক্তি পেতে কোন নির্দিষ্ট ঈশ্বর চিন্তা করেননি তিনি। নিরাকার এক বোধিত্বের আলোয় ইষ্টকে তিনি কখনও ‘হে প্রিয়’, ‘প্রভু’, ‘বিশ্বনাথ’, ‘মহাকবি’ প্রভৃতি সম্বোধনে পরমাত্মা স্রষ্টার পায়ে কবি তাঁর সৃষ্ট গান কবিতায় আত্মনিবেদন করেছেন। আত্মলীনতায় বিশ্ববিধাতার প্রেমে কায়ারূপী প্রেমকে মিশিয়ে দিতে চেয়েছেন। আমির মুক্তি সাধন ভজন পূজনের আচারসর্বস্বতা থেকে ছিন্ন করে বিশ্বশালার ভাঙ্গাগড়ার কাজে আত্ম নিয়োগের মধ্যে খুঁজেছেন। আমার আমিকে আলোর মহিমায় বলেছেন ‘বিস্তারো’। বলেছেন, ‘আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন প’রে বাঁধা সবার কাছে। এই উপলব্ধির উৎস উপনিষদ। চালিকা শক্তি উপনিষদ। আবাল্যকাল উপনিষদ আবৃত্তি করতে করতে আমার মন বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণতাকে অন্তর্দৃষ্টিতে মানতে অভ্যাস করেছে।’ (আত্মপরিচয় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ধর্ম মানেন না মানেন, অদ্বয় না দ্বয় ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক আছে থাকবে। ধর্ম অধর্ম, নাস্তিক আস্তিক এসব মানুষের টানা গন্ডীর সংকীর্ণ সংরক্ষিত এলাকা। এলাকার বিষয় নির্দিষ্ট, সীমায়িত জানা। প্রশ্ন-জীবনকে নির্দিষ্ট আকারে বাঁধা যায়? যায় না বলেই, ক্ষুদ্রবেষ্টনে রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষেরা কখনও আবদ্ধ থাকতে পারে? মহাবিশ্বের ঔদার্য রেখাবদ্ধ হয়? দ্বন্দ্ব হীন হয়? কবি জানেন অশান্তির অন্তরে শান্তি সুমহান। ভুবনে জীবন মৃত্যু হাত ধরাধরি করে আছে। ‘বিশ্বলীলার হিল্লোলে চিরন্তন নাড়া’ এটাই সত্য, এটাই ধর্ম। প্রাণের অফুরান খেলা রহস্যে রোমাঞ্চে বিস্ময়ে সবসময় নতুন গান সৃষ্টি করে চলেছে এই বিশ্বে। মানুষ রূপে সৃজকের কাব্য দেখাই তো ধর্ম। নিজে বলেছেন, ‘আমার রচনার মধ্যে যদি কোন ধর্মতত্ত্ব থাকে তো তবে সে হচ্ছে এই যে পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার সেই পরিপূর্ণ প্রেমের সম্বন্ধ উপলব্ধি ধর্মবোধ… যার মধ্যে শক্তি এবং সৌন্দর্য রূপ এবং রস, সীমা এবং অসীম এক হয়ে গেছে… যা যুদ্ধের মধ্যেও শান্তিকে মানে, মন্দের মধ্যেও কল্যাণকে জানে এবং বিচিত্রের মধ্যে ও এককে পূজা করে।’(আত্মপরিচয় :রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
রবীন্দ্রনাথ আজীবন আমির ব্যাপ্তিতে ‘বিশ্বগত আমি’তে উপনীত হতে চেয়েছেন। তাঁর সৃজনী তাই বলে। আরও বলে ভারতের জনসমষ্টির বিপুল এক অংশের মানসিক প্রতিনিধি তিনি। তাদের তিনি স্বানুভূতির সেই অভিব্যক্তির মন্ত্র ই শুনিয়ে গেছেন। আজ ও তাঁর সাহিত্যসম্ভার ঐ মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে এবং চলবে। পৃথিবী জুড়ে কান্নাহাসির দোলা, তারই মাঝে মানুষের জীবন চলা। এই সহজ সত্য উপলব্ধির প্রয়াসে, দ্বান্দ্বিকতার স্তর ভেঙ্গে আমাদের রবীন্দ্র চর্চা করতে হবে। তাঁকে আমাদের মননে জাগরণে ঠাঁই দিতেই হবে। তাঁর জীবনবোধে সংশয়হীন স্থির বিশ্বাসের কথাই হল মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সত্য সন্ধান তাঁকে বিযুক্ত রেখেছে বিদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে। করেছে দেশজ ভাবনায় ভাবতে, দ্বন্দ্ব সংঘাতের নন্দন তত্ত্বে বিশ্বাসী হতে। মাটির ওপরে হেঁটে চলে তিনি তার চারপাশের রূপের লীলায় মগ্ন থেকেই অরূপের সন্ধান করেছেন। মানুষের কল্যাণে ভেবেছেন ‘ভাইয়ের সাথে ভাগ করে মোর ধন / তোমার মুঠা কেন ভরি নে।’ বৃহৎ অর্থে আধ্যাত্মিক চেতনার ভাগ ব্যক্তিগত শক্তিতে অন্যকে দান। আর ক্ষুদ্র অর্থে সম ধনভাগ। এই পূর্ণতা দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে নিজের মহিমায় দেখতে চেয়েছেন। ‘আমিই সে’ _ এই জ্যোতিরেখায় উজ্জ্বল সমগ্র মানব কারো থেকে কোন রকমভাবে অনুজ্বল হতে পারে না। মানবতার উৎকর্ষ সাধনই রবীন্দ্রনাথের পূজা। এই পূজায় তিনি নিজেকে নতশিরে ধুলো আসনে বসিয়ে রেখেছেন। সরোজ দত্তের কবিতা ‘রবীন্দ্রনাথ’ পড়তে পড়তে শুনি ‘তোমারে বাঁচাতে হবে’ / এই শুধু বুঝিয়াছি / এইটুকু করেছি সম্বল।’ সত্যি তাই।