বহুমুখী প্রতিভার আধার রবীন্দ্রনাথ“অধরা মাধুরী”
ব্রততী রায়
আমরা স্বভাব উন্নাসিক বাঙালিরা যাঁদের নিয়ে শ্লাঘা বোধ করি তাঁদের মধ্যে যে নামটি সর্বাগ্রে মনে আসে তা নিয়ে অধিকাংশেরই কোনো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। অবশ্যম্ভাবী সেই নামটি রবীন্দ্রনাথ। প্রতি বছর তাঁকে আমরা স্মরণ করি তাঁরই রচনা গান কবিতা ও তাঁর মহৎ প্রতিভা প্রসূত আরো নানা সৃষ্টির মাধ্যমে। যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ হয়েছে প্রচুর এবং বলাই বাহুল্য আরো হতে থাকবে, এবং তার ব্যাপ্তি যে শুধু আসমুদ্র হিমাচলেই সীমাবদ্ধ নয় তাও সকলেরই জানা। কিন্তু তার অধিকাংশই হয় গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া মুগ্ধতার বর্ণনা যা রবীন্দ্রবীক্ষার পরিবর্তে অন্ধ ঈশ্বর পূজার সামিল হয়ে যায়।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন “কবিগুরু তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই সময়ের কবি নন তিনি কালজয়ী। রবীন্দ্র- প্রতিভা বঙ্গে পরম বিস্ময়। রবীন্দ্রনাথ মহাপুরুষ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর উপলব্ধিতে মহাপুরুষদের উপলব্ধিরই অনুসরণ লক্ষিত হয়। বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর উদয় ছিল এক যুগান্তর। প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি এক সহজ ও সরস কাব্য রচনা র আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর ঐশী প্রতিভার মত তাঁর জীবনের ব্যাপ্তি, তাঁর জমিদার বাড়ির ছোট ছেলে শখের কবি থেকে এক মহান স্রষ্টা হয়ে ওঠা, সেই থেকে একজন মনীষী, একজন মহাকবি হয়ে ওঠার আখ্যান, এই বিশাল ব্যাপৃত জীবনের অতলান্তিক গভীরতা কে স্পর্শ করা দূরস্থান, তাতে ডুব দেওয়াই একজনের পক্ষে পরম সমৃদ্ধির বিষয় হতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, ও সমাজ সংস্কারক। যদিও কবি হিসেবেই তিনি বিশ্ববরেণ্য। এশিয়ার মধ্যে তিনি ই প্রথম ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারের গৌরব অর্জন করেন।
যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন, জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং বিশ্ব পরিক্রমার মধ্যেদিয়ে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষার জীবন্ত ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্র এবং দেশ বিদেশে দেওয়া বক্তৃতা মালা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির অচঞ্চল এবং বহু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি ছিলেন নিজ আদর্শে স্থির অপরদিকে সৃজনশীল রূপটি ছিল জঙ্গম ও পরিবর্তনশীল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আধ্যাত্মিক চেতনাই রবীন্দ্রনাথ কে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। তাঁর সমগ্র মননশীল জীবনে এবং ব্যবহারিক জীবনে বাবার প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। বাবার মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ পেয়ে ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তিকে যিনি জাগতিক বিষয়ে নিষ্ঠাবান অথচ নিরাসক্ত, প্রখর যুক্তিবাদী কিন্তু হৃদয়বান। একদিকে দেবেন্দ্রনাথের ধর্মানুশীলন এবং তাঁর পরিবারের স্বাদেশিকতা সঙ্গীত সাহিত্য ও শিল্পচর্চার অনুকূল আবহ এবং দেশের বিভিন্ন দিকে নানাবিধ পরিবর্তন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে গভীর তাৎপর্য বয়ে এনেছিল।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যস্মৃতির অপূর্ব আলেখ্য লিখে গেছেন “ জীবন স্মৃতি” গ্রন্থটিতে। তাঁদের বাল্য জীবন কেটেছে ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে অতি সাধারণ বাহুল্য বর্জিত ভাবে। পরিবারের বন্ধন মা ঠাকুমার আদর থেকে শৈশব বঞ্চিত ছিল রবির জীবন। ভৃত্যদের শাসন পেরিয়ে দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। বহির্বিশ্বের হাতছানি তাঁকে কূহকের মত টানত। তাঁর জীবনের কবিতায় গানে এবং দেশবিদেশে ভ্রমণে শৈশবের এই অদম্য আকর্ষণই নানাভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
বালক রবির পরবর্তী ধাপে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৮৭৩ সালে বাবার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণ। সেই প্রথম কবি শহরের বাইরে অজানা কে জানা, অচেনাকে চেনার প্রকৃতির উঠোনে পা রাখলেন। বাবার স্নেহ পূর্ণ সান্নিধ্য লাভ রবির জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। দেবেন্দ্রনাথ দিনের শেষে বালক রবির সঙ্গে সন্ধ্যা আকাশের গ্রহ নক্ষত্রলোকের পরিচয় করিয়ে দিতেন। রবি মুগ্ধ হয় দেখতেন।
হিমালয় থেকে ফিরেই রবীন্দ্রনাথ যেন হঠাৎ করেই শৈশব থেকে যৌবনে পা দিলেন। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া রদ হলেও কবির সাহিত্য চর্চা অব্যাহত গতিতে বিকশিত হতে লাগল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৮৭৪ সালে ঠাকুর বাড়ির মনীষীরা বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক, সংবাদ পত্র সম্পাদক সহ বিদগ্ধ জনদের আমন্ত্রণ করে “বিদ্বজ্জন সমাগম” নামে একটি সাহিত্য সম্মিলনীর আয়োজন করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন সম্মিলনীর মূল উদ্যোক্তা। ভারতী পত্রিকা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত হতো। জ্ঞানাঙ্কুর সাহিত্য পত্রে সেকালের বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও স্থান পেয়েছিলেন। তার অন্যতম প্রধান কারণ হিন্দু মেলায় তাঁর কবিতা “হিন্দু মেলার উপহার” পাঠ করে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন।
এরপর মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ তাঁকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে পাঠান। সেখানে কিছুদিন ব্যাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে এবং পরে লণ্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়াশোনা করেন। সে পড়াও দেড় বছরের মাথায় অসম্পূর্ণ রেখে দেশে ফিরে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থেকে কোনো ডিগ্রি প্রশিক্ষণ না নিলেও সেখানে তাঁর প্রতিভার বিকাশের পথ প্রসারিত হয়েছিল। সে দেশের সঙ্গীতের ওপর অপার কৌতুহল নিয়ে তিনি নিজের মত করে পড়াশোনা করেন। তারই ফলশ্রুতি গীতিনাট্য “বাল্মীকি প্রতিভা।” এখানেই প্রথম স্বরচিত গানে পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ ঘটান। ঠাকুর বাড়ির “বিদ্বজ্জন সমাগম” উপলক্ষে অনুষ্ঠিত “বাল্মীকি প্রতিভা”য় বাল্মীকির ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন। এর পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে গান ও কাব্য রচনায় নিমগ্ন হন। ঠিক অব্যবহিত পরেই তিনি রচনা করেন সান্ধ্যসঙ্গীত (১৮৮২)ও প্রভাত সঙ্গীত (১৮৮৩)। এই সময়ের সকল অনুভূতিই কবির জীবনে এক স্মরণীয় ঘটনার প্রকাশ-জীবন স্মৃতিতে তা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি একদিন সূর্যোদয়ের মুহূর্তে আচমকাই তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে এক দিব্যচেতনা, যার ফলে জগৎ প্রকৃতি ও মানুষ সব তাঁর চোখে বিশ্বব্যাপী আনন্দধারায় প্লাবিত বলে মনে হয়েছে। এই অলৌকিক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ তার বিখ্যাত কবিতা- “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।” হঠাৎই আত্মকেন্দ্রিক জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে কবি এসে দাঁড়ান মানব জগতে। এই সময় থেকেই রবি প্রতিভার যথার্থ স্ফূরণ ঘটে। এরপর তাঁর লেখনীতে ঝর্ণা ধারার প্রবহমান গতি ধরা দিল- ছবি ও গান, প্রকৃতি র প্রতিশোধ, কড়ি ও কোমল, মায়ার খেলা, ও মানসী কাব্যে। পাশাপাশি গদ্য প্রবন্ধ, সমালোচনা, উপন্যাস ও লিখতে থাকেন। তখনই রচিত হয় তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস বউ ঠাকুরানির হাট ও রাজর্ষি।
১৮৮৩ সালে ৯ই ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয় মৃণালিনী দেবী রায়চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁদের দুই পুত্র ও তিন কন্যা। বিয়ের অনতি পরেই বাবার বিপুল কর্মের দায়িত্ব কিছুটা এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ওপর। তিনি ছিলেন মহর্ষির আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক। ব্রাহ্মসমাজে তখন নানা রকম দ্বিধা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। সে যুগে কলকাতার ধর্মান্দোলনের সময় তরুণ রবি নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করেন।
এরপরে শুরু হয় আরেক অধ্যায়। মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে এক মাসের জন্য আবার বিলেতে যান। ফিরে বাবার আদেশে জমিদারি, রক্ষণাবক্ষেণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এই নতুন দায়িত্ব পালন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মে এক নতুন পথের খোঁজ দেয়। এতদিন যে কাব্য, নাটক, উপন্যাস লিখেছেন তার সবই ভাবমূলক এবং বিশুদ্ধ কল্পনার ওপর। এবার তিনি লোকজীবনের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পান এবং ঘনিষ্ঠ ভাবে দরিদ্র মানুষদের সাধারণ যাপন পর্যবেক্ষণ করেন। কবি কল্পনার জগৎ থেকে নেমে আসেন বাস্তব পৃথিবীর প্রত্যক্ষ জীবনে। ফলে রচিত হয় বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ গল্পগুচ্ছের গল্পগুলি। এছাড়াও পূর্ববঙ্গের প্রাকৃতিক অপরূপ রূপের বর্ণনা ভাতুষ্পুত্রি ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রগুলিতে ফুটে ওঠে। পত্রগুলি ছিন্নপত্র ও ছিন্ন পত্রাবলী নামে সংকলিত হয়। সেই সময় কবি জমিদারি দেখাশোনা উপলক্ষে শাহাজাদপুর, পতিসর, কালিগ্রাম ও শিলাইদহে ঘুরে বেড়ান। পদ্মাবক্ষে নৌকাবিহারের সময় পদ্মানদী, বালুচর, কাশবন, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, দরিদ্র জীবন এবং সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কবিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তারই প্রতিফলন দেখি পরবর্তী পর্বে।
রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই গঠনমূলক কাজে জোর দিয়েছেন। এই সময়কার প্রবন্ধে একাধারে ফুটে উঠেছে বাঙালি সমাজ নিয়ে সূক্ষ্ম চিন্তা ভাবনা অন্যদিকে ভারতের ঐতিহ্য, তার আধ্যাত্মিক প্রকৃতি ও ঐক্য সাধনার ধারার স্বরূপ। সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কল্পনা, ক্ষণিকা, কথা ও কাহিনি কবির শিলাইদহ পর্বের রচনা। এই রচনাগুলিতে বাস্তবের চিত্র এবং সৌন্দর্য চেতনা, সমকালীন সমাজ ও ইতিহাসের মহৎ আত্মত্যাগের কাহিনি একই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ কখনো সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবে তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরেও রাখেননি। ১৮৯৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে
“বন্দেমাতরম” গান গেয়ে রবীন্দ্রনাথ তার উদ্বোধন করেন। মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক শিবাজী উৎসব প্রবর্তন করেন। তাঁরই প্রেরণায় কবি রচনা করলেন সেই সুবিখ্যাত কবিতা “শিবাজী উৎসব।’’ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় এই আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় তিনি তাঁর তিক্ত মনোভাব ব্যক্ত করেন। এর অব্যবহিত পরেই রাখিবন্ধনের দিনটিকে সাম্য ও মৈত্রীর বন্ধনে বেঁধে রচনা করলেন সেই সুবিখ্যাত কালজয়ী গানটি—
বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক হে ভগবান॥
সে সময় স্বদেশ পর্বের উল্লেখযোগ্য কিছু গান রচিত হয়। তাদের মধ্যে দুটি গান বাংলা দেশ ও ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করে। “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’’ বাংলা দেশের এবং “জন গণ মন।’’ দরিদ্র প্রজাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য বেশ কিছু সাধু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা, পানীয় জলের ব্যবস্থা, সড়ক নির্মাণ ও মেরামত, ঋণের দায় থেকে কৃষকদের নিষ্কৃতি প্রভৃতি। তবে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন করলেও উগ্র জাতীয়তাবাদ বা সন্ত্রাসবাদ কে কোনদিন সমর্থন করেননি।
১৯০১ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেদিন এর নাম ছিল ব্রহ্মচর্যাশ্রম। আজ সেটি শান্তিনিকেতন। এই বিদ্যালয় আরো পরে রূপান্তরিত হয় বিশ্বভারতীতে। মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র।
শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের জীবন যাত্রা ছিল প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে পরিচালিত। গুরু শিষ্যের মধ্যে নিবিড় সাহচর্যে সরল অনাড়ম্বর জীবন। এই আশ্রম পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের প্রধান সহায়ক ছিলেন- ব্রহ্মবান্ধ উপাধ্যায়, একজন রোমান ক্যাথলিক বৈদান্তিক সন্যাসী। ব্রহ্মবান্ধবই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথকে “বিশ্বকবি’’ নামে ভূষিত করেন।
প্রচলিত শিক্ষাবিধি কবিকে সন্তুষ্ট করেনি কোনদিন। নিজেকেও সেই বন্ধনে বাঁধতে পারেননি। তাই মনের মধ্যে দীর্ঘলালিত যে জীবনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার ছবি আঁকতেন তারই বাস্তব রূপ দিতে শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠা। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় স্বদেশী যুগের প্রারম্ভে এবং তা বিশ্বভারতীতে পরিণত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বমৈত্রীর সংকল্প নিয়ে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে বারবার কবি নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। সেই সঙ্গে গভীর অর্থসঙ্কটের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল সেইসময়। তবুও সমস্ত সঙ্কট থেকে উত্তরণের এক মহাশক্তি তিনি অর্জন করেছিলেন। তাই শত বাধা বিপত্তিতেও তাঁর কর্মযজ্ঞের ছেদ পড়েনি, থেমে থাকেনি সাহিত্য সাধনা।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনে শান্তিনিকেতনের ছাপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চোখের বালি, নৌকাডুবি, গোরা উপন্যাসে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে জীবনের বাস্তবতা, গভীর মনস্তত্ত্ব আবার অন্য দিকে স্বদেশের বহু সমস্যার চিত্র। জাতিগত সংকীর্ণতার উর্ধে চিরন্তন ভারতবর্ষকে নতুন করে আবিষ্কার করেন আধুনিক মননশীল কবি। সেই সময়ের বিখ্যাত কবিতা—
হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।
ধীরে ধীরে আধ্যাত্মচেতনা কবি চিত্তকে অরূপরতনের দিকে ধাবিত করতে লাগল। এই অনুভূতিরই প্রকাশ দেখি খেয়া, গীতাঞ্জলিকাব্য, রাজা ও ডাকঘর নাটকে।
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অন্যতম দিক তাঁর অসাধারণ গান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে গানের কথা ও সুরে নতুন নতুন বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে সঙ্গীতের এক অভিনব স্বতন্ত্র জগৎ সৃষ্টি করলেন যা কালক্রমে হয়ে উঠল কালজয়ী।
১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের অর্ধশত বছর পূর্তি উপলক্ষে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বিচারপতি সারদাচরণ মিত্র, জগদীশ চন্দ্র বসু, মণীন্দ্রনাথ নন্দী ও আরো অনেক পণ্ডিত প্রবর মিলে কবির জন্মোৎসব সাড়ম্বরে পালন করেন।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সমকালীন সাহিত্য ও শিল্পচর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল।
তাই বহু গুণীজন সমাগম হত প্রায়শই। বিখ্যাত সমালোচক আনন্দ কুমার স্বামী এবং ভগিনী নিবেদিতারও একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই পরিবারের সঙ্গে। কুমার স্বামী মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার অনুবাদ করেন। ভগিনী নিবেদিতা ১৯১২সালে রবীন্দ্রনাথের “কাবুলিওয়ালা’’ গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেন ওই পত্রিকায়। এই গল্প টি পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন ইংরেজ চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। রবীন্দ্রনাথের আরো কিছু কবিতার অনুবাদ তখন তাঁকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল সেই সময় এই সম্মেলনে ইংল্যান্ডে ছিলেন। সেখানকার বিদগ্ধ মহলের আগ্রহ দেখে রবীন্দ্রনাথকে ইংল্যান্ডে যাবার অনুরোধ করেন। সেখানে পৌছে কবি রোটেনস্টাইনের হাতে তুলে দেন তাঁর নিজের সৃষ্টির কিছু অনুবাদ। রোটেনস্টাইনের বাড়িতে আরো অনেক বিশিষ্ট কবি ও পণ্ডিতদের সঙ্গে কবি পরিচিত হন। তাঁদের মধ্যে কবি ইয়েটস ইংরেজি গীতাঞ্জলির ভূমিকা লিখে পাশ্চাত্ত্যে রবীন্দ্রনাথের খ্যাতির পথ প্রশস্ত করেন। ইয়েটস কবির গীতাঞ্জলি পাঠ করে শোনান। পরবর্তী কালে চিত্রাঙ্গদা, মালিনী ও ডাকঘর নাটকের ইংরেজি অনুবাদ তাঁকে ইউরোপে শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিতি দেয়। ১৯১৩সালে তিনি দেশে ফেরেন।
সে বছরই নভেম্বর মাসে গীতাঞ্জলি লেখা লেখার জন্য শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্মান নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
এই সময় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত “সবুজ পত্র’’ পত্রিকায় কথ্য ভাষারীতি কে অবলম্বন করে এক প্রগতিশীল পত্রিকার সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথও তাঁর সাহিত্য রীতি পরিবর্তন ও নিদর্শন তুলে ধরেন সবুজ পত্রে। গীতাঞ্জলির আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল ছেড়ে এক নতুন ধারা বা দিক উন্মোচিত হয় এই সব কবিতায়।
সবের মূলেই ছিল পাশ্চাত্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টি ভঙ্গি। সোনার তরী এবং চিত্রায়ন সীমা ও অসীমের দ্বন্দ্বে জীবনের মধ্যেই জীবনেশ্বর কে দেখেছেন। খেয়া থেকে গীতাঞ্জলি পর্যন্ত কবি আধ্যাত্মসাধনায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন। এলাকায় প্রচন্ড জীবনাবেগ নিয়ে নব কলেবরে কবির আত্মপ্রকাশ ঘটল। বস্তুত প্রাচ্য চিন্তা ও পাশ্চাত্য ভাবনার সমন্বয় সাধনই কবি মানসের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। বলাকা নবজীবনবাদের কাব্য। বস্তু জগতে পরমাণুর নিরন্তর গতি, অবিরাম প্রবাহ আর ছন্দের স্পন্দন যেন তাঁর চেতনার জগতেও সৃষ্টি করেছে এক অভিনব গতিময় ছন্দময়তা। তারই ফলশ্রুতি মুক্তছন্দ ব্যবহারে লক্ষ্য করা যায়-
পৌষের পাতাঝরা তপোবনে
আজি কী কারণে
টলিয়া পড়িল আসি বসন্তের মাতাল বাতাস,
নাই লজ্জা, নাই ত্রাস
আকাশে ছড়ায় উচ্ছ্বাস
চঞ্চলিয়া শীতের প্রহর
শিশির মন্থর।
রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ ও ঘরে বাইরে ও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় সবুজ পত্রে। বলাকা কাব্যের জীবনতত্ত্বকেই কবি রূপ দিয়েছেন ফাল্গুনী নাটকে।
দীর্ঘদিন পরে আবার কবি জাপান যাত্রা করেন। কলকাতায় ওকাকুরার সান্নিধ্যে এসে জাপানের মহৎ দিকটিই দেখেছিলেন। কিন্তু জাপানে গিয়ে চোখে পড়ল তার বিপরীত রূপটি। তখনই শুরু করলেন “Nationalism’’ বিষয়ক ভাষণগুলি। আমেরিকাতেও এই ভাষণ পাঠ করেন। এছাড়াও কবি তাঁর শিক্ষার আদর্শ, ব্যক্তি ও বিশ্বের সম্পর্ক, ব্যক্তিত্বের স্বরূপ প্রভৃতি বিষয়ে বক্তৃতা দেন। সেগুলো সংকলিত হয় “Personality’’ গ্রন্থটিতে।
ঠিক এই সময় কবির জীবনে স্মরণীয় ঘটনা ইংরেজপ্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ।
জালিয়ানওয়ালাবাগে এক বিপুল জনসমাবেশে ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে বহু নিরীহ ভারতবাসীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় কবি চরম মর্মাহত হয়ে ভাইসরয় একটি চিঠি দিয়ে ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন।
আমেরিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ধারণায় অনেক পরিবর্তন এনেছিল। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। এখানে অধ্যায়ন ও গবেষণার পাশাপাশি সঙ্গীত চিত্রকলা চর্চার ব্যবস্থাও হয়। ১৯২১ সালে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বভারতী পরিষদ গঠন এবং একটি স্থায়ী নিয়মাবলী রচনা করে এই বিদ্যায়তনকে কবি দেশের হাতে তুলে দেন। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র দুমাইল দূরে সুরুল গ্রামে শ্রীনিকেতন কৃষি ও পল্লীসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বিশ্বভারতীরই একটি অঙ্গ। এখানে শুরু হয় পশুপালন, তাঁতশিল্প, চাষাবাদ, কুটিরশিল্প প্রভৃতি উদ্যোগ।
রবীন্দ্রনাথের কাছে বিশ্বভারতীর এক অর্থ ছিল বিশ্বকর্ম আর অন্য অর্থ ছিল পৃথিবীময় বিশ্ববোধের প্রকাশ। এই বোধে অনুপ্রাণিত হয়েই সেই সময় এখানে যোগদান করেন পিয়ারসন ও কৃষি বিজ্ঞানী লিওনার্ড এলমহার্স্ট।
শ্রীনিকেতনের উন্নয়ন কল্পে এলমহার্স্টের আর্থিক অনুদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর স্ত্রী ডরোথি স্ট্রেইটের দীর্ঘকাল ব্যাপী আর্থিক সাহায্যেই শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার কাজ সম্ভব হয়েছিল।
শান্তিনিকেতন আশ্রম, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী এই তিনটির মধ্যে প্রথমটির রূপ শুধুই আধ্যাত্মিক, দ্বিতীয় লক্ষ্য ব্রহ্মচর্য আদর্শে ছাত্রদের জীবন যাপন ও শিক্ষালাভ আর শেষেটির লক্ষ্য মানবতা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় পূর্ব ও পশ্চিমের মেলবন্ধন। এছাড়াও তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনকে এক করতে। ব্রিটিশদের আরোপিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল জীবন বিমুখ। এই অসামঞ্জস্য দূর করতেই প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন। বহু দেশ বিদেশের শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিতদের কবি যুক্ত করেন এই বিশ্বভারতীর সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সিলভা লেভি, মরিটস উইনটারনিটস, ভিনসেন্ট লেসনি, স্টেন কোনো, কার্লো ফরমিকি, জুসেপপে তুচচি, ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ ডঃ হ্যারি টিমবারস প্রমুখ। বিখ্যাত দার্শনিক রমা রঁল্যার সঙ্গেও কবির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।
শান্তিনিকেতনে বেশ কিছু আদর্শ শিক্ষক আজীবন কবিকে সহায়তা করেছেন। তাঁরা হলেন মোহিত চন্দ্র সেন, সতীশ চন্দ্র রায়, অজিত কুমার চক্রবর্তী, জগদানন্দ রায়, হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ স্যান্যাল, মনোরঞ্জন বন্দোপাধ্যায়, কুঞ্জবিহারী ঘোষ, বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষীতিমোহন সেন। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবমুখী এক্যমূলক জীবন তত্ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।
১৯২০ সালে কবি আবারো ইংল্যান্ড হয়ে ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম যান। সর্বত্রই বক্তৃতা দিয়ে তিনি বিশ্বভারতীর কথা জানাতে চেয়েছেন। বিশ্বের দরবারে বিশ্বভারতী জ্ঞাত করতে চেয়েছিলেন। তবে এই সফরে আমেরিকা ভ্রমণ বিশেষ সুখকর হয়নি। ইউরোপে কবি রাজ সম্মান পেয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে গান্ধীজী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক ঐতিহাসিক আলোচনা হয় জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা ভবনে। ১৯৩২ সালে যখন গান্ধীজী যারবেদা জেলে অনশন করেন তখন কবি- “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো…” এই গানটি গেয়ে তাঁর অনশন ভঙ্গ করেছিলেন। এরই মধ্যে কবি রচনা করলেন পলাতকা ও পূরবী কাব্য এবং মুক্তধারা নাটক। এই সময় চীন জাপান ভ্রমণ করে ফিরে রচনা করেন বিখ্যাত নাটক রক্ত করবী। পেরুর স্বাধীনতা শতবর্ষ কবি যাত্রা করেও আর্জেন্টিনায় যাত্রা বিরতি দেন। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় স্প্যানিশ ভাষার বিদুষী কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে। কবির সমস্ত শুশ্রূষার ভার ওই বিদেশিনী নেন। কবি ওই বিদেশিনী ভক্তকে তাঁর পূরবী কাব্য উৎসর্গ করেন।
ইতিমধ্যে কবির আরো কিছু বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এরমধ্যে কাব্য গ্রন্থ মহুয়া, উপন্যাস যোগাযোগ, শেষের কবিতা নাটক তপতী, শেষ রক্ষা এবং গীতিনাট্য ঋতুরঙ্গ।
ষাটোত্তর বয়সে শুরু করেন চিত্রচর্চা। লেখার কাটাকুটি থেকেই এই চর্চার সূচনা।প্যারিস, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশে অনুষ্ঠিত কবির চিত্রপ্রদর্শনী শিল্পরসিকদের মুগ্ধ করে। রাশিয়া ভ্রমণ ও প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর রাশিয়ার সামাজিক বিপ্লব ও তাদের কর্মযজ্ঞ কবিকে অভিভূত করে। তারই প্রতিফলন দেখি রাশিয়ার চিঠিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে সম্মানিত করেছে। ১৯২১সালে ‘জগত্তারিণী পদক’ তাঁকেই প্রথম প্রদান করা হয়। এই সময় রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৩৮সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণ দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। জীবনের শেষ দশ বছর কবি বহু কাব্য, গান, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, সমালোচনা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ রচনা করেন । এই অন্তিমে পর্বে এসে তাঁর কাব্যে নতুন যুগের ছোঁয়া লাগে। শেষ সপ্তক,পত্রপুট, পুনশ্চ, শ্যামলী, গদ্য ছন্দে লেখা। এই পর্যায়ে রবীন্দ্র কবিমানসে এক গভীর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কবি ক্রমশ বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে ওঠেন। তার চেতনায় নেমে আসে নিগূঢ় দার্শনিক নির্লিপ্ততা। কবিতাগুলি হয়ে ওঠে নিরাভরণ ও ধ্যানগম্ভীর। মৃত্যু চেতনা প্রায়শই কবিকে আবিষ্ট করে দেয়। ঠিক পর মুহূর্তেই কবির মন ধেয়ে যায় মানবসমাজের বাস্তবতার দিকে, রূপকথার জগতে,বাউল মনের মানুষের সন্ধানে, শৈশব স্মৃতিতে, পীড়িত মানুষের বেদনায়। কোন এক জায়গায় বেশিক্ষণ তিনি আবদ্ধ নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। সর্বত্রই তাঁর বিচরণ। সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা আমৃত্যু চলতে থাকে। তার নতুন সৃষ্টি গদ্যগান। পুরনো কবিতার নতুন রূপ দেন নৃত্যনাট্যে। রচনা করলেন চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ও চণ্ডালিকা।
জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব নিয়ে ভেবেছেন। প্রথম জীবনে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সাহচর্য ও সখ্য বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়। সমকালীন বিজ্ঞানের গতিময়তার সুর তাঁর অসংখ্য কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে। সে, তিনসঙ্গী, গল্প সল্প এইসব গ্রন্থি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে গল্প উপস্থাপন করেছেন।
বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কট। এর ওপর ভাষণও তিনি পাঠ করলেন শেষ জন্মদিনে এক অনুষ্ঠানে। ১৯৪০ সালে কবি কালিম্পঙে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৪১ সালের ৭ ই আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বিশ্বকবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আকাশ পটে ধ্রুবতারার মত চিরভাস্বর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্ত জীবন, মানবাত্মা, ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ- সংসারকে তিনি দেখেছেন এক অখণ্ড রূপে। তাঁর গানেও সেই সুরই প্রতিধ্বনিত হয়-
আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে…